সুপ্রিয়া মণ্ডল

সুপ্রিয়া মণ্ডল

প্রিয় তন্দ্রা,
       কেমন আছো আর জিজ্ঞাসা করছি না, সেই অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। যেখানে আছো আশা করি ভালোই আছো। বিগত পাঁচ বছরে তোমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি, আর যে কোনোদিন হবে এই ধারণাও পোষণ করি না। কিন্তু আমার শেষ জীবনের না-বলা কথাগুলো তোমাকেই বলতে চাই। বর্তমানে আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, বসে দিন কাটাচ্ছি, ক্যান্সারের ফাইনাল স্টেজে, ডাক্তারবাবু জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এর আগে শেষ চিঠি কাকে কবে লিখেছিলাম মনে নেই, কিন্তু আমার অন্তিম সময়ে উপস্থিত হয়ে শেষ চিঠিটা তোমাকেই লিখে যেতে চাই।
আজ থেকে আট বছর আগে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়। সেদিন শীতের সন্ধ্যের বিয়েবাড়িতে তোমাকে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিল, শাড়ি পরে ঠান্ডায় জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে। মনে মনে সেদিনই তোমাকে আমার একমাত্র ছেলের জন্য পছন্দ করে নিয়েছিলাম। এরপর তোমার ঠিকানা পেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। বাড়ি থেকে ছেলে রাজি না থাকলেও তোমার প্রাক্তন শ্বশুরমশাইকে সাথে নিয়ে তোমাদের বাড়ি সোজা গিয়ে মিষ্টিমুখ করে এসেছিলাম। তুমি তখনও কলেজের গণ্ডি পেরোওনি, আঠারো পেরিয়ে সদ্য সাবালিকা হয়েছ, আরো পড়াশোনা করতে চাও। আমি কিন্তু সবাইকে বলে দিয়েছিলাম তুমি পড়াশোনা করবে, বিয়ে করে যতদূর ইচ্ছে পড়াশোনা করবে। ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম। উত্তর কলকাতার মহেন্দ্র গোস্বামী লেনের বিশ্বাস বাড়িতে যেদিন তোমার আলতা-রাঙা পায়ের ছাপ পড়ল সেদিন আমার ঘর চারপাশ থেকে আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তন্দ্রা, আমি সত্যিই মনে মনে চেয়েছিলাম আমার বাড়িতে শুধু লক্ষ্মী নয়, লক্ষ্মীর মধ্যে সরস্বতীরও যেন আগমন ঘটে। নবপরিণীতা তুমি অপটু হাতে চাইতে আমাকে সাহায্য করতে, তাড়াহুড়োতে একদিন হাতের ওপরে গরম সাঁড়াশির ছ্যাঁকাও খেয়েছিলে। তোমার চোখের জল দেখে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এরপর শাশুড়ি, বউমা মিলে খুনসুটি করে দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যেত। তোমার মনে আছে সেসব কথা? কী যে বলছি আমি! আসলে বয়সের সাথে সাথে অসুখটাও এমন হয়েছে যে, ভুলেই যাচ্ছি তুমি তো আর আমার কাছে নেই, আমার বাড়িতেও নেই, তোমার কেন ওসব কথা মনে পড়বে!
আসলে শেষ সময়ে এসে দু’টো মনের কথা কাউকে যে বলব সেই উপায়ও আর নেই। তোমার শ্বশুরমশাই, ওহ্ প্রাক্তন প্রাক্তন, দেখেছ আবার ভুলে যাচ্ছি; মনেরই বা কী দোষ বলো, সে একবার যা মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় তা আর বের করতে পারে না, একেবারে চিরস্থায়ী রূপে মাথার মধ্যে রয়ে যায়। তো যা বলছিলাম, তোমার প্রাক্তন শ্বশুরমশাই প্রায় তিন বছর হল গত হয়েছেন। উদয়ও আর আমার কাছে নেই, সে আর খোঁজ রাখে না। মানুষের বিপদের দিনে তো তার প্রিয়জনকেই সবথেকে বেশি কাছে পেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে কাছের মানুষদের একান্ত সঙ্গ। কিন্তু সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? নাহলে তুমি আজ আমার কাছেই থাকতে। ভগবানেরও বোধ করি সে ইচ্ছে হল না, তিনিও চাইলেন আমাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে।
আমি তোমার কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইব জানি না, তবুও যদি পারো এই বুড়িটাকে ক্ষমা করে দিও মা। এই বুড়িটা তোমাকে আগলে রাখতে পারেনি, তোমার বাবা-মা’কে দেওয়া কথাও রাখতে পারেনি। বুড়িটা তোমার ক্ষমার অযোগ্য। অথচ নিজে স্বার্থপরের ন্যায় তোমার মতো অনভিজ্ঞ একটা মেয়েকে সংসারের পাকে বন্দি করে দিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে, একদিন দুপুরবেলা বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলছিলাম, তোমাদের ছেলে হলে তোমার আর উদয়ের নাম যোগ করে তন্দ্রোদয় রাখব। তোমার তখন কী হাসি! সাথে তোমার শ্বশুরমশাইও যোগ দিয়েছিলেন। সব ঠিকই ছিল কিন্তু সম্পর্কগুলো আর ঠিক রইল না।
এখন কারোর সঙ্গে আর কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। নার্স, ডাক্তার এসে দেখে যায়, উদয় টাকা পাঠিয়ে দেয়, ওতেই চলে। কথা বলবার অনিচ্ছা থেকে ভাবলাম জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কিছু লিখে রেখে যায়। কাছের তো আর কেউ নেই, যারা ছিল সবাই একে একে ছেড়ে চলে গিয়েছে। বিশ্বাস করো, তোমার চলে যাওয়ার দিন থেকে এমন একটা দিন, একটা মুহূর্ত যায়নি যে তোমাকে মনে করিনি। জানো, যে নার্স মেয়েটা আমার দেখাশোনা করে, ওকে বলেছি তোমার ঠিকানায় চিঠিটা পাঠিয়ে দিতে। ও রাজি হয়েছে, টাকা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিল না। আগে ভাবতাম সবাই বুঝি টাকাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় মানুষের থেকে, বিশ্বাসটা যে ভেঙে গিয়েছে। আমার এবড়োখেবড়ো বাঁকাট্যারা লেখা একটু কষ্ট করে পড়ে নিও। আচ্ছা, তোমার ওই পুরোনো ঠিকানাটাই রয়েছে তো? নাকি বদলে গিয়েছে? ঠিকানা বদলে গেলে আমার শেষ লেখাগুলো যে তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না!
উদয়ের কথা না শুনে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছি, তোমার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছি। উদয় আমাকে জানিয়েছিল ওর পছন্দের একজনের কথা, তখন শুনলাম না। শুনলে আজ এই অবস্থা হত না। বিয়ে তো শুধু দু’টো মানুষের মিলন নয়, তার সাথে দু’টো পরিবারের মানুষগুলোর মিলন, সবার জীবন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়া। সে’রাত্রে যখন উদয় ঝগড়া করে জানিয়ে দিল যে ও তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে না, আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি। তুমিও সেই যে আমাদের ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আর কোনোদিন ফিরে এলে না। জানি তুমি খুব দুঃখ পেয়েছিলে, অবশ্য পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমাদের দু’জনের ডিভোর্সটাও নির্বিঘ্নে হয়ে গেল, তুমি তোমার বাবার বাড়ি থেকেই সই করে কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছিলে উদয়কে। এক মাসের মাথায় উদয় আবার বিয়ে করল, কিন্তু এবার আর ও কোনো ভুল করেনি। আমাদের না জানিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে সোজা উঠেছিল ওর নতুন কেনা ফ্ল্যাটে, সেখানে আমাদের যে জায়গা হবে না তা আমরা দুই বুড়ো, বুড়ি আগে থেকেই জানতাম, তাও ও পরিস্কার করে জানিয়ে দিয়েছিল আর যেন কোনো ঝামেলা না করি ওর নতুন সুন্দর গোছানো জীবনে।
এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের থেকে খবর পেয়েছিলাম তোমার বিয়ে হয়েছে। সব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কেন করবে না? তোমারও উদয়ের মতো ভালো থাকার সমান অধিকার রয়েছে। ওখানের সবাই নিশ্চয় আমাদের বাড়ির থেকে খুব ভালো, ওরা তোমাকে আমাদের থেকেও খুব ভালো রেখেছি জানি। তোমার নতুন ঘর, নতুন বর নিয়ে সুখে থেকো। আশা করি, এবারে তুমি তোমার সঠিক মনের মানুষকে পেয়েছ, সে তোমায় উদয়ের থেকে ভালো রাখবে এ আমি একশো ভাগ নিশ্চিত। আচ্ছা, তোমার সন্তান, ছেলে নাকি মেয়ে! তারা কি তোমার মতই দেখতে হয়েছে? একটিবার খুব দেখার সাধ ছিল গো! আমার পোড়া কপাল, বেশি আকাঙ্ক্ষা করতে নেই। মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমাকে মা বলেই ডাকবে, এক মা ছেড়ে আরেক মায়ের কাছে এসেছ। তুমিও মুচকি হেসে আমার কাঁধে মাথা রেখেছিলে। তোমার কি একবারও আমার কথা মনে পড়ল না? না পড়াটাই উচিত।
আমাদের মরচে পড়া সম্পর্কগুলোর আগেও একটা নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে— ‘প্রাক্তন’। আমরা সবাই যে এখন পুরোনো বাতিলের খাতায়। আমি পারিনি তোমাকে নিজের বাড়িতে নিজের কাছে রেখে দিতে, পারিনি সম্পর্কটাকে রক্ষা করতে। জীবনটা যে এরকমভাবে অন্য খাতে বয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমার এই বেরঙিন ধুলো পড়া সাদা-কালো দিনগুলোর সমাপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। যদি কোনোদিন আমার এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছয় সেদিন আমি থাকব কিনা জানিনা, না থাকলেও একমাত্র তোমাকেই আমার মনের গোপন কথাগুলো জানিয়ে গেলাম। যেখানেই থাকো ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো।
 
                                            ইতি,
                              তোমার প্রাক্তন (শাশুড়ি) মা

Leave a Reply