হেমন্ত দাস
প্রিয়তু “ম” বিরামহীন পথচলা ২২ শে শ্রাবণ ১৪২৯ “ম” ! জানো “ম” ! আমি জানি এই চিঠি পৌঁছাবেনা কোনদিন তোমার কাছে , ঠিকানাটাই ভুল ছিল আমাদের । ভাবাবেগগুলো কলসির ভেতর পুরে যদি অস্থি বিসর্জনের মতো ভাসিয়ে দেওয়া যেত ! তাহলে হাত পা ছুঁড়ে আর চেঁচামেচি করতো না । আমার একলা মনের ভাবাবেগ , বাজপড়া বাবলা গাছে বাঁদুরের মতো ঝুলে থাকবে আজীবন । তুমি কোনোদিন জানতে চাওনি “ম” ! কলেজের গেটে প্রথম দেখে ছিলাম ওড়না জড়ানো মুখে তোমার দুটো চোখ । লড়ির ড্রাইভার শখ করে কলেজে ভর্তি হয়ে ছিলাম । জীবনে কিছু করে দেখানোর কোনোদিন কোনো তাগিদ ছিলোনা আমার । কিন্তু বিশ্বাস করো ! তোমাকে প্রথম দেখাতেই নিজেকে উৎসর্গ করে ছিলাম । কামারকে সোনার হার তৈরি করতে দিয়েছিলো বিধাতা , হয়তো কৌতুকে অথবা সেদিন প্রহসন ছিলো দেবতার । কলেজের তিনটে বছর নদীর সামনে দাঁড়িয়ে শুধু ঢেউ গুনে গেছি , ভালোবেসে গেছি । কিন্তু ধোয়া তুলসী পাতা হতে চাইনি বলে খেয়া পাড় হতে পারিনি আর । সেই যে বাদামতলা ! তোমার বাড়ির পথ , আমার আত্মাটা আজও ওখানে আছে । বুকের উপর থেকে ছুটে গেছিলো একটা চলন্ত বাস , তারপর হৃদপিণ্ডটা বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ওপর ধড়ফড় করছিলো । সেদিন এমনটাই হয়েছিলো আমার সঙ্গে । যেদিন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো ! যখন দুপুর ও বিকেলের মাঝামাঝি ! তোমার বাড়ি যাওয়ার পোলটাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম । তাও মনে হবে অপেক্ষার একটা যুগ ! যুগই হবে হয়তো ! তোমাকে দেখার প্রলোভন ছিলো এক পলকের জন্য , একটুখানি , এক ঝলক মাত্র । এসেছিলে তুমি একটা ছাতার নিচে তার হাত ধরে । “ম” কলেজ পাশ করার পর বারাসাতে তুমি যে দোলের পরেরদিন মেয়েটার সাথে আমাকে দেখেছিলে ? তার ইতিহাসটা আজ তোমার জানা দরকার – “দোলের আগের দিন , তার কিছুদিন আগে আব্দালপুর পোস্ট অফিসের কাজ ছেড়েছি । বাবা সম্পূর্ণ বিরক্ত ছিলো আমার ওপর , দোলের আগেরদিন সব ক্ষোভ উগড়ে দিলো আমার প্রতি । শেষে নিজের ব্যবস্থা করতে বলে , বাড়ি ছাড়তে বললো । হায় রে ! সেই সময় আমার জন্মদাত্রী জগতজননী চুপচাপ ছিলো ! যে কিনা আমাকে পেটে ধরেছে ! তারপর শোনো – দোলের আগের দিন , দুপুরে পেটে ভাত জুটলো না ! রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে ছাড়লাম বাড়ি । চললাম সুইসাইড করতে জলভর্তি ঝাপসা চোখ নিয়ে । মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আজ মরবই । চলেছি পাড়ার ক্লাবের পাশ দিয়ে ! এমন সময় হতভাগা গুমসিপড়া বেলার বন্ধু মনমরা হয়ে আমাকে ডাকলো , “ছলছল চোখে বললো – আজ বাবা অনেক খারাপ কথা বললো আমায় । আমি বললাম – আমাকেও । এটুকু বলেই ইমোশনাল হয়ে রাস্তার ওপরেই কেঁদে ফেললাম একটু । ও আমার হাত ধরে ক্লাবের পেছনের মাঠে নিয়ে গেলো । প্রস্তাব দিলো মদ খাবার , কাল দোলের জন্য কিনেছিলো । বললাম – চল হয়ে যাক ! কাল নাহয় ব্ল্যাকে কিনে নেবো ! ভাবলাম – মরবো তো ঠিকই , তার আগে একটু দারু খেয়েই মরি ? দু’পেগ পেটে যেতেই আর কান্না চেপে রাখতে পারিনি জানো ? ছাগলটা আমাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিলো নাকি নিজে একটু কেঁদে নিলো ! কিছু বুঝতে পারলাম না । চার-পাঁচ পেগ হবার পর ! ও নিজের দুঃখের কাহিনী বলা শুরু করলো – ভাই ! আজ প্রথম বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছে । কিন্তু আমি বলেছি – আমি ওকেই বিয়ে করবো । ও কে ছাড়া আমি বাঁচবো না । আমি তখন তুফানিত বীর পুরুষ রঙিল জলের প্রভাবে , সদর্পে জিঞ্জাসা করলাম – ওকে কি বিয়ে করতে চাস ? একবার বল ? বাড়ি থেকে তুলে এনে তোদের বিয়ে দেবো ! আমার এক কথায় রাজী সে । চালচুলোহীন , বাপের হোটেলে খায় , আমাদের পরনের জাঙ্গিয়াটাও বাপের টাকায় । আগে পেছনে না ভেবে ও বললো – কালকেই নিয়ে আসবি ওকে ? কথা দে ? আমি বললাম – ওকে । ডান । চেস । দাসেদের ছেলে কথা দিচ্ছে তোকে , ও শুধু তোর । তারপর কটা পেগ খেয়েছি মনে নেই । যখন সন্ধ্যেবেলা হূশ আসে ! তখন দেখি দুজনের খুব করুন অবস্থা । জামা-কাপড়ে তরকারি এবং বমি ভর্তি । কে যে কার গায়ে বমি করেছি তা মনে পরছে না । পাশের পুকুরে নেমে দুজনে স্নান করে ফেস হলাম । পিয়ারা পাতা চিবাচ্ছি , এমন সময় আমার জন্মদাত্রী জগতজননী মা এসে ডাকছে । আমিও আর বাড়ি যাবো না বলে দিলাম । ঠিকই ধরেছো”ম” ! তেজ তো আমার বরাবরই ছিলো । তারপর শোনো – মা ভেজা গলায় আর্তস্বরে ইমোশনে ফেলে মাথার ঘিলু ঘেঁটে দিতে লাগলো । “বাবার বয়স হয়েছে । কোনদিন চোখ বুজাবে তখন কেঁদেও কুল পাবি না । একটু নাহয় রাগের মাথায় কিছু বলেছে , তাতে কেউ বাড়ি থেকে বেরায় ? তোর বাবা তখন থেকে কিছু খায়নি । বারবার বলছে – দেখ কোথায় গেলো ? দুপুর থেকে তোর দাদা বৌদি সারা পাড়া খুঁজছে তোকে । মেজ বৌটাও খুঁজতে বেরিয়েছে । নতুন বৌ । পরের মেয়ে । লোকে কি বলবে ? তোর ভাইপোটা শুধু ঘুরেফিরে এসে বলছে কাকা ? কাকা ?” এগুলো শুনে হাসি পাচ্ছে”ম” ? কি আর করা ? সেইবারের মতো সুইসাইড ক্যানসীল করলাম । পোষা নেড়িকুকুরের মতো মায়ের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম । বুঝলে “ম” কথায় আছে যে – “জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক ।” নেশার ঘোরে বন্ধুকে কথা দিয়ে ছিলাম – ওদের বিয়ে দেবো । পরের দিন দোল । গেলাম ট্রেনে করে ওদের পাড়ায় । বন্ধানীকে ডেকে বললাম সব । ও তো কিছুতেই রাজী হতে চায় না । শুধু বলতে থাকে – “কারুর বাড়ি থেকে কেউ মেনে না নিলে ! কি করবো বলো ?” ওর কথা শুনে খুব রাগ হতে লাগলো , বললাম – “ধুর বা* ! এই শোনো ? তুমিই পৃথিবীর শেষ মেয়ে নও কিন্তু আমার বন্ধু একটাই । ওর কিছু হলে তোমার দাদাকে ছাড়ছি না । তাড়াতাড়ি চলো এবং তোমাকে যেতেই হবে । তবু ও যেতে রাজী হয় না । শেষে ব্ল্যাকমেইল করলাম – “আমি একা ফিরে গেলে ও কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেবে বলেছে ! দেখলাম এই ঢপটা ওষুধের মতো কাজে লেগেছে । আরো বললাম – তোমাদের বিয়ের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি । শুধু তুমি চল স্টেশন অবধি ! বেচারী ঐ রঙ মাখা অবস্থায় আগে আগে চললো । হায়রে ! আর ঐদিনই তোমার সঙ্গে দেখা হলো আমার ! তারপর কি ? সব বন্ধুরা মিলে দিয়ে দিলাম ধরে বেঁধে বিয়ে । তারপর ওদের বাড়ি থেকে তো আর কেউ মেনে নেয় না । ভীষণ বিপদ । এই ঘটনার কথা আমার বাবা পরমেশ্বর কি করে বেশ জানতে পারে এবং আমিই যে মেন কালপিট ! সেটা বুঝতে পেরে আর একটা সুইসাইডের আগের ভূমিকা বিরক্তির আকারে প্রকাশ করলো । অল্প বয়সের আর এক নির্বুদ্ধিতার ইতিহাস আমার ।” তারপর মাঝের কয়েকটা মাস ভালো মানুষ সাজতে হয়েছিলো । কলেজ পাশ করে টেট পরীক্ষা দিয়ে ছিলাম , পাশও করে ছিলাম কিন্তু ওরা আজও আমাকে ডাকেনি । তারপর শুনে ছিলাম তোমার বিয়ের খবর , জানো “ম” মাষ্টার ডিগ্রির ফাইনাল পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না আর । বুড়ো বাবাটাও চলে গেলো অনেকটা অভিমান করে আমার উপর । সরকারি চাকরি জুটাতে পারিনি , কোনোদিন না খেয়ে , আধপেটা খেয়ে খুঁজে গেছি একটা চাকরি । যেটুকু জমানো টাকা ছিলো ! চিটফান্ডে হাতিয়ে নিলো কারা যেন । মদের ফ্যাক্টরিতে একটা কাজ জুটেছিলো ভালোই । দিব্বি চলছিলো বছর দুয়েক , তারপর ওয়ার্কআউট , ধর্মঘটে উঠে গেলো ফ্যাক্টরীটা । নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম ক্রমশঃ । সূর্য ডুবলেই অন্ধকার নেমে আসতো , একাকীত্বের রাতগুলো জাপটে টুটি টিপে ধরতো আমার । দেখেছো “ম” ! আমি কেমন নিজের অপদার্থতার কথা শুনিয়ে যাচ্ছি ! বেদনার মালা কেউ কি গাঁথতে চায় বলো ? কতটা কুয়াশা হলে জলের ওপর আস্তরণ জমে ? তবে এটা সত্য , ওড়না দিয়ে তোমার মুখ জড়িয়ে রাখা ! এখনো ভাসে চোখে । তোমার বিয়ের খবর শুনে , অনেকটা অভিশাপ বুকে সেদিন পিরিত আমার মাথায় চড়ে বসলো । বন্ধুর বোনের প্রতি ইয়েটাকে সমর্থন জানালাম । তার সঙ্গে একটা সীমান্তচুক্তি করতে হবে । পরে বুঝলাম সীমানা আমার কতটুকু ! বন্ধুর মাসির মেয়ে , বন্ধুর বাবা-মামা-মেশো বাড়ি এসে সীমান্ত নিয়ে বোঝাপড়া করতে চাইলো । আমার বাবা-মা আমজনতা , অপমানিত নিরব দর্শক । আমি সীমানা লঙ্ঘন করেছি , আমি অপরাধী । এসব পড়ে হাসবে জানি , কিন্তু হেসো না আরো আছে একটা । বরাবরের মতোই জল দেখলেই আমার সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে , ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে জলে নামা যায় কিন্তু ভিজে যাবো যে ! হটাৎ হটাৎ মনে জাগতো এক প্রবল ইচ্ছা , আত্মহত্যা করার মতো এক দারুণ লোভ । এরচেয়েও ভয়ানক প্রবণতা হলো তোমায় খুঁজে যাওয়া । মনে হতো – সমস্ত শপথ , সমস্ত অপমান ভেঙে চুরমার করে তোমার কাছে গিয়ে বলি – কেন ? কেন সেদিন — ! পারিনা জানো ? পারিনা । জানো “ম” ! আজও আমার ভাঙা দরজায় কেউ একটা পেরেক মারলো না । শুনেছি মানুষ মরে যাওয়ার পর সবাই বলে – আহারে ! লোকটা খুব ভালো ছিলো । আমারও মৃত্যু এসেছিলো আর একবার , ভাবছো হেয়ালি করছি ? তবে শোনো ঘটনাটা খুলে বলি ! সেবার উদাসী হয়ে একাকী বাড়ি ছেড়ে চললাম দক্ষিণের দিকে , একটা গ্রামে গিয়ে উঠলাম , চারিদিকে সবুজ ধানক্ষেত আর আলপথ , ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুদিকে ছোট ছোট গ্রামের বাড়ি , সামনে ঘোলাজলের পুকুর । পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠলো পড়ন্ত বিকেলের একফালি রোদ । যার চোখ দুটো যেন তোমার মতোই খোদাই করা একই কারিগরের সৃষ্টি । আবার মরতে হলো আমাকে , আবার প্রেমে পড়তে হলো । তারপর কি ! আর ভুল করিনি জানো ? নিয়ে ভেগে পড়লাম । শনি-কালী মন্দিরে বিয়ে হলো আমাদের । একটা গোটা বছর টিকলাম না দুজন দুজনের কাছে । জানিনা আজ সে কোথায় কার সঙ্গে থাকে ! তবে ভালো থাকুক , সুখে থাকুক সে । জানো “ম” ! ভালো মানুষদের সঙ্গে আর মিশতে ইচ্ছে করে না । জানি তুমিও তাদেরই দলে । হলেই বা ! এতে তো আর শ্যাম বাঁশি বাজানো বন্ধ রাখবে না । আমি জানি রাধা কলসী কাঁখে জল আনতে আর আসবে না , পৌরসভার কৃপায় বাড়িতেই কল । ছাদে এসে দু-চারটে চোখের কটাক্ষ ছুড়বে না আর । জানো “ম” ! তোমার ভালোবাসার যে আগুনে আমি পুড়ছি ! আমার মনে হয় এখনো পুড়ে সমস্ত খাদগুলো বেড় হয়নি । আজও ভাবী , আজও আফসোস হয় – তোমার সামনে দাঁড়িয়ে যদি সেদিন বলতে পারতাম – “ভালোবাসি তোমায়” অথবা ঐ ধরনের কিছু কথা ! যা হয়তো তোমাকে ভাবাতো কখনো , এমন কোনো একলা দিনে ! তোমার বিরহিত হেম |