সম্পাদকীয়
রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পকে যেভাবে বয়ান করেছেন বা নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীরা ছোট গল্পের জগতে যে উদাহরণ রেখে গেছেন বা এডগার অ্যালান পো, মোঁপাসা ইত্যাদি বিদ্বজনেরা যেভাবে ছোটগল্পের যুগান্তকারী বর্ণনা দিয়েছেন তারপরেও ছোটগল্প
সৌম্যশংকর আজও ভোরবেলা উঠে গায়ে একটা হালকা সুতির চাদর চাপিয়ে দোতলার দক্ষিণ কোণের জানালাটা খুলে দিলেন। আকাশে হালকা মেঘ। এখন ব্রাহ্ম মুহূর্ত। আরো একটু পর ভোর হবে। ভোরে ওঠা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যেস হলেও এত ভোরে ওঠেন না। আজ যে মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষ, মাতৃপক্ষের শুরু। বড় পবিত্র দিন। বাইরে শিউলি গাছ থেকে গন্ধ আসছে।
বুদ্ধি হয়ে থেকে পেনি দেখছে ওর ঠাকমা ছাড়া আর কেউ নেই। ও ছোটো থাকতেই ওর বাবা বাইরে কাজে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তারপর ওর মা ও ওকে ফেলে কার সাথে যেন চলে গেছে। রাস্তার ধারে ফুটপাতের ওপরে ছেঁড়া পলিথিনের নিচে ঠাকমার ঘর সংসার। ঠাকমা সকাল হলেই রাস্তার পাশে এক কোণে একটা ভাঙা থালা নিয়ে ভিক্ষা করতে বসে।
আমরা ছোটবেলায় শুনেছিলাম, পড়াশোনা এবং সততা বেশ দরকারি জিনিস। কৈশোরে জানলাম আদব কায়দা আর ইংরাজি বলাটাই আসল। উঠতি বয়সে শিখেছিলাম, সের’ম সুপারিশের জোর থাকলে সমাজে কলকে পাওয়া যায় সহজে। মধ্য তিরিশে এসে বুঝে গেছি, কোনও লজিক জীবনে শেষপর্যন্ত খাটে না। অদৃশ্য এক মন্ত্রবলে জীবনের মইতে কেউ চড়চড় করে উঠে যায়, আর কেউ পড়ে সাপের মুখে। অধিকাংশ লোককে কালসাপ গিলে খায়। সামান্য দু’চারজন ওঠে মগডালে। কিন্তু সে সম্বন্ধে লোকের আগেকার সব ধারণা বেমালুম ভুল।
অফিস থেকে ফেরার পথে আগের স্টপেজেই বাস থেকে নেমে পড়ে বৈশাখী। এখানে একটা হকার্স কর্ণারে মোটামুটি ভালো পছন্দসই জিনিসপত্র একটু সস্তায় পাওয়া যায়। সেখান থেকে টুকিটাকি দুএকটি জিনিস কিনে নেবে। সেইজন্য অফিসে বলে একটু আগে বেরিয়েছে সে। সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। ছেলে পাপানকে যে দেখাশোনা করে সাতটা পর্যন্ত তার ডিউটি।
রাত দুটো নাগাদ মন্মথর ডোরবেল এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। জোনাকি মন্মথকে ধমক দিয়ে বলে, যাও। দরজাটা খুলে দেখো কে কী দরকারে এসেছে। নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। নাহলে এত রাতে কেউ কারো বাড়ির বেল বাজায়। মন্মথ উঠে সোজা টয়লেটে চলে যায়। তার ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। ওদিকে বেল বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।
শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে উত্তরদিকে মুখ করে অন্যমনস্ক দেবল নাক খুঁটছিল খুব মন দিয়ে। কিছু পুরুষ মানুষ থাকে যারা অন্যমনস্ক হলেই নাক খোঁটে এবং খুব মন দিয়ে খোঁটে, দেবল সেইরকম। মনে হয় যেন অনেক ধনরত্ন গুহার অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসবে, তাই খননকার্য চলতে থাকে। উত্তরদিকের পুকুরে টলটলে জলে মৃদুমন্দ হাওয়ায় জলে ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে লাগছে। দেবল নাক থেকে কিছু বের করে হাতে নিয়ে দু-আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলা তৈরি করল মিনিট খানেক ধরে, তারপর আঙুলের ডগায় সেটি নিয়ে টিপ করে ছুড়ে দিল পদার্থটি।
আজকাল বাড়িতে ঢুকলেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায় বুলুর। কানের কাছে বাবার গঞ্জনা আর খকর-খক কাশি যেন তালে তালে কাঁসর-বাদ্যি বাজাতে থাকে। পলেস্তারা খসা বারান্দায় বসে দিন-রাত কাশতে কাশতে বাবা বুলুকে গালাগালি করতে থাকেন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না...
এই গল্পের প্রধান চরিত্র দেবেশ। দেবেশ সরকার। কোন ভিআইপি, সেলিব্রিটি, হাই প্রোফাইলের কেউ নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহী মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত গণিত শিক্ষক। এলাকায় সুপরিচিত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয়। এবার দেবেশবাবুর অন্যদিক নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
আরেকবার মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠল। হাতের শিরাগুলো এমন ভাবে উপড়েছে— যেনও মাটি থেকে নির্দ্বিধায় দূর্বা ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ! এই মৃত্যু ভয়ানক বেদনাদায়ক। কাঁধটা একদিকে হেলিয়ে, নিথর দেহটা কলেজের ছাদেই পড়েছিল। মেয়েটির সম্বল বলতে বিধবা মা। বয়স ষাট।