রিনা রায়

সাতাশটি পরিবার

রিনা রায়

বস্তিটা রাতারাতি পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। সাতাশটি পরিবারের ষাট জন মানুষের আশ্রয়স্থল এক রাতেই শ্মশানে পরিণত হল।
পুলিশের রিপোর্টে জানা গেলো নারী, পুরুষ শিশু মিলিয়ে চোদ্দো জন ঘুমন্ত অবস্হায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে, উনত্রিশজন আশংকাজনক অবস্হায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। যারা কোনোক্রমে বেরোতে পেরেছিলো ছোটোখাটো আঘাত ছাড়া তারা প্রাণে বেঁচে গেছে আর সেদিন যারা বস্তির বাইরে ছিলো তারা প্রাণে বেঁচেছে।
মফঃস্বলের এই ছোট শহরটায় এটি বেশ চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করলো।
পরদিন সকালে অনিমেষ বাগচিকে একটি অ্যাটাচি হাতে থানার দিকে যেতে দেখা গেল। থানা থেকে তিনি যখন বেরোলেন, খালি হাতেই বেরোলেন। যারা দেখলেন তারা বুঝলেন তদন্তের ফলাফল এখুনি লেখা হয়ে গেলো।
 
নন্দিনী যখন খবরটা শুনলো তার মাথায় হাত পড়লো, আজ অফিসে না গেলেই নয়, প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা দেবার আগে সুমন্তর সাথে আজকের মিটিংটা খুব জরুরী। 
এদিকে, মিঠাই এর জ্বর।
লক্ষ্মীর হাতে সব ছেড়ে দিয়ে ও কেমন নিশ্চিন্ত থাকতো, লক্ষ্মীটা এখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। তার খুব খারাপ লাগছিলো, বুঝতে পারছিলো এইসময় তার নিজের লক্ষ্মীর পাশে দাঁড়ানো উচিত, কিন্তু…
 
সেঁজুতির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আজ বাড়ীতে এতজন আসবে,নতুন ফ্ল্যাটটা নেওয়ার পর থেকেই স্কুলের কলিগরা খাওয়াতে বলতেন, সেই উপলক্ষ্যে স্কুলের দশজন দিদি ও মাস্টারমশাইকে আজ দুপুরে সে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। এদিকে ছেলের স্কুলে আজকেই পেরেণ্ট-টিচার মিটিং। শুভ ইদনীং পড়াশোনায় বেশ অমনোযোগী হয়ে উঠেছে, ফিজিক্স মিস্ নিজে ফোন করে তাকে দেখা করতে বলেছেন। 
যুথিকা কী সুন্দর সব সামলে দিতো, এখন সে কী করবে, কোনদিক সামলাবে বুঝে উঠতে পারছে না। যুথিকা তো চিরদিনের জন্য চলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি সে কাকেই বা পাবে, তাছাড়া শুনেছে গোটা বস্তিটাই নাকি পুড়ে ছাই, কাজের লোক তো কাছাকাছি ওখান থেকেই পেত…
 
নিঃসন্তান সুলেখাদেবী সকালে চা খেতে খেতে ভাবতে বসলেন, তার এই তিনতলা বাড়ীর আটটা ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ছাড়াও বাড়ীর যাবতীয় কাজ চাঁপারানী একাই করতো, কিছুতেই আর একটা কাজের লোক রাখতে দেয়নি, এমনকি মাঝে মাঝে মালতী না এলে রান্নাটাও করে দিতো। যদিও মাইনেটা বেশ ভালোই পেত, কিন্তু 
অমন বিশ্বাসী আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজের লোক কী আর পাবে! মালতী ঐ বস্তিতে থাকতো না, ও একটু দূর থেকে বাসে করে আসে, ও হয়তো একটু পরেই চলে আসবে, কিন্তু চাঁপারানীর এত কাজ কে করবে?  ইসস্ আজ তো তার পার্লারে যাবার কথা, অ্যাপয়েণ্টমেন্ট নেওয়া আছে, স্নিগ্ধার বুটিকেও একবার যাবার ইচ্ছে ছিল —
কাল স্নিগ্ধা ফোন করে বললো দারুণ সব কালেকশন্ এসেছে, একবার যেন যাই। তার আগে যদি মিসেস সান্যাল ওখানে পৌঁছে যান—
উফফফ্ আর ভাবতে পারলেন না তিনি
তার খুব রাগ হচ্ছিল চাঁপারানীর উপর! তুই তো অন্য কোনো বস্তিতে ঘর নিতে পারতিস–
তার স্বামী অনিমেষ বাগচির ওপরেও তার রাগ হচ্ছিলো। তিনি স্বামীকে বললেন, আচ্ছা, তুমি তো অন্য কোনো বস্তি বেছে নিতে পারতে!
অনিমেষ মনে মনে ভাবলেন–এই জায়গাটার যা দাম পাবো সেটা কি অন্য কোথাও  পেতাম! জমির মালিক রমেশবাবুকে সে কবেই টাকা দিয়ে রেখেছে— 
ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে গেলেই মুখে বললেন, চুপ করো, এসব কথা এত জোরে বলতে নেই।
 
শুধু ছটফটে তরুণী সাংবাদিক সুপর্ণা খবরটা শুনেই ছুটে গেছিলো। আশেপাশে যাকে পেরেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, যারা বেঁচেছিলো তাদের আশ্বাস দিয়েছে যে,
সে তাদের পাশে আছে,  সবরকমভাবে সে সাহায্য করার চেষ্টা করবে।  হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে প্রত্যেকর ব্যাপারে খোঁজ নিলো। থানায় গিয়ে বড়বাবুর সাথে কথা বলে তদন্তে সে কোনভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা জানতে চাইলো…
 
লোক মারফৎ খবরটা  অনিমেষ বাগচির কানে পৌঁছে গেল।
 
কয়েকদিন পর সুপর্ণা যখন তার স্কুটিটা চালিয়ে বাড়ী ফিরছিলো, একটা ট্রাককে বেপরোয়াভাবে অনেকেই ছুটে আসতে দেখেছিলো। ট্রাকটিকে ধরা যায়নি, তাতে ভুল নাম্বার প্লেট লাগানো ছিলো। একমাত্র মেয়ের এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যুতে সুপর্ণার মা বাকরুদ্ধ, পাথর হয়ে গেলেন।  বাবাও কেমন পাগলাটে হয়ে গেলেন
 
কিছু বছর পর ঐ জমিতে একটি অত্যন্ত আধুনিক মালটিস্টোরিড উঠতে দেখা গেল। এখানেও সাতাশটি আধুনিক ডুপ্লেক্স রয়েছে। বাসিন্দারা প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত। এরা কেউ জানেও না কতগুলো মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে তারা প্রতিনিয়ত শ্বাস নিয়ে চলেছে! কতগুলো স্বপ্নকে হত্যা করে তাদের স্বপ্ন গড়ে উঠেছে! 
আশ্চর্যের বিষয়, লক্ষ্মী, জবা, চাঁপাকে এদেরও বড় প্রয়োজন। এখানে এসে প্রত্যেকেই প্রথমে সেই খোঁজটাই করছিলো।

Leave a Reply