সমন্বিতা ঘোষ

সমন্বিতা ঘোষ

প্রিয় অপু,
      কি অদ্ভুত তাই না? জীবনের শেষ মুহূর্তটাতেও যে মানুষটার নৈকট্যে কাটাব ভেবেছিলাম সেই মানুষটাই আজ আমার থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে।নাঃ! কেবল স্থানিকভাবে নয় মানসিক ভাবেও। মনে হয় সবটা একটা স্বপ্ন,এই বুঝি ঘুম ভাঙলে মিথ্যে হয়ে যাবে। রোজ রাতের ঘুম শেষে সকালবেলা উঠে যখন মোবাইলটা হাতে নিই ,সেই ভাবনাটা মিথ্যে হয়ে যায়। রাত এলে আবার সেই ভেঙে যাওয়া আশা জুড়তে শুরু করে। গল্প বুনন হয় স্বপ্নের মাঝে কতশত একসাথে দুজনায়। বাস্তব এত কঠিন কেন হয় রে গেছোবন্ধু? দোষ করলে শাস্তি প্রাপ্য মানি, তাই বলে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা যে বড় অসহনীয় শাস্তি। এর চাইতে সেই ক্লাস এইটে আমার বেনি টেনে খুলে দিয়েছিলি যেমন অমন করতে পারতিস বা কান ধরে একশোবার উঠবস করতে বলতিস নতুবা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি–ভুড়ি নিয়ে করতে একটু কষ্ট হত তবে ঠিক করে নিতাম। কি বলতো, ওখানে না শারীরিক কষ্ট হত,মানসিক নয়।
মনে পড়ে তুই একটু বকার পর মুখ গোমড়া করলেই মিনিট এক পর সেই তুইই ভালোবেসে হাসিয়ে দিতিস? তবে আজ কতগুলো রাত আমি নীরবে দুঃখযাপন করে কাঁদি, কেন তুই এসে হাসিয়ে দিস না? মনখারাপ হলে যে মানুষটা সবসময় অজান্তেই মন ভালো করা সুখী বাতাস হয়ে আসত আজ সে-ই আমার মন খারাপ জেনেও কীভাবে দূরে? কত কথা ,কত গল্প, কত ব্যথা জমে রোজ,বলব কাকে ? শুকতারা কে ? সে কি পৌঁছে দিবে তোর কাছে আমার কথা? ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোকে। জানিস,তুই চলে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে রোজ এই শহরও কাঁদে বৃষ্টি নামিয়ে, তিস্তাও কাঁদে স্রোতের ফেলিলোচ্ছ্বাসে।ঘুম আড়ি করেছে, অশ্রু ভাব জমিয়েছে। হাসি ফিরে গিয়েছে আত্মার সঙ্গে তোর পিছে পিছে,দেহটা কেবল পড়ে রয়েছে। তুই ফিরবি সেই অপেক্ষায়। জানি অপেক্ষাটা দীর্ঘ হবে,আপত্তি নেই করতে। তবে ফিরে আসিস। হয়ত বলবি প্রেমিকপুরুষ পেয়ে গিয়েছি তবে কীসের এত শূণ্যতা। আগেও বলেছি,তোর জায়গা কেউ নিতে পারেনা,কেউ না। সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি পৃথিবীতে দুটো মানুষকে। এক তুই আর অপরজন ধ্রুব। হৃদয় একটা হলেও সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়েই ভালোবেসেছি দু’জনকে। আর হৃদয়ের সবচেয়ে নিকটস্থ হয় যেই মানুষটা, একমাত্র সে-ই আমাদের যেমন অনাবিল সুখ দিতে পারে তেমন সুন্দর বিরহযাপনের দুঃখও দিতে পারে। মানুষে বলে প্রেম করলে প্রেমিক-প্রেমিকা বিচ্ছেদকালে বিরহযাপন করে। কিন্তু আমরা প্রেমিক প্রেমিকা না হলেও সখাপ্রেমের বাঁধনে বাঁধা যে। বিরহ তাই এই বন্ধুত্বেও বিষের নীলচে জ্বালা দিয়ে যায় বুকের মাঝে। কি অদ্ভুত এ যন্ত্রণা তোকে বোঝাতে পারবনা। সারাটা দিন মন ভুলিয়ে রাখলেও রাতে মন বাঁধনছাড়া পাগলামি করতে শুরু করে আর একটা ভীষন ব্যথা হৃদপাঁজর বেয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠে আসে বুকের বাঁদিক থেকে। এ ব্যথা খানিক হলেও তুই অনুধাবন করবি জানি। কারণ আমার মতো যাতনা তুইও পাচ্ছিস, কাঁদছিস তুইও। দু’জনেই দুদিক থেকে দূরত্বের পাঁচিল ভেঙে মিলতে চাই কিন্তু পরিস্থিতি অনড় হয়ে এতটাই রূক্ষ যে ব্যর্থ সকল প্রয়াস।তুই না বললেও আমি বুঝি। কারণ তুইও যে অনেক ভালোবাসিস আমায়।
    জানিস, সেদিন যখন আমায় বাড়ির পথে তুই এগিয়ে দিতে এলি আর বাড়ি যেতে গিয়েও থমকে গিয়ে ছুটে এসে আবার তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম শেষবারের মতো, সেদিন মনে হচ্ছিল যেন ওভাবে তোকে ধরেই থাকি,ছেড়ে না দিই‌। ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবি। মন বলছিল বারবার,”দূরে যাচ্ছিস যা কিন্তু বিচ্ছেদ বিনা যাওয়া কি সম্ভব নয়? থেকে যা না। পিছুটান হব না ,তবে ভালোবেসে যোগাযোগের পরিপন্থীটুকু রব।”কিন্তু বলতে পারিনি। জানিসই বরাবরের মুখচোরা তোর এই ভীতু বন্ধু। আর এই স্বভাবদোষেই তো বিচ্ছেদ এলো।
    যাকগে, আজকাল বড্ড ছিঁচকাদুনে হয়ে গিয়েছি ,তাই তো লিখতে লিখতেও বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এসব আপাতত বাদ দে,আর শোন চিন্তা করিস না তুই ঠিক মনমতো প্রিয়বন্ধু খুঁজে পাবি দেখিস। আমি কৃষ্ণর কাছে প্রার্থনা করি।প্রার্থনার শক্তি অনেক।আর তুই যে বড্ড ভালো মনের মানুষ। একজন প্রিয় বন্ধু পাওয়ার অধিকার তোর আছে। আমি হতে পারিনি প্রিয় বন্ধু কিন্তু যে হবে সে তোকে খুব সুখী রাখবে দেখিস। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তোর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকবে।আর সেই মানুষটাও খুব ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী হবে যে তোর প্রিয় বন্ধু হবে,এটুকু বলতে পারি। তোর মতো মানুষকে বন্ধুরূপে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। আমি পেয়েছিলাম এবং তার জন্য প্রতিনিয়তই মহান স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আশীর্বাদ তুই।
যে কাজে সহস্র মাইল দূরে পারি জমিয়েছিস সেই কাজে তুই সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করিস যেন। নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত হোক যাতে আরো মানুষের মাথার উপর বটবৃক্ষ হয়ে থাকতে পারিস,এই মনোকামনা রইল। আর কখনো কোনো সমস্যা বা কিছু হলে দ্বিধাবোধ না করে একটাবার আমায় জানাস। যেখানেই হোক না কেন যেভাবেই হোক না কেন, ঠিক চলে যাব। তোর জন্য এই ভীতু বন্ধুটা সাহসী হতেও জানে আর সে সবসময় রয়েছে তোর সঙ্গে। শরীরীভাবে না থাকলেও মন থেকে সবসময় আছি।
   তোকে কিছু জানানোর ছিল, আমায় খুব কাছের কেউ অভিশাপ দিয়েছিল একটা, আজ সেই অভিশাপ ফলে গিয়েছে। তবে আত্মঅহঙ্কারী হবার জন্য সেই অভিশাপ পেয়ে থাকলেও অহঙ্কার করার মতো কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। তবু সে ভুল বুঝে দিয়েছিল।তবে ফলেছে। হারানোর ছিল যা,হারিয়েছি। জীবনে আর কিছু হারানোর নেই, পাওয়ারও নেই বন্ধু। আর যা আশা ছিল সেই আশাকেও বিদায় দিয়েছি কাগজের নৌকায় লিখে রাস্তার জমা জলে ভাসিয়ে। এখন অপেক্ষা আছে কেবল, একটা বৃষ্টিভেজা দুপুরের,যেদিন আবারো তোর পা পড়বে এই শহরে, যখন জড়িয়ে ধরব আমার হারিয়ে যাওয়া অপুকে। সাক্ষী থাকবে মেঘপ্রেয়সী বৃষ্টি। আমাদের প্রতিটা উদযাপনে বৃষ্টি যে আসবেই,সে সুখের হোক কিংবা দুঃখের;গভীর যোগ যে তার আমাদের সম্পর্কের সঙ্গে। সেই‌ বৃষ্টিবিলাসী ক্ষণ আমার জীবনের শেষ মূহুর্ত হলেও আক্ষেপ রইবে না।
ভালো থাকিস, সাবধানে থাকিস, ইনহেলার ছাড়া কোথাও যেন যাসনা। দেখেশুনে রাস্তা পার হোস কেমন? এখন যে তোর হাত ধরার জন্য পাশে এই সেকেন্ড মা নেই।
                                ইতি,
                            তোর লাবণ্য।
            

Leave a Reply