মোনালিসা চন্দ্র
প্রিয় সায়ন্তন, কে জানত বল, চিঠি লেখা কাজটা এত তাড়াতাড়ি এমন ‘রেট্রো থিং’ হয়ে যাবে? জগতে ‘মোবাইল’ নামের এক কেজো বস্তুর উদয় হবে আর সে এসেই চিঠি লেখার পাটকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ লেবেল সেঁটে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেবে একথা কি আমরা দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিলাম? আমরা যারা সত্তর আশির দশকের আগে পর্যন্ত জন্মেছি তাদের কাছে চিঠি তো ছিল জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকা এক আবেগ। সেই জিনিস লুপ্তপ্রায় অঙ্গের মত নামসর্বস্ব এক অকাজের বস্তু হয়ে রয়ে গেলে কষ্ট হবেনা আমাদের? জানি, অফিস কাছারিতে প্রতি পদে এখনও ‘চিঠি করা’ হয়, কিন্তু সে চিঠি আর আমাদের চিঠি কি এক? চিঠি লিখতে আর পেতে কী ভালোই না বাসতাম! লেখার আনন্দে আজও তাই মাঝেসাঝে লিখে ফেলি মস্ত মস্ত চিঠি। প্রাপকেরা কিন্তু সেসব চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার সেরে দেয় ফোনে। আমার প্রাপ্তির ঘরে তাই শুধুই শূণ্যতা। লেটার বক্স খুলে দেখার তাগিদও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। জানি তো, সেখানে পড়ে থাকবে স্টেটমেন্টবাহী কিছু কেজো খাম আর হ্যান্ডবিল। সপ্তাহান্তে বাক্স খুলে যাদের বের করে নিলেই চলে। চিঠি পাবার আনন্দ থেকে আজ আমরা বঞ্চিত এ কথা ঠিক, কিন্তু ‘আমাদের সেই সে-কালে’, চিঠি লেখালিখিটা যখন ছিল ‘মোস্ট ইন থিং’, তখন এ আনন্দ প্রচুর পেয়েছি আমি। সেসব চিঠির বেশিরভাগকে যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম বলে আজও তারা এক সুখ-সঞ্চয় হয়ে রয়ে গেছে আমার কাছে। একটা চিঠি তো শুধু বক্তব্য নয়, প্রেরকের স্পর্শ আর অস্তিত্বের একটা অংশও বয়ে আনে আমার কাছে। এমন জীবন্ত জিনিস ফেলে দিই কী করে, বল? হীরে-মাণিকের দ্যুতি ছড়ানো কত চিঠি যে রয়েছে আমার কাছে! স্পেশাল এক প্যাঁটরায় জমিয়ে রেখেছি তাদের। তবে মোটেও ভেব না তাদের একটিও হল ‘সেলেব-লেটার’, যাদের মালিকানার দৌলতে আমিও একজন মান্যিগন্যি লোক হয়ে উঠতে পারি। তেমন জিনিসের টুকরোটি নেই আমার ভাণ্ডারে। আমার যা আছে তা আমারই মা বোন দাদু দিদা মাসি পিসি আর বন্ধুদের লেখা চিঠি। তারাই আলো করে রেখেছে আমার চিঠির ভাঁড়ার। সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি বলে আমাকে লেখা বাবার কোনও চিঠি নেই। এই দুঃখটুকু কেবল আলোময় সেই প্যাঁটরার এক কোনে একটুখানি অন্ধকার হয়ে রয়ে গেছে। আজও যখন পুরোনো চিঠিগুলো খুলে বসি মনে আমার রামধনু খেলে। তাদের ছত্রে ছত্রে স্নেহ-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা-দুর্ভাবনা, অনুরাগ, এমনকি বিরাগেরও কত যে রঙ! রামধনুতেও অত রঙ আছে কিনা সন্দেহ। আশাভঙ্গের কাহিনিও কি কম লুকিয়ে রয়েছে তাদের ভাঁজে ভাঁজে! অলস অবসরে সেসব বৃত্তান্তের ওপর চোখ বুলোতে গেলে মনে পড়ে যায় সেই মানুষদের কথা, যারা একদিন নিজেদের আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নিয়েছিল আমার সঙ্গে, কখনও হয়ত কেবলমাত্র আমারই সঙ্গে। চিঠিগুলো তাই আমার prized possession. আমার এই সংগ্রহশালায় স্পেশাল একজিবিট-এর দাবীদার যদি কেউ থাকে তো তারা আমার কর্তামশায়ের লেখা চিঠি। সঠিকভাবে বলতে গেলে, তিনি যখন আমার কত্তামশায় হননি তখনকার লেখা চিঠি। বিবাহ-পূর্ব কালে বহুদিন ধরে চলেছিল আমার ‘ধানাই-পানাই’ পর্ব। সেই পর্ব থেকে ‘ছাড়া আর বাঁচিব না’ পর্বে আমার ক্রমিক যে উত্তরণ তার জ্বলজ্বলে দলিল সেই সব চিঠি। ঘুঘু ডাকা নির্জন দুপুরে সেগুলো খুলে বসলে আজও মনে পড়ে যায় সেসব চিঠি পাবার দিনের তীব্র রোমাঞ্চের কথা, সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে চিঠি পড়ে ফেলার আকুল প্রচেষ্টার কথা, আর সেইসব টান টান মুহূর্তে কেউ কাছে এসে পড়লে ধাঁ করে চিঠি লুকিয়ে ফেলার ভেলকির কথা। ওদের সযত্নে আর গোপনে রক্ষা করার তাগিদেই জীবনে প্রথমবার অনুভব করেছিলাম নিজস্ব এক ‘সেফ কাস্টোডি’র প্রয়োজনীয়তার কথা। ছায়াছবির মতো চোখে ভাসে পিওনদাদার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা নিজের সেই করুণ চেহারাখানি। চিঠি পেতে দেরি হলে বুকের ভিতরকার অসহ্য টনটনানি, কারণে অকারণে চোখে জল আসা, একটা চিঠি পাবার পরদিনই আরও একটা পেয়ে গেলে নিজেরই ভাগ্যকে নিজের হিংসে করার মতো হাস্যকর বৃত্তান্তও সব মনে পড়ে যায়। তার সেই চিঠিগুলো লেখার গুণে অসাধারণ ছিল, নাকি প্রেমে বোধবুদ্ধিবিরহিত হয়েছিলাম বলে যা লিখত তা পড়েই স্থবির বনে যেতাম সে বিচার আজও করে উঠতে পারিনি। তবে আজ, এত বছর পরেও, সেসব চিঠি পড়তে বসলে হৃদকমলে শিহরণের আভাস পাই। একত্রবাসের সুবাদে তার চিঠি পাবার সেই রোমহর্ষণ আজ জীবন থেকে বাদ পড়ে গেছে। প্রেমিক যখন কত্তা হন চিঠি থেকে শিহরণের ফ্লেভার বোধহয় তখনই অন্তর্হিত হয়। যে চিঠি কারওকে লুকিয়ে পড়তে হয়না, যাকে পড়ার পর টেবিলে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়, সেফ কাস্টোডিতে সামলে রাখার দরকার হয়না সে চিঠির শিরিশিরে সৌগন্ধ আসবে কোথা থেকে? সংসারচক্রের নিত্য ঘর্ষণে, তার তেলকালিতে শুধু চিঠির নয়, জীবনের অনেক সৌরভই বুঝি এমনি মাঠে মারা যায়। পুরোনো চিঠিগুলোই তখন খানিকটা ওডিকোলনের কাজ করে। পৃথিবী এধার থেকে ওধার হয়ে গেলেও সময় যেসব জায়গায় থমকে থেমে থাকে চিঠি হল তেমনই একটা জায়গা। কালির সামান্য কটা আঁচড়ে সময় স্তব্ধ হয়ে থেকে যায় চিঠির হলদে হয়ে যাওয়া পাতায়। আমার এক বন্ধু, যার সঙ্গে এখন আমার মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই, কদচিত দেখা হয়ে গেলে – হয় সে, নয়তো আমি – মুখ ফিরিয়ে অন্য পথ ধরি, অথচ তাকে কিন্তু মন থেকে কিছুতেই ঘৃণা করতে পারিনা আমি। পারিনা, তার লেখা একখানা ‘সহৃদয়’ চিঠির কারণে। পুরোনো সে চিঠিখানা তার এখনকার যাবতীয় হৃদয়হীনতাকে আড়াল করে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায় আমার সামনে। সে জানেই না, মুখ না দেখলেও তাকে আমি আজও ভালোবাসি, ভালোবাসি তার ওই চিঠিটার জন্যে। আর আছে আমার দাদুর চিঠি – অনেক অনেক চিঠি। ছেলেবেলায় তাঁর স্নেহচ্ছায়াতেই দিন কেটেছিল আমাদের। বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে মহাবিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে যখন পদপাত ঘটল, আজন্মের বাড়িঘর মায় শহর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হল রাজধানী নগরের এক হস্টেলে, তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে দাদুর চিঠি আসত নিয়ম করে। সেসব চিঠি জুড়ে প্রচুর কথা, কিন্তু যাবতীয় কথার ফোকাল পয়েন্ট মাত্র দুটি – মন দিয়ে পড়াশোনা কর, আর শরীরের যত্ন নাও। এই দুটি মাত্র বক্তব্যকে স্নেহ আর সরসতায় মিশিয়ে যে নিষ্ঠার সঙ্গে একের পর এক অতগুলো চিঠি লিখে গিয়েছিলেন দাদু, সে নিষ্ঠার সামান্য একটুখানি আত্মস্থ করতে পারলেও নিদেনপক্ষে ‘জজ-ম্যাজিস্টর’ হওয়া উচিৎ ছিল আমার, উচিৎ ছিল নীরোগ ও সুঠাম এক দেহধারী হওয়ার। ছিলেন এক দূরসম্পর্কিত দিদিমা। গদ্যে নয়, কাব্য করে চিঠি লিখতেন তিনি। সে দিদিমার ছিল অলৌকিক এক ক্ষমতা; খুব দুর্লভ ক্ষমতাও বটে। মানবচরিত্রের দোষত্রুটি নয়, তিনি দেখতে পেতেন শুধুই গুণাবলি। কোন পুণ্যের জোরে জানিনা, আমার মধ্যে সংসারের যাবতীয় সদগুণাবলির সমাবেশ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। সেইসব গুণাবলিকে ছন্দ-বাঁধুনিতে বেঁধে পত্রভেট পাঠিয়েছিলেন তিনি আমাকে। বেশ মনে পড়ে, তাঁর প্রথম চিঠিটি পেয়ে যে রোমহর্ষণ হয়েছিল, তা সহজে মেলায়নি। শজারু হয়ে আকাশে উড়েছিলাম কিছুদিন। তবে দ্বিতীয় চিঠিতেই একটা ঝাঁকুনি খেয়েছিলাম। এটা কেমন হল! যে আমি চা পর্যন্ত করতে পারি না তার মধ্যে তিনি ‘দ্রৌপদীসম রন্ধনপটিয়সী’র সন্ধান পেলেন কী করে! মানতে মন চাইছিল না মোটেই, তবু শেষ পর্যন্ত এ সত্য মানতে হয়েছিল যে, গুণাবলি বিবৃত করার সময় চর্মচক্ষু্র অভিজ্ঞতাকে পাত্তা দেননা তিনি। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে দিব্যচক্ষে যা দেখার দেখে নিয়ে মনোমত আধারে অর্পণ করেন সে গুণের তালিকা। আমার কপাল, তৃতীয় চিঠিখানি লিখবার আগেই দেহ রেখেছিলেন তিনি, ফলে আমার আসাধারণত্বেরও ইতি ঘটেছিল সেইখানে। মিষ্টি সেই দিদিমা আমার মনের মনিকোঠায় আজও বসে রয়েছেন আসনপিঁড়ি হয়ে। আচ্ছা কখনও শুনেছ, চিঠি মানুষকে ধাওয়া করে? আমাকে করেছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ এক চিঠি আমার কাছ অবধি পৌঁছোনোর জন্য একদা আমার পিছু পিছু ছুটে মরেছিল। বিশদে বলি তাহলে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর লম্বা যে ছুটিটা পেয়েছিলাম তার সদগতি করেছিলাম আমি মাসি-পিসি-মামা-কাকাদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে। এই বঙ্গেরই বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাঁরা। আমার সেই চরকিবাজির কালে আমি যখন বাঁকুড়ায় ছোটকাকার বাড়িতে তখন দুম করে রেজাল্ট গেল আউট হয়ে। কিন্তু সেই প্রাক-ইন্টারনেট প্রাক-মোবাইলের সত্যযুগে বাঁকুড়ায় বসে কিছুতেই মালদায় পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রীর রেজাল্ট জানা গেলনা। কাকুর অফিসে তখন কাজের খুব চাপ, ছুটি নেওয়া যাবেনা; অতএব, আমাকে কোনওমতে বর্ধমানে এক পিসিমার বাড়ি রেখে গেল কাকু। সেখানকার পিসতুতো দাদাটি আমায় মালদা পৌঁছে দেবে এমনই কথা হল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল একনিষ্ঠ কর্ষণকর্মী দাদাটি আমার তার সদ্য কেনা ট্র্যাক্টর দিয়ে তখন প্রতিদিন বিভিন্ন লোকের জমি কর্ষণ করে দিয়ে এত রোজগার করছে যে ট্র্যাক্টর ছেড়ে কোথাও যেতে সে রাজি নয়। কাঁচুমাচু মুখে লোক দিয়ে সে এবার আমায় পাঠিয়ে দিল মুর্শিদাবাদের কাঁদিতে আরেক পিসিমার বাড়ি। সেখানেও এক পিসতুতো দাদা আছে, যার চাকরিও নেই ট্র্যাক্টরও নেই, অতএব পরোপকার করার অঢেল সময় তার হাতে। সে বলল, চিন্তা করিস না। ম্যায় হুঁ না, আমি ঠিক পৌঁছে দেব। তবে এই তো এলি, দুদিন থাক, খাওয়া দাওয়া কর, কোনওদিন তো আগে আসিসনি আমাদের বাড়ি। পিসিমাও আদরে আহ্লাদে গলে গিয়ে ভাইঝিকে দুদিনের জায়গায় তিনদিন রাখতে চাইলেন। জীবনে ইসকুলের চৌকাঠ না মাড়ানো পিসিমার কাছে ইসকুল পরীক্ষা রেজাল্ট ইত্যাদি কোনও ধর্তব্য বস্তুই ছিলনা। শেষকালে তিনি যখন দেখলেন টেনশনে গলা দিয়ে ভাত নামছে না আমার তখন শুকনো মুখে ছেলেকে বললেন, যা বাবা, ওকে রেখে আয়। পিসিমার সেই সদ্বিবেচনায়, রেজাল্ট বেরোনোর অষ্টম দিনে মালদায় পদার্পণ ঘটল আমার। মালদায় পৌঁছে রেজাল্ট জানলাম, স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল এবং গলা দিয়ে ভাত নামল। এই ঘটনার দুদিন পর বাড়ির ঠিকানায় এল এক খাম। সে খামের গায়ে চার জায়গার ঠিকানা লেখা। খুলে দেখা গেল তার ভিতরেই রয়েছে আমার রেজাল্ট সম্বলিত চিঠিখানি, যা আমার মা পাঠিয়েছিলেন বাঁকুড়াতে ছোটকাকুর বাড়ি। কাকু সে চিঠি রিডাইরেক্ট করেছিল বর্ধমানে, সেখান থেকে তারা করেছিল কাঁদিতে এবং সর্বশেষে তারা করেছিল মালদায়। তিনবার রিডাইরেকশনের বৃত্ত কমপ্লিট করে সে চিঠি ফিরে এল মালদাতে এবং হস্তগত হল আমার। তার ভিতরকার বহুপ্রার্থিত খবর তখন বাসী রুটি। তাই চিঠির জন্য ততটা নয় বরং সেই খামের জন্য সে চিঠি সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে। এমনই আরও কতনা গল্প জড়িয়ে আছে আমার চিঠিগুলোর পরতে পরতে। এবার এক বন্ধুর কথা বলে শেষ করব। ছেলেবেলার বন্ধু সে। তার সঙ্গে সম্পর্ক আজও অটুট আমার। সুদূর সেই কৈশোরে পাড়ারই এক নব্যতরুণকে মনে মনে ভালোবেসেছিল বন্ধু আমার। সাহস ছিলনা বলে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। আমাদের সেই সত্যযুগে অবশ্য ‘আই লাভ ইউ’ বলার প্রাথমিক কর্তব্যটা ছেলেদের ঘাড়েই চাপানো থাকত। আমার বন্ধুটিও নিশ্চয় সেই আশায় বসে ছিল। একদিন সত্যিসত্যিই সেই তরুণটি আমার বন্ধুর কাছে এল মুখবন্ধ এক রঙিন খাম হাতে নিয়ে। অতঃপর, খামখানি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাজে রাঙা মুখে আমাদেরই অন্য এক বন্ধুর কাছে সেটি পৌঁছে দেবার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেল সে। সেই খাম হাতে নিয়ে ব্যথায় নীল হয়ে যেতে দেখেছিলাম আমার বন্ধুকে। সম্ভবত সেই প্রথম কারওকে অত কষ্ট পেতে দেখার অভিজ্ঞতা আমার। আজ আমার সেই বন্ধু এক সুখী গৃহিণী, উজ্জ্বল তিন সন্তানের গরবিনী মাতাও। কৈশোরে পাওয়া সেই কষ্ট এতদিনে তার ফিকে হয়ে গেছে নিশ্চয়, কিন্তু আমি যখনই আমার চিঠির ভাণ্ডার খুলে হিরে-মুক্তোগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বসি এবং করতে করতে আনন্দসাগরে ভাসি তখন অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই না পড়া চিঠিটার কথা, মুখবন্ধ রঙিন খামটার কথা। কাগজের একটা নিরীহ টুকরোকে সেদিন যে তীর হয়ে বিঁধতে দেখেছিলাম আমার বন্ধুর বুকে। লোকে মধুরেন সমাপয়েৎ করে, আমি উলটোটা করলাম। আমায় তুমি মাপ কর। চিঠি-কালচারের গঙ্গাযাত্রায় জগতের কতখানি ক্ষতিবৃদ্ধি হল, অথবা এক–দু লাইনের টেক্সট মেসেজগুলোর আবেগ-অভিঘাত চিঠির থেকে কিছুমাত্র কম কিনা সেই বিতর্কে কখনও যাবনা আমি, কারণ আমি হলাম গিয়ে অযৌক্তিকরকম চিঠিপন্থী। তোমাদের একটা বিজ্ঞপ্তির কারণে অনেকদিন পরে একখানা চিঠি লেখার সুযোগ পেলাম, এতেই আমি খুশি। আর এ সুযোগটা করে দিয়েছ বলে তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞও। মঙ্গল হোক তোমার, সায়ন্তন। খুঁজে খুঁজে এমন আরও হারিয়ে যেতে বসা বিষয়কে বিষণ্ণতার অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসো তুমি। অলমিতি, মোনালিসা চন্দ্র |