শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

“হে অভিন্নহৃদয়েষু,
আচ্ছা, আমার কি আপনাকে অমুকবাবু বলা উচিত ছিল? কিন্তু সে যে আমি বলতে পারিনি শুরুতেই। সামাজিক হিসেবগুলো আজও বুঝে উঠতে পারিনি, জানেন তো আপনি। নতুন করে আর বলে কী হবে? আচ্ছা, আপনি কি জানেন আপনার নামখানা অপরূপ? সে নাম ধরে কেউ ডাকে না কেন, এই তো ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার। সে যাক। এই ভবসংসারে কেউ না হয় আপনাকে বাবু বানিয়ে নাই বা ডাকল। এই নাম যে বারবার করে উচ্চারিত হবার মত। জপের মালার মত, অকাল-বর্ষার হঠাৎ-ভিজে হাওয়ার মত ফিরে ফিরে, ছড়িয়ে যাওয়া উচিত এই নামের। কামনা-বাসনা, বিকৃতি-সুকৃ্তি, মানুষ, সময়, ঋতুর পারে দাঁড়িয়ে এই নামটুকুই আমার সম্বল হয়ে উঠেছে মনে, বনে আর কোণে। আপনিই সেই লোক, যে আমাকে টেনে তুলেছে মৃত্যুর নীল-অতল থেকে। আমার বাঁচার শেষ ইচ্ছেটুকুও চলে গিয়েছিল পাহাড়ে বাসা নেবার অনেক আগেই। আমার শ্বশুরমশাই যখন জোর করেই আমাদের পাঠালেন অনুপের মায়ের চলে যাবার কিছুদিন পর, তার আগেই আমাদের যা হবার তা হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের রাত থেকেই আমার স্থান হয়েছিল অবহেলার মাটিতে। তবু “না” বলার মত জোর হয়নি আমার। কার কাছে যাব? এখান থেকে বার হলে পথেই যে স্থান হবে আমার। ঘরের মেয়ে, পথের হয়ে যাব? সমাজের আগল ভাঙার সাহস আমার হয়নি। কিন্তু দামি শাড়ি, বড় বাড়ি আর ভালো বাহনে মানিয়েও নিতে পারিনি রমা, লীলা বা প্রতিমার মতো। তাই দুঃখজীবন বরণ করে নিয়েছিলাম নিজের মতো করে, যতদিন পর্যন্ত না…
আমি সুখান্ধ হয়ে থাকতে চাইনি, তাই বোধহয় সুখ নামের কালবিহঙ্গের ফাঁদে আমার ঈশ্বর আমাকে পড়তে দেননি। আমার সব আশা, আনন্দ, উন্মত্তের মত, অন্ধের মত, ভিক্ষুকের মত শুধু একটিমাত্র অভিমুখে ছুটে যেতে পেরেছে তাই। কিন্তু সেদিন জানতাম না, কোথায়, কীসের জন্য আমার এই পথ-চাওয়া! আজ জানি, আপনি আমার অভিমুখ এবং উৎস।
আপনি জানেন না, আপনার সঙ্গে দেখা হবার পরপরই আমার লেখাগুলি শুরু হয়েছে। ওই চতুষ্পদীগুলি। বদলে গেছে আমার চিন্তার আদল। আমি ছন্দে ফিরে এসেছি। কবিতায় বাঁধা হয়েছে আমার ইচ্ছেনিকেতন। ভেবেছিলাম, আপনার জন্মদিনে আপনার পায়ে রাখব আমার এই সামান্য নিবেদন, কিন্তু তা আর হলো না। আমার যাবতীয় না-পাওয়া স্বপ্নের মতো বাসনাসম্ভব হয়েই রয়ে গেল এই অকাল-দুঃখের ভিতর-দুর্গে। আপনি কী ভেবেছেন আমার সম্পর্কে তা ঠিক জানি না,… জানি না, যা হচ্ছে আমার, তার কী অর্থ। শুধু এটুকু জানি যে আপনাকে দেখলে, আপনার গলা শুনলে আমরা যমযাতনা দূর হয়ে যায়।
জীবন থেকে আমার আর কিছু পাবার ছিল না হে আনন্দেশ্বর। সাত-পাঁচ ভেবে যখন দৈনন্দিন উঞ্ছবৃত্তির গিলোটিনে স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা মনে মনে স্থির বলে জেনেছি, ঠিক সেই সময়টায় আপনি এলেন। হে আমার দুঃখের আলো, আসুন আজ শেষবারের মতো আপনাকে কিছু কথা বলি।
কতটা পর্যন্ত হলে তবে ক্ষেপে ওঠা উচিত বলুন তো? জীবন কতটা পর্যন্ত অনাচার করলে সীমা টানা উচিত? ঘুরে দাড়ানো উচিত? সীমার সংজ্ঞা ঠিক কী? আর সবার কাছে কি সেই সংজ্ঞার একই মাপ? আর যে লোকটা গায়ের জোরাজুরিতে অক্ষম? মাঠে নেমে পাটকেল তোলায় অপারগ? কী হবে তার? কে দেবে আমার প্রশ্নের উত্তর? কার খোঁজে যাব আমি অপলক? প্রশ্নের আঘাতে বিদীর্ণ এই ‘আমি’র সামনে হঠাৎ এক নেভা অস্তরাগে আপনি এলেন।
একজন মানুষের দেবতা বা প্রিয়, তার নিজস্ব হয়। তার দুঃখের সঙ্গে তার দেবতার সন্তাপের যেদিন দেখা হয়, সেইদিনই তার কবি আবির্ভূত হন। এ আমার বিশ্বাস। চিরকালের বিশ্বাস। আপনার কথায়, ভাবনায়, আদরে, যে দেবীকে আপনি গড়েছেন, তিনি অশ্রুজলগামী। সেই অশ্রুজলে আপনি নিজস্ব আকার দিয়েছেন। প্রতিমা নির্মাণ করেছেন। আপনার দেওয়া লাবণ্য নামের লোকটাকে আমি এখন চোখের সামনে দেখতে পাই, জানেন। একজন একাকী, একহারা মানুষ। কপালে গোল সিঁদূরটিপ। গরমে, ঘামে একটু গলে গিয়েছে। হাতে ধপধপে শাদা চওড়া শাঁখা। সিঁথিজোড়া শূন্য দুঃখরেখা।
আপনি আমার আরশিনগর, আপনিই আমার পড়শি। আমি কী করব! আপনিই আমার অন্ধত্ব। যে অন্ধত্ব আমার ভিতরের চোখ খুলে দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে গেছে আমার ভিতরে, বাঁধ ভেঙে গেছে… আজ যে আমায় বলতেই হবে এই কথাগুলো। আজ যে আমার জ্যোৎস্নারাতের আনন্দ-গান গাইবার দিন। আপনি জানেন না, আমি আপনার ওই বইটা, “ঈশ্বরের কণা”, কতবার করে পড়েছি, আপনি জানেন না। আপনি জানেন না, রাতের আকাশে তারা দেখে বেড়ানো আপনার দুচোখের আলোয় কীভাবে পথ চিনে নিয়েছি আমি। আপনাকে সেই রাতে আমি কত কথা বলতে চেয়েছিলাম! বলা হয়ে ওঠেনি কিছুই। বলা হয়ে ওঠেনি কীভাবে একদলা বাদল মেঘের মতো মিলিয়ে যেতে চেয়েছি আপনার আকাশ-বুকে। আপনার পায়ের কেবল ধুলো হয়ে আপনার পথে মিশে থাকতে চেয়েছি। আমার এই হালভাঙা নৌকোর পাল তুলে বাঁধন যে খুলে দিয়েছেন আপনি। আমার গভীর রাতের আকুল অশ্রুর পারের যে পথ, সেই অনন্তযাত্রার সন্ধান আপনি। কিন্তু এসব কিচ্ছু বলা হলো না আপনাকে। অশ্রুমতী এই আমি, এই মুহূর্তে বলে যাচ্ছি, আমার অমৃতের সন্ধান, সুরের সন্ধান আমি পেয়েছি হে আমার জীবনানন্দ।
সে আপনি, সে আপনি, সে আপনি।
আমার ভয়ের ভিতরের জয়টুকু আপনি।
কোন এক নিরাশ বিকেলে, হতাশ দিনের পারে আমি এই মুখটিই দেখেছিলুম। সেদিন ঝরনার ধারে আপনি অমন হঠাৎ করে সামনে এসে না দাঁড়ালে আমি কি কখনো জানতেম, যে এ আমার জন্ম, কেবল এক অপেক্ষার শিলালিপি ছিল… চোখ বুজলেই চাঁদ দেখতে পেতাম। চাঁদের দেশ বড় টানে আমায়। তাই বোধকরি তার জ্যোৎস্নাটুকু আজ এই আমার ভিক্ষুণী-হৃদয়ে পড়েছে। পড়েনি শুধু, বয়ে গেছে, ভেসে গেছে, মিশে গেছে ভিতরে। আমার আমিটুকু আর কিছুই নেই। সবখানি ডুবে গেছে ওই চিৎপদ্মে। এসব কথা বলতে নেই, আমি জানি, কিন্তু না বলে যে আজ থাকতে পারছিনা। চোখ ভরে আসে জলে… গালি দিই, নিজের চোখকে শাসন করি, কিন্তু এ পোড়া অঙ্গ মাথার সঙ্গেই থাকে কিনা, তাই আমার এ বেবাক মনের কথা মোটে শোনে না। ঝাপসা করে দেয় ভরে থাকা চাঁদের আলো! কিন্তু কী জানেন, ভিতরের ওই বাইরেটুকু যতখানি ঝাপসা হয়ে আসে, গভীর ঘরে ততই নিবিড় হয়ে আসে আমার আজন্মকালীন দুঃখরাত। যে রাতের একমাত্র সঙ্গী বাঁশিখানি সেদিন শুনতে পেয়েছিলুম। শুনতে পাই। ঝাপসা চাঁদের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সুরের গর্জন। যেন অন্ধ হয়ে যাই, পিষ্ট হয়ে যাই, রিক্ত হয়ে বেঁচে উঠি। হে আমার দুঃখরাতের চাঁদ, আমায় নাও। আমার ভিতরে অন্তিম সুর হয়ে বেজে ওঠো, বাজতেই থাকো।
আমি অধম, আমায় গ্রহণ কর, আমি আর্ত, আমায় গ্রহণ কর, আমি দীন, আমায় গ্রহণ কর।…
কিন্তু আমার এই অবিরাম প্রার্থনার মাঝে হঠাৎই দেখলাম তোমার মুখখানি কেমন মলিন হয়ে যাচ্ছে, সংসার-তাপে, দূরে চলে যাচ্ছে তোমার মুখছবি। তবে যে শুনেছিলাম সব চলে গেলে, সবকিছু বিসর্জন হয়ে গেলে তুমি আসো? তবে কি আমার সব কিছু বিসর্জন হয়নি? কিছু বাকি থেকে গেছে? কিছু দেনা, কিছু পাওনা? আমারই অজান্তে? হে আমার নিশিদিনের গৌরব, তোমাকে তাই এখনো কি সম্পূর্ণ পাচ্ছি না? এখনো বাকি আছে পথ? এখনো সমাজ-সংসারের আবিল রেখার বেড়াজাল আটকাচ্ছে আমাকে? আজ বুঝলাম। এভাবে নয়, মাটির এই পৃথিবী প্রস্তুত নয় আমাদের আবেগের জন্য। জীবন, মানুষ, বাস্তব নামের বিভিন্ন প্রহেলিকা বারবার আচ্ছন্ন করবে আমাদের হৃদয়–পদ্মরাগ। আমি জানি না অনুপ আজ কেমন আছে, বেঁচে আছে কিনা। তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন রাগের মাথায় যেভাবে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম, তাতে মাথা আর শিরদাঁড়ায় গুরুতর চোট পাবার কথা। কিন্তু না। আমার জন্য তোমাকে কিছুতেই আইনি জটিলতায় আবার নতুন করে পড়তে দেব না। তাই আমি যাচ্ছি, সেখানে, যেখানে গেলে আর কখনো হারাতে হবে না তোমায়। পুণ্যসলিলা যে সুর ছুঁয়েছিল কবি লাল্লাকে, রুমিকে, কবীরকে, মীরাকে, সেই সুরে মিশে যাব আমিও। যে অনন্যোপায় স্রোতে ভেসে এসেছিলাম তোমার অচিনঘরে, সেখানেই চলে যাব, চিরকালের মত। যেখানকার হাওয়ায় আজও ভাসছে আমাকে প্রথম দেখার পর তোমার বিস্ময়মুখ, যেখানকার মাটিতে রয়েছে তোমার পায়ের ছাপ, সেই আমার আনন্দ-কালিন্দী, আমার হৃদ-যমুনা, আমার চিৎ-চন্দন।
এ বিদায় নয়, নতুন করে পাওয়া, হে আমার আজীবনের একমাত্র সর্বনাম।
তোমার চিরকালের অনুরাগিণী
লাবণ্য

Leave a Reply