শাশ্বতী মুন্সী

নীরব গোপন

শাশ্বতী মুন্সী

আমার বাপেরবাড়ির মালিকানা বদল হয়ে গেছে প্রোমোটারের হাতে। সাবেক আমলের দোতলা বাড়ি ভেঙে বহুতল বিল্ডিং হবে। শেষ বারের মতো জন্ম ভিটেকে দেখতে এসেছি। সারা এঘর ওঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে তিন তলার ছাদে উঠলাম। আয়তকার ছাদের বাঁদিকে দু ধাপ সিঁড়ি চাতাল পেরিয়ে ঠাকুর ঘর। দরজা খুলে ঢুকি। একসময় কাঠের সিংহাসনে অনেক দেবদেবীর পটচিত্র সাথে পাথরের রাধাকৃষ্ণর মূর্তি ছিল, নিত্য দুবেলা পুজো করতেন ঠাকুমা। আজ ঠাকুরের আসন ফাঁকা। বিষয় সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় রাধাকৃষ্ণর মূর্তি জেঠিমা নিয়ে গেছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, হঠাৎ চোখে গেল দেওয়ালের এক কোণে কুলুঙ্গি। ধুলো ঝুলে ভরা কুলুঙ্গিতে বেতের ঝাঁপি। ঢাকনা খুলতে দেখলাম ভাঙা সিঁদুর কৌটো, কতগুলো কড়ি, তামার পয়সা, মরচে পড়া তালা। ওগুলোর নিচে দেখলাম কাগজের একটু অংশ। বের করতে দেখি একটি বিবর্ণ খাম। ওপরে লেখা প্রিয় গঙ্গাজল, ঠিকানা মামারবাড়ি। খাম খুলতে চার ভাঁজ করা চিঠি। এ চিঠি মাকে কে লিখেছিল? বেশ বড়, পরেই দেখি কী লেখা আছে —
 
  মনে পড়ে সই, মেয়েবেলার দিনগুলো আমরা কত আনন্দ করে কাটিয়েছি, ছুটির দুপুরে বিশু জেঠুর বাগানে আম পেরে সর্ষের তেল, লঙ্কার গুঁড়ো মেখে খেতাম, বর্ষায় পুকুর ভরে গিয়ে যখন রাস্তায় জল উঠে আসত, বাড়ি থেকে চুপি বেরিয়ে যেতাম মশারির ছেঁড়া টুকরো নিয়ে, তোর মা বাবা জানতে পারলে বকত, তাই চুনো মাছ ধরে সোজা ছুটতাম আমাদের বাড়ি। আমার মা মাছগুলো ভেজে দিলে দুজনে মিলে খেতাম, শরৎ কালে শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতাম ঘরের ঠাকুরের জন্য, সরস্বতী পুজোয় দিন ভোর উঠে স্নান করে নতুন শাড়ি পরে চলে যেতাম রামুদাদুর বাড়ি, ঠাকুমার সাথে পুজোর জোগাড় করতাম, হলুদ কমলা গাঁদা, পলাশ ফুলের আল্পনায় সাজিয়ে দিতাম ঠাকুরের বেদি। দোলের মেলা থেকে কেনা মাটির পুতুল দিয়ে আমাদের বাড়ির বারান্দায় ঝুলন সাজাতাম, বাল্য কৈশোরের প্রতিটা দিন তোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তোদের বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল ছিল, সেই তুলনায় আমরা নিম্নবিত্ত। তবে সেইজন্য তোর মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না, বরং তোর নিখাদ ভালোবাসায় প্রকৃত বন্ধুত্বের স্বাদ অনুভূতি পেয়েছিলাম। তুই তো জানিস সই, আমার কত ইচ্ছে ছিল কলেজে পড়ব, চারজনের খাওয়া পরা, সাথে  দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ সামলাতে কারখানার শ্রমিক বাবার ওপর খুব চাপ পড়ত বুঝতাম, তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ছোট বাচ্চাদের পড়াতে লেগেছিলাম, যাতে কলেজে পড়ার খরচ টাকা জমানো থাকে,আমার পরে একটা ছোটবোন ছিল, দুই মেয়েকে পার করার দায়িত্ব ছিল বাবার কাঁধে, তাই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরেই বিয়ের দিন ঠিক করল। বিয়ের কথা জেনে তোর খুব মন খারাপ হয়েছিল, কারণ আমরা যে ভেবে একই কলেজে ভর্তি হয়ে, নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াব। বিয়ের সময় জন্মস্থান, পরিবার ছেড়ে যেতে সব মেয়ে কষ্ট হয়, কিন্তু মা বাবা বোন ছেড়ে থাকতে হওয়ার চেয়ে তোর সঙ্গে সারাদিন একটিবারও দেখা হবে ভেবে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল, পরদিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় তোর জরিয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম, তোর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা যে রক্তের সম্পর্কের উর্দ্ধে ছিল, তুই যে একাধারে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর সহোদরা-সম বোন।
 
  শ্বশুরবাড়ি হল দূর শহরে। যৌথ পরিবারের মেজ বৌ। শ্বশুর শাশুড়ি স্বামীও চাইত না বলে বেশি  বাপেরবাড়ি আসতে পারতাম, যদিও বা অনুমতি পেতাম, তো বর সঙ্গে নিয়ে আসত আবার সঙ্গে নিয়ে চলে যেত। কচ্চিত কখনো এক রাত থাকতে দিত। ঐ একটা দিন তোর সঙ্গে দেখা করে মনে হত যেন কত বছর পরে আমাদের দেখা হল, প্রাণ খুলে গল্প করতাম, তুই আমার শ্বশুরবাড়ির কথা জানতে চাইতিস, আমি কিছুটা বলতাম আর বেশি চেপে রাখতাম, কারণ চার মাস ঘর করেই বুঝে গেছিলাম, ওরা কেমন মানুষ। ছেলের বিয়ে দিয়েছে সংসার কাজ করা আর বংশ বৃদ্ধি করার জন্য, এসব কথা শুনলে তুই দুঃখ পাবি…
 
 বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান গর্ভে আসে, এই সময় মা চেয়েছিল, কিছুদিন বাপেরবাড়িতে এনে রাখতে কিন্তু শাশুড়ি রাজি হয় নি, ওনার মতে গর্ভাবস্থায় কাজকর্ম করলে তবেই সুস্থ সবল বাচ্চা জন্ম নেয়। অগত্যা বাড়ি আসা হল না, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পাইনি বলে চার মাসেই বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছিল। তখন অবশ্য আমিই দোষী হলাম, কেননা কচি খুঁকি তো নই যে নিজের খেয়াল রাখতে। অপারেশনের পরে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম বলে ডাক্তার বলেছিলেন ছয়েকের আগে যেন আবার বাচ্চা নেওয়া চেষ্টা না করি। কিন্তু স্বামী শাশুড়ি মত, ডাক্তাররা অমন অনেক নির্দেশ দেন, অত মানলে বয়স বেড়ে গিয়ে মা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, ব্যস! কড়া গলায় নিদান দিলেন, একটু সুস্থ হলেই বাচ্চা নিতে হবে। ইতিমধ্যে শুনলাম তোর বিয়ের ঠিক হয়েছে, কাকাবাবু এসে আমার শ্বশুরবাড়িতে এসে নেমন্তন্ন করে গেলেন। আইবুড়োভাত থেকে বৌভাত অবধি। আমি ভাবলাম যাক, এই সুযোগে মায়ের কাছে থাকতে পারব আর বন্ধুর বিয়েতে আনন্দ করাও হবে। আইবুড়োভাতের দিন সকালে বাড়ি দিয়ে গেল বর, কিন্তু বৌভাত অবধি থাকা হবে না, কারণ আমার বড় জা গর্ভবতী, শাশুড়ির শরীর ভালো নেই, একরাতের নেমন্তন্ন খেয়েই বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। জানি এ হুকুম শাশুড়ির, তাই অমান্য করার উপায় নেই। জানিস, খুব ইচ্ছে ছিল তোর বিয়েতে বাসর জাগব, কত গান হাসি মজা হবে, কিন্তু বিবাহিত মেয়েদের পায়ে যে শিখল পরানো… তুই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে বিয়ের রাতে মাপা সময় বিয়ে বাড়িতে কাটিয়ে ট্রেনে চাপলাম।
  মেয়েদের যে নিজের কথার জোর থাকে না সই। দু মাসের মধ্যে আবারও সন্তান ধারণ করতে বাধ্য হলাম। প্রথমবারের ঘটনার জন্য মা বাবাকে দিয়ে অনুরোধ করেছিল, যাতে দিন সাতেক বাপেরবাড়িতে আমায় পাঠান, দয়া পরবশ হয়ে সাতটা দিন থাকতে আসার অনুমতি দিয়ে ছিলেন। কি যে খুশি হল, ভাবলাম, এই সময় তুইও যদি বাপেরবাড়ি থাকতে আসিস তাহলে আরো ভালো হবে, মনে যে   কত কথা জমে আছে, সব তোকে বলব। বর দিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল, আমি যেন খুব সাবধানে থাকি, বাপেরবাড়ি এসেছি বলে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে না বেড়াই। কিন্তু এসে শুনলাম দিন চারেক আগেই তুই শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেছিস, আবার আসবি পরের মাসে।  অতএব ঘুরে বেড়াবই কার সাথে…
  মায়ের যত্ন-আত্তিতে বেশ ভালোই ছিলাম। তখন তো আর টেলিফোন আসেনি যে দেখা না হলেও ফোনে কথা বলতে পারব। নির্দিষ্ট দিনে বরের এসে নিয়ে গেল। তারপর থেকে টানা শ্বশুরবাড়িতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন। জানি না কী বুঝে শাশুড়ি মা সেবার আমার ভাগে একটু কম কাজের বরাদ্দ করেছিলেন। খাবার, ওষুধও ঠিকমতো দিতেন। সাতমাসে সাধের নানা ব্যাঞ্জন দিয়ে ঘরোয়া আয়োজন করলেন। আমার মাকে নেমন্তন্ন পেয়ে মা বোনকে নিয়ে এল। যাওয়ার আগে বলল, পরের সপ্তাহে একটা ভালো দিন আছে, সাধ দেবে। শাশুড়ি তো মায়ের মুখের ওপরই না বলে দিয়েছিলেন, বড় জা বলল, মাসিমারও তো ইচ্ছে হয় মেয়েকে সাধ খাওয়াবেন, তাই নিমরাজি হলেন। বরের সঙ্গে এলাম বাপেরবাড়ি, মা পছন্দ রান্না করে খাওয়াল, দুটো দিন থাকার অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম। শরীর ঠিকই ছিল, কিন্তু মন্দ কপাল হলে যা হয়, হঠাৎ দুপুর নাগাদ অসহ্য পেটে ব্যথা। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, বাচ্চা আর নেই, কী করে যে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছিল, আজও বুঝিনি। শ্বশুরবাড়িতে খবরটা জানাতে ওরা আমার সাথে মাকেও অনেক কথা শোনাল। শরীর আরো ভেঙে পড়ল। মাস খানেক মায়ের সেবায় থেকে সংসারের চাকায় জুড়তে ফিরে যেতে হল।
 এসব কথা তোকে জানাতে চেয়েছিলাম, চিঠি লেখাও যেত তাতে যে মুখে বলার মতো স্বস্তি হত না। ডাক্তার বরকে বারবার বলে দিয়েছিলেন, তৃতীয়বার সন্তান নেয়ার আগে যেন কয়েক মাসের বিরতি নেয়, নাহলে আমার মরণ বাঁচনের সমস্যা হবে। বাপেরবাড়ি যাওয়া আরো কমে গেল, শুধু মা এসে মাঝে সাঝে দেখে যেত। মায়ের মুখে শুনলাম বিয়ের তিন বছরেও মা হতে পারছিস না। ডাক্তার বদ্যি, ঠাকুর থান, দরগায় গেছেন তোর শাশুড়ি মা, কিন্তু ফল কিচ্ছু হচ্ছে না। ভাবলাম, ভগবানের কি লীলা, আমার কোল ভরিয়েও শূন্য করে দিচ্ছেন, আর তোর কোল ভরার কথা মনেই হচ্ছে না…
 গর্ভের প্রথম ভ্রূণের লিঙ্গ জানা যায়নি, দ্বিতীয় ভ্রূণটি ছিল ছেলে সন্তানের। তাই স্বামী শাশুড়ি রেগে ছিলেন। আমরা তো সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, তাই আবারো গর্ভবতী হলাম। মায়ের ওপর ভরসা, বিশ্বাস নেই বলে শাশুড়ি মা বাপেরবাড়ি আসতে দিলেন না। আট মাস অবধি তেমন অসুবিধা ছিল। ন’মাসে পড়তে শরীর খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার বললেন, প্রসবের সময় সমস্যা হতে পারে, হয়ত এমনও হতে পারে যে মা ও বাচ্চার মধ্যে যে কোনো একজনকে বাঁচাতে পারব আমরা। শাশুড়ি মায়ের ধারণা ছিল যে দুটো বাচ্চা পেটে এসেও জন্মাতে পারেনি, ওরা ফিরে আসছে, এবং খানিকটা নিশ্চিত ছিলেন আমার গর্ভে ছেলেই আছে।
   নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ডেলিভারি হল। মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলাম। না মরি নি, তবে শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক হল। বুঝতে পারছিলাম, আর বেশিদিন নেই আমি, ওদিকে আশা বিফল হওয়ায় স্বামী শাশুড়ি বেজায় চটে গেলেন। আমি অলক্ষী, অপয়া, বংশধরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি ইত্যাদি নানা কথা শুনিয়ে চলে গেল। সেইসময় জানতে পারি বাচ্চার জন্য তুই আকুল হয়ে উঠেছিস, মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মেয়েকে দেখতে তুই খুব শিগগির আসবি, তার আগেই তোকে সবটা জানিয়ে চিঠি লিখলাম, আমার মেয়েকে নিয়ে যা, মাসিরা মায়ের মতোই হয়, তুই না হয় ব্যতিক্রম হবি, সম্পর্কে মাসি হয়েও মায়ের পরিচয়ে মেয়েকে লালন পালন করবি। মায়ের প্রিয় বন্ধুর মধ্যে দিয়ে আমার সন্তান মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা পাবে।
           ইতি
                  তোর আরতি।
 
 চিঠিটা পড়া শেষ করে কতক্ষণ যে বিমূঢ় হয়ে বসেছিলাম! চিঠির সম্ভাষনে প্রথমে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝলাম, এই গঙ্গাজলই হল মায়ের বন্ধু আরতি মাসি। সাথে আরো বুঝলাম,  মা কেন বলত তোর মুখের আদলে আমার ছোটবেলার বন্ধুর খুব মিল। সে তো কবেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, তবে ওকে হারানোর কষ্ট লাঘব হয়েছে তোকে পেয়ে। আর বাবাও বলত আরতির জন্য আমাদের জীবন অনন্য সুখ পেলাম। আমাদের যৌথ পরিবারের সবাই একথা জানলে আমার কাছে গোপন রেখেছিল, যাতে এই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই বলে কষ্ট না পাই। মনে পড়ল ঠাকুমা বলতেন, আমি এসেছি বলেই ভগবান খেলার সাথী দিতে আমায় একটা বোন দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা গর্ভজাত সন্তান না হলেও আমায় আর বোনকে সমান ভালোবেসেছে মা। আমরা দুই বোনই ছিলাম বাবার চোখের মনি।
  বাবা মারা গেছেন দু বছর আগে, মায়ের বয়স হয়েছে। এসব কথা জিজ্ঞেস করে মাকে বিড়ম্বনায় ফেলব না। শুধু আমার অজানা যে সত্য অভাবনীয় ভাবে উদ্ঘাটিত হল, তা নিজের মনেই গোপন রাখব।

Leave a Reply