বেচে দ্যাও
মৃন্ময় গোস্বামী
রাত দুটো নাগাদ মন্মথর ডোরবেল এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। জোনাকি মন্মথকে ধমক দিয়ে বলে, যাও। দরজাটা খুলে দেখো কে কী দরকারে এসেছে। নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। নাহলে এত রাতে কেউ কারো বাড়ির বেল বাজায়। মন্মথ উঠে সোজা টয়লেটে চলে যায়। তার ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। ওদিকে বেল বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। মন্মথর কাণ্ড দেখে টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে জোনাকি বলে, ঘরে বসে তো অনেক রাজাউজির মারো, এখন দরজা খোলার নাম শুনেই তোমার বাথরুম পেয়ে গেল! ঠিক আছে আমিই দরজার ছিটকিনিতে হাত দিয়ে জোনাকি বাইরে থেকে উত্তর আসে, বৌদি আমি পরিতোষ। দাদা আছে? জোনাকি গেটের তালা খুলে পরিতোষকে ঘরে ঢুকিয়ে বলে, বেল বাজার পর থেকে তোমার দাদা টয়লেটে গিয়ে বসে আছে। এবারে ভাই তোমার দাদা পাল্টানোর সময় হয়েছে। তা এত রাতে! কোন বিপদ নাকি? ঠিক এই সময় টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে মন্মথ বলে, বৌমা কি মরে গেছে? জোনাকি ঝাড়ি মেরে বলে, বেচারা এত রাতে তোমার বাড়ি এসেছে আর তুমি এইসময় ওর সঙ্গে রসিকতা করছো! ছিঃ। তুমি একটা পশুর চাইতেও অধম। মন্মথ জোনাকিকে বলে, শোনো, এটা আমাদের দাদা ভাইয়ের ব্যাপার এ ব্যাপারে তোমার নাক গলানোর কোন প্রয়োজন নেই। পরিতোষ মন্মথর কথায় একটু বিরক্ত হয়ে বলে, দাদা, রসিকতা অন্য সময় করা যাবে। তুমি আমার সমস্যার কথা শুনলে হতবাক হয়ে যাবে। মন্মথ নিজের গলাটা রাজহাঁসের মতো এগিয়ে নিয়ে বলে, কী রকম! পরিতোষ তীব্র হতাশার সঙ্গে বলে, দাদা, আমি তো আর চালাতে পারছি নে। মন্মথর সোজাসাপ্টা উত্তর, চালাতে না পারলে “বেচে দ্যাও”। পরিতোষ উত্তেজিত হয়ে বলে, তুমি তো বলে দিলে বেচে দ্যাও। কী চালাতে পারছিনে সেটা বলতো? নিশ্চয় ফিনান্স থেকে গাড়ি কিনে গাড়ির মালিক হয়েছো, এখন আর ইনস্টলমেন্ট টানতে পারছো না। পরপর কয়েকটা ইনস্টলমেন্ট দেওয়া স্টপ করে দ্যাও তখন ঐ ফিনান্স কোম্পানিই তোমার গাড়ি টেনে নিয়ে যাবে আর তুমি ফ্রি হয়ে যাবে। এটুকু জানতে এত রাতে রাস্তার কুকুরের কামড়ের ঝুঁকি নিয়ে আমার বাড়ি এসেছো? পরিতোষ কিছু বলার চেষ্টা করতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে মন্মথ বলে, শোনো ভাই, বর্তমানে গাড়ির মালিক আর পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হওয়া সব চাইতে সহজ। যেমন তুমি গাড়ির মালিক হয়েছো। আবার আগামীকাল এ ফোর সাইজের কাগজের দু’পাতায় কিছু ছেপে প্রথম পাতায় একটা জম্পেশ নাম দিয়ে নিচে ছেপে দ্যাও, অনিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা। দ্বিতীয় পাতার একদম নিচে ছেপে দ্যাও, প্রধান সম্পাদক তারপর তোমার নাম। ব্যাস, তুমিও কাগজের প্রধান সম্পাদক হয়ে গেলে। পরিতোষ বিরক্ত হয়ে বলে, দাদা, তুমি একথা সেকথা বলে, আমাকে আমার সমস্যার কথা বলতে দিচ্ছ না। জোনাকি মন্মথকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে, বেচারা কঠিন সমস্যায় না পড়লে রাত দু’টোর সময় ঝুঁকি নিয়ে তোমার কাছে পরামর্শ নিতে আসে? মন্মথ বলে, ঠিক আছে ভাই। আমারই ভুল। তুমি শুরু করো। দাদা, আমি তো আর চালাতে পারছি নে। আমার তো ঐ একটা মুদিখানা দোকান। করোনায় চাকরিটা চলে যাওয়ার পর খুলেছি______ পরিতোষকে থামিয়ে মন্মথ গম্ভীর স্বরে বলে, রাত দুপুরে তুমি কি আমাকে তাগাদা দিতে এসেছো? পরিতোষ মাথা ঝাঁকিয়ে একহাত জিভ বের করে বলে, ছিঃ দাদা! এ কথা তুমি ভাবলে কী করে! তোমার সঙ্গে তো চুক্তিই হয়েছে যে, তোমাকে কোনদিন তাগাদা দিতে পারবো না। কিন্তু আমি তো চালাতে পারছিনে। মন্মথ বলে, তাহলে “বেচে দ্যাও”। আরে দাদা, আমি কি দোকান চালাতে না পারার কথা বলছি! এই যে সেদিন, লোডশেডিংয়ের সময় আমি আর তোমার বৌমা তোমার খাটে বসে তোমার ইনভার্টারে চলা পাখার হাওয়া খেয়ে গেলাম। তার পরদিনই বায়না ধরেছে যে, ইনভার্টার কিনে দিতে হবে। নিয়ে গেলাম শহরের বড় একটা দোকানে। সেলসম্যান বলল, আপনারা কি ইনভার্টার এ.সি. কিনতে এসেছেন? যদি সেজন্যে এসে থাকেন তাহলে আপনাদের ভাগ্য ভালো। আমাদের স্টকে এখন মাত্র দুটো আছে। আজ যদি বুক করেন তাহলে আগামীকাল ডেলিভারি দেওয়া হবে। পরের চালান কবে আসবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। হেব্বি চাহিদা। বিড়ি সিগারেটের মতো ইনভার্টার এ.সি. বিক্রি হচ্ছে। তোমার বৌমা বায়না ধরলো ইনভার্টার এ.সি. কিনবে। দিলাম কিনে। পারমিশন লাইন আগেই করা ছিল। পরদিন কোম্পানি থেকে লোক এসে এ.সি. লাগিয়ে ডেমো দিয়ে গেল। তোমার বৌমা মজায় ঘুমিয়ে বেশ খোশমেজাজেই ছিল কিন্তু বিপত্তি বাধলো গতকাল রাতে। গতকাল রাতে ঘণ্টাচারেক লোডশেডিং ছিল। তখন বায়না ধরলো এ.সি.চলছে না কেন? ঘরের আলো জ্বলছে না কেন? দাদার ইনভার্টারে আলো জ্বলে পাখা চলে। ওর বদ্ধমূল ধারণা কোম্পানি আমাদের ঠকিয়েছে। ইনভার্টার এ.সি. আর ইনভার্টার যে সম্পূর্ণ পৃথক টেকনোলজি এটা ওকে কে বোঝাবে! এখন বলছে ও কোম্পানির বিরুদ্ধে করতে মামলা করবে। পরিতোষ কাতর হয়ে বলে, দাদা, আমি তো আর চালাতে পারছি নে। মন্মথর একই কথা, “বেচে দ্যাও”। পরিতোষ জানতে চায়, কী বেচে দেবো? এ.সি.? মন্মথর উত্তর, উঁহু। বৌমাকে “বেচে দ্যাও”। পরিতোষ বলে, খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল ওয়াশিংমেশিন ফ্রিজ ল্যাপটপ এ.সি.মেশিন সোনাগয়না সহ এমনকি বাড়িটা দিয়েও তোমার বৌমাকে মাত্র একটা হরিতকি ফলের বিনিময়ে আমি বেচে দিতেই পারি। কিন্তু তাতে করে আমি কি সেভাবে বেঁচে থাকতে পারবো! সব শুনে মন্মথ বলে, একথা বলছো কেন? কারণ কেতকিকে বেচে দেওয়ার দু’তিন দিন পরই মারাত্মক বিস্ফোরক বিক্রির দায়ে আমি এন.আই-এর হাতে গ্রেফতার হয়ে আজীবন জেলে থাকবো। আমি তো ওকে নিয়ে ঘর করছি। দাদা ও জীবন্ত একটা আর.ডি.এক্স-এর পেটি। সব শুনে মন্মথ বলে, তোমার বৌদিও কম যায় না। ও একটা মাইন। আমার পদক্ষেপে একটু ভুল হলেই সশব্দ বিস্ফোরণে আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারি। তাই আমি বাড়িতে খুব সাবধানে থাকি। জোনাকি চোখ দু’টো বড় বড় করতেই মন্মথ বলে মজা করছিলাম, ও আসলে ক্যাপ বন্দুকের ক্যাপ। তাও ড্যাম্প ধরা। ফটাস করে শব্দ হয় না ভুট করে একটা শব্দ হয়। এই মেরেছে! বৌদির শুধু ভুট করে শব্দ হয়! দাদা, তাহলে “বেচে দ্যাও”। |
দারুণ লাগল।
রাত দুটোর সময় প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙিয়ে এই গল্প স্রেফ অবাস্তব ও অপ্রাসঙ্গিক।