সৌমী আচার্য
জর্ডনমামা, তোমাদের অতি সাধারণ কাঁকনের থেকে আর কোনো ভয় তোমাদের রইল না এই খবরটুকু পৌঁছে দেওয়া ভীষণ জরুরি মনে হয়েছিল একসময়। তারপর সময়ের প্লাবন ভাসিয়ে নিল উথালপাতাল কথার ফুলঝুড়ি, চোখ ছলছল, লেবুগন্ধের দুপুর, সিট্রানিনের মাদকতায় উপুরঝুপুর বৃষ্টি সব সব। চিঠিটা লেখা জরুরি কারণ কাঁকনের কবরের উপর চেপে বসে আমি অক্ষর সেলাই করি। ওর দীর্ঘশ্বাস এখনো আমার গায়ে লাগে। বাক্যগুলোতে নোনা ধরে যায়। ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দোরে দোরে ঘোরার সাহস নেই আবার চক্ষুলজ্জার সব চামড়া খসে পড়েনি বলে অপেক্ষা করি, কেউ এসে যদি তুলে নেয় পাণ্ডুলিপি। চোরের মতো অপেক্ষা করি নিজেকে বিক্রি করার জন্য। নিজের লেখাকে বেচার জন্য। ওঁত পেতে বসে থাকি কোন ঘুড়ির লেজ শক্ত করে ধরতে পারলে আমার আকাশ যাত্রার বাসনা সফল হয়। না এসব কথা আপনাকে বলার নয় তবু বলে ফেলি কারণ আপনাকে বোঝাতে চাই আমি আর ঠিক অতটা বোকা নই যতটা আপনারা মেপেছিলেন। শুনেছি আপনাদের আদরের ভাগ্নেটি চিরতরে পাহাড়ে নির্বাসন নিয়েছে। এখন প্রশ্ন হল কী করে জানলাম! জানলাম! না জেনেছিলাম। বছর সতেরো আগে একটা চিঠি আমাদের পুরোনো ঠিকানায় ধুলোর লূতাতন্ত্ত জালে আত্মগোপন করে শেষ পর্যন্ত এক সহৃদয় ব্যক্তি মারফৎ আমার হাতে এসে পৌঁছায়। কী আশ্চর্য সংবাদ তাই না! সে নাকি শ্লেটরঙা পাহাড়ের গায়ে একফালি জমি কিনেছে। বাড়িটার সামনে ছোট্ট বাগান, ক্যামেলিয়ার চারা বসিয়েছে। সামনের দরজায় লাল উলের বড়ো ড্রাগনমুখের কড়া, ঢুকেই যে ঘর তার বাঁপাশে মোটা ফরাস পাতা, ডানদিকে রান্নার খোলা জায়গা। ঘরের মাঝ বরাবর ঘোরানো সিঁড়ি দোতলায় উঠেছে। ভেবেছি বিষয়টা বড়ো বেমানান নির্ঘাত। ঘরের মাঝ বরাবর সিঁড়ি ! কিন্তু তার বর্ণনায় যা দেখলাম তা ভারী চমৎকার। প্রতিরাতেই সে কল্পনা করে হলুদ মোলায়েম রাত পোশাকে স্বপ্নের নারী হাতে মোমবাতি নিয়ে স্মিত মুখে নেমে আসে সে সিঁড়ি বেয়ে। তার কপালের বাঁদিকে আমার মতোই কাটা দাগ। দোতলার বড়ো শোবার ঘরের জানলা দিয়ে দূরের দুধসাদা পাহাড় কেবলি অপেক্ষা করে একটা মধুযামিনীর। আমি পড়তে পড়তে শস্তা নাইটির কোণায় মধ্যবিত্ত অভাব মুছে যত্নে রেখে দিই চিঠিটা। উত্তর দেওয়া হয়নি। যদি দিতাম তবে তাকে বলতে পারতাম আমার আতাগন্ধের দুপুরে আপনি কেমন জ্বলন্ত নরম তীব্র লৌহদণ্ড চেপে ধরেছিলেন আমার কোমড়ের নীচে। অথচ সেদিন লালিদিদা আমায় কত আদরে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিয়েছিলেন ডালের বড়ার ঝোল, আলুভাজা আর বোয়াল মাছ কষা। সে আমাকে অচিনসুরে চোখ নামিয়ে বলেছিল, কাঁকন তোমার চোখে কিসের অসুখ? রিনরিন করে গলা কেঁপেছিল। অতি ফর্সা মুখে সদ্য জাগ্রত গোঁফের রেখা আলতো গোলাপি ঠোঁটের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ভ্যাবলা হয়ে যাওয়া যতটা অনিবার্য ছিল আমার, আপনার টের পাওয়াটাও ততটাই। প্রায় টুঁটি চেপে ধরেছিলেন আমার। কাউকে বলিনি আমি। কখনো না। কেবল আমার আর কখনো ফাগুয়ার রঙ ভালো লাগেনি, ভয় লেগেছে। কত অবলীলায় আপনাকে বিশ্বাস করেছে আমার স্বল্প বুদ্ধির মা, একবারও ঘূণাক্ষরে টের পায়নি আপনার আপাত শান্ত গান গাওয়া কন্ঠ কতটা কর্কশ। আমার বুকের নরম মাংসপিণ্ডে লাল আঙুলের দাগ চিরকাল লুকিয়ে রেখেছি। আপনি কলেজে গেলেন আমি অষ্টমশ্রেণি, পরিবারের সিদ্ধান্তে চলে এলাম সব ছেড়ে অনেক দূরে নতুন শহরে। তবু আতঙ্ক আমার পিছন ছাড়ল না। প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতাম একটা অন্ধকার পিচ্ছিল পথে আমি দৌড়াচ্ছি আর আমায় পিঠে ছুরি বসিয়ে দেবে বলে উদ্যত এক তরুণ। দেখতে পাইনি তার মুখ। তবে আপনার মতো কোঁকড়া তার চুল, আপনার মতোই একটু ঝুঁকে দৌড়ায়। ভয় পেতে পেতে একদিন আমার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। আমি ভুলতে শুরু করলাম সারা শরীর জুড়ে কত না লজ্জার দাগ আছে আমার। ঘুমের চেয়ে বড়ো শান্তি কিছুতেই নেই তাই নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম আর ঐ তরুণকেও, যার নাম সপ্তর্ষি। আমি কি সপ্তর্ষিকে ভালোবাসতাম! নাকি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম! অথবা হয়তো আমাদের ভালোবাসা হত এবং ভালো বাসাও। সবই আজ বাতুলতা। কিন্তু একটা সম্ভাবনার বীজকে আপনার কুটিল ঈর্ষা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছিল এই যন্ত্রণা আমি তো সারা জীবন ভুলতে পারলাম না। সব পেয়েছি আমি ভালোবাসার মানুষ, ঘর, সন্তান তবু বুকের ভিতর ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন, থেকে থেকেই যে দীর্ঘশ্বাস বমন করে তার দায় কার? আপনার কেবল আপনার। খুব ইচ্ছে করে আপনার সাজানো গোছানো জীবনে ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে সব পোশাক খুলে উদোম হয়ে দাঁড়াই দাঁড় করাই আপনাকেও। চিনে নিক সবাই শ্বাপদের মতো আপনার দাঁত নখগুলো। মনে মনে চিৎকার করি, ফালাফালা করে চিরে দিতে চাই কৈশোরের যন্ত্রণার দিন। কিন্তু এই না পারা আর ব্যর্থতার আওয়াজ আমার চিঠিটা বহন করবে এইমাত্র তার অদিষ্ট হোক আমি চাইনি। ক্যান্সার আক্রান্ত আপনার শরীরের প্রতিও আমার কোনো করুণা নেই। শুধু একটা তরুণ হৃদয়ের জন্য বেদনা আছে। জর্ডনমামা! ভারী মজা না, আপনারা আমাদের রক্তের সম্পর্কের কেউ নন। তবু আমার মা আর আপনার দিদির এক নাম বলেই লালিদিদা হয়ে যান আমার মায়ের ধর্মমা আর আপনি আমার মামা। আপনাকে চিঠির শুরুতে পূজণীয় বা শ্রদ্ধেয় বলতে হত! কিন্তু আপনি তো তার যোগ্য নন। মনে আছে বীণাদিকে? আমাদের পাড়ার বীণাদি। ও এখন কৃষ্ণনগর স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে নোংড়া শাড়ি পেঁচিয়ে শুয়ে থাকে। ওর দাদারা বাড়ি এনে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল কিন্তু মানবিক মানুষজনের এত কষ্ট হয়েছে যে বিদ্যুৎদাদাদের মেরে পাটপাট করে বীণাদিকে শিকল মুক্ত করেছে। আমার সাথে দেখা হয়েছিল বিদ্যুৎদার। ওর মেয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেই সূত্রেই এসেছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম। দেখা হতেই হাত জড়িয়ে ধরল। অত বড়ো মানুষ শিশুর মতো কেঁদে উঠল। কাঁকনরে বীণার সারা গায়ে ঘা প্যাঁচড়া। আমার বুনডা একেবারে পেগলে গ্যাচেরে। ওহ্ ! হারামজাদাটার কুনো খবর জানিস? চোখ নামিয়ে কেঁদে গিয়েছি আমিও। বীণাদি কী সুন্দর নাচত ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে?’ তারপর শুধু কান্না আর কান্না। আপনার কখনো বিবেক দংশন হয়নি তাইনা? বীণাদির প্রেমে ভরা মনটা কুচলে দুমড়ে, আমার কৈশোরটাকে পুড়িয়ে কেবল উল্লাস পেয়েছেন। কী নির্লজ্জ উচ্চারণ নামিয়েছিলেন আমার বাড়ির বারান্দায়। আলোচনায় ভেসে আসছিল সপ্তমীর ভোগ আরতির গন্ধ। সপ্তর্ষির দিকে এগিয়ে যাওয়া আমার সাংঘাতিক অন্যায়। আমি নাকি শরীর নিয়ে খেলা করতে শিখে গিয়েছি। অথচ জর্ডনমামা আমাকে লুকোচুরি খেলার নামে প্রথম শরীর চিনিয়েছিলেন আপনি। মাত্র পাঁচ বছরের বড়ো ধর্মমামাকে মা আপনি ডাকতে শিখিয়েছিল। আপনি বললেই বুঝি বাঁচা যায়? এই এত্ত কথা আসলে গৌরচন্দ্রিকা। আপনার কাছে আসলে জানতে চাই সপ্তর্ষিকে শেষ কবে দেখেছেন আপনারা? আপনাদের আদরের ব্রিলিয়ান্ট ভাগ্নাকে সেই যে বাঁচাতে চেয়েছিলেন এক মফস্বলের অতি সাধারণ মেয়ের থেকে এবং পেরেওছিলেন! কিন্তু তারপর কী হল! আমি জানি, জানেন না আপনারা। কেউ জানেন না। আমি এখনো খুব সাধারণ। মধ্যমেধার চল্লিশ পেরোনো সাধারণ মহিলা কিন্তু আমি একজনের কাছে অনন্য। আমি অপ্রতিদ্বন্দ্বী আজো। যদিও জানিনা এই প্রাপ্তিতে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো? পরিবারের সাথে গত বছর রামধুরা গিয়েছিলাম। ভারী চমৎকার জায়গা। আমার জন্মদিন উদযাপন করবো বলেই যাওয়া। খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই ঘন কুয়াশার ভিতর পাইনবন যেন গভীর ব্যাকুলতায় আমায় দুহাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগল। পাশের মানুষেরা ঘুমে আচ্ছন্ন। একাই বেরিয়ে পড়লাম হোমস্টে থেকে। একটা সময় পর ঘন কুয়াশা আমাকে গিলে নিল। আমিও চাইছিলাম না ফিরতে। একটা পাথরের উপর বসে হেঁড়ে গলায় মৃদু মৃদু গান শুরু করলাম। কে তুমি আমারে ডাকো অলখে লুকায়ে থাক। ফিরে ফিরে চাই। দেখিতে না পাই। আলতো কুয়াশা কাটতেই সামনে এক পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মাথায় টুপি গায়ে জ্যাকেট ঢাকাচাপা দেওয়া তবু মনে হল একটু বেশিই রোগা। চোখ দুটো কোটরে তবে তাতে বিস্ময় স্পষ্ট। আপনার সৌজন্যে আমি পুরুষ জাতটাকেই ঘেন্না করতে শিখেছি। দ্রুত উঠে পাশ কাটিয়ে যেতেই অস্ফুট আওয়াজ ভেসে এল, আপনি ঠিক কাঁকনের মতো। তবে ও ছিল বোকা বোকা। আপনি আলাদা। তবু যেন কাঁকনের মতোই। আমার পা দুটো পাহাড় ফুঁড়ে পৃথিবীর শেষ অংশ ছুঁয়ে ফেলল বুঝি। আর কখনো দেখবো ভাবিনি তো। সে যেন আমার কল্পনা। আমার অতীতের কিছুই যেন নেই। আমিই তো শুয়ে রয়েছি চির কবরে। তবু দাঁড়ালাম। সপ্তর্ষি নামটা উচ্চারণ করতে কেঁপে গেলাম। তাই বললাম, আমিই কাঁকন। সময় বয়ে যায় জর্ডনমামা, কেউ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে আর কেউ বেঁচে থাকার মানেটাই বদলে দেয়।আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি ঘরের দরজায় আর সে পথের ধুলোমেখে চলে যাচ্ছে ঐদূরে। আমি এখানেই সিঙ্কোনা প্লান্টেশানের সিনিয়ার সাইন্টিস্ট কাঁকন। এই পাহাড়েই থাকি। আমি চোখ নামিয়ে বললাম, আর তোমার পরিবার! এই পাহাড়ীরা সবাই আমার পরিবার। আবার বাচাল হয়ে পড়ি, আর তোমার হিমাচলের বাড়ি! ঘরের ভিতর সিঁড়ি! মাথা থেকে টুপিটা খুলতেই কল্পনা টুপটাপ করে শিশিরের শব্দরেখায় মিলিয়ে যেতে লাগল এই প্রায়বৃদ্ধ আমার অতীতে নেই। কথায় কথায় জেনে নিই তার সারা ভারত ভ্রমণের ইতিবৃত্ত। সাথে করে নিয়ে আসি হোমস্টেতে। পাথরের টেবিল কাঠের গুঁড়ির চেয়ার আর অতলান্ত খাদের ওপাড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সুগার, হাই প্রেশারের রুগী মানুষটা লিকার চা আর মারি বিস্কুট খেতে খেতে আমার ছেলের বন্ধু হয়ে ওঠে। আমার বরের সাথেও গল্প জমে। আমার বরের কথার উত্তরে অথবা আমাকেই যেন কৈফিয়ৎ দেয়। জর্ডনমামা যদি বাধা না হতেন তাহলে এতদিনে আমার ঘর সংসার সবই হত। পছন্দের বোকাসোকা দামাল মেয়েটি শুনেছিলাম জর্ডনমামাকে পাগলের মতো ভালোবাসে অথচ ওর চোখে আমি অন্যকিছু দেখেছিলাম। আর কাউকে তেমন ভালো কেন লাগেনি জানিনা। আমার বর সপ্তর্ষির হাতে হাত রেখে বলল, এক কিশোরীর ভেতর এমন কী দেখেছিলেন? মায়া দেখেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম, আলো দেখেছিলাম আর আমার প্রতি মুগ্ধতাও। নিঃশব্দে পাশাপাশি হেঁটে চলেছি দুজন মাঝে বিষাক্ত কাঁটাঝাড় আপনি। কেন কেন এমন পৈশাচিক খেলায় মেতেছিলেন? আমি বলার আগেই শুনলাম, এত ভালোবাসতে যদি জর্ডনমামাকে বিয়ে করলে না কেন? সে তো নিজের মামা নয়। বয়েসেও মাত্র পাঁচ’বছরের বড়ো। ভালো চাকরী করে তাহলে ছেড়ে দিলে কেন? আমি লজ্জায় ঘেন্নায় মরে যেতে চাইলাম। শক্ত করে ধরলাম তার হাত যে হাত কখনো কখনো ধরতে পারিনি। গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে? বাড়ির লোকের কথা শুনে ভালো ছেলের মতো চলে গেলে আর কখনো তো ফিরলে না। তোমার ঐ জর্ডনমামা আমায় কতবার জোর করে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে জানো? কত পালিয়েছি তার থেকে। তোমাদের ব্যাঙ্গালোরের বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছিলাম দিদার কাছে তাই দোলের দিন রং দেবার নাম করে, বাড়ির পিছনে আমার গলা টিপে ধরেছিল, আমার বুকে বসিয়ে দিয়েছিল দশ আঙুলের ছাপ। ঘেন্না করি ঐ শয়তান লোকটাকে। পাথরের উপর বসে থরথর করে কাঁপতে লাগল আপনাদের আদরের ভাগ্নে অথবা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনি তো দশ বিশটা মেয়েকে ভেঙে ছড়িয়ে নিজে দিব্যি ঘর পেলেন আর এই মনুষটা একা থেকে গেল। কী করা উচিৎ আমার? বুঝতে না পেরে পাশে বসলাম। ফিসফিস করে বলল, সেই যে মহামায়া মন্দিরে যাবার পথে সাপ দেখে আমার জামা খামচে ধরেছিলে, জোর করে তোমার আইসক্রিম কেড়ে খেয়েছিলাম আর সন্ধ্যামালতি দিয়ে আংটি বানিয়ে পরিয়েছিলাম সব আজো স্পষ্ট হয়ে জ্বলে আছে মনের ভিতর। বুকের ভিতর ভীষণ শূন্যতা কাঁকন। এজীবনে তোমায় পাওয়া হলনা, পরের জন্মে তুমি আমার হবে? আমার কী যে হল? কেন যে পৌঁছে গেলাম অতীতে। সেই সদ্য তরুণের মুখখানি আরেকবার দেখবো বলে কেন যে ডুবিয়ে দিলাম ঠোঁট। আহ্ এই প্রথমবার আপনার শয়তানির গালে চাপড় মারলাম। পুরুষ যে কাঁদে তাতো জানতাম না। কাঁদতে কাঁদতে কাঁপা হাতে সে মুছে দিতে চাইল আপনার নোংরা ছোঁয়া। মনে রেখো না কাঁকন, কোনো কষ্ট মনে রেখো না। এই পাইনের গন্ধ, ঠাণ্ডা হাওয়া আর আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সব ধুয়ে দিলাম। তুমি সুন্দর, পবিত্র তুমি আমার একান্ত নিভৃত স্মৃতি। ভালো থেকো। কে জিতে গেল জর্ডনমামা! হিসেব করবে মহাকাল। আপনার শয়তানি বিষাক্ত কেমো রশ্মিতে পুড়তে থাকুক, পাহাড়ের নিভৃত কোলে সপ্তর্ষি একাকী ভালোবাসা নিয়ে জ্বলতে থাকুক আর আমি স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হতে হতে একা হই। মনে মনে ভাবি ধুস্ এ পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সবটাই ভাঁওতা। হয়তো রোগ আছে তাই বিয়ে করেনি। হয়তো কেউ আঘাত দিয়েছে, হয়তো হয়তো বা…যেদিন রামধুরা থেকে সিটং যাবার পথে রওনা হলাম একগোছা পাহাড়ি ফুল আর ক্যামেলিয়ার চারা হাতে এসেছিল। এই ভগ্ন স্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক আগামীমাসে চলে যাবে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায়। চোখে সেই তরুণ। কাঁকন এই পৃথিবীর দিগন্তে যেখানে শুকতারা মাটির গায়ে আলতো চুমু দিয়ে যায় সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকবো। দেখা হবে আমাদের। আমি জানি একথাই সে বলেছে মনে মনে। বাইরে বলেছে, ভালো থেকো তোমরা। আমরাও বলেছি দেশে এলে এসো, আমাদের শুকনো লতাপাতার মতো খড়কুটো জীবনে। হেসেছে সে। গাড়ি চলা শুরু করলে আর পিছনে তাকাতে পারিনি। বুকের ভেতর কী ভীষণ দীর্ঘশ্বাস। কাঁকন সপ্তর্ষি মণ্ডল আকাশে উঠলে আমার কথা ভেবো, শুকতারা দিগন্তে নামলে আমায় খুঁজো। আপনার জন্য কেবল আপনার জন্য অকারণে জীবনের সংবাদ বদলে গিয়েছে মানুষটার। স্রোতের টানে হারিয়ে গিয়েছে ডুবে মরেছে কাঁকন। এই সমঝে যাওয়া বৈষয়িক কাঁকন আপনার অত্যাচারের ফসল। এই চিঠির কথা জানতে পারলে আমার ব্যক্তিগত জীবন হাঁ হয়ে যাবে, আপাত শান্তির নীড়ে ঝোড়ে বাতাস বইবে সব উল্টে পাল্টে যাবে। হোক আমি চাই তাই হোক। বোকা মেয়েটাকে কবর থেকে তুলে এনে পোষ্টমর্টেমে পাঠাবো, আপনার নখ, দাঁত, লালার নমুনা পেতেই সিংহাসন টলবে আপনার। তাই তো এই চিঠি আজ লিখেই ফেললাম। সাহস নয় সাহস নয় স্পর্ধায় মাথা তুললাম। ধরে নিন এ চিঠি আপনার অন্তিম ফরমান। মৃত্যু অনিবার্য তাকে তরুপের তাসের মতো ন্যাকা কান্নার আবেগ বহুল সুড়সুড়ি দিয়ে উপস্থাপন করবেন না। আপনি তো আমার মতো অনেকের জীবনের মানেই বদলে দিয়েছেন। সময় কাউকে রেয়াৎ করেনা জর্ডনমামা, মনে রাখবেন কর্মফল পূর্বজন্মের নয়, এ জন্মেরটা এ জন্মেই শোধ করতে হবে। ইতি কাঁকনের প্রেত (ঠিকানা দিয়ে কলঙ্ক বাড়ালাম না। মহাকাল ভার নিক বাকিটুকুর) |