
পাচার
মৌসুমী চৌধুরী
আজকাল বাড়িতে ঢুকলেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায় বুলুর। কানের কাছে বাবার গঞ্জনা আর খকর-খক কাশি যেন তালে তালে কাঁসর-বাদ্যি বাজাতে থাকে। পলেস্তারা খসা বারান্দায় বসে দিন-রাত কাশতে কাশতে বাবা বুলুকে গালাগালি করতে থাকেন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না… —”এই যে এলেন, মহারাজাধিরাজ! ধাড়ি ছেলের আমার কাজকম্মের কোন চেষ্টা নেই। দিন-রাত বাপমায়ের অন্ন ধ্বংস করছেন আর সুখে ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছেন! নুড়ো জ্বালি অমন কুলাঙ্গারের মুখে!…খক্… খকর…খক্।” কাশির দমকে গলা বুজে আসতে থাকে বাবার, তবুও থামতে চান না। মা একটু থামানোর চেষ্টা করলেও খানিক বাদে আবার শুরু হয়ে যায়, -“গায়ের রক্ত-জল-করা পয়সা দিয়ে পড়ালাম। টাকা গচ্চা দিয়ে বি.এড ট্রেনিং করালাম। আর এদিকে তোমার ছেলে দিগগজ হয়ে বখাটে সঙ্গ ধরে উচ্ছন্নে যাচ্ছেন! এই তো সেদিন সেনবাবু এসে একগাদা কথা শুনিয়ে গেলেন। রেলের গুমটির ধারে গুণধর ছেলে তোমার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে গাঁজা টানছিলেন… খক্ খক্ খকর খক…” মায়ের দিকে কথার তীরখানা নিক্ষেপ করে উত্তেজনায় একেবারে কাঁপতে থাকেন বাবা! মা এসে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলেন, —”আহ্! থামো না, ছেলেটা বাইরে থেকে এল তেতেপুড়ে… যাও ঘরে যাও, এখানে বসে না থেকে একটু ঘুমোও গে বরং।” পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল বুলুর। ধোত্তোর! যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাব… টি-শার্টটা আবার গায়ে গলিয়ে থপথপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। পিছন থেকে মা ডাকতে থাকেন, —”ওরে যাসনে, বাবা। ভরদুপুরে দুটি মুখে দিয়ে যা…” অভিমানে পিছন ফিরে তাকায় না বুলু। এ পৃথিবীর কেউ ভালোবাসে না তাকে, মাও না…দ্রুত পায়ে স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে সে। খিদেতে পেটটা চোঁচোঁ করছে… রাগের মাথায় বেরিয়ে এসেছে। ঘরে জমানো একশ টাকা মতো আছে, সেটা নিয়ে এলে কিছু অন্তত কিনে খাওয়া যেত। স্টেশনের বাইরে কাচ-ঢাকা ঠ্যালাগাড়িতে ডিমটোস্ট, ডিমকষা-রুটি, মাংস-ভাত, মাছের ঝোল-ভাত, ঘুগনি-মুড়ি, পকোড়া-চপ-মুড়ি ইত্যাদি নানান খাবার বিক্রি করে ইকবালদাদা। এখন ভর দুপুরবেলা। তাই ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা টুলে বসে খদ্দেররা সব খাচ্ছে। বেশির ভাগই স্টেশনের কুলি, ক্লিনার শ্রেণির লোক। ইকবালদার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বুলু বলল, —”ডিমকষা আর রুটি দাও তো, খুব খিদে পেয়েছে। কাল টাকাটা দিয়ে দেব।” ধারে খাবার কথা শুনেই খেঁকিয়ে উঠল ইকবালদাদা, —”তোদের কত ধার হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে? সেদিন মাল গিললি, তখনও পকোড়া নিয়ে গেলি বাকিতে। তোদের পালের গোদাটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে রে? বল গে, টাকাটা শোধ করে দিয়ে যেতে। বাপে তাড়ানো, মায়ে খ্যাদানো ছেলে সব! যা যা এখন এখন থেকে দূর হ…।” —”শালা কাটার বাচ্চা…” ইকবালকে গালি-গালাজ করতে করতে স্টেশনের অন্যপ্রান্তের দিকে হাঁটা দেয় বুলু। স্টেশনের পিছন দিকটাতে হেঁটে যেতেই দূর থেকে চোখে পড়ে ভুট্টু আর বিজু কী নিয়ে যেন মনেহচ্ছে অন্তরঙ্গ ফিসফাস করছে। সে কাছে যেতেই চুপ করে যায়। ভুট্টু, বিজুরা ঠিক কী কাজ করে সেটা আজও ধোঁয়াশা বুলুর কাছে। তবে বেশ কাঁচা পয়সা হাতায় … গাঁজা-ভাঙ কিংবা দেশি-বিদেশি যে কোন রকম মদের আসর বসালে বুলুকেও ডেকে নেয় । লেখাপড়া জানে বলে তাকে তারা একটু সমীহও করে বটে। বুলুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বেশ উল্লসিত হয়ে উঠল ভুট্টুরা, —”কী বস, এই ভর-দুপুরবেলায় শুকনো মুখে স্টেশনে ঘুরছ যে? কী ব্যাপার? চল, চল, ‘নিরালা কেবিন’-এ মাছ-ভাত সাঁটাই। আর তারপর বিশেষ একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে।” হাতে যেন চাঁদ পায় বুলু। পেটে ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন দিতে শুরু করেছে। বিজুদের সঙ্গে নিরালা কেবিনে ঢুকে গরম গরম মাছের ঝোল ভাত খাওয়ার পর পেটটা ঠান্ডা হয়। খাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং-পাকাতে পাকাতে ভুট্টু বলে, —”আগামী শনিবার সন্ধেতে আসর বসবে, ন্যাড়াদের বাড়িতে, বুঝলে বস। মিল্টন, পিকাই সব্বাই আসবে। তুমিও এস কিন্তু। ন্যাড়া বলেছে এবারকার আসরটা একটু অন্যরকম হবে। তারপর চোখ মটকে বলে, —”একটু রোমাঞ্চকর। ন্যাড়াই সব ব্যবস্থা করবে বলেছে। একটা বড় দাঁও মেরেছে নাকি ব্যাটা। তারই সেলিব্রেশান আর কী! খানা-পিনা, মৌজ-মস্তি, মেয়েমানুষ সব কিছুরই ব্যবস্থা থাকবে।” চমকে ওঠে বুলু। মতলবটা কী এদের? বড় একটা লাফড়া লাগাবে নাকি! –“না না তোদের মেয়েমানুষঘটিত লাফড়ার মধ্যে আমি নেই বাবা।” —”আরে না না কিচ্ছু হবে না। ন্যাড়াদের বাড়িতে হবে সব। ওর দাদা বৌ-বাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেছে সাতদিনের জন্য। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। ন্যাড়া আজ রাতেই এসে পৌঁছবে।” ক’দিন থেকে ন্যাড়াকে দেখা যাচ্ছে না সত্যিই! কী নাকি এক ব্যবসার কাজে বিহারে গেছে। কাজটা মিটলে হাতে নাকি অনেক পয়সা আসবে। পিকাইয়ের মুখে শুনেছিল। আর কথা বাড়ায় না বুলু। বিজুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। সামুদার সাথে দেখা করতে হবে। সামনে ইলেকশান। তাঁদের পার্টির হয়ে দেওয়াল লিখনের কাজটা বুলুকে দেবে বলেছিল। কিছু পয়সা তো আসবে হাতে। বাবার গঞ্জনা আর সহ্য করতে পারছে না। যেন বুলু ইচ্ছে করে বেকার থাকছে। যত্তসব! টিউশন করত বেশ কতগুলো। অনেক দরাদরির পর যে পারিশ্রমিক ঠিক হতো তাও ঠিক মতো দিত না কে’উ। রাগে-দুঃখে গত মাস থেকে ছেড়ে দিয়েছে সকাল-বিকেলের বেকার ছাত্র ঠ্যাঙানো। সেবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার জন্য দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেবার পর মেরিট লিস্টে নাম এসেছিল বুলুর। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে হাইকোর্টে কেস হয়ে ঝুলে গেল নিয়োগ প্রক্রিয়া। ব্যাস, বাড়িতে বাবার গঞ্জনা আরও বেড়ে গেল। যেন নিয়োগ দুর্নীতির জন্যও বুলুই দায়ী। বঞ্চিত হলে, বিশেষ করে বুলুদের মতো গরীব ঘরের ছেলেরা বঞ্চিত হলে যে কী কষ্ট হয়, তা বুলু নিজে ছাড়া আর কে অনুভব করতে পারবে? কেউ বুঝল না তার কষ্টটা, বাড়ির লোকেরাও নয়। প্রত্যেকবার হাইকোর্টে তাদের কেসের শুনানির সময় বুলু এবং তার মতো কয়েকজন ক্যান্ডিডেট কোর্টে হাজির হয়। অনেক আশা নিয়ে বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। আবার নতুন একটা ডেট পড়ে। সেই দিন এই রকমই এক শুনানির শেষে কোর্ট চত্বর থেকে বাড়ি ফিরে এলে অশান্তি তুঙ্গে পৌঁছল। বাবার জুট মিলটা সেদিনই লক-আউট হয়েছিল। নিষ্ফল আক্রোশে বাবা চিৎকার করে পাড়া মাথায় করেছিলেন, —”এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। চুরি ছিনতাই যা খুশি করে খা গে যা। আমি তোকে বসিয়ে বসিয়ে দু’বেলা আর গেলাতে পারব না। মাথার ওপর দু’ দুটো আইবুড়ো মেয়ে… এরপর মরণ ছাড়া কোন পথ খোলা থাকবে না আমার”… সেদিনও আজকের মতোই দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল বুলু। পশ্চিম আকাশে তখন সবে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধের মতো রেললাইনের দিকে ছুটে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই দানবীয় গতিতে ছুটে আসছিল একটা এক্সপ্রেস ট্রেন। জ্ঞানশূন্য বুলু ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিল ট্রেনের লাইনে। হঠাৎ পেছন থেকে কার যেন এক হ্যাঁচকা টান! পিকাই একটা থাপ্পড় মেরে বলেছিল, —”পুরুষ মানুষের কি এমন কাজ শোভা পায়? ছিঃ ছিঃ! নিজেকে শেষ করে দিতে যাচ্ছিলি! চল্, আমাদের সঙ্গে সব দুঃখ ভুলে যাবি।” সেদিনই প্রথম পিকাই, ন্যাড়া, মিল্টনদের ঠেকে গিয়ে তাদের সঙ্গে আকণ্ঠ মদ খেয়েছিল বুলু। সেই থেকে শুরু। তারপর থেকেই তাদের গ্যাঙটা বুলুর পরম বন্ধু হয়ে উঠল। বিদেশি মদ-গাঁজা-ভাঙ-চুল্লু কিছুই বাদ রইল না। বাবা দিনরাত গালাগালি করলেও ন্যাড়াদের সঙ্গ ছাড়তে পারে না বুলু। তার স্কুল-কলেজ-পড়া মনটা তাদের জীবনশৈলীর সঙ্গে অনেক সময় খাপ খাওয়াতে পারে না। তবুও তাদের সান্নিধ্যে বুকের জ্বলন কিছুটা হলেও যেন কমে যায় তার! যদিও ন্যাড়াদের সোর্স অফ ইনকামটা যে সৎ পথে নয়, তা সে আন্দাজ করতে পারে। স্টেশনের আর.পি. এফরাও দু’একজন যে ন্যাড়াদের সাহায্য করার বিনিময়ে পকেট ভরায় তাও সে জানে। সেজন্যই ভুট্টু, ন্যাড়াদের দোষ তেমন একটা বড় করে দেখতে পায় না বুলু। আজ শনিবার। সকাল থেকে কয়েকটা ন্যাশনালাইজড্ এবং প্রাইভেট ব্যাঙ্কের পরীক্ষার জন্য অন-লাইনে আবেদন করল বুলু। সারাদিনে বাড়ি থেকে আর কোত্থাও বেরোল না। কিন্তু বিকেল হতেই কিসের যেন একটা অমোঘ আকর্ষণে বুকের ভিতরটা ধকধক, গুড়গুড় করতে লাগল। একটা নিষিদ্ধ তরঙ্গ বুকের ভিতরে অনবরত কাঁপন ধরাতে লাগল। তারপর সন্ধের ঠিক মুখে বাড়ি থেকে বেরোল বুলু একটু বেশিই যেন ফিটফাট হয়ে। নীল জিন্সের ওপর সবুজ পাঞ্জাবি চড়িয়ে নিল। স্কুল-কলেজ-পড়া বুলুর জীবনে কোন মেয়ে যে আসেনি তেমনটা নয়। সহপাঠী চন্দ্রাণীর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হলেও বুলুর পারিবারিক অবস্থার জন্য ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ায়নি। তারপর ফাল্গুনের এক জাফরানি বিকেলে লাজুক মুখে চন্দ্রাণী তাকে বিয়ের কার্ড ধরিয়েছিল! ন্যাড়াদের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল বুলুর। ন্যাড়াদের বাড়িটা দোতলা। সামনে, পিছনে কিছু ঝোপঝাড়, ফুলের বাগান আর নারকেল গাছের সারি। ওপর তলায় ন্যাড়ার এক অকৃতদার জ্যাঠামশাই থাকেন। বয়স নব্বুইয়ের মতো, বিশেষ চলাফেরা করতে পারেন না। আর নিচে ন্যাড়া থাকে তার দাদা-বৌদির সংসারে। ন্যাড়াদের ঘরে ঢুকে বুলু দেখল আয়োজন সব নিঁখুত। ঘরের বাতাস ম’ম’ করছে মাংস কষানোর সুবাসে। পিকাই আর মিল্টন মিলে রান্নার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ঘরের সেন্টার টেবিলে মালের বোতলগুলো আর কাচের গ্লাস রাখা। সঙ্গে রাখা হয়েছে পকোড়া আর চানাচুর। প্রায় একমাস পর ন্যাড়ার সঙ্গে দেখা হল বুলুর। ন্যাড়া তার মাথার চুল সবসময় সেভ করে রাখে। তাই বোধহয় নাম ন্যাড়া। জিম করা পেশীবহুল ছ’ফুট চেহারা তার। দুই বাহুতে ট্যাটু করা। চোখদুটোতে যেন সাপের চাহনি। বুলুর পিঠ চাপড়ে চোখ টিপে ন্যাড়া বলল, —”তাহলে কলেজ-পড়া ভালো ছেলেও আজকের এই বিশেষ আয়োজন মিস করল না রে। হাঃ হাঃ হাঃ…।” অন্যরা সবাই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল বুলু। তারপর ন্যাড়া এসে হাতে গ্লাস ধরিয়ে দেয়। অন্য সবাইও বসে যায় গ্লাস হাতে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে যেন বাবার খক খক কাশিটা শুনতে পেল বুলু… আর সঙ্গে সঙ্গেই পুরো গ্লাসটা গলায় ঢেলে আবার সেটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। আর ঠিক তখনই বুলু লক্ষ করল ন্যাড়া তার টি-শার্টটা সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে ডাইনিং হল পেরিয়ে বাঁ-দিকের প্যাসেজে অদৃশ্য হয়ে গেল! ওদিকটায় ন্যাড়ার ঘর। তারপর সব চুপচাপ। শুধু দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক আওয়াজে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এদিকে ডাইনিং হলে তখন পিকাই, মিল্টন, ভুট্টু, বিজুরা মহেন্দ্রক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আর গলায় মাল ঢেলে চলেছে ! একে একে সবার টার্ন শেষ হলে টলোমলো পায়ে বুলু ঢোকে ঘরের ভিতরে। ঘরে একটা মৃদু নীল আলো জ্বলছে। আলো আঁধারিয়া আবহে বিস্ফারিত চোখে বুলু দেখে খাটের ওপর বসে হাঁপাচ্ছে নগ্ন মেয়েটি! ফুলের পাপড়ি-মেলা তার শরীরটি দুমড়ে মুচড়ে গেছে! পাঁচটি আগুন শলাকা পালা করে তাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলার পর কাজল-নয়না ভীত হরিণীর মতো চোখ তুলে বুলুকে দেখছে মেয়েটি। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অসহায় বোধ করে বুলু। বুকের মাঝে টের পায় অবারিত হলুদ সর্ষে ক্ষেত! কী যে হয়ে গেল এক লহমায়! কাছে গিয়ে পরম যত্নে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিল মেয়েটির শরীর। আর ঠিক তখনই খাট থেকে লাফিয়ে নেমে মেয়েটি পা জড়িয়ে ধরল বুলুর, –“আমাকে বাঁচান। আমাকে এদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে আমার সৎমা। এরা আমাকে মিডল ইস্টে পাচার করে দেবে। আমাকে বাঁচান প্লিজ…” হা হা করে হাঁপাতে থাকে মেয়েটি। তারপর একটু থেমে বলে, –“আমাকে মুজফফরপুর থেকে নিয়ে এসেছে। আমায় একটু কলকাতায় পৌঁছে দেবেন? ওখানে আমার মামাবাড়ি আছে। কেষ্টপুরে…” নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে বুলুর। মুহূর্তের জন্য মাথা যেন কাজ করতে চায় না! পা টলমল করছে! ন্যাড়াদের এই ঘরটির পিছনের দরজাটা জানা ছিল তার… রাতের বুক চিরে ঝোপঝাড়, মাঠ-ঘাট, অলিগলি পেরিয়ে অচেনা মেয়েটির হাত ধরে বুলু দৌড়তে থাকে পরের স্টেশনটির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি স্টেশনে হয়তো ন্যাড়াদের লোক থাকতে পারে। তাই পরের স্টেশনে গিয়েই কলকাতার ট্রেনটা ধরতে হবে। ভাবতে ভাবতে মেয়েটিকে নিয়ে দৌড়তে থাকে সে। আর ঠিক তক্ষুনি একটা অটোর ঘরঘর শব্দ শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে বুলু বলে, –“একটু তাড়াতাড়ি চলুন, ভাই। কলকাতা যাবার শেষ ট্রেনটা ধরতেই হবে।” |