শম্পা চক্রবর্তী

শম্পা চক্রবর্তী

প্রিয় পাঠক বর্গ
              আমি সাবর্ণী সেন; আমি যদি আমার জীবন চরিত লিখতাম -তবে হলফ করে বলতে পারতাম ,আমায় পাবেনা কেউ আমার জীবন চরিতে। তাই পাঠকের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আমার স্বীকারোক্তি স্বরূপ এই চিঠি লিখে জানান দিলাম।মফস্বলের মেয়ে ছিলাম :ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছিলাম অত্যন্ত সুন্দরী আমি, কৈশোরে অবতীর্ণ হয়ে আমি নিজের সৌন্দর্যে মোহিত ছিলাম। মনে হতো, আমি যেন একখন্ড হীরা;আমি হাঁটলে যেন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আমার উজ্জ্বলতা;সেই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যেত ভ্রমর রূপী স্তাবক বৃন্দের। বিধাতা যখন তাঁর অবসরে আমায় এত সুন্দর করে নির্মাণ করেছেন তখন তাঁর সৃষ্টি কে মর্যাদা দেওয়া আমার জীবনের আশু কর্তব্য বলে মনে হলো । একটু আধটু লেখার নেশা ছিল আমার ;খুব ইচ্ছা ছিল আমি প্রথিতযশা সাহিত্যিক হব! লাইমলাইটে বিচরণ করব;তাই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ;থিতু হলাম কলকাতায়। জোগাড় করতে শুরু করলাম বিখ্যাত লেখক দের ঠিকানা ও ফোন নম্বর, অবশেষে টোপ গিললেন আমার সাহিত্যাকাশে অবতীর্ণ হবার ল্যাডার প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলু বাবু;না না এটি ওনার শুভ নাম নয়, ওনার কৃতিত্ব ওনাকে এই নাম নিতে বাধ্য করেছে মেয়ে মহলে । সে যাক,যার চরিত্র যত বেশি দুর্বল সেখানে আমার তত বেশী প্রবেশ। এভাবেই খুব তাড়াতাড়ি আমি প্রবেশ করতে পারলাম ওনার শয়নকক্ষে, ম্যাম ধরে নিলেন এটি বুঝি আমাদের প্রেম; তখন তো আলু বাবু আমায় চোখে হারাতেন।বুঝতে পেরেছিলাম নেশার ঘোর তাজা থাকতেই আমার কাজ সম্পন্ন করতে হবে:তাইতো অবলীলায় আলু বাবুর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি গুলি কে নিজের নাম দিয়ে পাঠাতে লাগলাম বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা তে। লেখার শৈলী দেখে কোনো কোনো প্রকাশনার সন্দেহ হয়েছিল হয়তো, কিন্তু তখন আমার শরীরের নেশায় মাতাল আলু বাবু সেই লেখা গুলো যে আমারই কল্পনা প্রসূত তা প্রেস কনফারেন্সে জানিয়ে দিলেন। ব্যাস আমায় পায় কে? কিছুদিনের মধ্যেই উঠতি লেখিকা রূপে সাবর্ণী সেন বিরাজ করতে লাগলেন বঙ্গ সাহিত্যের অঙ্গনে। 
                     প্রিয় স্বামীর ব্যভিচার সহ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ম্যামের;স্বামী কে সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র রূপে দেখার জন্য ম্যামের জীবন যুদ্ধে স্ট্রাগল করার কথা এখনো প্রচলিত আছে বই পাড়ায়। তাই একদিন পার্টি তে উদ্দাম ফূর্তি করে বেসামাল অবস্থায় স্যারের বাড়ি ফিরে দেখি ম্যাম ডিভোর্স নোটিশ ধরিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। ব্যাস, পথের কাঁটা দূরে গেল এখন আমায় পায় কে? অন্তর থেকে কেউ বলে উঠলো “কুইক সাবর্ণী সেন কুইক”;স্যার কে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে লিখিয়ে নিতে থাকলাম একের পর এক সৃষ্টি সুখের উল্লাস। আর তত আমি উঠতে থাকলাম ঊর্ধ্বাকাশে;নিন্দুকেরা প্রচার করতে লাগল-লেখা গুলো একপেশে হয়ে যাচ্ছে; নতুন কিছু বেরিয়ে আসতে পারছে না। আমি ভাবলাম তাই তো, শুধু কড়কড়ে যৌবন দৃশ্য বর্ণনার জন্য উপন্যাস গুলো একপেশে হয়ে যাচ্ছে:এভাবে চলতে থাকলে তো আমি অমর হতে পারবনা! তবে? আবার অন্তর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম “হেথা নয় হেথা নয়, অন্য ঘাটে নোঙর বাঁধ, এ বন্দরের কেনা বেচা হলো শেষ। “
                 পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্যার কে বললাম, বাড়ি থেকে ঘুরে আসি;বিয়ের ব্যাপারে জানান দেব যে। আলু বাবু তো আনন্দে আত্মহারা;তিনি ও যেতে চান সাথে। বোঝালাম,সেলিব্রিটি গাছে ধরে না;এভাবে মফস্বল অঞ্চলে গেলে ইমেজ নষ্ট হবার সম্ভাবনা। আগে সব ঠিক করে আসি – জামাই বলে কথা, যেতে তো হবেই। ওহ্ আলু বাবুর মুখের জিওগ্রাফি দেখার মতো ছিল! সিম টি চেঞ্জ করে ফেলে এবার আরো বড়ো সিঁড়ির খোঁজ করতে লাগলাম;ইতিমধ্যে কেটে গেছে কয়েকটি মাস , বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেলাম- আলু বাবুর হাড়ির ললাট ডোমের দুর্গতি ঘটেছে আমার অভাবে;অন্তর থেকে আবার কেউ বলে উঠলো “নদী চলতে চলতে যেখানে বাঁক ফেরে সেখানে আসে টুইস্ট, তুমি চরৈবেতি ব্রত নিয়েছ ফিরে তাকিও না। নতুন উদ্যমে বড়ো শিকার অনুসন্ধান কর।”
               হঠাৎই শুনলাম, আলু বাবুর হৃদযন্ত্রের গন্ডগোল ঘটেছে ;নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে বললাম-“সাবাস সাবর্ণী সেন :তোমার বিরহ এতটাই হৃদয় বিদারক! প্রায় বৃদ্ধ লম্পট আলু বাবুর হৃদয়ে তা ভাঙন ধরিয়ে দিলে? ‘
                 আমার জন্য চমক আরো বাকি ছিল;শুনলাম- মৃত্যু শয্যায় আলু বাবুর অবচেতন মন সৃষ্টি করে চলেছে অপূর্ব সৃষ্টি সম্ভার, সেক্রেটারি মনোজ সেগুলো পাবলিকলি আনতেই সেগুলো হট কেকের মতো বিকোচ্ছে;না এমন সুযোগ তো হাতছাড়া করা যায় না। আবার ভেক ধরতে হবে আমাকে;চোখে মুখে কুম্ভীরাশ্রু এনে চললাম আবার শিকারের জন্য। ওফ্ আলু বাবুর বাড়ির সামনে এতো মিডিয়া কেন? যাকগে,অ্যাক্টিং করতে হবে;লাইমলাইটে আসার এইতো সুযোগ! মড়া হাতি লাখ টাকা বলে কথা! 
         “আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামনে থেকে সাহিত্যের আকাশের অন্যতম নক্ষত্র সাবর্ণী সেন হেঁটে আসছেন” বাইট দিল বিখ্যাত টি ভি চ্যানেলের সাংবাদিক;”ম্যাম, সাবর্ণী ম্যাম একটু এদিকে “
              নিজেকে লাইমলাইটে আনার লোভ বড়ো লোভ, সানগ্লাস লাগিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলাম ক্যামেরার সামনে-“ম্যাম, শোনা যাচ্ছে আপনার জন্য ই নাকি স্যারের এমন অবস্থা! এই বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে? “
              না না, আমি কিছু দিন একান্তে থাকতে চেয়েছিলাম নতুন সৃষ্টির জন্য; এরমধ্যে এমন অবস্থা! আমি তো ভাবতেই পারছিনা। অশ্রু বেগ কোনো রকমে সংবরণ করে আমি ক্যামেরার সামনে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেলাম। স্যারের ঘরে গিয়ে দেখি, মনোজ স্যারের সৃষ্টি স্রোত কে ধরে রাখছে ল্যাপটপের মধ্যে; না, এবার কায়দা করে সরাতে হবে মনোজ কে। 
           এ একি দশা হয়েছে স্যারের, আমি তো কিছুই জানিনা! মনোজ দা, তুমি সরো আমি স্যার কে দেখছি। জোর করে মনোজ দা কে সরিয়ে দরজা বন্ধ করে আমি নামলাম আমার ভূমিকা পালন করতে। স্যারের সৃষ্টি স্রোত এবার ধরা পড়তে লাগল আমার ট্যাবে;রাত হলে মনোজ দা আমায় তাড়া দিল রেস্ট করার জন্য। আর রেস্ট? যে সোনার খনি সৃষ্টি হয়ে চলেছে, তার কাছে রেস্ট নেওয়া অতি নগন্য। ভোর রাতে স্যারের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার আগেই কেল্লাফতে;সৃষ্টি হল একটি সুন্দর উপন্যাসের, একটু ঘষামাজা করলেই এটি যে একটি যুগান্তকারী উপন্যাস হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ট্যাব টাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে;বাইরে অপেক্ষমাণ জনতার সামনে আবার কুম্ভীরাশ্রু এনে দুঃসংবাদ টি বেশ নাটক করে প্রচার করলাম। 
                 স্যারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলে আমি ফিরে গেলাম নিজের জায়গায়, এখন আশুলক্ষ্য
হলো উপন্যাস টিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। পাবলিশারের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পান্ডুলিপির হস্তান্তর করলাম। তাগাদা দিয়ে বারবার প্রকাশ কাল এগিয়ে আনতে চাইছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে বই প্রকাশ হল, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সই শিকারী দের মনোবাসনা পূরণ করে , হাসিমুখে সেলফি তোলার অনুমতি দিলাম। এবার রিভিউ করার জন্য একজন সাংবাদিক বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখেন, তাতে শুধু সাদা পাতা;কোনো অক্ষর ছাপা হয়নি সেখানে :পাবলিশার ভদ্রলোক শশব্যস্ত হয়ে বলেন তবে হয়তো প্রিন্টিং মিসটেক অন্য কপি তাঁকে দেওয়া হল; অবাক কান্ড সেই কপি টিরও একই অবস্থা। সাংবাদিক ভদ্রলোকের বই টির অবস্থা দেখে আর যাঁরা বই কিনেছিলেন তাঁরাও তাঁদের বই গুলো খুলে দেখেন এক অবস্থা;কারো বই তেই ছাপা অক্ষর নেই শুধু মাত্র সাদা পাতার সমাহার। সব বই ফেরত পাঠানো হলো;আবার পাবলিশার বই ছাপলেন আবার সাদা পাতা এল। প্রিন্টিং মেশিনে গন্ডগোল মনে করে অন্য মেশিনে ছাপলেও এক ধরনের ঘটনাই ঘটল। চুক্তি ভঙ্গ করে এবার অন্য পাবলিশার ধরলাম, সেখানেও এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।কি ঘটনা ঘটেছে বুঝতে পারছি না;সমস্ত মান সম্মান ধূলায় মিশেছে জমানো টাকাও শেষ এই এক  বই প্রকাশ করতে গিয়ে। কি ঘটছে বুঝতে না পেরে  মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম; আবার আমার অন্তর বলে উঠলো “এই বার এইবার কিবা করে লেখিকা ম্যাডাম;সব তো স্যারের কপি পেস্ট, নিজের থেকে তো আর কিছু বেরিয়ে আসে না”। একরাশ হতাশা নিয়ে মিডিয়ার মুখরোচক গরম গরম বাইটের সম্মুখীন হয়ে আপন করে নিলাম ঘুমের ওষুধ গুলোকে। গভীর ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে দিতে প্রত্যক্ষ করলাম স্যারের হাসিমুখ, ” এসো প্রিয়া, আলিঙ্গন করি তোমায়; আমার মৃত্যুর পরে ও আমার উপন্যাস তুমি নিজের নাম দিয়ে ছাপবে সেটি সহ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল আমার ;তাইতো ছাপাখানার ভূত হয়ে  আমার সব লেখা উড়িয়ে দিলাম! ভালো করিনি বলো? 
           পুনশ্চ:বঙ্গদেশের পাঠক সমাজ মাপ করবেন প্লিজ; আমি আমার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিলাম, ফাঁকি দিয়ে মিথ্যাচার করে বড়ো হওয়ার কোনো উপায় নেই। সাফল্য শর্টকাট বোঝেনা। 
      ইতি
  সাবর্ণী সেন

Leave a Reply