শুভনীতা দে
(একটি ঠিকানাবিহীন চিঠি, যার উদ্দ্যেশ্যে লেখা তার হদিস রাখা বড় দুষ্কর ব্যাপার..) মন, কেমন আছিস তুই, জানতে চাইব না। মূলত তিনটে বাহানায়। এক, তুই যাই বলিস ভাল কিংবা মন্দ, তার সত্যতা তলিয়ে দেখার সাহস আর আমার নেই। শুনেছি তুই এখন যা মুখে আসে তাই বানিয়ে বলতে শিখেছিস। দুই, যদি উত্তরটা হয় খারাপ, তবে সে আমি শুনতে পারব না। আর শেষ ও প্রধান কারণ হল যদি ভাল আছিস বলিস সে। আমার সইবে না। কতদিন কথা হয় না তাের সাথে। আয়নার মুখােমুখি তাে দাড়াই প্রতিদিন বহুবার, অথচ দেখা হয় কৈ!! এখানে এখন বর্ষা, তবে ভরা নয়। মানুষের সম্পর্ক গুলাের মত সেও কেমন ছাড়া ছাড়া। এখন আর ‘আষাঢ়স্য | প্রথম দিবস’এ মেঘ দূত হয়ে আসে না। আনে না কোনাে বার্তা। আজকাল মানুষের হাতে অত সময় কোথায়? এখন বিকল্প বহু পথ। মুঠোফোনে বন্দি সকলে, চুটকিতে মুশকিল আসান। আচ্ছা মন, মনে আছে কত বৃষ্টিতে ভিজেছি তখন, হঠাৎ হঠাৎ যত ক্লান্তি ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে ওই কয়েক লহমায়। শেষ যখন তাের সাথে কথা হয়েছিল, তখন ছিল বসন্ত। সেটা স্মরণে আছে কারণ ওই সময় তাে প্রতিবার কড়া নাড়বােই তাের দুয়ারে। যদিও এখন বসন্ত আসে শুধু তাের আমার অথবা আমাদের মত আরও কিছু পাগলের কাছেই। সুস্থ মানুষের তাতে কিছু যায় আসে না। আর সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃতিরই তাতে নেই তেমন হেলদোল। হ্যা তবে বর্তমান প্রজন্ম, এর মধ্যে একটি বিশেষ দিনকে ‘প্রেমের দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিদেশি কেতায় সেই দিনটি আর সাথে আগে পরে আরাে কিছু দিন নিয়েই তাদের মাথাব্যথা। আমি এটা বুঝিনা গােটা বছরের ভালবাসা উৎযাপন-কে কী করে বুকে বন্দী করে রাখা যায় ঐ একটি দিনের অপেক্ষায়। কোন এক গ্রীষ্মের বিকেল পেরানাে নরম গােধূলিতে, কিংবা এই বর্ষার কোন দামাল দুপুরে বা হয়ত শরৎ এর বহু দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ আর কাশ ফুলে ঢাকা জঙ্গলে.. | পেঁজা তুলাের ফাক থেকে উঁকি দেওয়া ঝকঝকে কোন এক সকালে অথবা একটু উষ্ণতার জন্য মন কেমন করা কোন এক শীতের রাতেও কি প্রেম উৎসবে মেতে উঠতে ইচ্ছে করেনা কারাের? জানি না রে। তবে এ জানি এখন জৌলুশে গা ভাসে, গভীরতায় নয়। তুই ও পুড়িস নাকী কিছু এ আলগা ছলে? জানিস এ বছরও ঝিলের ধারের গাছ। গাছালিগুলাে কিচিরমিচির এ ভরে উঠেছিল, পরিযায়ীদের আগমনে। মনে পড়ে মন, ওদের নাম দিতাম কেমন আবােল তাবােল! সূর্যাস্তের সময় হঠাৎ চোখ গেছিল যার দিকে তার নাম রেখেছিলাম, ‘অস্তরাগ’। ও আর সেই সকাল। হওয়ার খানিক পরেই যখন একটু একটু করে মিহি আলাে ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, ঠিক সেই সময় মখমলি পালক। ভর করে যেন সূর্যটাকেই লক্ষ্য করে বেপােড়ােয়াভাবে উড়ে যাওয়া পাখীটাকে ডেকেছিলাম ‘সূর্যস্নাতা’ নামে। তাদের ও বুঝি কদিন পরে আসার সময় হল, আবার। তবে আজকাল ওদের দেখি কিছুটা অনিহা এই আসার প্রতি। আমি জানি তুই সে সব কথা বলিস নি তাের কাছের মানুষটিকেও। এ যে তাের আর আমার বড় একান্ত প্রলাপ যাপন। জানিস একটা বড় অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে পথ চলেছি আমরা। জানি না কোথায় এর শেষ! আগুন নেই আগুন! কিন্তু নিজেকে ছাড়া কাউকে যে এ অসময়ের সাক্ষী বাতলাই সে সাহস আমার নেই। বড় স্বার্থমগ্নতা লােভ অন্ধ করে রেখেছে প্রায় সকলকে। আর তলিয়ে যেতে যেতে অবক্ষয়ের মূহুর্তেও কেউ নিজের সাথে কথা বলতে সক্ষম হয় না আর। এই যেমন তাের আর আমার মতই। ন’মাসে ছ’মাসে বাক্যালাপ আবার কারাের নেই একদমই। মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সে পাট চুকেছে চিরতরে। আমি শুধু ভাবি এ কী উপহার দিচ্ছি আমরা আগত প্রজন্ম কে, শুধু কিছু ছোঁয়াচে মানসিক ব্যধি? আচ্ছা বেশ ছাড় এ সব। দেখেছিস আমি কেমন বলে চলেছি শুধু নিজের কথা! তাের খোঁজ তাে রাখাই হয় না। কিসে তাের সুখ, কিসেই বা মুখ ভার, সবই প্রায় ভুলতে বসেছি। অথচ আগে এ ব্যাপারগুলােতেই থাকতাম কত সজাগ। তবে কি তােকে আমি হারিয়ে ফেলছি আস্তে আস্তে? ভয় হয় দূরত্ব টা বাড়তে বাড়তে না এমন হয় যে আর.. অথচ তােকে ছাড়া যে আমি কাদব দু-দন্ড সে ক্ষমতাও নেই আমার। তাই তাে পথ পেরােই যন্ত্রচালিতের। মত। যেতে হবে তাে অনেক দূর। তােকে সঙ্গে নিয়ে, ধারণ করে হাঁটতে গেলে বােধহয় পিছিয়ে পড়ব ক্রমশ। তাই তাের নামে এই খােলা চিঠি ছাড়লাম। পাওয়া মাত্রেই উত্তর করিস কিন্তু। অবশ্য জানিনা আমি অপেক্ষায় থাকব কি না।। ইতি তােকে ছাড়া আমি |