সুদীপ হাজরা
চিঠি:- ‘অপরিণতা’
প্রিয়তম, সম্বোধনটা তোমার ঠিক মনঃপূত হলো না জানি, কিন্তু কী করব বলো? ‘প্রিয়তম’ বলেই যে একদিন ডেকেছিলাম তোমায়। আজ অবশ্য সে’সব দিনগুলো তোমার স্মৃতিতে এসে আর উত্যক্ত করে না তোমাকে। করবেই বা কী করে? অমাবস্যায় কি আর চাঁদকে দেখা যায়! ওই দিনগুলোও ছিল আমার জীবনের অমাবস্যা। এখন আপসোস করি জানো, যে কেন এসেছিল ওই অন্ধকারময় দিনগুলো আমার জীবনে। শুধুই কি অপ্রাপ্তি আর অসম্মানের সুখ দেবে বলে? অথচ কোনও এক গোধূলির প্রাক্কালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তখন আমি তোমার জন্য অপেক্ষারতা… চূড়ান্ত যা কথাবার্তা সে’সব আগেই হয়ে গিয়েছিল দুই পরিবারের মধ্যে। সেদিনটা ছিল শুধুমাত্র আমাদের দু’জনের মধ্যে আলাপচারিতার দিন। তুমি আসবে বলে আমার মনে সে কী ঢেউয়ের মতো তোলপাড় করা মুহূর্ত! নিজের অগোছালো চেহারাটাকে নিজেরই অপটু হাতে একটু সাজিয়ে তুললাম। তারপর তুমি এলে। আচ্ছা তোমার মনে আছে, আমায় আলাদা করে সেদিন তুমি বলেছিলে, “শাড়ি পরে তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, রাই। শুধু চুলটা খোলা রাখলে আর তাতে একটা ফুল ফুটে থাকলে আরও মিষ্টি লাগত। এমনিতে অপরূপ আমার প্রিয়তমাটি। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে রাই, খুব।” জানো রূপ, মেয়েরা না ঠিক এমনই একটা স্বপ্নোজ্জ্বল দিনের আশায় অপেক্ষা করে থাকে। আর যখন স্বপ্নের পুরুষটি তার সামনে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তখন যেন তার মনের ভিতরে জমা সমস্ত আবেগ, অনুভূতি একত্রিত হয়ে পাখির মতো আকাশে ভেসে বেড়ায়। আমিও সেই আবেগের ডানাতেই ভর করে ভেসেছিলাম সেদিন। কিন্তু আমার ভুলটা ঠিক কী ছিল তুমি বলতে পারো? আমরা তো একে অন্যকে চেনার পর, জানার পর, বোঝার পরেই পরিণয়ের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। তাহলে আজ কেন আমাদের দু’জনের পৃথিবী এতটা আলাদা হয়ে গেল রূপ? এই পাঁচটা বছর আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু; আমার বাবা, মা, আরও কত কী! সব কি আর এভাবে হিসেব কষে বলা যায়? যায় না বোধহয়… আর তাই তো কারুর অধিকারের জেরে নিজের সমস্ত ইচ্ছা, অনিচ্ছাকে রাতের অন্ধকারে কবর দিয়ে দিতে হয়। তুমি কোনওদিন জানতেই চাওনি যে, আমার কী ভালো লাগে? কীসে খারাপ লাগে? বরং তোমার ভালোলাগা, মন্দলাগাগুলোকে তুমি আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছ অবলীলায়। জোর করে যে চাপিয়ে দিয়েছ, তা বলতে পারি না। আমিই একপ্রকার জোর করে নিজেকে তোমার মনের মতো গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছি। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি, একপাক্ষিকভাবে কখনওই কারুর মনের মতো হয়ে ওঠা যায় না। কিন্তু ওই যে… বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়! ভালোবাসা তো এমনই এক মায়া, আর ভালোবাসলে মানুষ কী না পারে! সব পারে, সব। ভালোবাসা থাকলে একটা সম্পর্ক বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু ভালোবাসাহীন অন্ধকারে শুষ্ক পাতার মতো ঝরে পড়ে সেই সম্পর্ক। আমি জানি যে, আমার মধ্যে একটা বিরাট খামতি রয়েছে। আমার শারীরিক অক্ষমতা তোমাকে সন্তান সুখ দিতে পারেনি। আচ্ছা রূপ, ভেবে বলো তো, তুমি কি পেরেছ সবাইকে সবটা দিতে? পারোনি বোধহয়! আমাদের মধ্যে যদি সত্যিকারের ভালোবাসা থাকত তবে ঠিক কোনও না কোনও উপায়ে আমরা নিজেদের না-পারাগুলোকে পুষিয়ে নিতে পারতাম। তাহলে হয়তো আমাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির… থাক! এই অন্যায্য কথাগুলো বলার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। আমি তো এখন মুক্ত হতে চাই। তোমার দেওয়া সমস্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভার থেকে মুক্ত হয়ে পাখির মতো উড়ে বেড়াতে চাই। যেখানের আকাশ, বাতাস জুড়ে থাকবে শুধুমাত্র আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর স্বপ্নগুলো। আজ থেকে তোমার দেওয়া এই এয়োতি সাজ আমি ত্যাগ করলাম। এবার থেকে কেবল নিজের জন্যই সাজব, বাঁচলে নিজের জন্যই বাঁচব। কাল থেকে আমরা দু’জন দুই মেরুর বাসিন্দা। এটাই বেশ ভালো হলো, তাই না রূপ? তোমাদের মধ্যে বাধা দেওয়ার তৃতীয় আর কেউ থাকল না। তবে কি জানো তো রূপ, তুমি তোমার অজান্তেই আমার একখানা উপকার করে ফেলেছ। এতদিন আমি জানতামই না যে, আমার এই আটপৌরে জীবনের বাইরেও মস্ত একটা পৃথিবী রয়েছে। কিন্তু আজ জানলাম। কাল যখন তুমি আমার গায়ে হাত তুললে, এক মুহূর্তের জন্য তখন আমার মনে হয়েছিল নিজেকে শেষ করে দিই। চেষ্টা যে করিনি, তা বলব না। ফ্যানের উপর শাড়িটা ঝুলিয়েও দিয়েছিলাম। তারপর চেয়ারে দাঁড়িয়ে ফাঁসটা যেই গলায় পরতে যাব, তখন আমার মনে হলো… এ’সব আমি কার জন্য করছি? যার জন্য করছি সে’তো আমাকে ভালোবাসে না! তাহলে আমি খামোখা কেন নিজের জীবনকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় সঁপে দেবো? জীবনে বেঁচে থাকাটা তো একপ্রকার লড়াই। তাহলে আমি কেন সেই লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে এমনি এমনি পালিয়ে যাব; যেখানে কেউ স্বেচ্ছায় এক ইঞ্চি জমিও কারুর জন্য ছেড়ে দেয় না! এ’সব মনে হওয়ার পর মন দিয়ে ভাবলাম, আমার জীবনটা যে ঠিকমতো শুরুই হয়নি এখনও। একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছ রূপ, আমি সত্যিই একজন অপরিণত। পরিণত হলে তুমি কি আর এতটা অবহেলা করার সুযোগ পেতে? তবে এটুকু তোমাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে পারি যে, আজকের পর এই অপরিণত মানুষটি পরিণত হয়ে ওঠার লক্ষ্যে পা বাড়াবে। একদিন সে ঠিক প্রমাণ করে দেবে যে, সে কারুর অনুগ্রহের পাত্রী নয়। নিজের চলার পথ সে নিজেই তৈরি করে নিতে পারে। হ্যাঁ, প্রথম প্রথম হয়তো চলতে গিয়ে সে অনেকবার পড়বে, বারবার আঘাত পাবে, রক্তাক্ত হবে, আবার একটা সময় পর উঠে দাঁড়াতেও পারবে। আর ঠিক এইভাবেই একদিন স্বয়ং সম্পূর্ণা হয়ে উঠবে সে। আমি বুঝতে পারছি, তোমার মনে এখন অজস্র প্রশ্নচিহ্ন মেঘের মতো আনাগোনা করে বেড়াচ্ছে। তুমি ভাবছ, আমি একা আর কী বা করতে পারি। যদিও করার হলে অনেক কিছুই করতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে ভালোবাসা মানে কারুর উপর অধিকারের পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া নয়। তোমার তো নিশ্চয়ই মনে আছে যে, আমি একজন নৃত্যশিল্পী। বিয়ের আগে এই নাচ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর, আমার নাচ করা নিয়ে তোমার প্রবল আপত্তি ছিল। আমিও তোমার মুখের দিকে চেয়ে সে’সবের পাট একেবারের মতো চুকিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আশ্চর্যের কথা কি জানো রূপ, যে নাচকে ভালোবাসার কারণে আমি লেখাপড়ার দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি, আর সেই ভালোবাসাই কিনা এক নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলাম! এখন বুঝতে পারি, বড্ড ভুল করেছিলাম যার কোনও ক্ষমা হয় না। আক্ষেপ করে এখন সময়ের অপচয় ছাড়া কোনও লাভ হবে না জানি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলতে পারি, আমি আর কখনওই পিছনে ফিরে তাকাব না। এবার থেকে আমার চলার পথ শুধুমাত্র সামনের দিকে থাকবে, আর আমিও সেই পথ ধরে এগিয়ে যাব নিজের লক্ষ্যে। রূপ, তোমাকে শেষ কয়েকটা কথা বলার আছে। আমি চলে যাওয়ার পর তোমাদের বিয়েটা যে হবেই, সেটা জানি। তবে যেটা বলার, জীবনে আর যাই করো না কেন, তাকে কখনও অসম্মান কোরো না। অসম্মানের আঘাত যে কেমন, তা আমি নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছি। চেষ্টা কোরো তার মনের মতো হয়ে ওঠার, সে-ও নিশ্চয়ই তোমার মন বুঝে চলার চেষ্টা করবে। আর তাতেই দেখবে, তোমাদের মধ্যে সুন্দর একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভেবো না যে জ্ঞান দিচ্ছি; নিজের অভিজ্ঞতাটুকুই তোমায় কেবল জানালাম। আশাকরি, জীবনের আগামী দিনগুলো তোমার ভালোই কাটবে। সন্ধ্যার সঙ্গে সুখী হয়ো। তাকে সত্যিকারের ভালোবেসো। এই চিঠির পাশে আরেকটা কাগজ রেখে যাচ্ছি, যাতে লেখা আছে, “আমি স্বেচ্ছায় এই সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। সন্ধ্যার সঙ্গে তোমার বৈবাহিক সম্পর্ক হলে তাতে আমার কোনও আপত্তি থাকবে না। আমার নিজের কোনও দাবিও নেই তোমার থেকে।” ডিভোর্স পেপারটা আমার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও। সই করে দেবো। আর হ্যাঁ, তোমার দেওয়া সমস্ত কিছুকে আমি এখানে ত্যাগ করে গেলাম। আমি শুধু আমার ‘আমি’টাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে তুমি অস্তিত্বহীন অচেনা একজন মানুষ। ‘প্রিয়তম’ শব্দটাকেও আমি নিজের সাথে করে নিয়ে গেলাম। ওটা আবার আমার স্বপ্ন হয়েই আমার মধ্যে বেঁচে থাক। ব্যাস! আর কিছু বলার নেই। ভালো থেকো। ইতি, অপরিণতা আমি |