লেবু নোনতার জল
সৌমী আচার্য্য
আমি রোজ আসমানে চায়া থাকি, রফিকুলের বা’জান। দেহি খোদাতালার রহমত কোন পথে আসে? আমাগো বাড়ির চাইরপাশে শুধু ছ্যামা ঘোরে। আইচ্ছা রফিকুলের বা’জান, এই যে আমার বুকির মইধ্যে চিনচিনায় ওঠে, ক্যান কোও দেহি? রাইতের বেলা কারা যেন চাঁদের মতো আঁচল ছড়ায় উঠানময়, ডাকতারে কইসে খোদার রহমত নাবলি আমার সব কষ্ট দূর হইবো। ওষুধের খরচা কার থিকা নাও? ও রফিকুলের বাজান ছ্যামড়াডা কাছে আসে না ক্যা? ওরে মানুষ কইরো। শুকনা হাওয়া যখন চড়বড় করি মাটি ফাটাবো হেয় যেন ছ্যামা দেয়। আমার বুকির ভিতর যন্তরডা এবার চুপমারি যাতি চায়? ক্যান কোও তো? গুনাহ করসি নাকি? হ গুনাহ আমার আছে, অনেক। তাই বলি আল্লার দরবারে যাওয়া লাগবো? নাকি জাহান্নামে? কারা যেন উঠি আসে কব্বরের মধ্যি থেকি। নাকে গন্ধ আসে রফিকুলের বা’জান। আমার বুকের ভেতর যনতন্না, মনিরার কোলে মাথি রাখি তুমি ফোঁপায় ফোঁপায় কইতাছিলা, ‘মনিরা রফিকুলের মারে ছাড়া আমি বাঁচুম না কিন্তু এত রোগ আর টানতি পারি না, এত খিদা নিয়া শুকনা হয়া বাঁচতি পারি না কিন্তুক ও বাঁচি থাকতি নিকা করবারও পারি না। বড়ো দোটানায় আছি মনিরা। রফিকুলডাও ফ্যা ফ্যা করি ঘোরে। আমারে একডু জুড়ায় দে রে মনিরা।’ আমার চোকখে পানি আসে। ও রফিকুলের বাজান এই রোগডা আর আমার মইধ্যি একডা দৌড় শুরু হইসে। ওই দূরে ধুলার আবছা কাগজের মইধ্যি খাঁড়ায় তুমি সেই চিকনকালের মতন আমারে আলটাও, আমি চ্যাতলেই সুরজু যেন গনগনায় আর অমনি তুমি গাঙের পানি হয়া আমারে তেঁতুল দাও। আমিও দৌড় লাগাই ওই কাগজের লাহান ছবিটা আমার ধরা লাগব। আর রোগটাও দড়ি নিয়া টান মারি আমারে কব্বরের মইধ্যি ফেলতে চায়। এই টানাটানি চলতেই থাকে গো রফিকুলের বাজান। রফিকুল বাজার যাবার আগে ওর মা খাদেজাবিবিকে ঠিক যেমন চোখ উল্টে শুয়ে থাকতে দেখেছিল এখনো তাই। আজকাল বিড়বিড় করে। শব্দ বেরোয় না। ওর আব্বা ছমির আলিকে লোকে বলে দয়ালু। রফিকুল মাদ্রাসায় শোনে, তোর বাজানে চাইলেই নিকা করবার পারে। পারে না কেবল তোর জইন্য। বাপরে কতগুলা বছর তোর আম্মি বেরেন্টের রোগে ভুগতাছে। কত খরচ করে তোর আব্বায়। রফিকুল মাঠঘাটের ভিতর সেঁধিয়ে থাকে। গাছেদের পাতা চুঁইয়ে জল নামে, ওতেই খানিক বুকের ভার লাঘব হয়। টানটান হয়ে শুয়ে থাকে মাটির উপর, নামাজের ইবাদত উপলব্ধি করে শিরায় শিরায়। মনিরা খালা বাড়িতে মৌমাছির মতো বিনবিনায়, সব বুঝেও মাঠঘাটে আস্তানা গাড়ে। —আম্মি তুমি মইরা যাইতে পারো না! যত বাঁচো তত বেশি আব্বার গুণকীর্তন বাড়ে আম্মি মইরা যাও, মইরা যাও, আল্লার দোহাই। মায়ের গায়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে এই একটা কথাই বিড়বিড় করে। খাদেজা ছনমন চোখে তাকায় দেখে না রফিকুল, ফিরেও তাকায় না। চোদ্দো বছরের জীবনে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে এ সংসারে দাম কেবল গতরের। রাতের অন্ধকারে অতীত ফিরে আসে, যেন কোন ছোটকালে ও শুনেছিল ইবলিশের কণ্ঠ। —খাদেজা আমার কামের কৈফিয়ৎ চায়া নিজের সব্বোনাশ ডাইকো না। তুমারে তো আমি কইসি সারাজীবন ইজ্জত পাইবা, ঘর পাইবা, কেবল চোপাডা বন্ধ রাইখো। —এই টাকায় গেরামের লোকের হক রফিকুলের বাজান! আপনে ঝাণ্ডার তলায় ওগো ডাকেন আর এখন ওগো হোগা মাইরা নিজের সম্পত্তি বাড়ান ক্যান? গলাটিপে ধরা মায়ের গোঙানি দু-কান চেপে না শোনার ভান করত। আজও করে না দেখার ভান, লোকটার ভালো সাজার খেলায় শরিক হয় না। শুধু বনে বাদাড়ে ঘুরে জুড়াতে চায়। মনিরা খালা ভাবে তার আব্বার মতো নেকবান্দা কেউ নাই, তার বুকের উপর হাতড়াতে চাওয়া লোকটা আসলে দিলদার। নিজের বউকে ছাড়তে চায় না অথচ পুরুষ মানুষের জ্বালাও তো আছে। উবু হয়ে দাঁতে কাঠি গুঁজে রফিকুল হাসে। খালের জলে নিজেকে দেখে বলে, শালার খানকির পুতের কায়দা খ্যান দ্যাখ রফিকুল, মাগীবাজি করনের জইন্য একটা মাইয়ামানসেরেই ইস্তেমাল করে। হায়রে মাইয়ামানুষ গুলানরে আল্লাহ্ কুনোই দিমাগ দেয় নাইরে রফিকুল। অবশ্য মনিরা খালারে বলদ মনে লয় না, চক্ষুগুলা য্যান লাট্টুর মতো ঘোরে, মনে লয় এইবার আব্বার কপালে চাপান আছে। যাইরে সন্ধ্যার কালে হেই মেখলার মাঠে দাঁড়ামু। দূর থিকা লাল হয়ে আসা সুরজুটা ডুববো আর একটা দিন খতম হওনের দুঃখে আমি শালা কাদুম। ক্যান কান্না পায়রে রফিকুল ক্যান! আম্মির জইন্যে। নাহ্ সে মরুক। সে যত বাঁচে তত আব্বার নেতাগিরি মজবুত হয়, ভালো মানুষী জিন্দা রয়। যাই আজ আরেকবার চেষ্টা করুম। (২) সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। সাজো সাজো রব চতুর্দিকে। ছমির আলি নিজের আস্তানায় কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। গলা পরিষ্কার করে আসিফ বলে, কিছু মনে করবেন না, আপনার কাজে একটা প্যাটার্ন আছে, সেটা একটু চেষ্টা করলেই বোঝা যায়। সদ্য শহর থেকে বিএ পাশ করে আসা ছেলেটাকে ছমির আলী পছন্দ করতে পারে না। কেন যে উপরতলা থেকে ছেলেটাকে আশকারা দিচ্ছে। মনেমনে ওর জিভটা এক টানে ছিঁড়ে নিতে চায় ছমির। মুখে কেবল রক্তের বদলে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।—সম্পত্তি যা করেছেন তা আপনি না চাইলেও সকলের সামনে আজ পরিস্কার। এলাকার মানুষের উন্নতি হয়েছে লবঢঙ্কা। মানুষের মনের ভিতর উষ্মা থাকলেও আপনার পারিবারিক বিপর্যয় তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। এবার নির্বাচনের আগে এলাকার উন্নতি না করতে পারলে অপজিশানের কোর্টে বল যাবার সুযোগ আছে। কেবল সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে কাজ হবে না। অনেক টাকার গড়মিল মিঞাভাই। ঘরের ভিতর চাপা উত্তেজনা, ফিসফাস। ছমির আলির গলার স্বরে চাপা যন্ত্রণা। চোখের দিকে তাকিয়ে আসিফ এক মস্ত অজগরের ছায়া দেখে। —আমার কামের হিসাব আমি কাউরে দিই না ঠিকই কিন্তুক এলাকায় আমার সুনাম আমার রহমতের জইন্য, আমার বউ আইজ তিন বছর ধইর্যা নার্ভের রোগে আধমরা তার জইন্য লোকে আমারে দয়া করে এইডা তাগো শোদ্ধার অপমান। আমাদের আসিফ আমার উপর যে অভিযোগ আনছে তারে সেইডা পোমান করতে লাগব আর আমারে ভালোবাসে যারা এইসব কথা জানার পর তারা যদি কুনো একশান লয় সেই দায় আমার নয়। যাই হউক পঞ্চায়েত ভোটের আগে আমাগো একলগে কাম করতে লাগব। অপজিশানের মারের হাত থিকা বাঁচবার এ্যাকশান প্লান লাগব। ঘরের বাইরে অন্ধকারে ঘন জমাট দুঃখের ভিতর জোনাকির ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে রফিকুল হাসে। আসিফের ধারালো কথাগুলো ওর মনের ভিতর নাচতে থাকে। পা টিপে খাদেজার বিছানার কাছে যায়। ওষুধের ঘোরে ঘুমায় সে মরা পাথরের মতো। —আম্মি শোনো এইবার তুমি মইরা যাও, তোমার কাম ফুরাইসে। বাঁইচা থাকলেও তোমার সোয়ামির পাপ ঢাকবার পারবা না। খাদেজা তখন ধোয়ায় ঢাকা কবরস্থানে আগরবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে জানাজা। গোরের গর্ত খোঁড়া শেষ। কে যাচ্ছে নীচে? এ যে সতেরো বছরের তাহমিনা। খাদেজার চাচাত বোন। কোলের বাচ্চাটা বুকে চেপে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় খাদিজা কিন্তু পারে না। —বইন আমার যাস না, খাঁড়া! আমি পাপ করসি আমারে জমজমের পানি দিয়া যা। রফিকুলের বাজান ওরে মাটি চাপা দিয়েন না, আপনে না ওরে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া নাড়াচাড়া দিয়া দ্যাখসেন। মায়া নাই এতটুকু। দমটা বন্ধ কইরেন না। চাচি আমি অনেকবার কইসি রফিকুলের বাজানরে তাহমিনারে নিকা করেন দুইবোনে মিলমিশ কইরা রমু। হেয় আমার একডা কথা শোনে না। কারা কারা উঠি আসে কব্বরের মইধ্যে থেকে? ওই যে খ্যাত হারানো মঈদুলের লাশ চোখ ভ্যাটকাইয়া শ্বাস নিবার চায়, বন্যায় সব হারাইয়া সাহাইয্য চাইতে আসা নূরুলের মার সব্বোনাশ হওয়া শরীলডা ফুইলা ভাইস্যা উঠছে, শোনেন ওয় জলে ডুইব্যা মরে নাই ওরে মারসে কে আমি জানি, কাউরে কই নাই, সেই পাপে আমার সব জ্বইল্যা যায়। রফিকুল আমার কাছে আয় বাপ কাছে আয়। কোল থিকা নাইমা গেলি! ক্যানরে? কই যাস বাপ! (৩) রফিকুল উত্তেজিত হলে নাকের ফুটোয় ডানহাতের তর্জনি গুঁজে খুঁটতে থাকে ভিতরটা। একেক সময় রক্ত বেরিয়ে আসে তবু খোঁটার শেষ নেই। আজ তার উত্তেজিত হবার কারণ আসিফ। মাদ্রাসায় তখন ভূগোলের ক্লাস, ভূমিকম্পের কারণ, লাভা লাভা ফুটছে ফুটছে,কানের কাছে ফিসফিস, তারেক গলা নামিয়ে গরম শ্বাস ফেলে, ইটভাঁটার কাছে গাঙের পাড়ে থাকিস, আসিফ আইব, তোর লগে কথা কওনের জইন্য। আসিফ ভাই! শহর থিকা পাশ করা আসিফ ভাই। আব্বার শত্রু আসিফ ভাই। গেরামের সগ্গলের ভালো চাওয়া আসিফ ভাই।—কী রে বলদ কী ভাবোস? —নাহ্ আসিফ ভাই আগ্নেয়গিরির মতো নাকি ভূমিকম্পের মতো তাই ভাবতাসি। —ধুর বলদ! গাঙের জল যেখানে খালের আকার নিয়ে ইটভাটার গায়ের ভিতর জড়িয়ে গিয়েছে সেইখানে বসে রফিকুল একমনে নাক খুঁটতে থাকে। ছোটো নৌকা করে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বয়স্ক তোতামিঞা। ওর বাড়ি গাঙের পানিতে ডুবেছে বহুকাল। ঘরের আশায় ঘুরে ঘুরে চোখের ছানি আকাশ ছুঁয়েছে, পায়নি কিছুই। পাবে কী করে? তখন যে ছমির আলির দোতলায় পাথর বসছিল। বাড়িটা জঞ্জালের স্তূপের মতো লাগে। যেখানে যত পাথর ছিল, রঙচঙে সঙের মতো সব জুটেছে বাড়ির আনাচে কানাচে। সর্বক্ষণ জোকারের মতো দাঁত বের করে হাসছে যেন। সেই হাসিটা অসহ্য, ভালোবাসা নেই, বুদ্ধি নেই কেবল দাঁত ভ্যাংচ্যানো। এইখানে সবুজের ভিতর জলের নীলে আর আকাশের নীলে মিলেমিশে যে ছবি আঁকে তার ভিতর নরম হাসি খুঁজে পায় রফিকুল। ওর মা পাগল না রুগি? সবাই বলে ওদের জন্য ওর আব্বার এত কষ্ট। বউ থাকতে বউ নাই, পোলা থেকেও নাই, অত বাড়ি যেন প্রেতপুরী। শক্ত সমর্থ জোয়ান মরদ ছমির আলীর দুঃখে সবার বুক ফাটে। টাকার আঁচে নিজেদের সেঁকতে আসে অনেকেই। রফিকুল জানে বেশি বাড়লেই সবাই খাদেজাবিবির স্বপ্নের ছ্যামা হয়ে যাবে। নীল ফড়িং-এর দিকে তাকিয়ে জলের নাচন দেখে এমন সময় সাইকেলে এসে দাঁড়ায় গোটা পাঁচেক মানুষ। এগিয়ে আসে আসিফ। খালের পাশের ভেজা মাটিতে থেবড়ে বসে। —রফিকুল কেমন আছো? —তোতামিঞার মতো। আসিফ ভুরু তুলে তাকায় রফিকুলকে ছুঁয়ে টুটানৌকার তোতামিঞাকেও দেখে নেয়। ডানহাতটা ছেলেটার পিঠে রেখে বলে, তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। সামনেই নমিনেশান আমরা চাই এবার দল থেকে তৌফিকমিঞা ভোটে দাঁড়ান। রফিকুল কুচুরকুচুর হাসে। উঠতি শহুরে নায়ক জানেনা ছমির আলীর পোলা কিডন্যাপ হলে এলাকায় কী হতে পারে। —হাসছ যে। —এইডা কুনো উপায় হইল? কেডায় দেয় এইসব আজুইরা বুদ্ধি? আর তৌফিকচাচা ভিজা বিড়াল। অহন চুপ মারি আছে, হোগার মধ্যি চেয়ার সেঁধালেই দাঁত দ্যাখাইব। তারচায়া আপনে ক্যান খাড়ান না? —সেই সিদ্ধান্ত দল নেয় রফিকুল, তুমি ছোটো মানুষ বুঝবে না। আবার খানিক হাসে এবার খ্যা খ্যা, দলের কথা আর কয়েন না, কত নেতারে আমাগো বাড়ি বইয়া মানষের সব্বোনাশ করবার দ্যাখলাম নাম কইলে আপনের মনটায় লেবু চটকায় যাইব। ওই যে যাগরে সব সঙ্গে কইরা লইয়া আইসেন দ্যাহেন গিয়া আমার আব্বা তাগো কুন খাসলত মেটাইবার পারে নাই বইলা আপনার লগে ভিড়সে। সগ্গলেই গিলবার চায়, মাগনায়, ফোকটে। —তুমি যেমন ভাবছো তেমন নয় রফিকুল, অনেকেই ভালো আছে। —হ ভালো মানুষগুলান আমার আম্মির মতো ছ্যামা দেহে, কান্দে, মাথার রোগে, বুকের রোগে মরে। আপনেও সাবধানে থাকেন। —চলো রফিকুল আমাদের সাথে। উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট ঝাড়ে, আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে, আমার নিয়া কলাডা হইব, তার চায়া চলেন ইবলিশ শিকার করি। আমারে বিশ্বাস যান। গভীর রাতের নোনতা জল থামিয়ে দিবার কামডা আমি করবো আর নিজের অজান্তে খালাস হইব ঘুঘু। আসিফের ছেলেটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। ফোন বার করে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল সূর্য তখন লালচে মুখে লজ্জা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। একটা দিন নষ্টের লজ্জা আজ ঘুচিয়ে দেবে রফিকুল। (৪) আজ আসমান থিকা খোদাতালার রহমত নামব রফিকুলের বা’জান। আজ চারিপাশ পরিষ্কার দ্যাখতি পাই। জনমকালেই মরণ লিখা থাকে শুনছি। তাইলে আজ সেইদিন। মাটির নীচ থিকা সগ্গলেই আইস্যা খাড়াইসে আমার চারিপাশে। বুকের ভিতর ব্যথা নাই, চকখে পানিও নাই। আইজ শুধু খুশি খুশি ঠ্যাহে। কে? কে আইলা? রফিকুল! কী বাপ কান্দো ক্যান? তুমি মাটি, পানি, আসমান সব নিয়া থাক, আমার ভিতরেও কী এগুলো নাই বাপ, আরো কাছে আসো বাপ্, তুমায় দেহি, পরাণডা ভইর্যা দেহি। কান্দো না বাপ কান্দো না।ঝিঁঝিঁর ডাক বাড়তে থাকে। ছমির আলী আজ দলের ঘরে বিপরীত পক্ষের শক্তি টের পেয়েছেন বলেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। চিৎকার করে শরীর ক্লান্ত, লিয়াকৎকে ফোনে সবটা বুঝিয়ে, গুগুল পে-তে পাঁচ হাজার পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ রাতটা কাটলেই নতুন ভোর আসবে। সময়ের আগেই গোস্ত আর রুটির সাথে নেশা করে অনেকটা। অশ্রাব্য গাল দেয় রফিকুলকে, খানিকের পুত, এতডা রাত হইল বাড়িত আসার নাম নাই, এই যে খাদেজা বিবি, আয়েস কইর্যা গতর তো ফুলছে ভালোই, তোমারে বাঁচায় রাখসি ক্যান হ্যাঁ! মুখে গোঁওওও আওয়াজ তোলা প্যারালাইজড্ খাদিজা কত কী বলতে চায়, পারে না। ওর গলাটা চেপে ধরে ছমির আঙুলের দাগ বসতে থাকে, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়, ছেড়ে দেয় তখনি। সপাটে একটা চড় মারে প্রবল আক্রোশে ঘোরে থাকা খাদিজাকে। সবেদা গাছের পিছন থেকে সবটা দেখে রফিকুল, আসিফকে তার আব্বার প্ল্যান জানিয়ে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে ছমিরের নৃশংস রূপটা আবার দেখে। মুহূর্তে ঝলসে ওঠে চোখ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর শিকারে বেরোয়। নিরীহ শিকার। ভালোবাসায় মোড়া অবাক চোখদুটো দিয়ে কত আদর করে, রফিকুল একটু একটু করে তার শ্বাস কাড়ে যত, তত তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে শান্তি। এক সময় বহুবছরের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় সে, রফিকুল কাজ শেষ করে শিকারের দুচোখে চুমু খায়। —আম্মি! আম্মিইইই! আমারে নিয়া যাও আম্মি! (৫) খাদেজার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে শ্বাসরোধের কথাটি দৃঢ় ভাবে উল্লেখ হলেও আরো কিছু চাপা সত্য ছিল, পুলিশের কাছে উপরতলা থেকে হুকুম এসেছিল অশ্বত্থমা হত এইটুকুই জরুরি, তাই ইতিতে পুলিশ ছমিরের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দায় সারল। আসিফের রফিকুলকে ছায়ার মতো আগলে রাখা দেখে সকলে ধন্য ধন্য করল। ছমির! হতবাক। যে লোকেরা তার গুণগান গাইত তাদের ক্ষোভ যখন চড়, কিল, লাথিতে ফুটে উঠল ছমিরের মুখে বিস্ময় ছিল। গনগনে চোখে রফিকুলকে দেখতে গিয়ে টের পায় ছেলেটার ভিতর বয়ে যাচ্ছে শান্ত নদীর ধারা। কে? কে ওর চোখ ভিতর? খাদিজা, নাকি অন্য কেউ? আসিফ!তছরূপের টাকাগুলো সাপের খোলসের মতো ঝেড়ে ফেলে স্বস্তি পায় রফিকুল। সারা বাড়ি জুড়ে আগরবাতির সুবাস। সন্ধ্যার মুখে ছায়া ঘনাতে থাকে চারপাশে। —আম্মি! আমারে মাফ কইর্যা দাও আম্মি! ওই লোকডা তুমারে ইস্তেমাল করে আম্মি! তোমারে হাগা মোতায় পচিয়ে হেয় একের পর এক নতুন শরীরের ভিতর সেঁধায়, গোস্তের মজলিসে জীবনডারে ভোগ করে আম্মি। তুমি অহন সত্যিকারের কাজে আসতাসো। পিঁপড়েরা খাবার পায়, পোলাপান গো খাওয়ায়, পোকারাও তাই। মাটিরে সার দাও আম্মি। তোমার গোরের মাটিতে আমি কাঠচাঁপা লাগায়সি। ও আম্মি আমারে মাফ করো। আমি গুনাহ করসি, জম্ম দেয় যে তারে আমি খালাস করি, ইয়া আল্লাহ, আমি কই যাই! নিজের থেকে তো বাচবার পারি না। আসিফ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে রফিকুলকে। বুকে মাথায় হাত বোলাতে থাকে। দুঃখের প্রবাহ বড় সহজেই ভাসিয়ে দেয়। —কেন কাঁদো? তুমি আজাদ করেছ তোমার আম্মিকে। এক শয়তানের হাত থেকে। —না ভাই, আমি তো রাজনীতি করবার চাই না, ক্যান করলাম! —তোমার মনে হয় রাজনীতি শুধু লোকে নিজের জন্য করে? না রফিকুল, মানুষের ভালো চায় যারা তারা যদি এগিয়ে আসে তবে রাজনীতি আর ছমির আলীদের জাগির হয় না। —আব্বার উপর প্রতিশোধ নিতে এ আমি কী করলাম? কী করলাম? —কিচ্ছু করো নি। তোমার আম্মির উপায় ছিল না বলে তোমার বাবার সব শয়তানি জেনেও, সব অত্যাচার সহ্য করেও তোমায় আগলে বেঁচে থেকেছেন। —আর তারেই আমি বালিশ চাপা দিয়া শ্যাষ করলাম, হায়রে ইবলিশের বাচ্চা। —প্লিজ রফিকল, তুমি এমন করে ভেবো না। তুমি কত অসহায় মানুষের সাহায্য করেছ একবার ভাবো। তোতামিঞা তোমার জন্য দোয়া করছে রোজ তুমি কি দেখতে পাও না। এমন অনেক তোতামিঞার তোমাকে প্রয়োজন। ওঠো উঠে দাঁড়াও, মন প্রাণ দিয়ে পড়ো, তৈরি হও। —আমারে ছাইড়া দাও ভাই, আমার শুধু মাটি, নদী, বাতাস, পানি থাউক। —সত্যিই যদি সব ঠিক রাখতে চাও রফিকুল তবে পড়ো, পড়ে তৈরি হয়ে রাজনীতিতে এসো। মূর্খ, লোভী আর ধূর্তদের হাতে এত এত মানুষের আশা ভরসা বেচে দিও না। রাতগুলো কাটতে থাকে পড়াশোনায় আলোচনায়। পঞ্চায়েত ভোট যায় আসে। নদীর জল কত খেলা দেখে। নিজের ভিতর লুকিয়ে রাখে কত কান্না। রফিকুলের সাথে আপনাদের দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি। আসিফ ওকে গড়ে পিটে নিচ্ছে। ওই যে গাঙের পাড়ে দুজনেই হাতে হাতে সকলের সঙ্গে পাড় বাঁধানোর কাজ করছে। |