মৌসুমী চৌধুরী 

না বলা কথাটি(মৌসুমী চৌধুরী)

তৃতীয়

প্রিয় কুশলদা,
বুজে আসা দীঘির মতো শুয়ে থাকা স্তব্ধ এ সময়ে বুড়ির সুতো হয়ে উড়ে আসছে স্মৃতি! আমার হাজার স্কয়্যার ফিটের তেল-হলুদ সংসারে আজ আছড়ে পড়ছে কুসুমগন্ধি বেদনা যত। স্মৃতির সরণি বেয়ে মনটা আজ যেন এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে হেঁটে চলেছে পিছনের দিকে। চোখের পাতায় যেন ঘনিয়ে আসছে কিশোর যীশুর মতো তোমার মুখ! নিঝুম দুপুরখানা আজ পাঁজর খুঁড়ে
অতীতের আলোয় ভেজাচ্ছে চৌকাঠ।
   তোমার কি মনে আছে কুশলদা, শুকতারা- কিশোরভারতী-আনন্দমেলার জগত ছেড়ে আমাদের “উদয়ন পাঠাগার”-এর সেই দিনগুজরান? আমাদের চোখের সামনে একে একে যেন খুলে যাচ্ছিল অপার রহস্যময় এক জগতের দুয়ার ! দিন-রাত ভাসছিল কখনও পুরোনো বইয়ের সোঁদা গন্ধে, কখনও বা নতুন বইয়ের গর্বিণী গন্ধে! সেই সময়ই লাইব্রেরি থেকে এনে তুমি আমায় পড়তে দিয়েছিলে — “শৃঙ্খল যাঁরা ভাঙল”।
বইটি পড়ে কোন এক শীত-দুপুরে বাঁধভাঙ্গা জলে ভেসেছিল বুক! 
—”এত কষ্টে এসেছে এদেশের স্বাধীনতা?”
উত্তরে উদাস স্বরে তুমি বলেছিলে,
“এ স্বাধীনতা মিথ্যে রে, ও তুই এখন ঠিক বুঝবি না।”
লাইব্রেরির জালানা দিয়ে দূরের পালাশগাছের দিকে গম্ভীর মুখে চেয়ে ছিলে তুমি।
হঠাৎ লাইব্রেরি-কাকু এসে বলেছিলেন,
“এই এবার ওঠ তোরা, এখন বন্ধ করব।”
        বয়সের চেয়ে তুমি কিন্তু তখন থেকেই অনেক বেশি পরিণত আর পরিপক্ক ছিলে, কুশলদা। অথচ তখন আমার নবম শ্রেণি, তোমার দশম। কবিতা মানে তখন আমার কাছে ছিল সঞ্চিতা বা সঞ্চয়িতা —
“আমি ভিক্ষা করে ফিরিতেছিলেম /গ্রামের পথে পথে,/তুমি তখন চলেছিলে /তোমার স্বর্ণরথে…”
আর কবিতা বলতে তুমি যে কি সব যে আওড়াতে —
” ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।
হলুদ-তেল মাখা একটি সকাল,
ঝর্নার জলে বৃষ্টিপাতের মতন শব্দ
ঝুল বারান্দার সামনের বাগানে কেউ হাসছে
শীতের রোদ্দুরের মতন।…”
আমি তো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম,
তুমি হো হো করে হেসে আমার মাথায় একটা চাটি মেরে বলতে,
“এ হল আধুনিক কবিতা।  আলো-ছায়া- মায়াময়, বুঝলি?”
      আধুনিক কবিতা আলো-ছায়া-মায়াময়? আহ্! তখনই কি আমার সেই কিশোরী বুকেতে
চারিয়ে যায় কবিতা-শিকড়? তখন কি? তখনই কি?
        আমাদের একটি নিজস্ব নদী ছিল। তার স্নিগ্ধ পাড় জুড়ে সবুজ আঁচল উড়িয়ে লাজুক পল্লীবধূর মতো দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের সেই ছোট্ট গঞ্জটি। তোমার  নিশ্চয়ই মনে আছে, কুশলদা, সেখানে আমরা প্রতিবেশীরা একে অপরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উৎসব ছুঁয়ে পরম আত্মীয়ের মতো বসবাস করতাম।
         ফাল্গুনমাসেও বাতাসে তখন একটা শিরশিরে ভাব থাকত, পুঁটিদের ঝাকড়া কাঞ্চন গাছটা আলো করে ইষৎ গোলাপী রঙা ফুল ফুটত, উমাদের সুুন্দরী আম গাছটায় ঝেঁপে মুকুল আসত, ওই আমের লাল-সবুজ অপূর্ব রূপ দেখে তুমিই তো তার নাম দিয়েছিলে সুন্দরী আম। মনে আছে? মুকুল গন্ধে ম ম করত আকাশ-বাতাস! আর ফাল্গুন মাসে মাঠের ধারের পলাশ-শিমূল গাছগুলো বিরোহিনী রাধার মতো পাঁজর ফাটিয়ে রক্ত ঝরাত। ওদিকে আকাশে চাঁদটা তখন আস্তে আস্তে গোল রুপোলী বল হয়ে ভাসত। দোল পূর্ণিমার আগে থেকেই পাড়ায় হরিনাম গান, পদাবলী কীর্তন শুরু হয়ে যেত। সে বছর দোলের দিনের কথা খুব  মনেপড়ে! আমরা রাধাকৃষ্ণ সেজে সারা পাড়া গান গেয়ে, নেচে নেচে ঘুরেছিলাম—আমি রাধা আর মালা কৃষ্ণ। সখীরা হল পুঁটি, পপি, মণি, উমা, মণিকা। রাধা-কৃষ্ণের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তারা নেচেছিল,
“আজ হোলি খেলব ও শ্যাম তোমারই সনে….”
পাড়ায় বয়স্কারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে রাধা- কৃষ্ণের ভোগের জন্য চাল-আলু-সবজি যে যা পারেন দিচ্ছিলেন… সত্যি খুব মজা লাগছিল আমার!
  সেই পূর্ণিমা রাতেই তোমাদের বাড়ির সামনের
ফাঁকা মাঠটায় আমাদের  মুনলাইট পিকনিক হচ্ছিল। হঠাৎ তুমি ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছিলে আমায়। তোমার ঘরে বাল্বের ফিকে হলুদ আলো তোমার মুখে এসে পড়েছিল, জানালার বাইরের বোগেনভেলিয়া লতার স্লেটরঙা ছায়া মেঝেতে দোল খাচ্ছিল। তোমার মুঠোয় ধরা সবুজ আবীর ছুঁয়েছিল আমার দু’গাল। তোমার মুখেও তখন বহু যুগের সবুজ কৈশোর রঙ, আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিলে একটি চিরকুট।
   দুরুদুরু বুকে আড়ষ্ট গলায় আমি বলেছিলাম,
—;” মা বকবে, কুশলদা। হাত ছাড়, যাই…”
হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ফিরে এসে দোর বন্ধ করে পড়েছিলাম চিরকুটটি,
সুমি,
তুই আমার একলা দুপুর , আমার শান্ত চিলেকোঠা
তোর স্পর্শেই জীয়নকাঠি, তোকে ঘিরেই বৃষ্টিফোঁটা।

ইতি
কুশলদা

জানালার বাইরের আকাশে তখন একলা চাঁদটা তার বুকের সবটুকু রূপো গলিয়ে দিচ্ছিল…
স্কুল জীবন শেষ হয়ে আসছিল তোমার, তাই আমাদের আর দেখাই হত না তেমন। বুকের কোটর ছেড়ে মনটা কেমন যেন দূরে দূরে, সুরে সুরে, উড়ে উড়ে  বেড়াত । তোমার চিঠির উত্তর লিখতে বসলাম। সেই চিঠিতেই প্রথম তুমি “তুই” থেকে “তুমি” হয়ে উঠেছিলে।
কুশলদা,
আজকাল আকাশটা বড্ড বেশী নীল লাগে,
চাঁদটার গায়ে যেন মোহিনী মায়া। দূরের ভূটান পাহাড়টা কী ভীষন সু্ন্দরী হয়ে ওঠে! তুমি যখন ঘোর লাগা চোখে তোমার জানালা থেকে হাঁ করে আকাশ দেখ, চাঁদ দেখ, পাহড় দেখ।
তোমার সবটুকু ভালোবাসা কেড়ে নেয় ওরা।
আমার কিন্তু খু-উ-ব হিংসে হয়! বুঝলে?
  ইতি 
  সুমি

তখন কুয়াশাময় শীতভোরে পল্লীর পথে পথে আমাদের পাড়ার ভক্তরা যেতেন কীর্তন গাইতে গাইতে,
—“প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনার মাঝে/গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে…”
শীতের শান্ত সকালের বুকে যেন আলাপনা এঁকে যেত কীর্তনের নরম মেঠো সুর। মস্তিষ্কের কোষে কোষে সুর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘুম ভেঙে যেত আমার। তখন বারান্দা থেকে দেখতাম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে, কুশলদা! সেই শীতের সকাল-দুপুর-রাত জুড়ে জোর কদমে চলছিল তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। অনেকদিন বুলু বা চম্পাও আসছিল না তোমার চিঠি নিয়ে! বুকে আমার বইছিল অহল্যা সময়….হঠাৎ একদিন, তুমি নিজেই এলে আমার মায়ের কাছে অংক কষতে। সদ্য বের হওয়া এবিটিএ টেস্ট পেপারের কোন একটা অঙ্ক আটকে গিয়েছিল তোমার। আমার মা ছিলেন তোমার-আমার স্কুলের অঙ্কের দিদিমণি।
   মনেপড়ে কুশলদা, তুমি এক ফাঁকে আমায় ডেকে চুপিচুপি বলেছিলে,
—” শোন রেখাদি,  সুপর্নাদি, কণিকাদি, বীথিকাদিরা দল বেঁধে কাল ‘গৌরি টকিজ’এ সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। যাবি? তাপস পালের ‘সাহেব’ চলছে। তুই গেলে আমিও যাবো…”
—-“তাপস পাল?  কে সে?”  আমি প্রশ্ন করেছিলাম ।
উত্তরে রেগে গিয়ে তুমি বলেছিলে,
—  “আমার ঠাকুরদা।”
আমাদের পাশের আধা-শহরের গৌরিটকিজ ছিল আমাদের সে সময়ের একমাত্র বিনোদন।
মাকে অনেক বলে রাজি করিয়েছিল রেখাদি।
কিন্তু সেইদিন সিনেমা হলে পৌঁছে গিয়ে দেখা গেল ‘সাহেব’ নয়, তখন চলছে তাপস পালের এক নতুন সিনেমা “ভালোবাসা ভালোবাসা”….
বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে উঠেছিল বুকে— ভালোবাসা! আহ্! কিন্তু ভয়ে ভয়ে আমি আর রেখাদি বলেছিলাম,
—”না বাবা, ফিরে চল্। বাড়িতে জানলে রক্ষে থাকবে না।”
তুমি বীর বিক্রমে বলেছিলে,
— “না। এসেছি যখন কিছুতেই ফিরে যাব না। তোরা সব ভীতুর ডিম। কেউ জানতে পারবে না।”
সেদিন সিনেমা হলের সেই রহস্যময় অন্ধকারে
ভালোবাসা বকুল গন্ধের মতো,  চাঁদের আলোর মতো, বেহাগ সুর লহরীর মতো আছড়ে পড়েছিল আমাদের দুই কিশোর- কিশোরী বুকে। যখন নায়ক অরূপ নায়িকা কেয়ার জন্য গাইছিল,
— “খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে মনটা কেন এত কাছে আনলে?” 
ভালোবাসা তখনই তার সূক্ষ্ম শরীর নিয়ে
আমাদেরও কি সংক্রমিত করে নি, কুশলদা?”
ফেরার পথে রূপশ্রী স্টুডিওতে আমরা একটি
সাদা-কালো গ্রুপ ছবি তুলেছিলাম। আমাদের মিঠে কৈশোর রঙের।
এক একটা দিন বড় উজ্জ্বলতা নিয়ে আসত,
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত আনন্দ-টনিক! উচ্ছ্বসিত গলায় বাবা বলেছিলেন,
—”দারুন, দুর্ধর্ষ রেজাল্ট করেছে ছেলেটা,
গোটা মহকুমায় প্রথম, জেলায় তৃতীয়!”
মা গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন,
—”জানতাম, ও অঙ্কে একশতে একশই পাবে।”
বাবা বলেছিলেন,
—”সাহিত্যটাও ও বড় ভাল বোঝে।”
সারা পাড়ায়, গোটা গঞ্জ জুড়ে তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের আলোচনা, কুশলদা! সেদিন বড় গর্বে, ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিল আমার বুক…
  আমাদের স্কুলে সে সময় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি ছিল না। তুমি ভর্তি হযেছিলে বিজ্ঞান বিভাগে পাশের আধা শহরের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। একটু একটু করে যেন বদলে যেতে লাগলে। হালকা কিশোর গোঁফ হঠাৎ একদিন দেখি দাদার কীর্তির তাপস-পাল -গোঁফ! একটু পরিণত, একটু সাহসীও…সেইদিনের কথা কি তোমার মনে আছে কুশলদা? যেদিন প্রথম তুমি আর আমি একা গিয়েছিলাম আমাদের সেই নিজস্ব সাঞ্জাই নদীটির কাছে। বাতাসে সেদিন শীত-যাই ভাব। বসন্ত দূতী কোকিলটা কোথায় যেন লুকিয়ে পাগলের মতো একটানা ডেকে চলেছিল কুউ-উ-উ-উ, কুউ-উ-উ-উ…গোধূলির গেরুয়া রঙা রোদ যেন মীরা বাঈ সমর্পণে মিশে যাচ্ছিল ফিকে ছাই রঙা নদীর গভীর বুকে! সবুজ টিয়ার ঝাঁক ট্যাঁ ট্যাঁ রব তুলে ফিরে যাচ্ছিল নীড়ে। সুস্মিতাদের বাড়ি-লাগোয়া ঘাটে চুপচাপ বসেছিলাম আমরা, আমাদের মাঝে ছিল শুধু ফিসফিসে বাতাসের সেতু। অদূরে কাদের জাল ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল। নৈঃশব্দ্য অযুত শব্দের সুর তুলছিল আমাদের বুকে …
সহসা গমগমে স্বরে তুমি বলে উঠলে দুটি লাইন,
“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;…”
রৌদ্রেরও গন্ধ থাকে?  আমার হঠাৎ মনে পড়েছিল —হ্যাঁ, থাকে তো। শীতকালে মা যখন লেপ রোদে দিতেন তাকে বুকে জড়িয়ে আমি একটা অপূর্ব মন-কেমন-করা রোদ-গন্ধ পেতাম! আমি তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“আচ্ছা কুশলদা, এ কি সেই রোদ গন্ধ?”
ঠিক তখনই তুমি আউড়েছিলে আরও দুটি লাইন,
“সব পাখি ঘরে আসে… সব নদী… ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন ;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
   কী যেন এক  এক অসহ্য ঘোরলাগায় আমি নিথর হয়ে বসেছিলাম!
যেদিন তুমি চলে যাচ্ছিলে, প্রকৃৃতিও খুব কাঁদছিল, কুশলদা! ঘন মেঘে ঢেকেছিল ডুয়ার্সের আকাশ। সকাল থেকে টিপ টিপ অভিমানী বৃষ্টিতে ভিজেছিল তোমার সাধের বোগেনভেলিয়া, টগর, গন্ধরাজ! বাড়ির পিছনের কচুগাছের জঙ্গলে ঝরছিল কুচি কুচি বৃষ্টি। অযুত মুক্তোদানায় যেন অথৈ কান্নাজল।
তীব্র হা-হুতাসে তারা গড়িয়ে পড়ছিল মাটিতে!
বন্ধুরা মন ভারী করে ভীড় করেছিল তোমার চারপাশে। আমার মা-বাবা খুব আক্ষেপ করছিলেন। মেধাবী ছাত্রটি একদিন গণিতের অধ্যাপক হবে — তাঁদের সেই স্বপ্ন চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়েছিল! তুমি যোগ দিয়েছিলে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। পাড়ার বয়স্করা বলেছিলেন, “এখানে থেকেই কিছু করা যেত না রে, বাবা?”
       তোমার সেই দশ বাই আট ফুট কাঠের ঘরে, জানালার বাইরে কাঁঠাল গাছের ডালে বৃষ্টি ভেজা চড়ুই দম্পতিকে সাক্ষী রেখে
মরিয়া আমি বলেছিলাম,
— “যেও না কুশলদা, প্লিজ!”
একটুকু চুপ করে থেকে তুমি বলেছিলে,
“ক্ষমা করো, ধৈর্য ধরো, /হউক সুন্দরতর/বিদায়ের ক্ষণ/… “
তারপর আমার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে সহাস্যে বলেছিলে,
— “সব সিচুয়েশানেই রবিবাবু  ঠিক আছেন! দেখলি? “
   তুমি চলে গেলে — ঝালাই করা রূপোলী রঙের বিশাল এক টিনের ট্রাঙ্ক, হোল্ড-অল, বইয়ের কার্টুন গুছিয়ে দিয়েছিল অপুদি। আমি দেখেছিলাম, তুমি কাঁধের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলে একটি বইঃ  কালবেলা। বেয়নেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই বই তুমি পড়তে পেরে- ছিলে কিনা তা আর কোনদিই জানা হয় নি আমার। তবে রাত জেগে আমি বহুবার পড়েছি সেই বইটি। বইটি যেন আমাদের বিনিসুতোয় বেঁধে রেখেছিল।
       তা-র-প-র… অনেক  অনেকদিন পর পুঁটিদের বাড়ির ঠিকানায় অসমের দুলিয়াজান থেকে আমাদের কয়েকজনকে চিঠি লিখেছিলে তুমি। আমার নামেও এসেছিল একটা মোটা খাম তাতে লেখা ছিলঃ  ফ্রম — লেফটেন্যান্ট কুশল দত্ত।
    
    রাজৌরি থেকে লেখা শেষ চিঠিতে তুমি বলেছিলে, সংসার ছেড়ে দিয়ে তুমি ভারতবর্ষ -কে রক্ষার ব্রতে নিজেকে পুরোপুরিভাবে সঁপে দিতে চাও। ভারতীয় স্থল সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কুশল দত্তের সেই সিদ্ধান্তে আমার সেদিন খুব কষ্ট-রাগ-অভিমান হয়েছিল। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার সবটুকু সেদিন যেন কেড়ে নিয়েছিল ভারত- বর্ষ। সেদিন ভারতবর্ষকে যেন নিজের সবচেয়ে  বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়েছিল!
            স্থানীয় ডাক্তার বলেছিলেন, আয়ু আমার আর মাত্র তিন মাস, আমার ওভারি- ক্যান্সার — থার্ড স্টেজ। চিকিৎসার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুম্বাইয়ের  “টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার সেন্টার”-এ। ‘লোকমান্য তিলক এক্সপ্রেস’টা খুব ভোরে যখন কল্যাণ স্টেশনে পৌঁছেছিল, তখন আমাদের নিতে স্টেশনে এসেছিল আমার মায়ের এক ছাত্রীর আত্মীয়, সঞ্জয়দা। সে তখন আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। সে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল তার কোম্পানির কর্ণধার আনসার আহমেদের বাড়িতে। তাঁরা ছিলেন কুচবিহারের মানুষ। আমরা তাঁর বাড়িতে স্নান সেরে, জলখাবার খেয়ে তাঁদের গাড়িতে করেই রওনা হয়েছিলাম টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার সেন্টারের উদ্দেশ্যে। সেদিন সঞ্জয়দা, আনসারকাকু এবং আমরা দুপুরে খাবার সময়টুকুও পাই নি। সারাদিন  লাইন দিয়ে নানারকম টেস্টিং, এক্স-রে, স্ক্যান ইত্যাদি করে, ডাক্তার দেখান  সেরে  সন্ধেতে আমরা পৌঁছেছিলাম “সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট”এ, যেখানে পরবর্তী কয়েকটা মাস আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে আমাদের পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনী—নাম তাঁর মার্গারেট হুগওয়ার্ফ। তিনিও তখন আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিতাই ছিলেন।
          জানো কুশলদা,  ভিনরাজ্যের মাটিতে সেই অপরিচিত তিনজন মানুষের মধ্যে প্রকৃত অর্থে সেইদিন আমি তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম “তোমার ভারতবর্ষ”কে।  আমার সামনে শীতলপাটি আশ্রয় বিছিয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতবর্ষের বিচিত্র এক মানবিক মুখ!
                       এ কথাটি তোমায় না বলাই রয়ে গিয়েছিল, কুশলদা। তাই আজ এতদিন পরে এ চিঠিটি লিখলাম। ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।
                          ইতি
                           সুমি

Leave a Reply