সুভাষ কর্মকার
বন্ধু বিনয় , দীর্ঘদিন তোমার চিঠি না পেয়ে ভেবেছিলাম যে তোমাকে আর চিঠি লিখবো না । তোমার আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই চিঠি ছাড়া তোমার সাথে যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যমও নেই । যাই হোক তোমার কি মনে পড়ে ‘ মোল্লা নাসিরুদ্দিন ‘ স্যারের কথা । আমি গল্প বইয়ের নাসিরুদ্দিনের কথা বলছি না । আমরা যখন সারগাছি বোর্ডিংয়ে পড়তাম সেখানে নরেন স্যার আমাদের খুব শাসন করতেন । মনে পড়ে ওনার কথা । কিছুদিন আগে ফোনে খবর পেলাম , নরেন স্যার নাকি ভীষণ অসুস্থ । পড়িমরি করে মধ্যরাত্রে বাড়ির থেকে বেরিয়ে শিয়ালদহ-লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠে পড়ে ট্রেনের সিটে জায়গা পেয়েই ঘুমে চোখ দুটো বুঁজে আসল । ঘুম ভেঙেই দেখি নরেন স্যার দুই হাতে আমাদের দুজনের কান গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের মতো মোচড় দিচ্ছে । সারা ক্লাসের ছেলে হো হো করে উঠল । দুজনের জায়গা হল ক্লাসের বাইরে নিল-ডাউন অবস্থায় । অবশ্য বেশির ভাগ ক্লাসেই তো আমরা ওই ভাবেই থাকতাম । দুজনে কোনোদিনই পড়াশোনা করতাম না । সব স্যারেদের ক্লাসের শাস্তিগুলো হজম হয়ে গেলেও টিচার ইনচার্জ নরেন স্যারের অভিনব শাস্তি আমাদের হাড়ে ডুগডুগি বাজিয়ে দিয়েছিল । বোর্ডিংয়ে শাসন ছিল ভীষণ কড়া । গরমের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ফিরতি পথে লালগোলা ট্রেন থেকে নেমেই দেখতাম স্টেশনে উনি দাঁড়িয়ে । পুরো মিলিটারি মেজাজে সবাইকে বোর্ডিংয়ের বাসে ঢুকিয়েই ওনার যেন ভোল পাল্টে যেত । ” গরমের ছুটিতে তোরা বাড়িতে কি কি করলি ? ” ”টিভিতে ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠানে ‘কিং কং’ এর সিনেমা কারা কারা দেখল ? ” যেন জন্মজন্মান্তরের আত্মীয় ! কিন্তু সেই মাস্টারমশায় বোর্ডিংয়ের বাস থেকে নামলেই তার হিটলারি মেজাজ শুরু ।” কে বাথরুমে বেশিক্ষণ সময় কাটায় বা কে বোর্ডিংয়ের আলো বন্ধ হওয়ার পর টর্চ লাইট জ্বেলে কমিকসের বই পড়ে ।” উনি সব খোঁজ রাখতেন । আবার কেউ লুকিয়ে কমিকসের বই পড়তে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে কমিকসের বই থেকে প্রশ্ন করে বসতেন । তুমি তো জানো আমি ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বইয়ের ভেতরে ফেলুদার বই রেখে পড়তাম , একদিন ওনার হাতে ধরা পরে গেলাম । শাস্তিস্বরূপ উনি জিজ্ঞাসা করলেন , ”ফেলুদা কোন রঞ্জি দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন ? ” ভেবে দেখো ? ক্লাসচলাকালীন লুকিয়ে লুকিয়ে ওনার বসন্তের দাগ ভর্তি মুখের ছবি অনেকেই আঁকতো । কেউ ধরা পড়লেই , উনি পড়া থামিয়ে সবার সামনে তাকে ক্লাসরুমের বোর্ডের মধ্যে ওনার ছবি আঁকতে বলতেন । যদি মোটামুটি চোখ-নাক-মুখ মিলে গেল তো রক্ষা আর না মিললে , যতক্ষনে না মিলছে , ততক্ষন ধরে আঁকতে হতো । তার এই বিচিত্র বিচিত্র শাস্তিতে আমরা পুরো ভয় পেয়ে গেলাম । এর থেকে পিঠে লাঠি ভাঙা অনেক সহজ শাস্তি । সব স্যারের কিছু না কিছু মুদ্রা দোষ ধরে ফেলে আমরা তাদের একটা করে খ্যাপানো নাম দিয়ে দিতাম যেমন সচিন স্যারের ‘কিপ্টে’ , মৃণাল স্যারের ‘ সুখের পায়রা ‘ কিন্তু নরেন স্যারের খ্যাপানো নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না । একদিন বাংলা স্যার না আসায় উনি ক্লাস নিতে ঢোকেন । মোল্লা নাসিরুদ্দিনের চিনি খাওয়ার গল্পটি পড়তে গিয়ে উনি যেন গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন , ”রাজা বাচ্চাটিকে চিনি খেতে মানা করার আগে নিজে চিনি না খেয়ে অভ্যাস করে নিলেন । ” সেদিনের পর থেকে ওনার মধ্যেকার মানুষটা যেন কেমন কেমন পাল্টে গেল এরপর থেকে ওনার শাস্তির ধরণও গেল বদলে । যেমন যার দৌঁড়ানোতে স্কুলে খুব নাম তাকে শাস্তিস্বরূপ উনি স্কুলের মাঠের দশ-পাক দৌঁড়াতে বলতেন বা যে ভাল আবৃত্তি করতে পারে তাকে আগামী এক সপ্তাহ সকালে প্রার্থনা সংগীতের পর একটা করে কবিতা আবৃত্তি করতে হবে । উনি বেশ আমাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে যেতেন । আমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারতেন , ” কে গ্রিনিচের সময় ধরে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বের করতে খাপি খাচ্ছে বা কে তুন্দ্রা অঞ্চলের জলবায়ু মনে রাখতে পারছে না ? ” ক্রমশ নরেন নামটা চাপা পড়ে ‘ মোল্লা নাসিরুদ্দিন ‘ নামটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল । আমাদের দুজনের মধ্যে আমি ছিলাম বাবা-মায়ের বড্ড অদূরে । স্যারের বিচিত্র অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে একদিন কাওকে না বলে , এমনকি তোমাকেও না বলে চুপি চুপি বোর্ডিংয়ের প্রাচীর টপকে পালাতে গিয়ে ওপাশে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আমার পা -দুটো ছোঁড়ে গিয়েছিল । আমি যখন যন্ত্রণার মধ্যে কাতরাচ্ছি হঠাৎ দেখি উনি গেট খুলে বাইরে এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে গেলেন । উনি মনে হয় আমাকে দূর থেকে ফলো করছিলেন । পা দুটোর ফাস্ট-এড করে উনি রাতেই আমাকে নিয়ে ছুটলেন ডাক্তারের কাছে , ডাক্তার আমাকে ইনজেকশন দিলেন । আমি ঘরে ফিরে গেলাম । উনি ঘটনাটা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাননি পাছে জানাজানি হয়ে কর্তৃপক্ষ আমাকে বোর্ডিং থেকে না বের করে দেয় । তোমরা জানতে আমি নাকি বারান্দায় স্লিপ খেয়ে পড়েছি । সব থেকে তাজ্জব ব্যাপার ঘটালে তুমি । আমাদের দুজনের মধ্যে নতুন কোনো বদমাইসির চিন্তা-ভাবনা সব সময় আগে আমার মাথায় আসতো কিন্তু সেবার কি হল তুমিই আম চুরির পরিকল্পনা করলে । আমিও তোমার সাথে জুড়িদার হলাম । স্কুল কম্পাউন্ডের একমাত্র আম গাছটি ছিল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ভারতীদেবীর স্মৃতিবিজড়িত । ওই গাছের আম পাড়া বারণ ছিল । একদম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আগের রাতে অপকর্মে দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । প্রথমে মনে হয়েছিল কেমন করে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের হাত থেকে বাঁচবো । পরেরদিনের অনুষ্ঠানের জন্যে সেইদিন সন্ধে অব্দি খাটাখাটনি করে সবাই যখন পড়াশোনা বন্ধ করে রাতে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । আমরা প্রথমে স্যারের ঘরের দরজার হ্যাজবোল্ট বাইরের থেকে বন্ধ করে চুপি চুপি মধ্যরাতে চললাম আম পাড়তে । তারপর সারারাত দুজনে মিলে তিনঝুড়ি আম কুড়িয়ে ভোর ভোর বোর্ডিংয়ের ঘরে ঢুকতে যাব দেখি সামনে মোল্লা নাসিরুদ্দিন দাঁড়িয়ে । আমাদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আর শাস্তির বিধান হল যতক্ষন তিনঝুঁড়ি আম খেয়ে শেষ না করতে পারি , আমরা দুজনে ঘর থেকে বেরোতে পারবো না । বুঝতে পারিনি নিষিদ্ধ গাছের ফলের স্বাদ এতো অম্ল-মধুর । দুজনের ওই আম শেষ করতে সময় লাগল প্রায় তিনদিন । ঘর থেকে যেদিন দুজনে বেরোলাম , আমাদের সারা গায়ে ঘা বেরিয়েছে । মোল্লা নাসিরুদ্দিন আমাদের দুজনকে যা সেবা করলেন , তাতে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা সুস্থ হয়ে গেলাম । পরে জানতে পেরেছিলাম , ভারতী দেবী নরেনবাবুর মা ছিলেন । তবে এরপর আমাদের জীবনে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল । ঘটনাটা আমাদের দুজনের জীবনেই যেন একটা টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারো । আমি পুরোপুরি স্পোর্টসে ফোকাস করলাম আর একদিন তোমার ব্যাগ থেকে পাওয়া গেল ‘ রেড বুক ‘ । দুজনের মধ্যে যোগাযোগ কমে গেল । একটা ঘটনায় জোড় থেকে বিজোড় হয়ে গেলাম । হয়তো আমরা নিজেদের জীবনের লক্ষ বুঝতে না পেরে পরস্পর অনেকটা সময় একই স্টেশনে কাটিয়ে দিয়েছিলাম । একদিন খবর পেলাম তুমি নাকি বোর্ডিং ছেড়ে কোথায় চলে গেছো ? তারপর বহুবছর কেটে গেছে । তোমার সাথে যোগাযোগ নেই , হঠাৎ রাঁচি থেকে স্পোর্টস মিট থেকে ফিরতি পথে ট্রেনে এক মুখ চুল, দাঁড়ি মার্কা একটি ছেলেকে দেখে সন্দেহ হল । বিনয় বলে ডাকতেই তুমি এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দিলে যা শুধুমাত্র তুমিই বুঝতে পারো আর আমি । তুমি নিজের একটা অদ্ভুত ঠিকানা দিলে যেটা নিজেই একটা পোস্ট অফিস । যাই হোক গল্পে ফিরে আসি ,সেদিন সারগাছি বোর্ডিংয়ে গিয়ে মৃত্যুপথ যাত্রী স্যারকে মুখে বসন্তের দাগ ছাড়া কোনোভাবেই চিনতে পারতাম না । ঋষিমুনির মতো লম্বা চুল-দাঁড়ি , চোখদুটো বড্ড বৌদ্ধিক । স্যার আমাকে দেখে ভুল করে বললেন ,” বিনয় , এসেছো , I am always proud of you . ” এটাই স্যারের শেষ কথা । ভীষণ অভিমান হল , এতো বছর ধরে একমাত্র আমিই স্যারের খোঁজ নিয়েছি আর তুমি তো সবাইকে ভুলে জঙ্গলমহলে সমাজের কাজে লেগে পড়েছো । তাও স্যার মারা যাওয়ার আগে স্যারের শুধু তোমায় মনে পড়ল । সেদিন স্যার মারা যাওয়ার পর যখন তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে , তার পিঠে বহুদিন আগের ফোঁড়ার দাগগুলো দেখে চমকে গেলাম । তোমাকে বলা হয়নি ওই ভয়ঙ্কর আম-খাওয়া তিনদিন শুধু আমরাই আম খাইনি । মাঝরাতে আমরা যখন ঘুমাতাম , স্যার লুকিয়ে আমাদের দেখে যাওয়ার নাম করে ওই ঝুড়ি থেকে আম তুলে নিয়ে যেতেন । পরে সারা পিঠ ভর্তি ঘা হয়ে উনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন । সবাই ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিন’ এর গল্পের উপদেশ নিয়ে আলোচনা করে , খুব কম লোকই আছে যারা তা জীবনে পালন করতে পারেন । স্যারের মতো আমরা সবাই তোমার উপর গর্বিত । নিজের যত্ন নিও । ইতি তোমার সারথী পুনঃশ্চ : ছোটবেলায় গোয়েন্দা বই পড়ে পড়ে সন্দেহবাতিক মনটা রয়েই গেল । সেদিন স্যারকে যখন শ্মশানে জ্বালানো হচ্ছিল , অদূরে একটা গাছের তলায় দুটো চোখ দেখে সন্দেহ হয়েছিল । সেই চোখদুটি তোমারই ছিল । সামনে থেকেও শুধুমাত্র পুলিশের ভয়ে তুমি স্যারের সামনে আসোনি । স্যার মারা যাওয়ার পর বোর্ডিঙের পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটার সুযোগ হয়েছিল সেখানে তোমার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির সময়ে অভিভাবকের জায়গায় স্যারের নামটা দেখে চমকে গিয়েছিলাম । স্যারের ডাইরিতে যেদিন তুমি বোর্ডিং ছেড়ে চলে গেলে , শুধুমাত্র সেদিনের পেজটা ফাঁকা ছিল । বাকিটা আর নাই বা বললাম । চিঠিটা পড়ে পুড়িয়ে ফেলো । তোমার উপর অনেক দায়িত্ব । ওখানকার কাজ সেরে বোর্ডিঙের দায়িত্ব নিতে হবে যে । ” we all proud of you ” |