শম্পা রায়

শম্পা রায়

প্রিয় বন্ধু,
    আজ অনেকদিন পর আবার চিঠি লিখতে বসলাম ৷জানিনা কিভাবে শুরু করব৷ শুধু জানি রোজকার চেনা মুখের ভিড়ে, মেকি সম্পরক গুলোর ওপারে এক অচেনা মানুষকে, বন্ধু করে নেওয়ার অছিলায়ে এ চিঠি লিখতে বসার আয়োজন।বন্ধু শব্দটা খুব ছোট্ট।যেন মনে হয় ইচ্ছা করলেই তাকে হাতের মুঠোয়ে দিব্বি ধরে ফেলা যায়।আসলে কিন্তু এই যান্ত্রিক স্বার্থপরতার যুগে বন্ধুকে হাতের মুঠোয় কেন চলার পথে পাশে পাওয়াই দুস্কর।বন্ধু আসলে এক মুঠো রোদ্দুর মেঘলা আকাশের ফাঁকে ।বন্ধু আসলে এক চিলতে খুশির হাওয়া একলা ঘরের কোণে।এ হল সেই সুর যার ছোঁয়ায় সঙ্গীত পায় তার প্রাণ।কততো মানুষ দেখলাম , তাও কেন জানিনা মনে হয় সেই বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া আজও হলনা।মনে হয় একটা যুগ পার করে এসেছি। এই ব্যস্ততার ভিড়ে, ফেসবুক কিম্বা হোয়াটস্অ্যাপের নকল কথাদের স্তূপে কোথায় যেন আমার মনের অনুভূতিগুলো চাপা পড়ে গেছে।আজ লিখতে বসে বার বার মনে পড়ছে এক সময় কত না চিঠি লিখতাম আমার দূরের সেই অনেক দিনের অদেখা বন্ধু মানুষটাকে।তখন রোজগারহীন ছাত্রজীবণে চিঠিটাই ছিল সবচেয়ে সস্তা পথ মনের মানুষের কাছে পৌঁছানোর। কত কথা ,কত ব্যাথা, সুখ-দুঃখ-অভিমানে ভরা সেই চিঠি সামান্য এগারো টাকার বিনিময়ে ডাক পিওনের হাত ধরে পৌঁছে যেত মনের মানুষের ঠিকানায়। তারপর কত কাল কেটে গেছে আর চিঠি লেখা হয়েনি। সেই বন্ধুও বদলে নিয়েছে তার ঠিকানা। তারপর পেরিয়েছে সময় নদীর মত। কত মুখই না উঁকি দিয়েছে এ মনের জানলায়ে। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে আমাদের ভাবনা, আমাদের ভালোলাগা আর চেনা বন্ধুর মুখ। আজ আর চিঠি নয়, মুঠো ফোনেই কোনরকমে কাজ সারা।এখন জং ধরেছে আমার হাতের কলমে , জং ধরেছে আমার মনের কোণে। তাই এত দিন পর কেমন যেন অদ্ভুত বাঁধা বার বার ঘিরে ধরছে আমার ভাবনাকে , কলমকে। মন বলতে চাইছে অনেক কিছু, কিন্তু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। হৃদয়ের গভীরে বইছে এক চোরা স্রোত , কখনও সেখানে উঁকি দিচ্ছে কিছু অভিমানী ব্যাথা , নয়তো খুনসুটি ভরা আমার শৈশব ।  মনের স্মৃতিতে ভাসছে কিছু ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া অতীতের ক্যানভাস। তাদের ধূসর হাতছানি মনে করিয়ে দিচ্ছে  জীবনের অনেকটা সময় পার করে এসেছি , আমার আমিকে ভুলে। সেই বোকা – বোকা , আবেগপ্রবণ আমিকে আজ খুব ইচ্ছে করছে  এই চিঠিতে মেলে ধরতে। খুব ইচ্ছে করছে যেন এত দিনের  য্ত্ন করে গোপনে আগলে রাখা ভাবনাগুলকে উডিয়ে দিতে এই চিঠির পাতায়ে পাতায়ে – ঠিক যেন বর্ণময় প্রজাপতির মত।কিম্বা ধরো শরতের জলহারা ধীর লয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেদের মত।মেঘমেদুর আকাশে , শ্রাবণের ধারাপাতে আর সবুজ পাতার দোলাতে কেমন যেন নেশা জাগছে মনে। এ মন চাইছে থমকে যাক সবকিছু , শুধু জেগে থাক আকাশের একলা চাঁদ আর নির্বাক তারারা।হাসনুহানার গন্ধ মেখে একটু একটু করে সজীব হয়ে উঠুক এক নির্ভেজাল বন্ধু্ত্ব।   যেখানে চাওয়া নেই,পাওয়া নেই, নেই কোন দাবী। আছে শুধু চিরন্তন গণ্ডীর ওপারে আমার আমিকে তোমার তুমিতে উজার করে দেওয়ার এক ক্ষুদ্র আয়োজন ।না হয়ে তুমি ভাবলে আমি একটা আস্ত পাগোল কিম্বা খামখেয়ালি মানুষ ।তবুওতো সেই আগের মত এ চিঠি একদিন তোমার কাছে পৌঁছাবে। তবে ডাকপিয়নের হাত ধরে নয়ে, প্রযুক্তির চোরা গলি বেয়ে। আর যদি এ চিঠি পরে ভালো না লাগে তবে উডিয়ে দিও তোমার খোলা জানলা দিয়ে মেঘেদের দেশে।যখন কোন উত্তর আসবে না তখন আমি আমার কল্পনার চোখে দেখবো আমার এই চিঠি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে উড়ে চলেছে ঠিকানাহীন কোন এক পথে। কিম্বা এই শ্রাবণের ধারায় ভিজে আমার সব ভাবনাগুলকে মিশিয়ে দিয়েছে সে ।শ্রাবণের মেঘে মেঘে ভরে দিয়েছে আমার গোপন অশ্রুজল। কিম্বা তোমার ফিরানো এ চিঠি  হয়তো পরম  আদরে তুলে নেবে বিকেলের গোধূলীমাখা বাতাস।সে যাই হোক, তাই বা কম কি? আর যদি সাড়া দাও বন্ধুর মত তবে জানব তুমিও আমার মতই ভাব।আমার তো মনে হয়ে যারা চেনা গণ্ডীর বাইরে জগৎটাকে দেখে তারা সবাই পাগোল। তাই আজ মনের অবাধ্য ভাবনাগুলকে নাই বা বাঁধলাম যুক্তির বেড়াজালে। তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই। লাভও কিছু নেই। তুমি কি জানো আজও আমি গভীর রাতে তারাদের আলো মাখি, শিশির ভেজা ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে কাছের মানুষের খোঁজ করি। সন্ধ্যা ঘনালে সিঁদুর রাঙানো আকাশে আর ঘরে ফেরা পাখিদের পাখায়ে নিজের মনকে ওড়াই ঠিক যেন  ঘুড়ির মত।গঙ্গার জল ছুঁয়ে যাওয়া প্রিস্নেপঘাটে বিদায়ী সূর্যের রূপোলী আলোর খালায়ে স্বপনের জাল বুনি। আমার অদেখা তুমি  যদি সত্যি আমার মত ভাবতে পার তাহলে জানতে পারবে এই সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক সৃষ্টির ছন্দ। লুকিয়ে আছে এক সুন্দর  আনুভুতি যা রোজকার ব্যস্ততার ভিড়ে, স্বার্থপর সামাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে কথাও হারিয়ে গেছে। সেই আমার আমিকে আজ এই চিঠির প্রতিটা বর্ণে গেঁথে দিতে চেয়েছি। সেই আমার আমিকে ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি তোমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা তোমার তুমি কে। নদীর বুকে যেমন ঢেউ জাগে , কিম্বা শ্রাবণের ধারা হঠাৎ করে ভিজিয়ে দায়ে পথচলতি মানুষকে , কিম্বা ধরো যখন এলোমেলো হাওয়া হঠাৎ করেই কুঁড়িয়ে নেয় শীতের ঝরে যাওয়া শুকনো পাতাকে – কোন নিয়ম না মেনেই , তেমনই কোন নিয়ম ছাড়া আজ মন চাইছে মাততে সৃষ্টিছাড়া আনন্দে। আমি জানিনা এ চিঠি তোমার মনের দারজায়ে কড়া নাড়বে কিনা, তবে যদি শেষ পর্যন্ত তোমার মনে পৌছাতে পারি তবে আর দেরি করনা। বন্ধু হয়ে চলে এসো। কবির মত বলব না চলে এসো শিউলি বিছানো পথ বেয়ে শরতের হাত ধরে। তুলে নিও তোমার হাতের কলমখানি, আর ভরে তুলো তোমার সাদা পাতাকে মনের গভীরের না বলা কথা দিয়ে। এই কলম আর খাতার পাতাই তখন গড়ে তুলবে দুই বন্ধুর মধ্যে অন্তহীন নির্মল রাতের আকাশের মাঝে বন্ধুত্বের ছায়াপথ। আমরা তো সবাই দেখেছি দিগন্তের পার ধরে মাটি আর আকাশকে মিশে যেতে , কি সুন্দর না! কতও দুরের দুই বন্ধু , মাঝখানে বিস্তর বাঁধা, তবুও তারা কেমন মিলে গেছে প্রকৃতির খেয়ালে।তুমি কি শুনেছ তারা কি কথা বলে? আমি যখনই দিগন্তর পানে চাই  চুপটি করে  উপলব্ধি করার চেষ্টা করি তাদের নির্বাক ভাষাকে। আর এক বন্ধুর কথা শোনাই তোমায়ে।সাগর আর বেলাভুমির কথা।সাগর কেমন বার বার তার ফেনিল ঢেউ দিয়ে ছুঁতে চায়ে বেলাভুমিকে।আর সেও সেই ফেনিল জলে ভিজে আলতো সোহাগ জাগায়ে সাগরের বুকে।আমি সেই বালুকাবেলায়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি কেমন তারা হাত ধরে পারি দিয়েছে বহু দূর।ওদের দেখে খুব হিংসা হয়।আসলে এই ইট-কাঠ প্রাচীরে মোড়া শহরে টাকা দিয়ে আর যাই কেনা যাক না কেন মনের সুখ আর সত্যিকারের বন্ধু কেনা যায়ে না। প্রতিদিন এ শহর , এ শহরের মানুষজন নিজেদের ফ্রাশট্রেশন আর একাকিত্বকে বেচে বেঁচে আছে। এ নিয়মের যারা বাতিক্রম তারাই আমার মত নিতান্ত অকেজ বেমানান এ শহরের ভিড়ে। তাইতো চিঠির পাতা পড়ে আছে খালি। খাম , ডাকটিকিট আর কলমের সাথে মানুষের আজ আড়ি।আজ খুব মনে পড়ছে সেরিন , ছিত্রনিভাদের কথা ।ছোট্টবেলাকার সেই বন্ধুরা কোথায়ে হারিয়ে গেছে এই শহরের ভিড়ে।আজ বড় অভিমান হচ্ছে যেন , ওরাও  তো পারতো দু কলম লিখতে আমাকে।স্কুলের গণ্ডী পেরনোর সাথে সাথে ওরাও যেন কোথায়ে হারিয়ে গেল।বড়ো কষ্ট হয়ে সে সব কথা ভাবলে। তাই আজ আর আশা রাখি না।হয়তো তোমারও মনে পড়বে এমন কোন কথা। হয়তো নয়। তবে যাই হোক  না কেন আমি কখনই তমায়ে বলবো না  আমার মত ভাবতে। আগেই বলেছি এই বন্ধুত্বের মধ্যে কনো দাবি, কোন নিয়ম আনতে চাইনা। চাই শুধুই বন্ধু হতে।তোমার আমার মাঝে থাকনা হাজারো ব্যবধান, হাজারো মতের অমিল, তবুও কি আমরা বন্ধু হতে পারিনা এই আকাশ আর মাটির মত নয়েত সাগর আর বে্লাভুমির মত? তোমার আমার মনের কথারা চাইলেই কি উঁকি দিতে পারে না এই চিঠির থরে থরে সাজান ভাষার মধ্যে।একটার পর একটা ফুল গেঁথে যেমন হয় মালা, শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে বাক্য, ঠিক তেমনি বাক্যর সাথে ভাবনা মিশে তৈরী হয় চিঠি। চিঠির আর এক নাম পত্র।গাছের সবুজ পাতার নামও তো পত্র। এই দুটির মধ্যেই রয়েছে অসীমকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা। ভাবজো বুঝি এসব কি বলছি! তুমি কি জাননা যে একটা চিঠির পাতায়ে ভরে ফেলা যায়ে অনেক প্রেম ,ভালবাসা, অনেক ব্যাথা, অনেক ভাবনা,আর রাশি রাশি আনন্দ।জ্বালিয়ে তোলা যায় আশাহীন মানুষের বুকে আশার আলো।আর গাছের সবুজ পাতা সেওতো সূর্যের প্রাণ শক্তিকে মিশিয়ে নিচ্ছে আপন ক্ষুদ্র কোষে।সেই প্রাণ শক্তিই তো সাঞ্চারিত হচ্ছে জীবণী শক্তিরূপে আমাদের মধ্যে।আজ লিখতে বসে মনে পড়ছে শুভমিতার সেই গান- যদি বন্ধু হও বাড়াও হাত।তাই যদি বন্ধু হও বাড়িও হাত, খুঁজে নিও বন্ধুত্বের সেই ছায়াপাথ। শরতের মুক্ত আকাশ , ধানের শিষে খেলা করা সোনালী আলো, বৃষ্টি ওড়ানো দমকা বাতাস আর সোঁদা মাটির গন্ধ মিশিয়ে লিখব তখন চিঠি তোমার ঠিকানায়।
 
         ভালো থেকো বন্ধু। সুস্থ থেকো । বাঁচিয়ে রেখো নিজের মনের বেহিসাবী একেবারেই অবাধ্য ভাবনাগুলোকে।আকাশের  ছায়াপথের দিকে চেয়ে  আমি থাকব তোমার প্রতীক্ষায়ে ।তোমার জন্য রইল আমার এক রাশ পাগলামো, অন্তরের নিখাদ ভালোবাসা, বর্ষার জলে ভেজা জুঁই ফুলের গন্ধ মাখা অনেকটা বন্ধুত্ব।
                ইতি-
           তোমার বন্ধু           

Leave a Reply