রাজর্ষি বর্ধন

হৃদয়ঘটিত

রাজর্ষি বর্ধন

বসন্ত বাতাসে, অবশ্য সেটা  থাকলে তো?  “বাতাস” নামক সূক্ষ্ম, মোলায়ম, ভারহীন বস্তুটির অস্তিত্ব মাঝে-মাঝে অনিশ্চিত মনে হয় এই ৩০২২ সালে দাঁড়িয়ে। হাজার-হাজার বছর আগে বিজ্ঞানীদের করে যাওয়া বাতাসের চরিত্রের সঙ্গে বর্তমানের কোন মিল নেই। এখন পৃথিবীর সব চাইতে জটিল জিনিস বুঝি “বাতাস” ব্যপারটা ব্যাখা করা!  বাতাস, বা বায়ুমণ্ডল  আছে বটে, তবে সেটা একরকম না থাকারই সমান। বিশ্বউষ্ণায়নের যে প্রবল দাপট গত পাঁচশ বছরে বিশ্ববাসি দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে  তাতে এমন পরিণতি ঘটবে সকলেই তা আন্দাজ করে নিয়েছিল আগে থাকতেই! বায়ুমণ্ডল  নামেই রয়ে গেছে, কেবল নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের চাহিদা মেটাবার জন্য, বাকি বৈশিষ্ট্যগুলোর পরিবর্তন ঘটেছে! ঋতুচক্রের ধারণাও পাল্টে গেছে ক্রমে ক্রমে। ‘শরৎ, ‘হেমন্ত’, ‘বসন্ত’ এহেন ঋতুর জায়গা হয়েছে ইতিহাসের পাতাতে! বিজ্ঞানীরা এই ঋতুদের নাম দিয়েছে “ fossilized season“ , অর্থাৎ যেসব ঋতু জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক পশুদের মতো। শুনতে অতিরঞ্জিত হলেও এমনটাই ঘটেছে ! এ যুগের মানুষ ঋতু নিয়ে অতো মাথা ঘামায় না, ঋতু পরিবর্তন নিয়েও তেমন ভাবিত নয় তারা, এমনকি একটা ঋতু থেকে কখন অন্য ঋতু ঢুকে পড়ে সেদিকেও নজর দেওয়ার মতো সময় নেই তাদের এই ব্যস্ত জীবনে! এ যুগে তেমন শিল্প-সাহিত্যও রচনা হয় না, ঋতু পরিবর্তনও তেমন কোন তাৎপর্য বহন করে না কারো কাছে!  
 
তবু বাতাসে বসন্ত লেগেছে বলে কথা! অন্তত বৈশম্পায়ন এই মুহূর্তে তেমনটাই ভাবতে ভালোবাসছে। বসন্তকাল সম্পর্কে সামান্যতম  ধারণা না থাকলেও সে তার চারপাশে প্রবলভাবে বসন্তের  অস্তিত্ব টের পাচ্ছে হঠাৎ করে !  আজ বারোই ফেব্রুয়ারি, ৩০২২, অন্তত ঘড়ির ক্যালেন্ডার তাই বলছে। আজ সকালেই সে দেখেছে তারিখটা। ঘড়ির গায়ের ওপরের সুইচ টিপতেই ঘড়ির গা  থেকে মৃদু আলো বেরিয়ে এসে সন, মাস সহ তারিখটা চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে। দারুণ প্রযুক্তি! এখন কোন সাল, কোন মাস, কত তারিখ এসব জানতে হলে উল্টোদিকের লোককে জিজ্ঞেস করতে হয় না, বা সেল ফোন ঘাঁটতে হয় না, ঘড়ির একটা বোতাম টিপলেই দেখা যায়, এবং তা সর্বত্রই দেখা যায়, অন্ধকার ঘরে, সমুদ্রের গভীরে কিংবা মহাকাশে। সে ক্যালেন্ডারের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না, তবে সে শুনেছে হাজার বছর আগে লোকেদের ঘরে-ঘরে কাগজের ক্যালেন্ডার দেখা যেত, এবং মানুষজন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দিনক্ষণ দেখত। উত্তরপাড়ার বড় মাসির বাড়িতে এরকম কাগজের ক্যালেন্ডার দেখেছে সে। সেগুলো প্রায় হাজার বছরের পুরনো। দু’রকম ক্যালেন্ডার সে দেখেছে, ওয়াল ক্যালেন্ডার আর স্ট্যান্ড ক্যালেন্ডার। বড়মাসির বর্তমান স্বামী যিনি, অর্থাৎ যিনি বৈশম্পায়নের নতুন বড় মেসো, তাঁর পুরনো জিনিস জমাবার শখ আছে, তিনিই এই দু’রকম ক্যালেন্ডার জোগাড় করেছেন অনেক মহার্ঘ্য মূল্যের বিনিময়ে। তাঁর বাড়িতে প্রাগৈতিহাসিক বালির ঘড়িও দেখেছে বৈশম্পায়ন।
 
যাইহোক, পুরনো দিনের কথা ভেবে লাভ নেই, আজ যে বারোই ফেব্রুয়ারি, সেটাই ঘটনা, এবং তা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই!  বারোই ফেব্রুয়ারি মানে বসন্তকালের  সূচনা, অন্তত হাজার বছর আগের পণ্ডিতরা তেমনটাই মনে করতেন, বৈশম্পায়নও আজ তেমনটাই মনে করতে চায়। সে বসন্তকাল কী জিনিস, খায় না মাথায় দেয় তা জানে না।  বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমস্ত ঋতু-টিতু সব মায়ের ভোগে গেছে।  এখন খোদ কলকাতাতেও গরমকালে সাহারা মরুভূমির মতো গরম পড়ে আর শীতকালটা সাইবেরিয়া হয়ে যায়!  আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে, ২৪৮৬ সালে কলকাতায় প্রথম তুষারপাত হয়। ইতিহাস সাক্ষী ছিল দিনটার, সেই থেকে আজও প্রতি শীতে কলকাতার রাস্তা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে!
 
বৈশম্পায়ন  তো আজন্ম শীতের কলকাতাকে বরফে ঢাকা থাকতে দেখে আসছে। খুব ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে প্রতি শীতে কলকাতার ময়দানে যেত। শীতে ময়দান বরফের চাদরে ঢাকা থাকে, সেখানে তারা ভাইবোনেরা মিলে বরফের বল বানিয়ে ছোড়াছুড়ি করত, বা স্নোম্যান বানাত! একটু বড় হতে কলকাতার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নামক সরু খালটা যখন জমে বরফ হয়ে যেত শীতের সময়, সেখানে তারা বন্ধুরা মিলে স্কেটিং করত। শীতকালে কলকাতায় বরফ না পড়াটাই একটা অস্বাভাবিক ব্যপার! বৈশম্পায়ন এটা মনে করে, সবকিছুই যখন পরিবর্তনশীল, তখন আবহাওয়ার ক্ষেত্রেও সেটা ঘটবে না কেন? পৃথিবীর গায়ে যে বাতাসের সূক্ষ্ম চাদরটা আছে, সেটা বহুব্যবহারে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে, যার ফলস্বরূপ আবহাওয়ার এই পরিবর্তন।
 
বসন্তকাল প্রেমের মাস, এমনটাই বলত পুরনো দিনের লোকেরা, অন্তত যতদিন ঋতুটার অস্তিত্ব ছিল। এমনকি বৈশম্পায়ন যতগুলো প্রাচীন সাহিত্য পড়েছে, তাতে বহু জায়গায় বসন্ত ঋতুর সাথে প্রেমে পড়ার একটা ওতপ্রোত সম্পর্কের কথার উল্লেখ পেয়েছে। এই যুগের বাদবাকি তরুণদের মতো গভীর চিন্তা এমনিতেই অপছন্দ তার, তবু এই ব্যাপারটা তাকে অনেক ভাবিয়েছে। প্রেমের সাথে ঋতুচক্রের যে একটা যোগসূত্র থাকতে পারে, এটা তার বৈজ্ঞানিক মন মানতে চায়নি। প্রেম যে যৌনতারই একটা প্রকাশ, হরমোনের খেলা, সেটা ৩০২২  সালে দাঁড়িয়ে বাকি যুবক-যুবতীদের মতোই বিশ্বাস করে সে। প্রেম ব্যপারটা গোটাটাই শরীরী, এখানে মন বা মনস্তত্ত্বের কোন জায়গা নেই, এমনটাই আজন্ম জেনে এসেছে বৈশম্পায়নদের প্রজন্ম। সে নিজেও সেটা সর্বান্তকরণে মানে। প্রেম জিনিসটাকে অতো জটিল করে ভাবতে চায় না বৈশম্পায়ন, যেমনটা হাজার বছর আগে তার পূর্বপুরুষেরা মানত। প্রেম নিয়ে যত পৌরাণিক কাহিনি সে শুনেছে, সে কাল্পনিক হোক কি ঐতিহাসিক, সেখানে বহু জায়গায় প্রেম সংক্রান্ত আত্মবলিদানের কথা সে জানতে পেরেছে, যেগুলো শোনার পর বা জানার পর তার ভারি মজার লেগেছে, এবং কখনো-সখনো প্রবল পরিহাসে সে মুখ টিপে হেসেওছে ! হাজার যুক্তি দিয়েও সে নিজেকে বোঝাতে পারেনি, কেন সে যুগে একজন প্রেমিক নিজের প্রেমিকার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে চাইত, এমনকি নিজের প্রাণটুকুও দিতে প্রস্তুত হতো! প্রেম কি প্রাণের চাইতেও দামী জিনিস? বেঁচে-বর্তে থাকলেই তো কিছু কাজের কাজ করা বা জীবনের মজা নেওয়া সম্ভব?  এই যে সে তার বন্ধুদের নিয়ে এক সপ্তাহ আগে জুপিটারের ইউরোপা উপগ্রহে দুটো দিন কাটিয়ে এলো, বা পাঁচদিন বাদেই তার বন্ধু অয়স্কান্তের বাবার অ্যান্টার্টিকায় যে রিসর্টটা আছে, সেখানে রাত কাটাবার পরিকল্পনা করছে, মরে গেলে সেসব কি করতে পারত? সে উত্তরপাড়ার মাসির বাড়িতে বাদবাকি পুরনো জিনিসের মধ্যে হাজার বছর পুরনো অনেক চিঠিপত্রও দেখেছে, সেখানে কয়েকটা সুইসাইড নোটও পেয়েছিল, হাজার বছর আগে করা আত্মহত্যার জবানবন্দি। সেগুলো পড়ে সে জানতে পেরেছে, প্রেমে ব্যর্থ হয়েও মানুষে একটা সময়ে মানুষে আত্মহত্যা করত ! এসব পড়ে তার যত না খারাপ লেগেছে, অবাক হয়েছে সে চতুর্গুণ ! এগুলো কী ধরনের নির্বুদ্ধিতা? প্রেমেই তো ব্যর্থ হয়েছে, তার বেশি তো কিছু নয় ! নতুন কোন গ্যালাক্সি আবিষ্কার করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া নয় বা ক্যান্সারে আক্রন্ত হয়ে জীবনের শেষ ক’টা দিন গোনার অপেক্ষা নয়,  প্রেমের মতো একটা তুচ্ছ, নগণ্য এবং আদ্যপ্রান্ত শারীরিক অনুভূতির জন্য মৃত্যুবরণ করত প্রাচীন যুগের বাস্তববোধহীন, আবেগপ্রবণ মানুষেরা! বৈশম্পায়ন আরো অবাক হতো, যখন প্রেমিক-প্রেমিকা একে ওপরের জন্য বিরহবোধ করত! এটাকে বেশ  বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে বৈশম্পায়নের। দূরের জিনিস যখন নাগালের বাইরে, তখন হাতের কাছে যেটা আছে, সেটা দিয়েই কাজ চালানো দরকার! শারীরিক চাহিদা মেটানোই যখন প্রেমের মূল উপজীব্য বিষয়, তখন একে ওপরের জন্য কাঁদুনে না গেয়ে সেই জিনিসটা মিটিয়ে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো! তাছাড়া সে যুগেও যখন এসকরট সার্ভিস, জিগোলো সার্ভিস রমরমিয়ে চলত, তখন কেন  সে যুগের মানুষে এতো তুচ্ছ একটা হরমন্যাল ব্যাপার নিয়ে হেঁদিয়ে মরত?  হ্যাঁ, প্রেমকে হরমন্যাল ব্যপারের চাইতে বেশি কিছু ভাবতে পছন্দ করে না বৈশম্পায়ন। এটা ঠিক যে হাজার বছরে বিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন থেকে প্রেম সংক্রান্ত আবেগ, স্নেহ, বাৎসল্য ব্যাপারগুলো কমে গেছে, শারীরিক ব্যপারগুলো প্রবল হয়েছে।  শারীরিক চাহিদা মিটে যাওয়া মানেই প্রেম মিটে যাওয়া। সেই কারণেই তো এখন নিয়ম হয়েছে, কোন দম্পতি, বিবাহিত হোক কী অবিবাহিত, তারা কেউ দুবছরের বেশি সম্পর্কে থাকতে পারবে না। অবশ্য এ নিয়মের একশ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে বহুদিন হল।  যে কোন দম্পতি, সে যে বয়সেরই হোক, সমকামী হোক কী উভকামী, তারা দু’বছরের বেশি সম্পর্কে থাকতে পারবে না। দু’বছর অতিক্রম করলেই সে দম্পতি সমস্ত রকমের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, এমনকি কারাবাসও হতে পারে!   এই যে বৈশম্পায়ন শৈলদুহিতা নামক মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চলেছে, এর মেয়াদও কিন্তু ওই দু’বছরেরই! তবে  চল্লিশ বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কিছু প্রাচীনপন্থি এবং প্রেমের শুদ্ধতায় বিশ্বাসী কিছু মানুষ এ নিয়মের প্রতিবাদ করেছিল। তবে প্রতিবাদে ফল কিছু হয়নি, সামান্য ঝড় তুললেও পরে আস্তে-আস্তে সব স্তিমিত হয়ে গেছিল। তারপর যেই-কী-সেই, দুবছর পর প্রেমিক পাল্টাও!
 
এমনটাই হয়ে আসছে গোটা পৃথিবী জুড়ে, দু’ বছরের বেশি কোন সম্পর্কই টিকছে না। বৈশম্পায়নের মা-বাবা যাঁরা ছিলেন, যাঁরা তাকে জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁরাও আজ সম্পর্কে নেই। এই ছাব্বিশ বছর বয়সে সে বারো জোড়া সৎবাবা ও সৎমায়ের সংস্পর্শে এসেছে! তবে এ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, এ জিনিসটা  তার সমবয়সী প্রায় সব তরুণদের ক্ষেত্রেই ঘটছে। এরকম বলগাহীন নিয়মের  কারণে একবার তো তার মায়ের সঙ্গে তার পিসেমশাইয়ের আর তার বাবার সঙ্গে তার ছোটমাসির বিয়ে হয়েছিল ! অবশ্য শুধু বৈশম্পায়নের ক্ষেত্রেই সেটা হয়নি, পৃথিবীর সব মানুষদের ক্ষেত্রেই এমনটা হচ্ছে !
 
একগুঁয়ে মাছির মতো যাজ্ঞসেনীর মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বৈশম্পায়নের। তার একটা সময়ের প্রেমিকা ছিল যাজ্ঞসেনী। কততম, তা ভুলে গেছে এতদিনে বৈশম্পায়ন, তবে শেষের দিক থেকে দুই কী তিন। তাদের সম্পর্কও ভেঙে গেছিল দু’বছরের আগেই। তবু তাকে কেন বারবার মনে পড়ছে বৈশম্পায়নের? সামনের দেওয়াল জুড়ে  শৈলদুহিতার মোহময়ী ছবি, তার আগামী কয়েকদিনের প্রেমিকা, তবু সে যেন সেই ছবির ওপর মনোনিবেশ করতে পারছে না, যাজ্ঞসেনী বাধা দিচ্ছে! ডেমস, ফোবস বা জুপিটারে গেলে যেমন টাওয়ারে সিগন্যাল আসে না, নেটওয়ার্ক ঘেঁটে যায়, তেমনই শৈলদুহিতার প্রতি তৈরি হওয়া প্রেমের বুদ্বুদটা যেন বারে বারে  এসে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে যাজ্ঞসেনী ! এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে অন্তত পঁচিশজন বান্ধবী হয়েছে বৈশম্পায়নের। সেই পনের বছর বয়স থেকে প্রেম করছে, তবুও তার বয়সী অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় তার স্টাইকরেট একটু নিম্নগামী। তার বন্ধু যাগবল্ক্যের মধ্যে সেঞ্চুরি কমপ্লিট! সে তো মজা করে বৈশম্পায়নকে বলে, “এর থেকে সেলিবেসি প্র্যাক্টিস কর তুই !”
 
যাই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, এতদিনে যে পঁচিশজন বান্ধবী হয়েছে তার, অর্থাৎ পঁচিশবার পার্টনার বদল হয়েছে, কখনও দু’বছরের মেয়াদের আগেই বা কখনও তার মাথায়-মাথায়, কিন্তু কোনবারই নতুন সম্পর্কে যাওয়ার আগে পুরনো প্রেমিকাদের কথা মনে পড়েনি। কমপ্লিট সুইচ ওভার যাকে বলে, সেটাই ঘটেছে প্রত্যেকবার। পুরনোকে ভুলে নতুন চ্যাপ্টারে ঢুকে পড়েছে সে। কিন্তু এবার এমনটা হচ্ছে কেন? পুরনো প্রেমিকা যাজ্ঞসেনীর কথা এমন মনে পড়ছে? এটা কি কোন মানসিক বিকৃতির লক্ষণ? আর মনে পড়ল তো পড়ল, শেষে যাজ্ঞসেনীকে? সেই পুরনো ধ্যান ধারণা রাখা মেয়েটাকে? বৈশম্পায়নের একমাত্র প্রাক্তনি, যে কিনা সহজেই শারীরিক সম্পর্কে যেতে চাইত না। চার দেওয়ালের মধ্যে শারীরিক ক্রিয়া ঘটানোর চেয়ে কোন পাহাড়ের কোলে বা সমুদ্রের ধারে হাত ধরাধরি করে একান্তে সময় কাটাতে চাইত। অসহ্য ! এ যুগে এসব চলে? বৈশম্পায়নের মনে হতো, বিজ্ঞানীরা এখনো টাইম মেশিন আবিষ্কার করতে পারেনি বটে, কিন্তু মেয়েটা নিশ্চয়ই কোন টাইম মেশিনে চেপে হাজার বছর আগে থেকে এসছে, অন্তত তার কথাবার্তায় তা স্পষ্ট !
 
দু’ বছর তো দুরের কথা, দু’ মাসও টেকেনি তাদের সম্পর্কটা। এত প্রিমিটিভ মানসিকতার মেয়ে বৈশম্পায়নের পছন্দ নয়!  যেই  মেয়েকে  মিউজিয়ামে রেখে দাওয়া দরকার, এর সঙ্গে কি প্রেম হয়? যখন তারা সম্পর্কে ছিল, তখন যাজ্ঞসেনী প্রায়ই একটা  কথা বলত- “সাত জন্মের সম্পর্ক!”এটা কী  জিনিস  তা বৈশম্পায়ন সাতদিন ধরে ভেবেও কিছু বের করতে পারেনি! মাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে, কিন্তু মাও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি “সাত জন্মের সম্পর্ক” সম্বন্ধে। পরে সে ইন্টারনেট থেকে এ ব্যাপারে জেনেছিল, এবং সেটা এতোটাই   অবাস্তব এবং হাস্যকর বিষয় ছিল যে বৈশম্পায়ন আর   বিষয়ে  পড়াশোনা করেনি!  এমনকি এটাও বুঝেছিল যে যাজ্ঞসেনীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে এরকম অনেক  অবাস্তব এবং অবান্তর জিনিস শুনতে হবে, অতএব এখানেই সম্পর্কের ইতি ! তারপর ভুলেও গেছিল তাকে।
 
কিন্তু আজ যেন যাজ্ঞসেনীর স্মৃতি নিম্নচাপের মেঘের মতো ছেয়ে আছে বৈশম্পায়নের আকাশে ! এটা কি তবে কিছুর ইঙ্গিত? সেই কোন অলৌকিকে বিশ্বাস করে না, তবু শৈলদুহিতার যে সুন্দর মুখের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সে মনোনিবেশ করতে চাইছে সেখানে বারেবারে কেন এসে হানা দিচ্ছে সাদামাটা চেহারার যাজ্ঞসেনী? বৈশম্পায়ন কি কোন ব্যাধির শিকার? আজ বিকেল পাঁচটায় তার শৈলদুহিতার সঙ্গে যে দেখা করার ব্যাপার আছে, সেটা কি তবে ভেস্তে দিতে হবে? এখুনি কি তাকে ছুটতে হবে মাথার ডাক্তারের কাছে?
 
মাথায় হাত দিয়ে ঘরের উড়ন্ত সোফায় গিয়ে বসল বৈশম্পায়ন। তার অস্থির লাগছে, নিজেকে চঞ্চল লাগছে। একশ পঁচিশ তলার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সূর্যটাকে পশ্চিমের  দিকে ঢলে পড়তে দেখতে লাগল। তক্ষুনি ঘড়িতে সময় দেখল সে, চারটে পঁয়তাল্লিশ, পাঁচটায় তাদের দেখা করার কথা। এখন সে আছে পাথরপ্রতিমাতে, তাকে এখন যেতে হবে ধর্মতলায়, সেখানেই দেখা করবে বলে জানিয়েছে শৈলদুহিতা। প্রথমে শুনে বেশ অবাক হয়ে গেছিল বৈশম্পায়ন। পাথরপ্রতিমা, মথুরাপুর, লক্ষীকান্তপুরের মতো অত্যাধুনিক, পশ এলাকা ছেড়ে কলকাতার মতো একটা ধ্যাঁড়ধ্যাড়ে, অতিপ্রাচীন, ভগ্নপ্রায় একটা শহরে কেউ প্রথম ডেটে যায় জানা ছিল না তার ! তবু কথা যখন দেওয়া হয়েছে, বৈশম্পায়নকে যেতেই হবে। হাতে পনের মিনিট মতো সময় আছে, তবে বৈশম্পায়নের হাওয়া-মোটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছাতে লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট!
 
ধর্মতলার মোড়ে ওবেরয় গ্র্যান্ড নামের যে প্রাচীন হোটেলটার ধবংসস্তুপ রয়েছে, সেখানে দেখা করার কথা তাদের। শৈলদুহিতাই এমন প্রস্তাব দিয়েছে। এই মেয়েটার সবকিছুই কেমন অদ্ভুত, সেই জন্যই তো বৈশম্পায়নের প্রথমেই এত ভালো লেগে গেছিল ! আর তার এতদিনকার প্রেমিকাদের মধ্যে সব থেকে সুন্দরী হল শৈলদুহিতা ! বৈশম্পায়ন তো ঠিকই করে রেখেছে, একবার যদি তারা সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবে খুব শিগগিরি তারা বিয়ে করে নেবে। তবে একটাই দুঃখ থেকে যাবে, শৈলদুহিতাকে সে পাবে ঠিক দু’বছর, তবে এ দু’ বছরে সে চুটিয়ে উপভোগ করবে শৈলদুহিতার সঙ্গ !
 
পার্কস্ট্রিট পেরতেই নিজের হাওয়া-বাইকের গতিটা একটু শ্লথ করল বৈশম্পায়ন। কিছুটা এগোতেই গ্র্যান্ড হোটেলের ধবংসস্তুপটা নজরে এল। ওই তো দূরে শৈলদুহিতাকে দেখা যাচ্ছে, চুপচাপ এক মনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাজপোশাক আর প্রসাধন থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরচ্ছে ! তাকে দেখতে লাগছে ঐশ্বরিক! বৈশম্পায়নের হৃদয়ে ধরাম-ধরাম করে শব্দ হতে লাগল ক্রমাগত। এ মেয়ে যে রক্তমাংসের তৈরি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় !
 
কিন্তু একি, তার হাওয়া-বাইকের গতিরোধ করল কে?  গ্র্যান্ড হোটেলের কাছাকাছি আসার পর এ কী বিপত্তি হল? পাশ দিয়ে সাঁ-সাঁ করে সব গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হাওয়ায় ভেসে-ভেসে, শুধু তার বাইকটাই এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই সে বুঝতে পারল, সমস্যা তার বাইকে নয়, সমস্যা তার নিজেকে নিয়ে, কারণ বৈশম্পায়নের বাইক নিজে থেকে থেমে যায়নি, সে নিজেই যেন কেমন থমকে  গেছে! হঠাৎ কী হল তার? তাকে কি বোবায় ধরল? এটা কি কোন ওষুধ বা ভ্যাক্সিনের সাইড এফেক্ট ? নইলে হঠাৎই সে এরকম পাথরের মতো হয়ে গেল কেন? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না বৈশম্পায়ন। বুঝে উঠতে পারছিল না, তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, সে কি এইভাবেই হাওয়ায় ভেসে থাকবে, নড়বে-চড়বে না?
 
খানিক দূরে প্রাচীনকালের এক বিলাসবহুল হোটেলের ভগ্নস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে শৈলদুহিতা অবাক দৃষ্টিতে বৈশম্পায়নের হাওয়াতে ভেসে থাকা বাইকের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখতে পেল, বৈশম্পায়ন হঠাৎই নিজের বাইকটা ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল গঙ্গার দিকে মুখ করে। সে অবাক হয়ে গেল, হঠাৎ কাছাকাছি এসে বাইকের মুখ কেন ঘোরাল বৈশম্পায়ন? কী কারণে?
 
কারণটা শৈলদুহিতা না জানতে  পারলেও বৈশম্পায়ন জানে, তাকে এক্ষুনি  বৈদ্যবাটি যেতে হবে, যেখানে যাজ্ঞসেনী থাকে…

Leave a Reply