এক অভাগিনী মেয়ের অনুভব
সুস্মিতা সাহা
শ্রীচরণেষু , পিসি-মা, পত্রের প্রথমেই তুমি আমার প্রণাম নিও আর তার সাথে একবুক ভালোবাসাও। এই ভালোবাসাই তো তুমি ছোট থেকেই আমায় দিয়েছ। না না…ভেবো না যে তুমি দিয়েছিলে বলেই তোমাকে তা ফেরত দিচ্ছি। ভালোবাসা তো এমনি আসে ,তাই না বলো! বিশেষ করে কেউ যখন মন থেকে ভালোবাসা দেয় তখন তার প্রতি ভালোবাসাটা আপনা থেকেই আসে, জোর করে ফেরত দিতে হয় না। তুমি আমাকে এতটা ভালবেসেছ যে , ততটা হয়তো আমার নিজের জন্মদাত্রী মাও আমাকে ভালোবাসেন নি। জানি না বললে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা ,কিন্তু মাঝে মাঝেই না খুব ইচ্ছে হতো তোমাকে মা বলে ডাকি। কিন্তু… কিন্তু , কেন যে পারিনি ! হয়তো ভয় পেতাম যে তোমাকে মা বললে আমার জন্মদাত্রী কি মনে করবে! যদি রাগ করে! সবাই তো শুধু বাইরেটা দেখে , ভেতরটা যে কেউই দেখে না গো। আমার এখনও মনে পড়ে জানো, আমার মুখ দেখেই তুমি বুঝে নিতে আমার মনটা কেমন আছে, ভালো না খারাপ। আমার মনের ভেতর কোনো কষ্ট লুকিয়ে আমি সবাইকে দেখানোর জন্য শুধু ওপর ওপর হাসছি কিনা সেটা তুমি ঠিক বুঝতে পারতে, তারপর আমাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করতে কী হয়েছে আমার? কিসের জন্য কষ্ট পাচ্ছি? আমি বলতে না চাইলেও তুমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক বার করতে আমার মনের খবর। আমার কষ্ট হলে, আমি কাঁদলে তুমি মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে কত্ত আদর করতে, সান্ত্বনা দিতে, বোঝাতে। এসব কেউ কখনো করেনি আমার সাথে জানো! এমনকি আমার নিজের মাও না। আচ্ছা পিসি, শুধু কি জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়? যে মা তার সন্তানের কষ্ট, দুঃখ, মনের কথা, চোখের ভাষা কিছুই বোঝে না সে কি আদৌ মা হতে পারে? মা মানে তো মায়া, মমতা, স্নেহ, আদর কত কিছুর সমন্বয়। আমার কি মনে হয় জানো, মা শব্দটা সবথেকে ছোট হলেও এর ওজন, এর ভার, এর ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। সবার হয়ত এতটা ভার, এত ব্যাপ্তি গ্রহণ করার, বহন করার ক্ষমতা থাকে না, যেটা তোমার মধ্যে আছে। আমি তোমার নিজের মেয়ে না হওয়া সত্ত্বেও তো তুমি কত বোঝো আমাকে, তাহলে তুমি নিজে মা হিসেবে কতটা ভালো হবে তাই ভাবি আমি! ভগবান আমাকে তোমার মত একটা মা কেন দিল না বলত? আচ্ছা, সে নাই দিল, হয়তো আমি তোমার মেয়ে হবার যোগ্য নই তাই…। কিন্তু আমার মাও তো একটু আমাকে বুঝতে পারতো, আমাকে একটু ভালোবাসতে পারতো, আমাকে কখনো একটু আদর করতে পারতো! মা কি ওসব কিছু পারেনা ? না না, ভুল বললাম একটু, মা পারে না তা নয় । আসলে আমার জন্য পারে না, পারে শুধু মায়ের ছেলের জন্য। আমি তো মেয়ে , আমার ওসবের কি দরকার বলো! আমি তো অন্যের সম্পত্তি, পরের ধন। আমার প্রতি ওসব দেখিয়ে কি হবে! ছেলেরা হলো মায়ের বৃদ্ধবয়সের লাঠি, তাই তাদের জন্যই সবকিছু। আমাকে জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে, বিয়ে দিয়েছে, ব্যস সব দায়িত্ব শেষ। এর বেশি আর আমার জন্য কি থাকতে পারে বলো? মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে জানো যে মা কি আমাকে কখনোই একটু ভালোবাসেনি, শুধুই কর্তব্য করে গেছে আমার প্রতি? আজকাল একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে জানো। আমার বিয়ের পর একবার মা আমাকে ফোনে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল যে ভাই নাকি মায়ের ওপর রাগ করে কথা বলে না বেশ কিছুদিন ধরে, মাকে মা বলে ডাকে না। তাই নিয়ে মায়ের মনে কত কষ্ট। আজ তিনবছর হল আমিও তো মাকে মা বলে ডাকি নি গো, মায়ের কি সে জন্য কষ্ট হয় কখনো? কখনো কি বলে সে কথা দুঃখ করে সবার কাছে? আজ একবছর ধরে আমি একা। তাই নিয়ে কখনও মায়ের কষ্ট হয়? আমি কেমন আছি, কতটা ভালো আছি এসব নিয়ে কি একবারও চিন্তিত হয় মা? খুব জানতে ইচ্ছে করে জানো। অবশ্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিয়ের পরেও তো মা কোনদিনও জানতে চায়নি আমি কেমন আছি, আমার বিবাহিত জীবন কেমন ? আমি সুখী কিনা? শেষপর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির আর স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে যখন নিজেই বললাম নিজের কষ্টের কথা, সেদিনও মা কী ভীষন নীরব ছিল। আমার কোনো দুঃখ কষ্ট মাকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয়নি একটুও। শেষে শুধু একটা কথাই শুনেছিলাম যে মেয়েদের সয়ে নিতে হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। মা বাবা সবাই মিলেই এক কথাই বলেছিল। সেদিন বিস্ময়ে আর আঘাতে মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছিল না। বাবার কথা বাদ দিলাম কিন্তু মাকেও স্পর্শ করলো না তার মেয়ের কষ্ট!! কেন মেয়েদের সব সয়ে নিতে হবে বলতো , কেন? মেয়েরা কি মানুষ নয়? তাদের কি নিজস্ব আবেগ, অনুভুতি, ইচ্ছে, আকাঙ্খা , ভালো, মন্দ, মান-সম্মান কিছুই থাকতে নেই? যদি মা বাবাই মেয়ের কষ্ট , মেয়ের অনুভুতি এসব না বোঝে তাহলে কী করে আমরা আশা করবো যে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পরিবার আর অচেনা মানুষজন সেসব বুঝবে? মেয়েরা কি আজীবন অবহেলিত আর ক্রীতদাস হয়েই থাকবে, যার নিজস্ব কোনো ইচ্ছে , আকাঙ্খা, কামনা, বাসনা কিছুই থাকবে না! যে যখন যা বলবে তাই করতে হবে, ইচ্ছে না হলেও? নাহ্,আমি আর পারলাম না। আর পারলাম না সবার ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে। তাই একা নিজের মতো থাকারই সিদ্ধান্ত নিলাম। আমিও তো চাই একটু মনে খুলে বাঁচতে, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে এই পৃথিবীর বুকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওই দমবন্ধ করা নরকে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। জানতাম কাওকে পাশে পাবো না, কেউ সমর্থন করবে না আমার সিদ্ধান্তকে তাও…। নাই বা থাকলো কেউ পাশে তাও একটু তো শান্তির শ্বাস নিতে পারবো আমি। আমিও যে একটা রক্তমাংসে, ইচ্ছে অনুভূতিতে গড়া মানুষ এই বোধটুকু তো নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারবো। এক জীবনে তো সবাইকে খুশি করা যায় না বলো, তাই জীবনের বাকি দিনকটাতে নাহয় শুধু নিজেকেই খুশি করলাম। আর তাছাড়া আমার ভালো-মন্দ, খুশি-অখুশি এসব নিয়ে যাদের মাথাব্যথা নেই তাদের কথা আর নাইবা ভাবলাম। জানি, হয়তো সমাজ আমাকে ভালো বলবে না, বলবে মেয়েদের এত জেদ ভালো না। বললে বলুক, আর ভালো লাগে না জানো সমাজের কথা ভাবতে, লোকে কী বলবে সেসব ভাবতে। আচ্ছা পিসিমনি, যারা গর্ভধারণের খবর জেনেই পরীক্ষা করে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে আর তারপর কন্যাভ্রূণকে মেরে ফেলে তাদের তো সমাজের লোকেরা খুব খারাপ বলে, ঘৃনা করে। এমনকি আইনে এর জন্য শাস্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু যারা কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তাদের অবহেলায়, অযত্নে , অনাদরে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেয় তাদের কেউ কিছু কেন বলে না বলতো? ভ্রূণগুলো তো কিছু বোঝার আগেই বিদায় জানায় পৃথিবীকে , তাই ওরা দুঃখ কষ্ট ভালোবাসা ঘৃনা কিছুই বোঝার সুযোগ পায় না। কিন্তু এই অবহেলিত মেয়েগুলো যে সব বুঝে কষ্ট যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে মরে সেটা কী কেউ বোঝে! তাই আমার মত মেয়েদের চেয়ে ওরা অনেক ভালো থাকে, অন্তত পৃথিবীতে আসার পর কারোর অবহেলা তো সহ্য করতে হয় না। তুমি হয়তো এবার আমাকে খুব পাষন্ড মনে করছ তাই না পিসি? আমি কারো মৃত্যুকে ভালো বলছি বলে আমাকে হয়তো খুব খারাপ ভাবছো। সত্যি অন্য কারো মৃত্যু কামনা করা একদমই অনুচিত, পাপ সেটা। না না, আমি আর এসব কথা বলবো না গো, ক্ষমা করে দিও আমাকে। তবে একটা কথা অন্য কারো না হোক, নিজের মৃত্যু কামনা করাও কি পাপ? না না, তুমি ভুল ভেবো না, আমি মরবো না এত সহজে, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। যতদিন ভগবান নিজে থেকে আমাকে ডাক না দেবে ততদিন আমি থাকবো এখানেই। থাকতে আমাকে হবেই, আমার মেয়েটার জন্য। আমি না থাকলে যে আমার মেয়েটাও আমার মতই অবহেলায়, অযত্নে বড়ো হবে। তাহলে আর মায়ের মধ্যে আর আমার মধ্যে তফাৎ রইলো কোথায় বল? আমি আমার মেয়েকে খুব আদরে, খুব ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করবো। দেখেছ, কত কি আবোলতাবোল কথা লিখে ফেললাম চিঠিতে। আসলে তোমাকে চিঠিতে লিখতে বসে আর নিজের আবেগ গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না জানো। আর তাছাড়া তুমিই তো একমাত্র মানুষ যে প্রথম থেকেই আমার মনের কথা জানতে বা আমাকে বুঝতে আগ্রহ দেখিয়েছো , তাই আজও তোমার কাছেই আমার সমস্ত মন উপুড় করে ঢেলে দিলাম। মনের অন্ধকার গহীনে থাকা আবেগ, কষ্ট, রাগ, অভিমান সবকিছুই তালা খুলে তোমার সামনে বের করে রাখলাম। হয়তো তুমি বুঝবে। আর কেউ থাক না থাক তুমি ঠিক থাকবে আমার সাথে এই বিশ্বাসটুকু হৃদয়ের কোনো এক চোরকুঠুরি থেকে বার বার ধাক্কা মেরে জানান দিতে লাগলো, তাই এত কিছু লিখে ফেললাম তোমাকে। আসলে কী জানো কখনও ভাবি নি তোমায় চিঠিতে এসব লিখবো। কিন্তু কী করে জানিনা আজ এসব…. । ছোটবেলায় তুমিই তো আমায় লেখাপড়া শিখিয়েছো, আমার স্কুলে গেছো যে কোনো দরকারে। তাই তুমি বিয়ে করে চলে যাবার পর খুব মিস করতাম তোমায় জানো। প্রথম প্রথম মনে হত তোমাকে ছাড়া ওই বাড়িতে থাকা অসম্ভব আমার পক্ষে। কিন্তু তারপর একদিন সেটাও অভ্যেস হয়ে গেলো। আসলে এটাই তো জীবন তাই না বল! কখনোই যা থেমে থাকে না, চলতে থাকে আপন ছন্দে, আপন গতিতে। এই দেখো, আবার কত কী লিখে ফেললাম, কত বড় চিঠি হল দেখোতো! তোমার পুরো চিঠিটা পড়তে অনেক সময় লাগবে , তবুও কিন্তু তুমি পড়বে পুরোটা। ইশ দেখেছ অত কথা বললাম অথচ তোমার শরীর কেমন আছে, তুমি কেমন আছো , সেটাই এখনও জিজ্ঞেস করিনি। একবার পারলে তোমার এই মেয়ের কাছে এসো, দেখে যেও কেমন আছে তোমার মেয়ে একা একা। আমারও তোমার সেবা করার সুযোগ হবে একটু। তুমি এলে তখন জমিয়ে গল্প করবো দুই মা-মেয়েতে। আসবে কিন্তু। আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। বাকি কথা অন্যসময় হবে বা অন্য চিঠিতে হবে। তুমি ভালোমত থাকবে, আমার জন্য চিন্তা করবে না। আমি খুব ভালো আছি। ইতি – তোমার পূর্বজন্মের অথবা পরজন্মে হতে চাওয়া মেয়ে । |