মানস কুমার মন্ডল

মানস কুমার মন্ডল

প্রিয় সুধাদি,
ভালো আছো নিশ্চয়ই। চাকরিসূত্রে এখন তুমি আমাদের থেকে অনেকটাই দূরে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। মনে হয় আগের মতই যেন তুমি কাছেই আছো। আমার মনের আশা-আকাঙ্খা, ভালোলাগা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, তোমাকে না জানিয়ে যেমন থাকতে পারতাম না, এখনও তাই। পার্থক্য একটাই, তখন তোমার সামনে বসে, নিজের মুখে জানাতাম, আর এখন চিঠি লিখে। আমাদের পাশের বাড়িতেই তোমরা থাকতে। আমাদের হতদরিদ্র অবস্থার কথাও তুমি ভালো করেই জানো। সেই ছোট বেলায়, যখন ভাঙা, আধভাঙা মার্বেল গুলি
নিয়ে খেলা করতাম, তখন লাহিড়ীবাবুর ছেলের কাছে চকচকে, অনেক নতুন মার্বেল গুলি থাকত। কেবলই ভাবতাম কবে আমার হাতেও ওই রকম চকচকে সুন্দর মার্বেলগুলি আসবে। তোমাকে বলতাম, তুমি বলতে, হবে, সব হবে আরও বড় হও, তখন সব হবে। যখন স্কুল যাওয়া শুরু  করেছিলাম, জুলজুল করে তাকিয়ে দেখতাম, কী সুন্দর টিফিন নিয়ে আসত কেয়া, মৃণাল, তিমির আর মিতা। যখন টিফিন পিরিয়ডে কৌটোর ঢাকনা খুলত তখন কী সুন্দর মিষ্টি সুবাস উঠত। আমার ভেতরটা কেমন যেন আঁকুপাকু করে উঠত, মনে হত, কোনওদিন খেয়ে দেখতে পারব না, ওই সব কিছুর স্বাদ। কে জানে কেমন খেতে? শুকনো মুড়ি, আর পান্তা ভাতের স্বাদটুকুই আমার জানা। ওরা যখন নতুন ঝকঝকে বইয়ের গন্ধ শুকত, আমারও খুব, খুব ইচ্ছে হত। গাঁয়ের স্কুল থেকে ওরা যখন শহরে পড়তে গেল, আমি চুপিচুপি খুব কেঁদেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি তো পড়াশুনায় বেশ ভাল, মাস্টারমশাইরা তো খুব প্রশংসা করত। তাহলে কেন আরও পড়তে পারব না। সেই প্রথম দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে রাগও হয়েছিল। “-কী আমার অপরাধ?” আমার সদ্য জেগে ওঠা কৈশোরে এই প্রশ্ন অহরহ ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল। তুমি তো সবই জানো, সে সময় আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাই মণিময়বাবু বাবার সঙ্গে কথা বলে, আমার পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সমস্ত রকম সাহায্য করেছিলেন। বইপত্র জোগাড় করা থেকে টুকটাক খরচ উনিই জোগাতেন। এ’সময় আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। বাবার বয়স বেড়েছে, ধীরে ধীরে আমার ওপর পুরো সংসার। কোনও রকমে সময় বার করে পড়াশুনো চালিয়ে গেছি। তবে এ’কথা স্বীকার করতেই হবে সেসময় মণিময়বাবু পাশে না থাকলে আমার গ্রাজ্যুয়েট হওয়া হত না। এরপর স্কুল সারভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসা। টেট পরীক্ষায় ভাল স্কোর করে পাশও করেছিলাম। প্যানেলে নাম উঠেছিল, কিন্তু কোথায় চাকরি? আমার চেয়ে অনেক নীচে যাদের নাম ছিল, তারা চাকরি পেয়ে গেল। কীভাবে, কেমন করে? সে সময়, তুমি আমাকে সাহসী হতে বলেছিলে। এই অনাচার নীরবে মেনে না নিতে বলেছিলে। তোমার কথা মেনে নিয়েই শুরু হল আমার হাঁটা।
সে সময়, ভেবে দেখলাম, আসলে একটু বড় হওয়ার পর থেকেই তো আমাকে হাঁটতে হচ্ছে, রাস্তা নেই, তবু হাঁটছি, হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে কখনও পড়ে গেছি, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার হেঁটেছি। কখনও তোমার মত ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কাছে পথ জেনে নিয়েছি। কখনও উত্তাল নদী, কখনও সমুদ্র পার হয়েছি। যত এগিয়েছি, এক এক করে সঙ্গীর সংখ্যা বেড়েছে দেখে, আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, এমনি করে যেতে যেতে, একদিন ঠিক পৌঁছে যাব সেই বাড়িতে, যেখানে চাকরিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। রাজপুত্র যেভাবে রাক্ষসদের কবল থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছিল, সেই ভাবেই, সবাই মিলে একদিন চাকরিকে উদ্ধার করবই। এখন তোমার আশীর্বাদ চাই, আগে যেভাবে মাথায় হাত রেখে সাহস দিতে, এখন দূর থেকে সেই সাহস দাও। আমি যেন সফল হতে পারি। ভালো থাকবে, আনন্দে থাকবে সবসময়।
ভালোবাসাসহ
তোমার আদরের ভাই।

Leave a Reply