সুব্রত ভৌমিক

তালাশ

সুব্রত ভৌমিক

এক
দেখেছে, মানুষ তাকে তিনবারে চেনে। প্রথমবার খুব পাত্তা দেয়। দ্বিতীয়বারে চটে। তৃতীয়বারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তো এইরকমই একটা সাক্ষাতে লোকটা এবার পাল্টা যুক্তি দেখান, ‘বৃষ্টি তাতে কী। তোমার তো ছাতা আছে। তুমি তো আর ভিজবে না, তোমার রিকশা ভিজবে।‘সশব্দ উত্তর এল, ‘না না, ও বিষ্টি-ফিষ্টি হলিই দশ টাকা বেশি লাগবে।’
        ‘সেকি! বৃষ্টির দাম এত! একটু কম করো।’
‘না না, বললাম তো।’ রিকশাওয়ালাটি এবার খেপচুরিয়াস। কিছুতে রাজি হল না।
রাগটা গিয়ে পড়ল বৃষ্টির উপর। শালার বৃষ্টি! হয়েই চলেছে। ট্রেনটা ঠিক প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে ঝেঁপে এল। নাও, এখন নগদ দশ-দশটা টাকা গচ্চা দাও। নইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেডটার নীচে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিটবেচা লোকটার চাকরিসর্বস্ব থমথমে মুখটা সহ্য করো। বৃষ্টি নামার আর সময় পেল না। ঠিক বাড়ি ফেরার পথে।
অবশ্য পথে কত কী না ঘটে। ফোলানো ইন্ করা শার্ট উঠে গিয়ে সরু কোমর দেখা যায়, জামাকাপড়ে নানা বিচিত্র দাগ লাগে, চুলের সিতে ঘেঁটে যায়, বৃষ্টিও নেমে যেতে পারে কোনও একদিন। একই রকম রোজ ফেরা যায় না। লোকটা ভাবছিল। কিন্তু তার দাম এত! বাদে বাদে আকাশচেরা বিদ্যুৎঝলক, পিলে চমকানো একেকখানা মেঘনাদ, উথাল-পাথাল হাওয়া। বিকেল সাড়ে পাঁচটা কে বলবে। নিজের হাত-পা’গুলোকেই ভালো চেনা যাচ্ছে না। চারধারে যেন সব অন্য মানুষ—কেমন অচেনা, কবেকার!
নাহ্, সিদ্ধান্তটা ফাস্ট নিতে হবে। রিকশাগুলো পটাপট ভাড়া হয়ে যাচ্ছে। সত্যি, লোকের হাতে এত পয়সা থাকে কী করে কে জানে। মা-লক্ষ্মী কি অনেস্ট দেখলেই খেপে যান? অবশ্য আভিজাত্যও হতে পারে। ভাড়া-টাড়া কিছুতে জিগ্যেস করতে নেই। দরদাম তো নয়ই। আসছে, ফটাফট উঠে পড়ছে।
কিন্তু এ কী! আচমকা ফের এক বিদ্যুৎফালি! তবে আকাশে না, মাটিতে। ফেটে পড়া ব্লাউজ, ধনুক শিরদাঁড়া, তুমুল ঢেউ, ভেজা পিচরাস্তাটায় লেডিজ ছাতা মাথায় খানিক ওঠানো কাপড় থেকে বেরনো দুটি ধবধবে পা আর পিছনে স্লেটরঙা আকাশ! নাঃ, বৃষ্টি আজ পাগল করে দেবে তাকে, লোকটা ভাবল। তো পাত্তাই দিল না। সটান রিকশাওয়ালাটার কাছে এসে সপাটে প্রশ্ন, ‘যাবেন তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চলেন।‘ রিকশাওয়ালাটি অমনি বত্রিশপাটি।
        লোকটা খেপে গেল, ‘সেকি! আর আমি? আমার সঙ্গে যে আগে কথা হল!’
চোখের কোণে মণি। তাচ্ছিল্যে দেখল বিদ্যুৎ, ‘কোথায় যাবেন আপনি?’
বলতে হল।
‘ঠিক আছে, উঠুন। আমি তার আগে নেমে যাব।‘
        দিনটায় কিছু আছে? কোনও হাওয়া? তো চলল। একই রিকশায়, গায়ে বিদ্যুৎ। নাম আছে নিশ্চয়ই। ভাড়ার ব্যাপারটা কিন্তু পরিষ্কার হল না। আধাআধি হবে কি? সে দু-এক টাকা কম-বেশি হল, হতেই পারে। অত ধরলে চলে না। কিন্তু জিগ্যেস করাটা ঠিক হবে? দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে, ধনী কা দুলালী। দিল কা পিকচার। ভাসবে কিন্তু আসবে না। আর সে?
সে অথৈ, অথৈ তরফদার। বাবা নেই। তবে বাবার দেওয়া চাকরি আছে। কলকাতার দিকে একটা সস্তা মেস ভাড়া করে থাকে। দিন পনেরো অন্তর বাড়ি ফেরে। আজ যেমন ফিরছে। স্টেশন থেকে নেমে রিকশ, তাতে চেপে একটা নদী পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে বাড়ি। তাদের গ্রামের বাড়ি, মুড়িঘাটা। বাড়িতে মা, দিদা আর ছোটো এক বোন থাকে। আসবার সময় বোনটা পইপই করে একটা নতুনওঠা শাড়ি কিনে আনতে বলে দিয়েছে, মায়ের জন্য একটা জোয়ানের কৌটো, আর দিদার পঞ্জিকা। বিদ্যুৎ হঠাৎই মুখ খুলল, ‘আপনি ভিজে যাচ্ছেন তো।’
অথৈ সচকিত পায়ের দিকে তাকাল। বলল, ‘হ্যাঁ, পর্দাটা একটু ছোটো।’
‘আপনার দিকে একটু টেনে নিন।’
‘না, থাক। বৃষ্টি হলেই আমি ভিজে যাই।’
‘তার মানে!’ বিদ্যুৎ ঝলকাল। চোখে লাগল।
বিস্ময়টা সঙ্গত। মানুষ এখন টেকে তবে বাঁচে না। অর্থাৎ গায়ে যেন একফোঁটা ছাঁট না লাগে, জ্বর হবে। সামান্য শীতেই অনেক অফিসযাত্রীর মতো কান-মাথা আচ্ছা করে মাফলার দিয়ে বেঁধে ফেলো। সবাই খুব সমীহ করবে। পাশে বসা সহযাত্রীটির সঙ্গে কিছুতে কথা বলতে নেই।
তো এইরকমই পাশ কাটা দুটো মানুষ। ঘটনাচক্রে হঠাৎ কাছাকাছি। এক রিকশায়। কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। মনে নেয় না। হবে, সে কথা ঢাকতেই যেন মেয়েটি ফের প্রসঙ্গ টানল, ‘বৃষ্টি হলেই ভিজে যেতে হয় কেন?’
‘সঙ্গে ছাতা থাকে না বলে হয়তো।’
        ‘কেন, ছাতা নেই?’
‘দুটো হারাবার পর বাড়ি থেকে আর দেয় না।’
        ‘সেকি! কে দেয় না!’
        ‘মা আর ছোটো বোন।’
‍        মেয়েটি তাকিয়ে। নীচের ঠোঁটটায় হালকা দাঁত বসানো। হঠাৎই খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসতে গিয়ে দারুণ একটা শব্দ হল। যেন গলার মধ্যে আর কেউ বসে আসে। কে সে! কিন্তু পরক্ষণে চেঞ্জড, গম্ভীর। বাইরের দিকে মুখ ঘুরানো। অথৈ আড়চোখে একটু দেখল, বাহ্! আদলটি তো বেশ। একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। গালে একটাও দাগ নেই। ঠোঁটদুটোয় কি একটু অহংকার লেগে আছে? দারুণ কিন্তু। কিন্তু এভাবে লুকিয়ে দেখা কি ঠিক? মেয়েরা টের পায়? মনে হতেই যেই চোখ সরাতে যাবে, কানে এল, ‘কিন্তু ভিজলে তো জ্বর হয়।‘
উত্তর করল, ‘কে জানে, আমার কেন হয় না।’
মেয়েটি ঘাড় ফেরাল।
যেন ঠিক দেখছে না, বুঝছে। খেপে গেল কি? ধরা গেল না। ভারিক্কি গলায় শুধু বলে উঠল, ‌‘ঠিক আছে, পর্দাটা টেনে নিন। আমার কোনও অসুবিধা হবে না।‘
এর নাম হুকুম। অতএব টানতে হল। পায়ের নীচে পর্দাটা চেপে রাখলে খানিক কাজ হয় বটে। কিন্তু না, বৃষ্টিটা এখনও যায়নি। কমছে, বাড়ছে। পুরোপুরি যেন থামতে পারছে না। কাছের এক বাড়িতে একটা বিকেলহীন শিশু ঘুমিয়ে উঠল। এবার কিছু খাবে, বসবে। তারপর ধরে-বেঁধে পড়া মুখস্থ। না পারলেই ভায়োলেন্স, প্রেসার। এভাবে জীবন থেকে ছেঁটে যাওয়া চৌত্রিশটা বছর। কারও বা আরও বেশি। শেষমেশ একটাই টার্গেট, চাকরি। তবে বাঁচবে, হাসবে। বেঁচে থাকার এই একমাত্র পথ।
অথৈ এপথ হারিয়ে ফেলত। অন্য পথে চলে যেত। বাবা প্রাণপণ তাই ভয় দেখাত, ‘দিনকাল তো চেনো না। মরবি…মরবি। শেষমেশ কী করবি, ভ্যান চালাবি?’ অর্থাৎ ভ্যান চালানোটা খুব খারাপ। ভালো বউ জোটে না। তো সত্যি সত্যিই সে ভ্যান চালাত কিনা জানে না, তবে সেই চিন্তায় চিন্তায় শেষে বাবাই যেন বুদ্ধি করে একটা সুরাহা করে দিল। মানে হঠাৎ করে একদিন বাড়ি ফেরার পথে একটা চলন্ত বাসের নীচে চোখ দুটো ঠিকরে মাথাটা থেঁতলে গিয়ে বাবা আর না আসুক, তার চাকরিটা এসেছে। লোকে খুব খুশি হয়েছে। বলেছে, ‘যাক, ছেলেটা বেঁচে গেল।‘
তো এইরকম বাঁচতে গিয়ে লোকটা মরে যায়। বারবার মনটা বেড়া ভাঙে, হারায়। হতে পারে, আজও তাই থেকে থেকে সে এইরকমই হারিয়ে যাচ্ছে। একটু বেশিই কথা বলছে। অন্য কথা বলছে। আসলে প্রতিদিন সে এইরকম নয়। হতে পারে না। এক-একটা দিন শুধু এইরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। নিজেকে ঠেকাতে পারে না। কেন, তা সে জানে না। তাই এমন একটা দিনে ফের সে কথা ধরল, ‘আপনার কি এখানেই বাড়ি?’
মেয়েটি রেসপন্ড করল, ‘হ্যাঁ।’
‘আগে দেখিনি কেন কে জানে।‘
‘তার মানে! দেখলে কী হতো!’
‌‘কী জানি।’
মেয়েটি চটে গেল। কিছু বলার জন্য তেড়ে উঠল। সামলে বলল, ‘কেন, আমি তো প্রায়দিনই পড়তে বের হই। এখানাকার কলেজেই অনার্স করা। এছাড়া এ-টি-এম, মল, নানা পারপাসেও বের হতে হয়।’
উত্তর এল, ‘পথটা আলাদা ছিল হয়তো।’
মেয়েটির চোখ জ্বলে উঠল। খানিক ফেলে রেখে ঝোড়ো দিনটার দিকে মুখ। চুপ থেকে বলল, ‘কেন, আপনার পথটা কোন দিকে ছিল?’
‘যে পথে রোজ ছুটি, হাঁপাই, এ টি এম পড়ে, সেদিকে নয় বোধহয়।’
‘মানে!’
‘প্রায়ই মনে হয়, কোথায় যেন যাওয়ার ছিল। কে জানে সেইদিকে ছিল কিনা।’
না, রিকশওয়ালাটা ভিজছে না। বিশ্বকর্মার কোনও বংশধর-টংশধর হবে। মাথার উপর চটা আর পলিথিন বেঁধে একেবারে বিন্দাস। ক-টা বাজে? চারধারটা ক্রমশ সন্ধ্যাগ্রস্ত। ইদানীং বিকেলটা দ্রুত মরে যায়। মাঠগুলোয় তেমন খেলতে দেখা যায় না। চোখে পড়ে না, কেউ বিছানা ছেড়ে উঠে বিকেলের আকাশটার দিকে একটু তাকাল।
এভাবে বেলা না যেতেই সন্ধে। দোকানের আলোগুলো আগেভাগে জ্বলে ওঠে। বিকেলটা গিলে খায়। আজও তাই। রাস্তা বরাবর লাইন দেওয়া সব স্টেশন-রিকশ, লরি, অটো। বাদে বাদে জ্যাম। জট খুলতে সময় নিচ্ছে। ভালো এগোনো যাচ্ছে না। সামনেই একটা টুরিস্ট বাস। ফিরছে। বাড়ির সামনে রোজকার যে পথ, তার সঙ্গে কত দূর চলে গিয়েছিল কে জানে। কিন্তু এভাবে পাশাপাশি পর্দার ভিতর মুখ বুজে কতক্ষণ কাটানো যায়, ভিতরটা যেখানে এক বৈশাখী সন্ধ্যায় বারবার হারাচ্ছে। সুতরাং অথৈ ফের মুখ খুলল, ‘চাকরি?’
‘না, মাস্টার্স করছি। ইংরাজি।‘ থেমে বলল, ‘আপনি?’
‘আমি করিনি। পারতাম না।‘
মেয়েটি বাইরে তাকিয়ে। কোনও রিঅ্যাকশন হল কি? বোঝার উপায় নেই। সংযত গলায় জানতে চাইল, ‘এমনি কী করেন?’
উত্তর মিলল, ‘কিছু না। এমনি এমনি ঘুরে বেড়াই। কাজ ধরলে বাবা সার্ভিস পিরিয়ডে মারা যাওয়ায়একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি জুটেছে।‘
‘প্রাইমারি স্কুল? বাঃ, ভালো তো।‘
‘তা ঠিক। তবে আপনিই কেমন যেন একটু নাক কুঁচকালেন।‘
‘আমি? হট্! মোটেই না। অ্যাই, এবার কিন্তু—!’ মেয়েটি হঠাৎ সপাটে ঘুরল। প্রচণ্ড খেপে গেল। তারপর নিজেকে সামলে বলল, ‘খুব না? শুধু ইয়ার্কি।’ বলেই চোখমুখ সিরিয়াস করে ফেলে থামা কথাটার ফের খেই ধরল, ‘প্রাইমারি স্কুল তো ভালো। ছোটোদের নিয়ে থাকা, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা, সারা সন্ধ্যা ফ্রি। তা কীকরেন সারা সন্ধে?’
‘কাকে যেন খুঁজি।’
‘মানে!’
‘না, মাঝে মাঝে মনে হয়, কার সঙ্গে যেন দেখা হওয়ার কথা।‘
‘কার সঙ্গে!’
‘কে জানে।’
মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কে জানে কী দেখল। আর কিছু বলল না। ফের রাস্তাটার দিকে মুখ। খানিকচুপ থেকে কথা পাল্টাল, ‘আপনি কি ডেইলি প্যাসেঞ্জার?’
‘না। মাসে এক-দুবার বাড়ি ফিরি। বেশ আনন্দ হয়। তবে মুশকিলও আছে।’
‘মুশকিল কেন!’
‘বোনটা প্রতিবার কাঁদে। মা-দিদা আরও দুটো দিন থেকে যেতে বলে। ফেরার দিন মা হাঁটতে হাঁটতে বোনকে নিয়ে অনেক দূর অব্দি চলে আসে। যতক্ষণ দেখা যায় দুজনে দাঁড়িয়ে থাকে।‘
কথাগুলো বৃষ্টির ফলার মতো। ফোটে, ভেজায়। চোখের সামনে ভেসে উঠল,শহরগামী এক মানুষের পায়ে পায়ে লতার মতো জড়িয়ে ধরা একটা মাঠ, ঘাট, নদী। ক্রমশ এক শহরের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। মেয়েটি পাল্টা প্রশ্ন তুলল, ‘খারাপ লাগে না?’
‘লাগলেই বা।‘
‘ছেড়ে আসেন কী করে?’
‘না ছাড়ালে যাওয়া যায়।’
হয়তো ঠিক। মেয়েটি নিজের সঙ্গে কথা বলল। যাকে প্রিয়জন ছেড়ে যেতে হবে, ভালোবাসা লুকিয়ে ফেলে সে। সযত্নে প্রিয়ার বাহুপাশ ছাড়িয়ে উঠে পড়ে, চলে যায়। পিছনে পড়ে থাকে মায়ের কান্না, বোনের কান্না, হাট-মাঠ-ঘাটের চোখের জল। এইভাবেই কি প্রতিবার ভিজে যায় লোকটা? প্রসঙ্গটা হঠাৎ একটু ভারি ও উদাসী হয়ে যেতে দু-মুহূর্ত একটা স্তব্ধতা নেমে এল। আর সেই অস্বস্তিটা কাটাতেই যেন মেয়েটি ফের স্বর কাটল, ‘আপনি বোধহয় একটু অন্যরকম। ছেলেরা এইরকম হয় জানতাম না। আর কিছু করেন?’
‘একটু লিখি-টিখি।’
‘লেখেন! ও তাই বলুন—।‘ এতক্ষণে যেন চোর ধরা পড়েছে। হাসিটা এইরকম। অথৈ এবার চুপ। খানিক ইতস্তত করে শেষমেশ ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বার করল। তারপর বলল, ‘এতে দু-একটা আছে। পড়েন কি?’ বলে সলজ্জ একটু এগিয়ে ধরতে মেয়েটি খানিক থমকে হাতে নিল। কিন্তু ডায়েরিটার যেই পাতা উল্টাতে যাবে, রিকশটা হঠাৎ ব্রেক করে একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। মানে এসে গেছে। এতক্ষণের এক অচেনা ঘ্রাণ, চোরা স্পর্শ, গায়ে বসা ব্লাউজ সরে যাবে। নেমে যাবে। নামতে গিয়ে হঠাৎই অথৈ-এর জামার হাতাটায় একটু হাত ঠেকাতেই বলে উঠল, ‘এমা, আপনার জামাটা তো—’
উত্তর এল, ‘বললাম না, ভিজে যাই।’
মেয়েটি ঝট্ করে তাকাল। চোখে বিদ্যুৎ। কিন্তু না, কোনও উত্তর করল না। ভাড়া নিয়ে একটা গোল বাধল। মেয়েটির কাছে দু-হাজার টাকার নোট। কিন্তু রিকশাওয়ালা বা আর কারও কাছে তার ভাঙতি নেই। তাহলে? লোকটা প্রমাদ গুনল। একে বৃষ্টির কল্যাণে এ বাজারে তার দশ-দশটা টাকা গচ্চা গেছে, তার উপর এখন যদি—। না, নোটটা ভাঙছে না। জাল-টাল নয় তো? অবশ্য অনেকেই জাল নোট চিনতে পারে না বলে গম্ভীরমুখে ভাঙানি নেই বলে পাশ কাটে। অগত্যা তাকেই গলা বাড়াতে হল, ‘থাক না হলে, আমিই দিয়ে দেব’খন, পরে দেখা হলে না হয়—’
কথা শেষ হল না। অমনি ফণা, ‘আপনি নিয়ে দেবেন মানে! কেন!’
নাও, উপকার করো। অথৈ থতমত খেল। মেয়েরা কি দুর্দান্ত ডিগবাজি দিতে পারে? কোনওক্রমে তুতলে বলল, ‘না মানে, দু-হাজার টাকার নোট তো, এই ঝড়জলে ভাঙানো যাচ্ছে না, তাই—’
মেয়েটি ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। ডায়েরিটাও থাক তাহলে। একসঙ্গে দিয়ে দেব। নাম্বারটা দেখি।’
‘আমার?’ লোকটা তাড়াতাড়ি মোবাইল নম্বর দিল ।
সেভ করে নিল সে। তারপর আর তাকাল না। ফের রোজকার ভিড়টার মধ্যে হারিয়ে গেল। সঙ্গে নম্বর।

দুই
নম্বরটা ‘বৃষ্টি’ নামে সেভ করা।
না, এখনও সেই নম্বরে মেয়েটি ফোন করেনি। নাম অঙ্কিতা, অঙ্কিতা ব্যানার্জী। তা থেকে অ্যানি। বাবা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ড। মা হায়ার সেকেন্ডারি একটা স্কুলে। বাড়ি ফিরে ঘটনাটা জানাতেই দুজনে একমত, ‘ও শিশুর, ইউ হ্যাভ টু পে ইওর ডিউজ।’ অঙ্কিতা দেওয়ারই মেয়ে। দেওয়ার জন্যেই নম্বরটা নিয়েছে। কিন্তু একাজে-ওকাজে প্রতিদিন কথাটা ভুলে যাচ্ছে সে। রাতে শোওয়ার সময় শুধু খামোখা কথাটা মনে পড়তে লোকটা ভেসে ওঠে। টাকার কথাটা খেয়াল হয়। লোকটার অদ্ভুত কথাগুলো কানে বাজে। অমনি একা ঘরে ঠোঁট চিপে হেসে ফেলে। দু-হাত মাথার নীচে। চুপ করে সিলিংটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
        কিন্তু অত রাতে তো আর ফোন করা যায় না। ভাবে, পরদিন অবশ্যই করবে। টাকাটা দেওয়া দরকার। ডায়েরিটাও। কিন্তু সকালে উঠে সারাদিনের ব্যস্ততা-পড়াশোনা-ফ্রেন্ডসার্কেলের ভিড়ে লোকটা কোথায় তলিয়ে যায়। কিছুতে মনে পড়ে না। ব্যস্ততার মধ্যে শুধু টের পায়, কাকে যেন খোঁজা হয় না। তো আজ সে কিছুতে ভুলল না। ‘বৃষ্টি’ নামে সেভ করা লোকটার ফোন নম্বরটা বার করল। তারপর কল্ করল। উল্টো দিক থেকে হঠাৎই একটা লোকের বিশ্রী গলা ঝেঁজে উঠল, ‘কৌন? কে বইলছেন?’
‘হ্যালো, আপনি?”
‘আরে, এ আপনি কৌন হ্যায়? কাকে খুঁজছেন বলবেন তো?’
        ‘ইয়ে, এটা কোন জায়গা? আমি মানে সেদিন স্টেশনে—’
‘ও, ডার্লিং? হাঁ হাঁ, বহুত মনে পড়েছে, উদিন তো—’
        ‘কী যা-তা বলছেন!’
‘আরে, এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? হ্যালো শুনিয়ে, হ্যালো—’
‘সরি, রং নাম্বার।’
অ্যানি একঝটকায় কান থেকে মোবাইল নামাল। লাইনটা কেটে দিল। চোখদুটো জ্বলছে, পুড়ছে। কানদুটো জ্বালা জ্বালা করছে। মনে মনে বলে উঠল—অসভ্য, চিটার, মিথ্যেবাদী। একটা ফলস্ নম্বর দিয়েছে তাকে। বলেই মোবাইলটা টান মেরে বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল। ফুঁসতে লাগল। তারপর শান্ত হলে ভাবল, কিন্তু টাকাটা? কী করে ফেরত দেবে তাহলে! লোকটা কি সত্যিই ইচ্ছে করে ভুল নম্বর দিয়েছে। কিন্তু কী করে তা সম্ভব? আচ্ছা এমন নয় তো, কলটা ভুল করে অন্য জায়গায় চলে গেছে। হতেও তো পারে। মনে হতেই আবার মোবাইলটা টেনে নিল সে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুল। অমনি কালো মিনি স্কার্টটা উল্টে মোমের মতো ধবধবে ভারী পা’দুটো দুলতে থাকে। টার্গেট নম্বরটায় ফের কল-বাটনটা প্রেস করে মোবাইলটা কানে ঠেকাল। রিং হচ্ছে, ‘চোলি কা পিচে কিয়া হ্যায়, চোলি কা নীচে…।’ হঠাৎই একটা শান্ত পুরুষস্বর এল, ‘হ্যাঁ বলছি।’
‘আচ্ছা, এটা কি 9760223872?’
‘হ্যাঁ, তা-ই।’
যাক, লোকটা তাহলে মিথ্যে না। সত্যি নম্বর দিয়েছে। শুধু শুধু এতক্ষণ তাকে খারাপ ভাবছিল। মনে মনে কত বাজে কথাই না বলেছে। ছি ছি। তবে একটা কাজ হল। একটা বিশ্বাস জন্মাল। বিশ্বাস করার চেয়ে বিশ্বাসের জন্ম ভালো। টেকে। কিন্তু অ্যানি এবার আরও নিশ্চিত হতে চাইল। প্রফেশনের কথা জিগেস করল। মিলে গেল। বাব্বা, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। বলে উঠল, ‘ওফফ্, যাক। এমন একটা নাম্বার দিয়েছেন যে—’
‘কে বলছেন আপনি?’
‘আমি? আমি অ্যানি। আমার কাছে আপনি ভাড়ার টাকা পান—চিনতে পারছেন?’
‘অ্যানি? কই না, এ নামে তো কাউকে চিনি না।‘
‘স্বাভাবিক। আপনি তো আমার নামটা শোনেননি। সেই যে স্টেশনে—বৃষ্টির দিন, রিকশোয়—’
‘দেখুন, আপনি বোধহয় ভুল করছেন।‘
‘না না, শুনুন, আমি তো আপনার নাম্বারেই—’
লোকটা হঠাৎ বিশ্রী খিঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ধুর, আপনি কাকে চাচ্ছেন বলবেন তো?’
অ্যানি এবার থমকাল। ভ্রূকুঁচকাল। আস্তে বলল, ‘আপনি কে বলছেন!’
‘বাঃ! বা, বা। আপনি ফোন করছেন আর কাকে করছেন আমি বলে দোব?’
‘ও হ্যাঁ, তাই তো। ধাত্।‘ অ্যানি নিজেকেই যেন উত্তেজনায় ভীষণ ধমকাল। তারপর ঘাবড়ে গেল। ঘামতে লাগল। চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। এসবের মানে কী! লোকটা কি সত্যি সত্যিই তাকে ধোঁকা দিয়েছে? কিন্তু কেন! কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। নাকি নামটা জানে না বলে কনফার্মড হচ্ছে না। সংশয়টা উকি দিতেই লাস্টটাইম একটা ট্রাই করল সে, ‘আচ্ছা, আপনি কি লেখেন?’
‘কী লিখব!’
‘ওই কবিতা-টবিতা?’
‘না, না।’
‘ও। তা সন্ধেবেলায় কাউকে খোঁজেন না?’
‘মানে!’
‘না মানে, বৃষ্টি হলে ভিজে যান?’
‘হট্ রাবিশ। ছাড়ুন। রং নাম্বার।‘ ফোনটা কেটে দিল।
অ্যানি কাঁপছে। অপমানে থরথরিয়ে উঠল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সারা শরীর টলছে। দু-চোখ কেটে জল আসতে চাইছে। গা দিয়ে আগুন ঠিকরাচ্ছে। ঘামছে। এত বড়ো লম্পট, ধোঁকাবাজ—। আজ হলিডে, মা-বাবা বাড়িতে। টলতে টলতে দরজা ঠেলে কোনওক্রমে ডাইনিং স্পেসটায় এসে দাঁড়াল সে। সোফায় বাবা। একটা ইংলিশ নিউজে চোখ। মুখ তুলেই চমকে উঠল, ‘কী হয়েছে অ্যানি! এনি থিংক রং? আর ইউ ওকে?’ স্বর শুনে মা ছুটে এল।
অ্যানি সব বলল।
শুনে মা খেপে গেল। ছিটকাল। প্রবল উত্তেজনায় ফেটে পড়ল, ‘হোয়াট আ বীচ্! পাকা শয়তান। ইনটেনশানালি রং নাম্বার দিয়েছে। দেয়ার ইজ জাস্ট আ মোটো ফর সামথিং ইন মেকিং অ্যান ইনসিডেন্ট। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। হি মাস্ট বি পানিশড্। এক্ষুণি থানায় ফোন করো।‘ বাবা বিচক্ষণ মানুষ। রাশ ধরলেন, ‘ওয়েট ওয়েট, ডোন্ট ডু সো মাম। অনেক সময় ক্রস রুট হয়। অ্যানি, কাম অন। ট্রাই এগেন।‘
‘না। দু-বার মিস্ রুট হয়েছে। দ্যাটস্ মোর দ্যান রাস্টিক।’ অ্যানির মাড়ি শক্ত। বেঁকে বসল। ‘প্লিজ, ট্রাই এগেন ডিয়ার। লুক, হিয়ার য়ু উইথ আস্।’
সুতরাং অ্যানি ফের বিশ্বাসী। মোবাইলটা হাতে নিল। নম্বরটায় কল্ করল। রিং হচ্ছে। ধরছে
না—ধরছে না। আচমকা একটা সশব্দ বিস্ফোরণ! কুৎসিত একটা হুমকি ঝাঁপটাল—’অ্যাই শালি, কী ভেবেছিস তুই? একেবারে চিরে ফেলে দোব। চিনিস আমায়? শালা, এটা ভদ্দরলোকের বাড়ি। এক্ষুণি থানায় ফোন লাগাব দেখবি, অ্যাঁ?’ পাশ থেকে এক মহিলাকণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে গো! কী হয়েছে গো!’
‘আরে, একটা প্রস্টিটিউট।‘
অ্যানি একটা বিকট শব্দে জ্ঞান হারাল। চেয়ার-টেবিল সমেত উল্টে পড়ল। গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। ঝনঝন আওয়াজে দামি টিভি-সেটটা চৌচির হয়ে গেল। সেই অ্যানি! অঙ্কিতা ব্যানার্জী। হায়ার-সেকেন্ডারিতে নাইনটি থ্রি পার্সেন্ট, অনার্স ইংলিশ, এম-এ পাঠরতা, চোখের পক্ষে দারুণ। মাঝে মাঝে অকেশনালি ড্রিঙ্ক করে। ঋক, অঙ্কুর, বর্ষণ নানা ছেলেবন্ধু। রনি নামে একটা অগভীর ধনী ছেলের সঙ্গে প্রায় দিন কফিহাউসে মিট্ করে। একটু বেশিই ইন্টিমেট, লোকে দেখে। অবশ্য লোকে কত কী-ই না দেখে। যার যেমন চোখ।
       
জ্ঞান ফিরল অ্যানির।
তা থেকে যেন এক ভিন্-মানুষ। কেমন আমূল পাল্টে যেতে লাগল সে। আগের মতো আর উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। নেট খুলে যার-তার সঙ্গে ফাউ চ্যাটিং করে না। ফেসবুকে খোলামেলা ফোটোগ্রাফটা পাল্টে গেছে। স্লাং এস-এম-এস’গুলোর কোনও রেসপন্স নেই। কম কথা বলছে। ভালো করে খাচ্ছে না। কিন্তু কেন? ডাক্তারএল। জানাল, ‘রিস্‌ক নেই। তবে শকটা জটিল। কিছু দিন যা চায়, করতে দিন।‘ শুনে মা কেঁদে ফেলল, ‘কী হয়েছে ওর? আপনি কি কিছু লুকোচ্ছেন?’ বাবা বলল, ‘আমাদের কোনও অভাব নেই। অনেক টাকা। সব ওর। ও কী চায় বলুন।’
ডাক্তার মুখটা নামিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে একবার তাকাল। তারপর বলল, ‘কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে, টাকায় ভরে না। জায়গাটা বরং এনালিসিস করুন।’ বলে চলে গেল।
বিকেলে জুন এল। বান্ধবী। ফ্রেন্ডসার্কেলে সব চেয়ে ক্লোজ। চোখে গ্লাস, শর্ট টপ, আঁটো জিন্‌স। অ্যানির ঘরে এসেই দোর এঁটে সটান আলোচ্য বিষয়ে ঢুকে গেল, ‘গেট আপ অ্যানি। একটা জাস্ট কো-ইন্সিডেন্ট নিয়ে কেন এত রিঅ্যাকট্ করছিস? নেটে থাকিস না, কাউকে মিট্ করছিস না, রনি রেগুলারলি মিস্ করছে তোকে। হাউ ফানি! ফোনে, নেটে, ক্যান্টিনে—কোত্থাও অ্যানি ব্যানার্জী নেই। আউট অব্ সীন। বাট হোয়াই! আর য়ু ক্রেজি? সব ছেড়ে কী খুঁজছিস? কাম অন্ অ্যানি, আনসার মি। ফেস্ দ্য রিয়ালিটি।‘ অ্যানি যেন ঘোরে। নির্বিকার। ধীরে উত্তর করল, ‘কিছু সত্যি আছে, ঘটে না। চোখ বুজলে ফুটে ওঠে। তোর যদি কখনও এরকম চোখ ফোটে, দেখতে পাবি। যা ঘটে তা বেশির ভাগ মিথ্যে।’
‘মানে! কী ঘটে!’
‘এই রোজকার রনি, চ্যাটিং, কেরিয়ার, ডেইলি সারকেল।’
‘সো ওয়াট!’
‘সারাটা দিন পাক খাই মাত্র। আসলে কোত্থাও যাই না। পাই না।’
        ‘ওয়াট আ ফিলোসফি! কিন্তু যাকে খুঁজছিস তাকে পাওয়া যাবে?’
‘কেন নয়? সে তো মোবাইল নম্বর দিয়েছে।’
‘ওফ্, ডোন্ট ক্রস্ ইয়োরসেলফ, ভুল নাম্বার দিয়েছে।’
‘কেন দিয়েছে? ইজ ইট নর্ম্যাল? তার টাকা, ডায়েরি—’
‘ডায়েরি!’
অ্যানি বালিশের তলা থেকে এবার একটা ডায়েরি টেনে আনল। হাতে দিল। যার প্রথম পাতাতেই লেখা, ‘পালক ঝরে গেলে তুমি আর পাখি নও/ মনে পড়া গল্প।’ আরেক পাতায় লেখা, ‘আমার মধ্যে যাকে খুঁজছ/ তাকে আমি ফেলে এসেছি সেইসময়/ যে সময় তুমি ছিলে না।’ জুন এইরকম দু-চার পাতা পড়ে মুখ তুলল। বলল, ‘এই মানুষটাকে তুই খুঁজছিস? পাবি?’
‘না পেলে তার ডিউজ? ডায়েরি?’
জুন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়াল, ‘ওয়েল। আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। নেভার টেক মি রং। আমি বোধহয় তোকে ফিল্ করছি। টিপিক্যাল কমপ্লেক্সিটি। দেন বেটার, পেপারে অ্যাড্ দে না।’
প্রস্তাবটা পাশ হল। বাবা-মা রাজি। এছাড়া আর উপায়ই বা কী। ডাক্তারও বলে গেছে, কিছু দিন সহ্য করুন, যা বলে মেনে নিন। তাছাড়া একটা চান্সও নেওয়া হবে। তো শেষমেশ একটা স্থানীয় দৈনিকপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, ‘লেখে। বৃষ্টি হলেই ভিজে যায়। কিছু টাকা এবং একটা ডায়েরি ফেরত পাবে। ফোন করুন, 9832552703 এই নম্বরে।’ কিন্তু লোকটার কি আদৌ চোখে পড়বে এই পেপারটা? এই দিনের পেপারটা? যেটা দাঁড়াল, প্রচুর ফোন আসতে লাগল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে স্বর শুনেই ফোনে চেনা শক্ত, যার সঙ্গে কিনা একবার মাত্র দেখাশোনা, তাও অনেক দিন হয়ে গেছে। সুতরাং প্রথম দিকে অ্যানি দু-একটা কল্ রিসিভ করল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আজ্ঞে আমি। ওই কাগজের বিজ্ঞাপনে—’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘ইয়ে, আমি মানে একজনের কাছে কিছু মালকড়ি পেতাম।’
‘মালকড়ি! মানে টাকা? কত?’
‘তা ধরেন গিয়ে—’
‘বৃষ্টি হলে ভিজে যান?’
‘বৃষ্টি? না না, মাথা খারাপ! ভিজলে আমার জ্বর।’
লোকটার হয় না। কেন যে হয় না, জানে না। কথাটা মনে হতেই অ্যানি মুখ নীচু করে একটু হেসে ফেলল। চোখে জল। এই মানুষ এমন হয়ে গেল! বিশ্বাস কি কাউকেই করা যাবে না? বিশ্বাসহীন বাঁচা যায়? ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগল সে। শান্ত হয়ে এল। কেমন ক্লান্ত, চুপচাপ। বাবা-মা সমস্যাটা ধরতে পারছে না। অথচ কষ্টটা দেখতে পাচ্ছে। তাদের একমাত্র মেয়ে, মিষ্টি মেয়ে, প্রতিদিন কষ্ট পায়। রাতে চোখের জল মোছা মা সাবধানে একদিন মন খুলল, ‘আচ্ছা, প্রবলেমটা কী বলো তো? কেন এমন করছে ও।’ বাবাও অনিশ্চিত। বলল, ‘মানুষটা খারাপ, এটা বোধহয় মেনে নিতে পারছে না।’
‘কিন্তু সে তো তা-ই। তাহলে?’
‘জানি না।’ বাবা ফের চুপ করে গেল।
কিন্তু এভাবে কত দিন? অতএব সকালে উঠে দুজনেই একদিন মেয়েকে অনুরোধ করল, ‘ফোন নম্বরটা এবার মুছে ফ্যাল। আগুনের শেষ রাখতে নেই।’ মেয়ে সম্মত হল। আড়ালে নম্বরটা ডিলিট করতে গেল। কিন্তু এটাই একমাত্র যোগসূত্র। মুছে ফেলবে? সত্যিই কি লোকটা আসলে চিটার। তাহলে যাকে দেখেছিল সে কে!
না, এসব কথা আর ওঠে না। অ্যানি ফের স্বাভাবিক। দেখলে ঠিকঠাক। কোনও ইচ্ছে নেই। ইমোশান নেই। বাবা-মা খুশি। মেয়ে ফের কলেজে যায়। পড়ায় মন দিয়েছে। শুধু মাঝেমধ্যে কোনও পাবলিক বুথ থেকে হঠাৎই নম্বরটায় ফোন করে। ওপ্রান্তের গলাটা ভালো করে শুনেই লাইনটা কেটে দেয়। আবার কখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। দুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। কেন, কেউ জানে না।
 
তিন
সেদিনও এমন বৃষ্টি। ওলট-পালট আকাশ। অ্যানি লেডিস কমপার্টমেন্ট থেকে নামছিল।
হঠাৎই দেখল, লোকটা! এই ট্রেনটাতেই উঠছে। সেই মুখ! সেই চেহারা। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চিনতে পেরে হাসল।
অ্যানি ঘামছে। ফুঁসছে। চোখদুটো ধক্ করে উঠল। মাড়ির কাছটা শক্ত। লোকটা হাসিমুখে কাছে এসে দাঁড়াতেই ঠাস্ ঠাস্ করে দু-গালে দুটো চড় কষিয়ে দিল সে। তারপর জামার কলার’দুটো চেপে ধরে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
লোকটা হতচকিত, অপ্রস্তুত। তবে কিচ্ছু বলল না।
কান্না থামলে শুধু জানাল, আসলে তার ডাবল সিম। একটা ফিক্সড। অন্যটায় অফারের সিম ঢোকায়। এভাবেই সেদিন সে তাড়াহুড়োয় যে মোবাইল নম্বরটা দিয়েছিল, সেটা অফারের ছিল এবং পরে তা পাল্টে যায়। এইজন্য সে ভীষণ ক্ষমাপ্রার্থী। বলে নিজেই এবার সে ফিক্সড নম্বরটা দিল। ততক্ষণে ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। অ্যানি চুপ। জীবনের আলোছায়ায় ফের বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। নম্বরটা সেভ করল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতে গলা তুলে বলে উঠল, ‘ও হ্যাঁ, টাকা আর ডায়েরিটা কবে দিতে পারব রাতে ফোন করে জানিয়ে দেব।’
কানে এল, ‘আচ্ছা-আ—’

তো সেই রাত। বালিশে মাথা। নতুন নম্বরটায় ফোন করল অ্যানি।
রিং হচ্ছে। লতা মঙ্গেশকরের একটা গান বাজছে, ‘মনের আগুন নিয়ে খেলা তুমি ভুলে গেছো বুঝি…। ‘হঠাৎ থেমে গেল। ফোনটা ধরেছে কেউ। অ্যানি কাঁপছে। চোখে জল। ঠিক কাকে খুঁজছে সে! বলে উঠল, ‘হ্যালো, আপনি?’

Leave a Reply