সুমনা দত্ত
সুপ্রিয় অক্ষরশিল্পী, তাং : ২২ শ্রাবণ ১৪২৯ এক আকাশ ভালোবাসা জেনো। বাহ্যিক যোগাযোগ না থাকলেও তো কিছু সম্পর্ক থেকেই যায় মনের গহনে । ধীরে ধীরে সে টানও হয়তো গভীরতর হয়। তুমি হয়তো অবাক হচ্ছো। তোমাকে আর কি বলে সম্বোধন করব বল ! অবশেষে সম্বোধনে কি আর যায় আসে তবুও ,তারপরও কিছু একটা তো থেকেই যায়। জানি, তুমি হয়তো ভাবছো হোয়াটস আ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, টুইটারের অত্যাধুনিক যুগে আমি আবার কেন চিঠির ঝাঁপি খুলে বসলাম !আসলে যে কথাগুলো মন খুলে চিঠিতে লেখা যায় তা অন্য কোথাও কোনোভাবেই লেখা সম্ভব নয় । হয়তো এই চিঠি তুমি কখনই পড়বে না। তবু তোমায় লিখছি একবুক আশায়। মাস কয়েক আগে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় “উড়ো চিঠি”-তে। যদিও সাক্ষাৎ হয়নি কোনদিন ! বইমেলায় এক প্রকাশনির স্টল থেকে নিছক আগ্রহের বশবর্তী হয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ইচ্ছে হলো বইটি সংগ্রহ করার। বহু কষ্টে সংসারের খরচের সামান্য কাটছাট করে সাতপাঁচ না ভেবেই কিনে ফেলেছিলাম বইটি। বাড়ি ফিরে মন্ত্র মুগ্ধের মতো গোগ্রাসে পড়েছিলাম নাওয়া খাওয়া ভুলে । সেদিন তোমার উপর বড্ড অভিমান হয়েছিল , শেষ লগ্নে গল্পের নায়িকাকে এসাইলামে পাঠানোর জন্য। যদিও সে কথা তোমায় বলেছি আগের চিঠিতে। বইয়ের প্রচ্ছদে তোমার ঠিকানা পেয়ে চিঠি লিখেছিলাম তোমায় ভালো লাগার কথা জানিয়ে। জানতাম তুমি ব্যস্ত মানুষ উঠতি লেখক, নাম ডাকও আছে অনেক। আমার মত সামান্য পাঠকের চিঠি তোমার হাতে পৌঁছালেও তা যে নেহাতে ডাস্টবিনে ঠাঁই পাবে তা জেনেও তোমায় লিখেছিলাম। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন দিন পনের পর নীল খামে গোটা গোটা অক্ষরে আমার নামে লেখা তোমার পাঠানো চিঠি দিয়ে গেল পিয়ন কাকু! এর আগে কখনোই আমার নামে কোন চিঠি আসেনি। তাই যথারীতি ভাই বোন মা-বাবার উৎসুক দৃষ্টি আমার নজর এড়িয়ে যায়নি। জানো, সেদিন প্রাণ ভরে চিঠির গন্ধ নিয়েছি। আমার মত সামান্য মেয়েকে লেখা তোমার চিঠি ঊর্ধ্বশ্বাসে পড়েছি এক, দুই, তিন না…. কতবার তা মনে নেই! ঢ় তুমি হয়তো হাসছো! আর হাসবে নাই বা কেন? আমার মত কত হাজার পাঠকই হয়তো আছে তোমার চিঠির অপেক্ষায়। তোমার চিঠি নিয়ে এমন পাগলামি হয়তো করে তারাও। আজকাল নিজের সাথে নিজের কথা হয় রোজ, চলে তুমুল তর্ক। মনে মনে ভাবি আমি কি তবে প্রেমে পড়েছি! কার? তোমার নাকি তোমার লেখনীর? উত্তর খুঁজে পাইনি। জানি পাবোওনা কোনদিন। আমার এই একলা জীবনে তোমার পাঠানো কয়েক ছত্রের চিঠি খোলা বাতাসের মত। জীবনের প্রতি এক অনাবিল আকর্ষণে আমায় ছুটিয়ে নিয়ে চলে। হাতছানি দেয় আগামী জীবনের প্রতি। একে একে পিছনে ফেলে আসি আমার একাকীত্ব, মেঘলা মন, আর বৃষ্টি যাপন! খাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমি কে তোমার একটি মাত্র চিঠির কয়েকটি অক্ষরমালা এক ঝটকায় কেমন টেনে তোলে, দেখায় বাঁচার দিশা। আর একবার, আর একবার আবার নিজের জন্য ভাবতে ইচ্ছে হয়। দিন দিন প্রতিদিন দেখি শ্রাবণের এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে আমায় ঘিরে থাকা মন খারাপেরা ধীরে ধীরে কোথায় যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে । জীবনে প্রথম প্রেমে প্রথম পাওয়া গোলাপের মতো অত্যন্ত চুপিসারে তোমার পাঠানো চিঠিখানা লুকিয়ে রেখেছি বইয়ের ভাঁজে। বুকের গভীর উচ্ছ্বাসে দিয়েছি মন কেমনের বাঁধ। এরপর তোমার যত গল্প উপন্যাস পড়েছি মনে হয়েছে তারা তোমার “উড়ো চিঠি ” গল্পের নায়িকাদের থেকে ভিন্ন। মনে মনে তোমার প্রতিটি গল্পের নায়িকা হতে চেয়েছি আমি। তাই কখনো নিজেকে সাজিয়েছি চোখের কাজলে, হালকা লিপস্টিক ও খোপার ফুলে। আবার কখনো এলোকেশী ,এলো চুলে। যদিও তাদের কারো মত নেই আমার আর্থিকঅবস্থা অথবা চরিত্র। তোমার গল্পের নায়িকারা তো সব সোনার চামচ মুখে জন্মেছে। তারা কেউ আমার মত হা-ভাতে ঘরের নয় ! তাদের গায়ের দুধ সাদা ফর্সা রং ,টানা টানা পটল চেরা চোখ, তীক্ষ্ণ চাহনি আর বিলাসী প্রেমিকের বাহুডোরে সুখযাপনের গল্প শোনায় । অহেতুক মান অভিমান শেষে সুন্দর প্রেম প্রেম খেলা শেষে ঘর বাধার গল্প। ব্যতিক্রমী শুধু নিশা উড়ো চিঠির নায়িকা। তার সাথে আমার হয়ত খানিকটা মিল আছে। যদিও জানি তোমার গল্পের নায়িকাদের পাশে আমি বড্ড বেশি বেমানান। আমায় সংসারের খরচ জোগাতে হয়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশনি করতে হয়। রোদে ঝলসানো আমার তামাটে ত্বক, তেল শ্যাম্পু বিহীন আমার রুক্ষ চুল, ফাঁটা গোড়ালি, গায়ে কোন সুগন্ধি নেই তার বদলে আছে ঘামের উগ্র গন্ধ। রংচটা পরনের শাড়ি, শুকতলা ক্ষয়ে হয়ে আসা হাওয়াই চটি । বিছানায় অসুস্থ মা, হঠাৎ কারখানায় লকডাউন হয়ে বেকার বাবা, ভাই এর লেখাপড়া , বোনের ক্ষুদার্থ চাহুঁনি। পলেস্তরা খসা দেওয়াল, মাথার উপর চুঁইয়ে পড়া এডবেস্টারের চাল, পেটে অনন্ত খিদে আর কাঁধে চেপে বসা দায়িত্বগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েও না পারা আমি ! জানি, তোমার গল্পের নায়িকা হতে পারব না কোনদিনই । তবে কি জানো এমনই এক শরতের দিনে আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল চুপিসারে। আমি তখন আঠেরো, সদ্য কলেজ ছাত্রী। হঠাৎ ক্লাসের সব চেয়ে সুদর্শন ছেলেটি লাইব্রেরীতে বসে হাতে হাত রেখে বলেই বসলো ভালোবাসে আমায়। আমার সরল বিশ্বাস। ভেবেই নিলাম সত্যি সত্যি সে হয়তো আমায় ভালোবাসে। ভালোবাসার রঙিন স্বপ্নে বিভোর আমি জীবনে প্রথম প্রেম নিয়ে এতটাই বিভোর হয়ে পড়লাম যে বুঝে উঠতে পারিনি কি ঠিক আর কি ভুল। বলো, আমি কি করে জানবো ভালোবাসা নিয়েও যে মজা করা যায়! দিন কয়েক যেতে না যেতেই সে জানিয়ে দিল আমার মত কুৎসিত মেয়েকে ভালোবাসা তো দূরের কথা কাছে ঘেষতেও ঘৃণা হয়। সেদিন নাকি শুধু বন্ধুদের সঙ্গে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলতে গিয়েই এমনটা করেছিল । সত্যিই তো আমাকে কেউ কিভাবে ভালোবাসতে পারে ! সেদিনের পর থেকে ভালবাসা শব্দটার উপরে বিশ্বাস রাখতে পারিনি কখনো। আর তারপর জীবনে কখনো কোন বসন্ত আসেনি, কোন রঙ ছুয়ে যায়নি আমায়। সাদাকালো জীবনে তখন একমাত্র ধ্যান শুধু পড়া আর পড়া। খুব ভালো রেজাল্টও করি গ্রাজুয়েশনে। ইচ্ছে ছিল ল নিয়ে পড়বো ক্যারিয়ার গড়বো। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবার কারখানায় লকডাউন। অবশেষে সে ইচ্ছাতেও জল ঢেলে দিল। সেদিন বুঝেছিলাম আমার মত মেয়েদের ইচ্ছে বলেও কিছু থাকতে নেই। সংসদের হাল ধরতে তারপর থেকেই সকাল বিকেল টিউশনি পড়িয়ে চলছে দিন। মাঝে কয়েকটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল বটে! তবে কালো মেয়ের বিয়ে হওয়াটা অত সহজও তো ছিল না। আটকে গেল দেনা পাওনার গেরোয় !অথবা বলতে পারো বাড়ির একমাত্র আর্নিং মেম্বারকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দেবার সদ ইচ্ছাও বাবা-মায়েরও ছিল না। তাই নিজের একটা ঘর, নিজের একটা সংসার, নিজের একটা মানুষ তাও আর হলো না! আর ঠিক যখন দম বন্ধ অবস্থা সংসারের ঘানি টেনে অতিষ্ঠ। তখন একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠলো, বই ! তবে টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। তাই পড়াতে গিয়ে এ ওর থেকে চেয়ে চিন্তে বই পড়েই দিন কাটছিল। বই কিনে পড়াটা ছিল আমার কাছে বিলাসিতা মাত্র। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করে সে বিলাসিতা করেই ফেললাম। আজ ভাবি ভাগ্যিস সেদিন সেই বিলাসিতা করেছিলাম তাই তো তোমার মত একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তুমি হয়তো ভাবছো এ কেমন গায়ে পড়া মেয়ে রে বাবা, সে তুমি ভাবতেই পারো। আমায় নিয়ে কেউ কখনোই কোনদিন পজেটিভ কিছু ভাবিনি ।আমি কিন্তু তাতেই খুশি! ভাবছো তো আমার জীবনের গল্প শুনে তোমার কি বা লাভ অথবা এত লম্বা চওড়া চিঠি দেখে এতক্ষণে ছুঁড়েই ফেলেছো ডাস্টবিনের এক কোণে ! তবু আগের বারের মতোই ভুল করেই যদি পড় এই ভেবেই তোমায় লিখছি লিখছি। লিখছি নাকি লিখিয়ে নিচ্ছো জানিনা! আজ খুব মনে হচ্ছে লজ্জার মাথা খেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সাধারণ মেয়ের” মত আমিও তোমায় বলি……. . ” পায়ে পরি তোমার, একটা গল্প লেখ তুমি শরৎ বাবু , নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প । যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয় অন্তত পাঁচ সাত জন অসামান্যার সঙ্গে…….” ভালো থেকো তুমি, এভাবেই সৃষ্টিতে থেকো, অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ে থেকো। ইতি তোমার একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা মাত্র |