রঞ্জনা ভট্টাচার্য

স্ত্রী

রঞ্জনা ভট্টাচার্য

স্ত্রী এই শব্দটির দিকে তাকালে কখনও কি প্রেমের আবির রং দেখেছেন? অথবা বন্ধুত্বের সোনালী রোদ্দুর। ‘স্ত্রী কি প্রেমিকা?’
—উঁহু’,
স্ত্রী বন্ধু?
‘নৈব নৈব চ’
তবে স্ত্রী ব্যাপারটা কি?
বর এবং বৌ এর তাপমোচী ও তাপগ্রাহী রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত হন স্বামী এবং স্ত্রী। এর মধ্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বাজার, শপিং মল, শ্বশুর বাড়ি ও বাপের বাড়ির বিভিন্ন যোজনা ও প্রকল্প। স্ত্রী এবং ইস্ত্রি এই দুইটির মধ্যে প্রভূত মিল আছে। সংসারকে পাটে পাটে, ভাঁজে ভাঁজে প্রেজেন্টেবল করার জন্য দুজনের প্রয়োজন।
স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে কি ভালোবাসার সম্পর্ক?
খুবই জটিলতম সরল প্রশ্ন। যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার কি দাঁত মাজার বুরুশের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক? মোটেও না। তবু প্রতিদিন সক্কালবেলা সবার আগে ব্রাশটিকেই প্রয়োজন।
সেরকম প্রতিদিন সকাল থেকে রাত স্ত্রীরও স্বামীকে প্রয়োজন, স্বামীরও স্ত্রীকে প্রয়োজন। দুজনেই দুজনের চরম অভ্যাস: ভালবাসা, প্রেম, বন্ধুত্বের থেকেও সিমেন্টিং বন্ধন হল অভ্যাস।
স্ত্রীর অনেক প্রকারভেদ আছে: গদগদ স্ত্রী,তদ্গত স্ত্রী, তদ্ভব স্ত্রী,উদ্গত স্ত্রী, ঘনীভূত স্ত্রী, দ্রবীভূত স্ত্রী, পরাক্রমী স্ত্রী, পরাভূত স্ত্রী, দূরীভূত স্ত্রী। পরে এই বিভাজন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আসছি। স্ত্রী ব্যাপারটার সাথেই জড়িয়ে আছে সতী আর সাধ্বী কথাটা। সাধ্বী প্রেমিকা বা সতী বন্ধুনী নিশ্চয়ই বাংলাভাষার প্রপ্রপ্রপিতামহের আমলেও পাওয়া যায় নি। কারণ,স্ত্রী ও স্বামী এই দুটোই অনেকটা প্রপার্টি গোছের। যদিও সতী-সাধ্বী স্বামীর কথা আমি অভিধানে পাইনি। কেউ পেলে জানাবেন। এবার জীবন্ত প্রপার্টির কিছু ঝুট ঝামেলা তো থাকবেই। তাই যখন অভ্যাসেএকঘেয়েমি আসে অথবা একেবারেই পোষায় না তখন ডিভোর্সের মাধ্যমে ডিসওন করা— ‘তুমি আর আমার প্রপার্টি রহিলে না। আপনি হইয়া গেলে।’ একটি কাল্পনিক দৃশ্য পাঠকের সামনে নিয়ে আসি। হঠাৎ করে প্রাক্তন স্বামী ও স্ত্রীর বাসে দেখা। দুজনেই দুজনকে মাপছে। স্বামীর পকেট থেকে ঘেমো রুমালটা বেরোতেই স্ত্রীর মনে হল, ‘বোঝ এখন কেমন লাগে! ফর্সা ধবধবে রুমালটার কি তেলকাষ্টে অবস্থা।’ অর্থাৎ আমি নেই, তাই আমার প্রপার্টির যত্নও হচ্ছে না। প্রাক্তন স্বামীকে দেখলে রক্ত চলকে ওঠার বদলে বোধ হয় কত রোগা হয়ে গেছে! দেখে মনে মনে সুখ আর অসুখ দুইই হয়।
যা বলছিলাম, স্ত্রীর সেই বিভাজন নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনায় আসি;
গদগদ স্ত্রী: ছেলে মেয়েদের স্কুলের মাঠে বসে বরের দেওয়া অলঙ্কারের ভরি ও ডিজাইন নিয়ে অভিভূত স্ত্রী তাঁর বন্ধুনীদের ঈর্ষার কারণ। স্বামীর দেওয়া ভরিতে ভারী গদগদ।
তদ্গত স্ত্রী: লক্ষ্মীর পাঁচালি আর স্বামী সংসার গোছানই যার কাছে একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ। এরা ক্রমেই দুর্লভ প্রজাতির হয়ে উঠছেন। এখন বাইরে আর ঘরে সামলাতে গিয়ে তদ্গত প্রাণারাই উদ্গতা ।
উদ্গত স্ত্রী: সবসময় উৎকন্ঠিত। অফিস থেকে বাড়ি সবজায়গায় একদম পারফেক্ট হবার ভ্রান্তিবিলাসে কন্ঠাগত।
তদ্ভব স্ত্রী:মানে তোমাতেই ভব সংসার। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মাজায় চোটের জন্য গনগনে রাগ গিয়ে পরলো ঘুমন্ত স্বামীর উপর। পৃথিবীর যাবতীয় অনাসৃষ্টি ও সমস্যার কারণ তার স্বামী। কিন্তু, তার সাথে একটু মুচকি হাসিও আছে। সমস্ত মুশকিল আসান ও ঐ স্বামী নামক ঘুমন্ত মানুষটি।
ঘনীভূত স্ত্রী: এই স্ত্রী জাতি একটু গোলমেলে টাইপ মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্রের’ মৃণালের মতো। সংসার তাকে চিনতে পারেনা, সেও সংসারের খোপে বোল তুলতে পারে না। সে নিজের মেধা ও মানবিক অনুভূতিতে ঘনীভূত।
দ্রবীভূত স্ত্রী: সংসারে এইরকম একজন স্ত্রী থাকলে ‘লে হালুয়া।’ অভিমানে একটু ফ্যাঁচফোঁচ করে, কিন্তু, একটু ভালো কথায় এঁরা ভুলে যায় সব অপমান। আবার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছু পরম মমতায় করে চলে আর মাঝে মাঝে শুধুমাত্র ভাগ্যকে দোষ দেয়।
পরাক্রমী স্ত্রী: এঁদের স্বামীরা বিশ্বজগতের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখান, দেশ ও দশের ভুল ধরেন, অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলে দশের নিমিত্ত কি সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত সেই নিদানও দেন, কিন্তু ভুলেও সংসারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যান না বা স্ত্রীর ভুল ধরার সাহসও করেন না।
পরাভূত স্ত্রী: এঁদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কেরোসিন তেল, ঘুমের ওষুধ, ঘূর্ণায়মান পাখা। কারণ পরাভূত স্ত্রীকে বীরের সম্মান কেউ কোনোদিন দেননি।
দূরীভূত স্ত্রী: যারা সংসারে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন না। সমস্ত কিছুর মধ্যে শারীরিক উপস্থিতি থাকলেও মানসিক ভাবে কখনো জড়ান না, এমন দুষ্প্রাপ্য স্ত্রীকে দূর থেকেই নমস্কার জানিয়ে এই বিভাজন সংক্রান্ত আলোচনার ইতি টানছি।
স্ত্রী প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার কথা।
‘অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশম।।’
অনেকে আবার কুন্তীর জায়গায় সীতার নামও করেছেন। অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা কেউই একজন স্বামীর প্রতি তদ্গত প্রাণা ছিলেন না। মন্দোদরী রাবণকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে তিনি অধর্মের পথে চলেছেন। সীতা রামের প্রতি অভিমানে পাতালে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়। তার কারণ , প্রত্যেকে তাঁদের জীবনের বিষাদ, বিয়োগ, ঝড়-ঝাপ্টা স্থির বুদ্ধি, মেধা, ধৈর্য ও মনন দিয়ে পার করছেন। নিজের মর্যাদা কখনো ক্ষুন্ন হতে দেননি। আত্মসম্মানের সাথে কখনো কম্প্রোমাইজ করেন নি। তাই তাঁদের স্মরণে মহাপাতক নাশ হয়।
এখনও বহু জায়গায় স্ত্রী পাপোশের মতই ব্যবহৃত হয়। তার কারণ নারীর আর্থ সামাজিক অবস্থা। যতই কন্যাশ্রী, বেটি বাঁচাও, ইত্যাদি-প্রভৃতি হোক, স্ত্রীকে মারধোর করে টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়া, বা যৌন নির্যাতন করা এখনও বিরল হয়ে যায় নি। বিরল হয়নি কারণ মেয়েরা এখনও পড়ে পড়ে মার খায়,উল্টে মার দিতে শেখেনি।
লেখিকা তৃষ্ণা বসাকের ‘পানিবাঈ’ প্রত্যন্ত গ্রামের স্ত্রীদের আগুনে ধোঁয়া জলের ইতিহাস বলে। মনে হয়, অনেক পথ আমরা স্ত্রীরা হেঁটেছি। আসলে, পা দুটো সমানে উঠেছে নেমেছে, কিন্তু আমরা এগোয়নি। পায়ের তলায় সেই ফুটিফাটা আগুন ঝরা মাটি।
এতকিছুর পরেও এমন তো ঘটেই, সারাদিন প্রচুর মতানৈক্য, ঝগড়া, ঝামেলা। ঘাড় টনটন, মাথা ঝনঝন, পা খনখন…, ‘একটু ঘাড়টা টিপে দেবে?’ মোবাইলে চোখ রেখে আরেকজন ব্যথার থেকে তিন ইঞ্চি দূরে টিপে দেবার বদলে দিল মোক্ষম ব্যথা…
তারপর? তারপর নিজেদের মতো ভেবে নিন। স্বামী-ইস্ত্রির মধ্যে আমার না ঢোকাই বুদ্ধিমানের কাজ…

Leave a Reply