রঞ্জনা ভট্টাচার্য 

দৃশ্যমান অদৃশ্য 

রঞ্জনা ভট্টাচার্য 

আমার নাম ছায়া। শ্মশান থেকে উঠে আসা ভূতের ছায়া নয়। আমি জন্মেছি ছায়া হয়ে। ভেসে ভেসে যাই, যখন ইচ্ছা যার দেওয়ালে ইচ্ছে ঠেস মেরে নিই। আমি সবাইকে দেখতে পাই। কিন্তু, সবাই আমাকে দেখতে পায় না। তোমাদের মতো মরণ-বাঁচন নিয়ে আমি চাপ খেয়ে থাকি না। আমি এই আছি আবার এই নেই, যখন নেই তখনও আসলে থাকি, শরীরের গন্ধ, মনের ঈর্ষা-দ্বেষ, প্রেম যা কিছু তোমাদের নিজস্ব বলে ভাব, তা আমাদের অনু-পরমাণুতেও ছড়িয়ে আছে।
সেদিন দেয়াল চাটছি খিদে ব্যাপারটাকে একটু রেলিশ করার জন্য, দেখি, তিনবছরের মলি মেঝেতে হিসু করে চলে গেল, ছবছরের ডলি ঐদিকেই এগোচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে আসা রোদে জল‌ তো দেখা যাবে না। আমি তখন ছাদের উপরে তড়াক করে  উঠে জলের উপর ছায়া ফেলে দিলাম। থপথপ করতে করতে আসা ডলি একটু দাঁড়িয়ে গেল জল‌ দেখে, তারপর দৌড়ে মাকে বলতে  গেল, ‘মা, বনু আবার মেঝেতে হিসু করে ফেলেছে।’
আমি মুচকি হেসে আবার আমার জায়গায়, ‘তাহলে আমার মনে স্নেহ আছে  তো?’ আমার কি মাঝে মাঝে তোমাদের হিংসা হয় না? খুবই হয়। আয়নায়  তোমাদের  কত সুন্দর সুন্দর ছবি।কতরকমের দেখতে মানুষ আর আমার মুখ নেই, চোখ নেই, শুধু আউটলাইনের ভিতর অন্ধকার। কে আমার প্রেমে পড়বে বল? অথচ আমার প্রেমের খুব শখ। যেমন নানা ধরনের খাবারের শখ। কতরকম রঙ, কতরকম গন্ধ। আমার তরঙ্গ দিয়ে সব বুঝি, কিন্তু, স্বাদ বুঝতে তোমাদের লাল রঙের জিভটা খুব প্রয়োজন।
 সেদিন পার্কের বেঞ্চে বসে আছি, পাশে ঝালমুড়ির প্যাকেট হাতে একটা উদাস ছেলে এসে বসলো। ঝালমুড়ির মধ্যে সবুজ ধনেপাতা, লঙ্কাকুচি, হলুদ চানাচুর, ঈষৎ ধূসর আমচুর পাউডার; সাদা সাদা মুড়ি; এতকিছু রং, রূপ, স্বাদ —ছেলেটি কিছুই দেখছে না। আনমনে গালে মুড়ি ফেলছে।ওর চতুর্দিকে যেন নিরেট শূন্যতা। ওর বান্ধবী ওকে ছেড়ে গেছে বলে ওর  সবই শূন্য। চাকরিটা চলে গেছে বলে কোথাও কোনো রং নেই। এইমুহূর্তে ঝালমুড়ি
 শুধু পেটের আগুনের আহুতি। আচ্ছা, তোমরা এরকম কেন? সবসময় হয় অতীত না হলে ভবিষ্যতে বাঁচ? আমি ছায়া, আমি যতক্ষণ থাকি বর্তমানকে চেটেপুটে খাই। আহা! বেচারা ঝালমুড়ির স্বাদ বুঝতেই পারলো না।
 ঐ যে ডলি, মলির বাড়ি পার্কের বিপরীতে।মলির মা মলির বাবার  পিঠের ব্রণ খুঁটে দিচ্ছে, কিন্তু,মন রয়েছে সিরিয়ালে। ব্রণ থেকে একটু জল বের হলে মলির বাবার যে আরামটা হল তাতে মলির মাকে মনে পড়লো না, মনে পড়লো লুকিয়ে দীঘা যাবার ট্রিপের কথা। তারপর একসাথে দুজনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে ভাবলো দুজনেই কত একা। মা, বাবার থেকে একটু দূরে বসে মলি, ডলি একটা পুতুলের সাথে বকবক করে চলেছে। সামনে দেয়াল-জোড়া টিভি থেকে ভেসে আসছে কতরকম কথা। এত শব্দ, এত কথা সত্ত্বেও মানুষ কেন একা ভাবে নিজেকে আজ অবধি বুঝলাম না।
 পাশের একটা বাড়ি থেকে রেওয়াজ ভেসে আসছে। আমি ছায়া, যে কেবল ভাবতেই পারি, কিছু করতে পারি না সেভাবে, ভাবছি সা কি নিজেকে একা ভাবে?রে গা মা এদের ছাড়া কি সা-এর অস্তিত্ব বিপন্ন? যেমন ছেলেটি বান্ধবী আর চাকরি ছাড়া বিপন্ন বোধ করছে। ছেলেটিকে দেখে আমার খুব কষ্ট হল। ওর সাথে আমার তরঙ্গ সেট করে নিয়ে বললাম, ‘এমন একজনকে খোঁজো যে ভয় পায় না। তার পাতের এক কণা ভাত খেলেই তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ প্রথমে ছেলেটি হকচকিয়ে গেল, ভাবল কোথা থেকে এইসব এলোমেলো কথা  আসছে!ও কি শোকে —দুঃখে পাগল হয়ে গেছে? পৃথিবীতে আবার এমন মানুষ আছে নাকি যে ভয় পায় না? কিন্তু, নিজের ভিতর  তিনবার একই কথা শোনার পর ও ঠিক করল তাই করবে, তবে এককণা পাতের ভাত ব্যাপারটাতে গা গুলিয়ে উঠলো, কিন্তু, ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ‘আগে তো পাও।’
 মলি, ডলির বাড়ির দরজায় টোকা মারল ছেলেটি। দরজা খুলে মলি, ডলির মা বেরিয়ে এলো। ছেলেটিকে দেখে তার চোখ বড়বড় হয়ে গেল।আমতা আমতা করে বলল, ‘তুমি?’
 ছেলেটি ওকে দেখে বলল, ‘তুমি ভয় পেয়েছ সুমনা? তাহলে তো হবে না। তুমি তো সেদিন বিয়ে করতে ভয় পাওনি আমি আত্মহত্যা করব বলা সত্ত্বেও।’
 ‘তুমি এখানে কেন? আমার উপর নজরদারি করছ?’
 ‘না, না… এদিকে এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। ঢুকতে বলবে না?’
 সুমনার মুখটা চুপসে গেল, ওর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আমি আর ছেলেটি দুজনেই বুঝে গেলাম কাজ হবে না। এটাও বুঝলাম ছেলেটা একটা ডাহা ফেইলিওর। বারবার প্রেমে পড়ে আর প্রেমিকা চলে যায়। সুমনার ঘরের বিছানায় মলি, ডলি খেলা করছে। বাচ্চারা তো নির্ভয় হয়, তাহলে হয়তো এইবার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। সুমনা ওদের বিছানার পিছন দিকে সোফায় বসিয়ে ভেতরে চলে গেল। ডলি তখন নাক খুঁটে খাটের তলায় লাগাচ্ছে নাকের মশলাপাতি। নিজের অজান্তেই ছেলেটি বলে উঠলো ‘এমা!’
 ডলি চমকে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ‘মাকে বোলো না,মাকে বোলো না’ আহা! ছয় বছরের বাচ্চা ও ভয় পায়? তবে মলি চুপচাপ খেলনা ঘাঁটাঘাঁটি করছে, তাহলে এটুকু বাচ্চার হয়তো ভয় নেই। কিন্তু, ওর দিদি ওকে ডাকতেই ও চমকে উঠে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। কান্না শুনে সুমনা ঘরে ঢুকে ছেলেটির হাতে চন্দন রঙের একটা পানীয় ধরিয়ে দিল। তারপর তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিয়ে মলিকে যেই জোরে একটা ধমক দিল, অমনি ভয়ে মেয়েটা চুপ করে গেল। খুব তৃপ্তি করে পানীয়টি খেয়ে এবার ও জিজ্ঞেস করলো সুমনাকে, ‘তোমার বর নিশ্চয়ই খুব সাহসী। ভয়টয় পান না।’
 ‘কী ব্যাপার বলো তো তোমার? তখন থেকে শুধু ভয় ভয় করছো? বর তো আমাকেই ভয় পায়। উল্টোপাল্টা বেশি বাজার আনলে এমন চেঁচাই! দুটো বাচ্চা সামলে সম্ভব একগাদা রান্না করা?’
 ‘টেবিলের উপর ঠক করে গ্লাসটা রাখাতে টেবিলও যেন কেঁপে উঠল।’ সুমনার সাজানো সংসারে শুধু ভয় আর ভয়। এখানে হবে না।
 সুমনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আজ উঠি।’
 সুমনা কেমন যেন বোকার মতো জিজ্ঞাসা করে উঠলো, ‘তুমি কি আবার আসবে?’
 বিষণ্ণ কালো মুখ করে ছেলেটি মাথা নাড়লো, ‘আর কোনোদিন আসব না।’
 সুমনা কেমন অপ্রতিভ হয়ে লজ্জা পেয়ে কিছু বলতে গেল। কিন্তু, ওকে বলার সুযোগ না দিয়েই ছেলেটি  বেরিয়ে গেল। আমিও ওর পিছনে চললাম। মানুষের দুনিয়া আজব তো। যাকে এত ভালবাসতো, তাকেই এত ভয়? এরপর ছেলেটি ‘ভয় নেই’ বাড়ির খোঁজ চালানো শুরু করল। গলায় একটা ফলস্‌ আই কার্ড লাগিয়ে সমীক্ষার নামে বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে যেত। কোথাও গলা ধাক্কা, কোথাও সরবত, কোথাও গালাগালি জুটতো। কিন্তু, জনগণনার নামে ঢুকে ভয় কাউন্ট করেই বের হতো। ছেলেটির সাথে সাথে আমারও বেশ ভাল লাগছিল। উচ্চ, মধ্য, নিম্ন সমস্ত বিত্ত ও মেধার মানুষই ভয় পায় এবং প্রচুর ভয় পায়।
 
 মৃত্যুকে ভয় পায় না এমন মানুষও আছে! এই তো সেদিন এক ঘটনা ঘটলো। আমার খুব আলস্য লাগছিল, তাই গাছের তলায় বসে রেস্ট নিচ্ছিলাম। ছেলেটিও ক্লান্ত ছিল, ও বসেছিল আমার পাশে। আজকাল আমার কী যেন হয়েছে, কিছুতেই ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ওর উপর হেভি মায়া পড়ে গেছে। ছেলেটি ‘ভয়হীন’ বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে ভুলে গেছে যে ওর চাকরি নেই, দু-দুটো প্রেমিকা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। যদিও জানে এরকম বাড়ি ও কোনোদিন খুঁজে পাবে না, তবুও এই খোঁজ ওর নেশার মতো হয়ে গেছে। যাইহোক, দুজনেই গাছের তলায় রেস্ট নিচ্ছি, এমন সময় দেখি এক বৃদ্ধ গাছের পাশেই জানালার কপাটটা খুলে ছেলেটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি বুদ্ধি করে বললো, ‘খুব তেষ্টা পেয়েছে। একগ্লাস জল হবে?’
 বৃদ্ধ ভিতরে ডাকলেন, চোরটোর ভেবে ভয় পেলেন না। ঢকঢক করে একগ্লাস জল খেয়ে ও ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে, কে থাকেন বাড়িতে?’
 ‘আমি একা। মৃত্যুর জন্য দিন গুনছি।’
 ‘আপনার মৃত্যু ভয় নেই?’
 ‘সামনা-সামনি মৃত্যুকে দেখলে জানি না কিহবে? তবে মরতে আমি ভয় পাই না।’
 ‘আপনি কোনো কিছুই ভয় পান না?’
 ‘পাই তো। অসুস্থ হয়ে যেন বিছানায় শুয়ে না পড়ি। বিছানায় পড়ে যাওয়াকে আমার খুব ভয়!’ নিমেষে ছেলেটির মুখের আলো নিভে গেল। জলের গ্লাস ফেরত দিয়ে বলল, ‘আসি।’
 উনি বললেন, ‘একাই থাকি। তেমন টাকা পয়সাও নেই যে চোর ডাকাতের ভয় পাব। যা পেনশন পাই একজন মানুষের কোনোরকমে চলে যায়। পারলে, মাঝে মাঝে এস। একটু গল্প শুনব তোমার।’
 ‘আপনার ছেলে মেয়ে কেউ নেই? ‘হা হা করে হেসে বললেন, ‘বিয়েই করিনি, ছেলে মেয়ে কোথায় পাব?’ পুলিশে চাকরি করতাম। এখন রিটায়ার্ড লাইফ। বই পড়ি, গান শুনি, কখনও একটু টিভি দেখি। মোড়ের মাথায় আড্ডা মারি বুড়োদের সাথে। শুধু একটাই ভয়…’
 ‘বুঝেছি। বিছানায় শুয়ে পড়ার ভয়।’
 
 ছেলেটি খেয়াল করল প্রায় সাড়ে তিনকাঠার উপর জায়গা আম, কাঁঠাল, সুপুরি, লিচু গাছ সমেত সুন্দর একতলা বাড়ি। কলকাতার উপান্তে এরকম জায়গার দাম কম হবে না। পরেরদিন আবার ইচ্ছাকৃত গাছতলায়। আমিও সতর্ক হয়ে ছেলেটিকে দেখছি। আমার তরঙ্গ ওর ইচ্ছেকে বুঝতে পারছিল। ওর মধ্যেও কাজ করছে দোলাচল। একটু পরেই জানালার পাল্লা খুলে গেল। আমিও ঠান্ডা দেয়াল চাটতে চাটতে ওদের কথা শুনছিলাম। শুনছিলাম কিভাবে একাউন্টসে জোড়াতালি দিতে হতো বলে ওর হাত কাঁপতো আর কাঁপতো। আর ওর হাত কাঁপা থামলো না বলে দুবার চাকরি চলে গেল, দুবার প্রেমিকা পাত্তাড়ি গোটালো। আহারে! আমার যদি চোখ থাকতো  তাহলে দেখতেন ওখানেও টলটলে জল। আমার শরীরটা কেমন ভিজে ভিজে হয়ে উঠলো। এরপর সেই বৃদ্ধমানুষটি কাকাবাবু হলেন, ছেলেটি ভাইপো হয়ে ওনার বাতের মলম, ওষুধ, চোখের ছানি কাটা, মায়ের হাতের রান্না, যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সাপ্লায়ার হয়ে গেল। 
সাধারণ বি.কম পাশ করে যার একাউন্টসের জোড়াতালি দিতে হাত কাঁপে তারপক্ষে  বেসরকারি চাকরি পাওয়া অসম্ভব।আর সরকারি চাকরির পাওয়ার আশায় তিনটে ডট থাকাই ভাল। ডট ডট ডট।
যাইহোক, ছেলেটির একজন কাকাবাবু থেকে দুজন, দুজন থেকে তিনজন, এইভাবে বেশ একডজন কাকু, কাকিমা জুটে গেল এবং তাদের সৌজন্যে মোটামুটি পঁচিশ হাজার টাকা মাসে তার আয় হতে শুরু করল। বারোজন কাকু —কাকিমার  চোখের মণি হয়ে উঠল আমার রতন। হ্যাঁ। ও এখন আমারই। আমি সারাদিন ওর পিছনে পিছনে ঘুরি।ওর খুব সুন্দর একটা নাম আছে রত্নদীপ। তবে ও ডাকনামেই পরিচিত হয়ে গেল। আর এর জন্য সে ও আমি দুজনেই অকৃতদার বৃদ্ধটির কাছে কৃতজ্ঞ।
সেদিন আকাশে ছিল দশমীর চাঁদ। ভিতরে ছ্যাঁক-ছোঁক রান্নার আওয়াজ। ভাড়া বাড়িতে একটা বিষাদের বাষ্প থাকে, জানালার শিকগুলোতে লেগে থাকে উদ্বাস্তু ছাপ। সেখানে হঠাৎ কোনো ফাল্গুনী বসন্ত মন খারাপ করে দেয়। চাঁদের মৃদু আলো ভাড়া বাড়ি, নিজস্ব বাড়ির পার্থক্য করে না। তাই আমাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছিল আর রতনকেও আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রতনের মতো আমিও চোখের উপর হাত রেখে  শুয়ে ছিলাম। আমরা ছায়ারা এরকমই। কাউকে একবার ভালবেসে ফেললে আর তাকে ছাড়তে পারি না। 
আধা আলো-আঁধারে  তিরিশ বছরের রতনের বুক ফুঁড়ে যে জ্যোৎস্না ঢুকে যাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছিলাম। এমনসময় রতনের মা চার পাঁচটা আলুর বড়া  আর চা নিয়ে এসে  ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। নিমেষে দশমীর চাঁদ কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেল।‌ ঘরটা ঝলমল করে উঠল। মা বলে উঠলেন,’ এই ভর সন্ধ্যায় ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস কেন?’
ছেলের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললেন, ‘এবার একটা বিয়ে কর। এখন তো রোজগার করছিস।’
‘রোজগার! একজন বুড়ো, বুড়ি চলে গেলেই রোজগার কমে যাবে।’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রতনের মা বললেন, ‘এদেশে বৃদ্ধ -বৃদ্ধার অভাব নেই। তোর এখন তো ভালো একটা রেপুটেশন হয়েছে। তুই ব্যবসাটা এবার বড়ো কর। তারপর একটা বিয়ে কর।’
‘তুমি যেটা বলছ, তা করতে গেলে লোকবল লাগে। হাতে কিছু টাকা লাগে।’ এবার মেনকা একদম অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বললেন, ‘ঐ যে একা থাকেন ভদ্রলোক, কেমন আছেন রে?’
‘ভালই তো। তিয়াত্তর বছর বয়সেও তো দিব্যি ভালই ব্যাটিং করছেন। তবে, ওনার ভিতর একটা খুব অনুশোচনা আছে।’
‘তাই? কিসের অনুশোচনা?’
‘পুলিশে চাকরি করার সময় উনি নাকি ডাকাত ভেবে তাড়া করার সময় ভুল করে এক নিরীহ পথচারীকে খুন করে ফেলেছিলেন। পরে তাঁর বাড়ি খোঁজ করেছেন, তাঁর স্ত্রী, পুত্রের সন্ধান পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, পাননি।’
রতনের মা শুধু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘তাই? আমাকে ওনার ঠিকানা দিস তো।’
‘আমার সাথেই যেতে পার।’
‘তা পারি। তবু দিস’
 পরেরদিন সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ দেখছি রতনের মা  শাড়ি পরে বের হচ্ছেন। রতন তখনও ঘুমিয়ে কাঁদা। আমার কেমন যেন মনে হলো ওনার পিছনে পিছনে যাই। হুঁ, যা ভেবেছি তাই। উনি সেই অকৃতদার বৃদ্ধটির বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ছেন।
 ভদ্রলোক এত সকাল সকাল এক ভদ্রমহিলাকে  বাড়ির দরজা খুলে দেখে অবাক?
 রতনের মা বললেন  ‘আপনি কি শিবপদ বাবু?’
 ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।
 ‘আমি রতনের মা। একটু ভিতরে আসতে পারি?’
 ‘অবশ্যই। রতন ভাল আছে তো?’
 ‘হ্যাঁ। আপনার সাথে একটু দরকার ছিল।’
 ভিতরে আসার পর  ভদ্রমহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তারপর আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘আপনার সেই সোমবার দিনের কথা মনে আছে? আজ থেকে প্রায়  তিরিশ বছর আগে। দিনটা ছিল পয়লা ভাদ্র। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল সমস্ত শহর জুড়ে ছিল কারফিউ। দুটো গলির মাঝখানে  আপনার গুলি খেয়ে এক নিরীহ মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে গেছিলেন।’
 ‘হ্যাঁ… আপনি আপনি…’
 ‘হ্যাঁ। আমি ওনার স্ত্রী। তারপর বাড়িওলা পরেরদিনই আমাদের তাড়িয়ে দেয় পুলিশের ভয়ে। রতন তখন তিনমাসের। ঐ দুধের শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য কখনো রক্ত বেচে, কখনও শরীর বেচে, আয়াগিরি করে, রান্না করে মানুষ করেছি। আমার সুখের সংসার আপনার মুহূর্তের ভুলে ছাড়খার হয়ে গেল।’ ভদ্রমহিলা ডুকরে কেঁদে চললেন। আর ভদ্রলোকের মুখ ফ্যাকাশে হতে হতে ছাই রং হয়ে গেল।
 
 মুখাগ্নি রতনই করেছিল। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে শিবপদবাবু চলে যান। হার্ট অ্যাটাক না প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে সেটা নিয়ে অনেকেরই প্রচুর সংশয় আছে। তবে তিয়াত্তর বছরের অকৃতদার বৃদ্ধটির জন্য  অত  ছোটাছুটি করার কেউ নেই। রতনই প্রাণপনে সেবা করেছে ওনার।রতন যে সৎ তা নিয়ে কারুর সন্দেহ নেই। রতনের নামেই বাড়ি, ঘর সমস্ত সম্পত্তি  লিখে দিয়ে গেছেন। রতন ওখান থেকেই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখাশোনা করার একটা টিম তৈরি করেছে। ইচ্ছে আছে ব্যবসা আরো একটু দাঁড়ালে বাড়িটা দোতলা করে সেখানে বৃদ্ধাশ্রম করবে। সৎ পথে থাকলে উপার্জনের অভাব হয় না।
সেদিন  ওর মা বললেন,
‘কি রে এমন কোনো মানুষ পেলি যে ভয় পায় না?’
রতন লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললো। ওর মা নিজের পাতের থেকে একদলা ভাত  ছেলেকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো। ‘এই যে আমি। আমার কোনো ভয় নেই।’
‘মৃত্যু ভয়ও নেই?’
‘না, তোর বাবা আত্মহত্যা করার পর থেকে সেই ভয়ও চলে গেছে।’
 
 আমি বুঝলাম ছায়ার দিন এখানে শেষ।

Leave a Reply