প্রতারণা
রবীন বসু
‘এখানে সই করো, তোমার জামিন হয়েছে।’ একটা লম্বা বাঁধানো খাতা বের করে তার নামের পাশে পেন ঠেকিয়ে বলল জেলার। বিমল নাম সই করে জেলারের দিকে তাকায়। সে বেশ অবাক হয়। ‘আমার জামিন হয়েছে!’ ‘হ্যাঁ, তিন মাস তো পার হয়ে গেল। বাড়ির লোক কেউ এল না। আমি বাধ্য হয়ে একটা এনজিওকে বলতে, তারাই সব ব্যবস্থা করেছে। তোমাকে কিন্তু প্রতি মাসে একবার করে লোকাল থানায় রিপোর্ট করতে হবে।’ ভাউচার জাতীয় আর একটা কাগজ বের করে চোখের ইশারা করল। সেখানেও একটা সই দিতে হল। এরপর জেলার একটা খাম দিল তার হাতে। ‘তোমার পারিশ্রমিকের টাকা। আর এই নাও ফোন।’ সংশোধনাগারে ঢোকার সময় তার কালো রঙের দামি মোবাইল জমা দিতে হয়েছিল। এখন টাকার খাম, মোবাইল আর জামাকাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আলিপুর সংশোধনাগারের বড় লোহার গেটের ছোট দরজা ঠেলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল বিমল। ঠিক এমন ভাবে মাথা নিচু করে সে একদিন ঢুকেছিল এখানে। অ্যারেস্ট হবার পঁচানব্বই দিন পর সে আবার মুক্ত আকাশের নিচে। মনে মনে জেলার আর অজানা সেই এনজিওটাকে ধন্যবাদ দিল। সংশোধনাগারে জীবন এক রকম নরক হয়ে গিয়েছিল। টাকা দাবি করে প্রায় তাকে মারধর করত দাগি কিছু মস্তান কয়েদি। এখানে ফোন নিষিদ্ধ। তবু এই যাব্বজীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিগুলো বিশেষ বন্দোবস্তয় সহজে তা পেয়ে যায়। বাইরে থেকে অস্ত্র আসে, নেশার জিনিস আসে। ঢোকে মাদক। তাই এই টাকার জুলুম। একশ্রেণীর জেলরক্ষীদের যোগসাজশে এসব হয়। জেলার সব জানে। তবু কী এক অলিখিত চুক্তিতে সবাই চুপ। এক অসহায় আক্রোশ আর গাঢ় অবসাদে বিমল ভিতরে ভিতরে ধ্বস্ত হচ্ছিল। প্রতিটা মুহূর্তে নিজের কাছে নিজে মরে যাচ্ছিল। খুব রাগ হচ্ছিল সেই স্কুলের সহপাঠী বন্ধু সুদেবের উপর। যে তাকে এই চিট ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। এতগুলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা! না বুঝে সরল মনে সে ফেঁসে গিয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতে বলত, ‘কোনদিন লোককে ঠকাবি না। কারও ক্ষতি করবি না। খেটে খাবি, সৎ পথে থাকবি, বিমল।’ নিরক্ষর ক্ষেতমজুর বাবা আজ আর নেই। বি.এ পাশ করেও বিমল কোন চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। প্রাইমারি টেট পরীক্ষায় পাশ করে প্যানেলে নাম তুলেছিল। কিন্তু ইন্টারভিউ কল পায়নি। খবর নিতে দলের দাদারা বলেছিল, ‘তিন লাখ লাগবে। পারবি? তবে ইন্টারভিউ পাবি।’ লাখ তো দূরের কথা পেট চালাবে কী করে তার উপায় ছিল না। অল্প কয়েকটি টিউশন করে চারটে পেট চালানো যায় না। লজ্জা না করে বিমল একটা ভ্যান রিক্সা কিনে গঞ্জের হাটে মাল বইতে শুরু করল। এমন সময় এক দিন স্কুলবন্ধু সুদেবের সঙ্গে দেখা। সব শুনে বলল, ‘তোর বাড়ি যাব এই রোববার। থাকবি।’ রোববার বাইক হাঁকিয়ে এসেছিল সুদেব। চা মুড়ি খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কথা শুরু করেছিল। ওর কাছে প্রথম শুনল, সূর্য ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির নাম। ‘আমাদের কোম্পানিতে যদি কেউ টাকা রাখে তাহলে তিন বছরে সে টাকা ডবল হবে। ইনভেস্ট করার সময়ই আমরা প্রিপেড চেক দিয়ে দিই। মেয়াদ শেষ হলে ব্যাঙ্কে ফেললেই আমানতকারী টাকা পেয়ে যাবে। আমাদের গ্যারান্টি সরকার। আমরা অনেক টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রেখেছি। যদি কখনও কোম্পানি ফেল করে তাহলেও মানুষের টাকা ফেরত নিশ্চিত। আমাদের এককালীন স্কিম আছে। আবার দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক স্কিমও আছে। কোম্পানি এখন বেশকিছু নতুন এজেন্ট নেবে। আমি চাই তুই এজেন্ট হিসেবে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন কর। মাসে যত টাকা কালেকশন করবি তার উপর ভালো পার্সেন্ট কমিশন থাকবে। তোকে একটা টার্গেট ঠিক করে দেওয়া হবে। টার্গেট ফুলফিলমেন্ট হলে তুই তখন নতুন কিছু ছেলেকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে পারবি। তারা তোর আন্ডারে কাজ করবে। তাদের যাবতীয় কালেকশনের উপর তুই টোয়েন্টি পার্সেন্ট কমিশন পাবি। তারা আবার নতুন কিছু এজেন্ট নিয়োগ করবে। এটা এইভাবে চেন সিস্টেমে চলবে। তুই এই সবার কালেকশনের উপর টোটাল কমিশন পাবি। এটাকে পঞ্জি স্কিম বলে। প্রথমে বাইক, তারপর রিপোর্ট ভালো হলে ফোর হুইলার। মন দিয়ে কাজ করলে খুব তাড়াতাড়ি তোর হাতে অনেক নগদ টাকা চলে আসবে। তুই তখন চাইলে ডোনেশন দিয়ে প্রাইমারি স্কুলে চাকরিতে ঢুকতে পারবি। চাকরিও হল, আবার সূর্য ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি থেকে মাসে মাসে মোটা আয়। ভেবে দেখ্।’ ভাবার বেশি অবকাশ ছিল না বিমলের হাতে। সে যেন অন্ধকারে আলো পেল। তবু সংশয় নিয়ে একবার বলেছিল, ‘তিন বছরে টাকা ডবল! তা কি সম্ভব?’ ‘হ্যাঁ রে। এই দ্যাখ্…’ এরপর কয়েকটি চেক বের করে দেখায়। অভাবের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সুদেবের প্রস্তাবকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরল বিমল। কিন্তু তখন বুঝতে পারেনি এর পরিণাম এমন ভয়ঙ্কর হবে! কিছু ধূর্ত অসাধু লোকের পরিকল্পনার এই পঞ্জি স্কিম গ্রামের সাধারণ গরীব মানুষকে সর্বস্বান্ত করবে! সূর্য ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির এজেন্ট হয়ে বিমল কাজ শুরু করল। দু’তিন বছরের মধ্যে সুদেবের কথা ফলে গেল। প্রচুর নতুন আমানতকারী টাকা রাখল। তার আন্ডারে দশ দশ করে প্রায় একশো জন ছেলেমেয়ে এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করল। ফোর হুইলার পেল। তা নিয়ে কলকাতার হেড অফিসে গিয়ে কালেকশনের টাকা জমা করলেই হাতে হাতে তার কমিশনের চেক পেয়ে যেত। পাঁচ বছরেই সে দোতলা পাকা বাড়ি তুলল। মার্বেল ফ্লোর। ভাইবোনদের ভাল স্কুলে ভর্তি করাল। আর অক্লেশে ডোনেশন দিয়ে স্কুলে চাকরিটাও পেল। বিমল তখন পাড়ার গণ্যমান্য। কালীপুজো, দুর্গাপুজোয় পাড়া ও বেপাড়ার ক্লাবকে মোটা চাঁদা দেয়। সফল মানুষ হবার একটা আত্মতৃপ্তি তাকে ঘিরে ধরে। এই সময় মা একদিন আবদার ধরে, ‘সব তো হল বাবা, এবার একটা বে’ কর, আমি চলে গেলে এ সংসার কে দেখবে!’ শেষে বন্ধু সুদেবের এক দূর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করে। কিন্তু তারপরেই অশনি সংকেত। কানাঘুষো চলছিল অনেক দিন ধরে। কোম্পানির ভিতরের অবস্থা ভালো না। মেয়াদ উত্তীর্ণের পরও মানুষ তাদের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছিল না। চেক বাউন্স করছিল। কারা যেন কোম্পানির সব টাকা লুট করে নিচ্ছে। দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছিল আমানতকারীদের মধ্যে। তারা প্রায়ই বিমলের বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায়। তাদের টাকা ফেরত চায়। ও কিছু একটা বলে তাদের শান্ত করে। সময় নেয়। পরিস্থিতি আরও ঘোরাল হয়। একদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে চোখ ছানাবড়া। বড় বড় হরফে হেডলাইন হয়েছে সূর্য ইনভেস্টমেন্ট গোষ্ঠীর মালিক ফেরার। কোম্পানির জিএম গ্রেপ্তার। তাদের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করা হয়েছে। মাথায় হাত পড়ল বিমলের। একটু বেলা হতেই বাড়ির সামনে ভিড় বাড়তে লাগল। যাদের অল্প টাকা ছিল, গরীব লোক, নিজের সঞ্চয় থেকে কিছু কিছু পরিশোধ করল। একদিন সঞ্চয় শেষ হল। নিচের এজেন্টরা আমানতকারীদের তার কাছে পাঠাতে লাগল। সে নিরুপায় হয়ে সুদেবকে ফোন করল— ‘বেপাত্তা হয়ে যা কোথাও। ফোন ফেলে দে।’ কল এন্ড করে দিল। আর যোগাযোগ করা যায়নি। লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে ওর হাতে দিয়েছিল। এখন বিপদের দিনে সে দায় ঝেড়ে ফেলল। অগাধ জলে পড়ল বিমল। কী করে! মাথা কাজ করছিল না। সরে পড়ার আগেই রাতে বাড়িতে পুলিশ এল। সঙ্গে প্রচুর লোক। তারা তাকে মারধরও করল। প্রতারণা, টাকা পরিশোধ না করা, বেআইনি চিটফাণ্ডের অংশিদার, বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল। টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলে নিয়ে থানার লক আপে ঢোকাল। একদিন পর কলকাতার আলিপুর কোর্টে চালান করল। সেই থেকে জেলে। অসহায় মা শুধু ডুকরে কাঁদছিল। ‘কী সব্বোনাশ হল রে বাবা! আমি এখন কী করি!’ স্ত্রী দেবযানী আর ছোট ভাইবোন দুটো অপলক ভাবে তাকিয়ে ছিল। তার কানে বাজছিল মৃত বাবার কণ্ঠস্বর, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। বেশি লোভ করবি না বাপ্।’ ‘আমি লোভ করিনি বাবা, যা করেছি সংসার বাঁচানোর জন্য করেছি। আমার সঞ্চয়ে যা ছিল, সব ওদের দিয়ে দিয়েছি। আমাকে সুদেব ঠকিয়েছে। আমি বুঝে উঠতে পারিনি।’ আলিপুর জেল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের ফুটপাত দিয়ে হাজরা মোড়ের দিকে হাঁটা শুরু করল বিমল। এখন ফাল্গুনের শেষ। দুপুর বারোটার মতো। রোদের তেজ বেড়েছে। এতদিন আধো অন্ধকার সেলে থেকে বাইরে আসতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন ঝাঁ-ঝাঁ করছে। আস্তে আস্তে এগুতে থাকে সে। আদিগঙ্গার মজা পচা খালের উপরের ব্রিজ পেরিয়ে কালীঘাট মন্দিরের গেট দেখতে পেয়ে একটু থামল। কপালে হাত ঠেকিয়ে মা কালীর উদ্দেশ প্রণাম ঠুকল। মনে মনে বলল, ‘সব বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর মা।’ সুখের সময় মনে হয়নি, এখন এই ঘোর বিপদের মধ্যে সে মাকে স্মরণ করল। মানুষ তো ভয়েই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়। হাজরা মোড়ে এসে মনে হল খুব খিদে পেয়েছে। একটা পাইস হোটেলে ভাল ভাত আর ডিমের ঝোল খেল। চল্লিশ টাকা নিল। তা নিক, অনেক দিন পর ভালো ভাত খেয়ে একটু তৃপ্তি পেল। সংশোধনাগারের খাবার তো মুখে দেওয়া যেত না। পাশে পানের দোকান থেকে একটা সিগারেট কেনে। দড়ির মুখে ঝোলানো আগুন থেকে ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোয়। একটা অটোতে উঠে বালিগঞ্জ স্টেশনে আসে। টিকিট কেটে ঘণ্টাখানেক বসার পর তবে নামখানা লোকাল আসে। এতদিন পর বাড়ি ফিরছে, জানে না কী অবস্থায় আছে মা, ভাইবোনেরা আর দেবযানী। একটা কথা ভেবে সে অবাক হয়। মা না হয় বয়স হয়েছে, শহরে আসতে ভয় পায়, কিন্তু দেবযানী তার স্ত্রী। সাতপাক ঘুরে বিয়ে করা বউ। সে কেন এতদিন একবারও খোঁজ নিল না। কোন উকিল ধরে তার জামিনের ব্যবস্থা করল না। যে দু’ তিনবার ফোন করেছিল, সে ফোন বেজে গেছে, ও ধরেনি। মনে রহস্য আর দুশ্চিন্তা দানা বাঁধে। তার অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে প্রতারিত আমানতকারীদের দিয়েছে। এখন শূন্য। যখন কানাঘুষো শুনছিল, দেবযানীর নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে অনেক টাকা সরিয়ে রেখেছিল সে। সেই টাকাটায় এবার হাত দিতে হবে। পুলিশ কেস হয়েছে, হাজতবাস। স্কুলের চাকরিতে আবার জয়েন করতে পারবে কি জানে না। দুর্ভাবনার পাহাড় চেপে বসে মাথায়। বুঝতে পারে না পরিত্রাণ পাবে কীভাবে ! ভাবনায় ভাবনায় এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুম যখন ভাঙল তখন বহড়ু স্টেশন এসে গেছে। পরের স্টেশন জয়নগর। তাকে নামতে হবে। ওখান থেকে আবার ট্রেকারে যেতে হবে আরও পনেরো কিলোমিটার জামতলা হাট। নিমনিয়া নদী পেরিয়ে কুন্দখালি গ্রাম। তার বাড়ি। হাটে যখন নামল তখন সূর্য পাটে বসেছে। অন্ধকার নামে নামে। একদিকে ভালো হল। চেনা মানুষের সামনে পড়লে লজ্জার শেষ থাকবে না। অবশ্য তিন মাসে মুখে দাড়ি গজিয়ে চেহারা ভেঙে গেছে। জামাকাপড়ের অবস্থা মলিন। একটু সন্তর্পণে অনেকটা কুঁজো হয়ে সে হাঁটছিল। যাতে কেউ চিনতে না পারে। হাটপাড়াটা কোনক্রমে পেরিয়ে গেলে নিমনিয়া নদীর পাড়ে উঠবে। নতুন পাকা ব্রিজ ধরে সোজা হাঁটলে তাদের গ্রাম। কিন্তু কপাল খারাপ। যোগেনের চায়ের দোকান পার হতে গিয়েই বিপদ। ‘কে যায় অমন গুঁড়ি মেরে? দেখি দাঁড়াও তো। চেনা মনে হচ্চে।’ বিমল দেখল চায়ের দোকানের বেঞ্চ থেকে তাদের গাঁয়ের মাতব্বর সদাশিব উঠে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে পঞ্চায়েত মেম্বারও। অনেকক্ষণ ভালো করে তাকে দেখল। তারপর বলল, ‘আমাদের বিমল মাস্টার না! কবে ছাড়া পেলি বাপ্! জামিন হয়েচে? কে জামিন করাল?’ ‘সব বলছি কাকা। আগে একটু জল খাব।’ ততক্ষণে যোগেন দোকান ছেড়ে উঠে এসেছে। ‘এসো এসো, মাস্টারদা। বেঞ্চিতে বস। আমি জল দিচ্চি।’ অগত্যা বিমল পায়ের কাছে ব্যাগটা রেখে বেঞ্চে বসে। যোগেন একটা স্টিলের গ্লাসে জল দেয়। জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সদাশিব কাকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আগে বাড়ির খবর বল কাকা। মা, আমার ভাইবোনেরা সব কেমন আছে?’ বিমলের একটা হাত চেপে ধরে সদাশিব। ‘কেমন আর থাকবে। পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে। তোর বাপ ছিল সৎ খেটেখাওয়া মানুষ। কারও কাছ থেকে পাওনা ছাড়া একপয়সাও নিত না। সেই বাপের ছেলেকে লোকে জোচ্চর বলছে, ঠক বলছে, কেমন করে মেনে নেবে সরলাখুড়ি। শুধু কেঁদে বুক ভাসাচ্চে। আমার কাছে একদিন এয়েছিল। কার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে এনে বলল, ‘এটা নাও বাবা। আমার ছেলেটাকে জামিনে ছাড়াও।’ চেষ্টা করেছিলুম খুব। কিন্তু কোনো উকিল রাজি হল না কেস নিতে। আমানতকারীদের চাপ, রাজনৈতিক নেতাদের চাপও ছিল। ওরা বলল, জনরোষ একটু থিতোতে দাও। এখন কিছু কত্তে যেও না। তাই কিছু করে উঠতি পারিনি। সর খেলো কারা, আর জেলের ঘানি টানলি তোরা।’ বিমল নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে বসে আছে। যোগেন কাচের গ্লাসে চা নিয়ে তার হাতে দেয়। ‘অনেক দূর থেকি আসচ মাস্টারদা, ধকল গেচে। গরম চা খেলে ভাল লাগবে।’ চা খেয়ে উঠে দাঁড়ায় বিমল। পকেট থেকে পয়সা বের করে দিতে যায়। যোগেন হাত চেপে ধরে। ‘না দাদা, পয়সা নিতি পারবুনি। ভুলে গেচ, দোকান করার সময় সাহায্য করেছিলে।’ সদাশিবও উঠে দাঁড়ায়। ‘চল্ বিমল, আমি যাই তোর সঙ্গে। কতা আছে।’ ব্রিজ পেরিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। পরিচিত মাটির গন্ধ। কতদিন পর সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিল। এত অপমান ঘৃণা সব তার প্রাপ্য ছিল না। সেও তো বাবার মতো সৎভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। সংসারকে বাঁচাতে চেয়েছিল। সুদেব আর তার চিটফান্ড তাকে ঠকিয়েছে। শুধু তাকে না, তার মতো হাজার হাজার বেকার যুবককে। আর ঠকিয়েছে হাজার হাজার গরীব খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষকে, ছোট ব্যবসায়ী ও নিম্ন মধ্যবিত্তকে। তারা সর্বস্বান্ত হয়েছে। অন্যমনস্ক ভাবে একটা মাটির ঢেলায় হোঁচট খেল বিমল। চকিতে তার হাত চেপে ধরে সামলায় সদাশিব। ‘আস্তে বিমল। সাবধানে দেখে হাঁট। একটা খুব খারাপ খবর আচে রে।’ বিমল দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘কী বলছ তুমি? আরও খারাপ খবর!’ সে অস্থির হয় জানতে। সদাশিব তার পিঠে একটা হাত রাখে। ‘তুই জেলে যাবার কিছুদিন পর, তোর বউ বাড়ি ছেড়ে চলে গেচে। সোনারপুরের ওদিকে কোথায় যেন কার সাথে থাকে এখন বিয়ে না করে। যাবার আগে ওর নামের অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে নিয়ে গেচে। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জানতে চেয়েছিল সব টাকা তুলছেন কেন? ও তখন বলেছিল স্বামীকে ছাড়াতে হবে তো। কেস লড়তে হবে। তাই। এখন কী করবি তুই!’ সত্যি তো বিমল এখন কী করবে! সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। অবসাদ হতাশা আর নিজের প্রতি ঘেন্নায় সে কুঁকড়ে বসে পড়ল পথের ধুলোয়। লজ্জা ঢাকতে তার একটা অবলম্বন চাই। মানুষ হিসেবে সে পরাজিত, বিধ্বস্ত। এক সময় এক চোখ অন্ধকার নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় বিমল। আঘাত সামলাতে হবে তাকে। মা, ভাইবোনদের মুখ ভেসে ওঠে। তাকে আবার নতুন করে জীবনের লড়াই শুরু করতে হবে। চাকরি ফেরত না পেলে সে আবার ভ্যানরিকশা টানবে। সুদেব চিট করেছিল আগেই, তার সম্মান গেছে। দেবযানী এবার সমস্ত বিশ্বাসটা চিট করল। তবু সে হারবে না। শিরদাঁড়া সোজা করে সদাশিব কাকার হাত ধরে বলে, ‘চল কাকা, বাড়ি যাই। |