মানসী মন্ডল

মানসী মন্ডল

তোকে, 
 
আজ এই শেষ শ্রাবণে আমার শহরে আর তোর গ্রামে আকাশ ঘিরে মেঘ করে এসেছে।অনেক অনেক দিন পর সুদূর  বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। এই নিম্নচাপের জন্য সবার হাপিত্যেশ অপেক্ষা ছিল। ঠিক সময়ে ঠিক বৃষ্টির অভাবে কত জমি আবাদ হল না।অবশেষে অসময়ে বৃষ্টি এল। কালো মেঘ উড়ে যাচ্ছে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। থেকে থেকে দু এক পশলা বৃষ্টি।আমি আমার বাড়ির উত্তর দিকের খোলা বারান্দায় দোলনায় জয় গোস্বামীর রানাঘাট লোকাল হাতে বসে আছি। পাঠে মন নেই। আকাশে মেঘের উড়ে যাওয়া দেখছি। সঙ্গে দমকা হাওয়ার ঝাপট। আমার মন কেমন করছে। ভারি একলা বোধ হচ্ছে। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ছে। যে গ্রাম তোরও। তোর কথা মনে পড়ছে। সে আজ কতকাল আগের কথা।পড়াশোনার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এলাম। এবছর রথে আঠাশ বছর পূর্ণ হল। ভেবে আশ্চর্য হই এই যে এত দীর্ঘকাল শহরে আছি তবু তার ব্যাপ্তি আমার জীবনের প্রথম ষোলো বছরকে ছাপিয়ে উঠতে পারল না। জীবনের নানা অনুষঙ্গে সেদিনগুলো ফিরে ফিরে আসে, তুই আসিস। যখন এমন বাদল দিন হতো তখনও কেমন জানি মনখারাপ করতো আমার। কে জানে সে কীসের মনখারাপ।বাড়ি ভর্তি লোক, ঠাকুমা দাদু, কাকারা, মা বাবা, বোনেরা ।রান্নাচালায় খিচুড়ি বসিয়েছে মা। তবু কীভাবে  হঠাৎ যেন খুব একলা হয়ে যেতাম। স্কুলে যাওয়া হতো না। আমি সারাদিন দোতলায় দক্ষিণ দিকের বারান্দায় পুতুল খেলতাম। খুঁজে খুঁজে এঁটেল কাদা নিয়ে এসে পুতুল বানাতাম। দক্ষিণের বারান্দা থেকে তোদের বড় দোতলা বাড়িটা দেখা যেত। কিন্তু ওই এক খাবলা এক খাবলা। কণিকা দিদিদের জাম গাছটার ডালে অনেক খানি আড়াল করে রাখত। আমি সেই খণ্ডদৃশ্যের ভেতর দিয়ে তোকে দেখতে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কল্পনা করার চেষ্টা করতাম তুই এখন কী করছিস। হয়তো তোর বাবার ভয়ে পড়তে বসেছিস। অথচ একটুও পড়ায় মন নেই তোর। তোর হেডমাস্টারমশাই বাবা ভীষণ বকছেন তোকে। তোদের বাড়ির বন্ধ সদর দরজাটা স্পষ্ট দেখা যেত। বারান্দায় মেলে রাখা মায়ের কাপড়ের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম কখন দরজা খোলে, কখন তুই বেরিয়ে আসিস। তুই যখনই বাড়ির বাইরে আসতিস কিছু একটা বাহানায় অকারণে খুব জোরে জোরে কথা বলতিস। যাতে আমি শুনতে পাই। তোর গলা পেলেই আমি পড়া ফেলে, অঙ্ক ফেলে, আমার পুতুল ফেলে ছুটতাম দোতলায় মা ঠাকুমার মেলে রাখা শাড়ির আড়ালে নয়তো পড়ার ঘরের ভেজানো জানালার পাল্লার ফাঁকে। তোকে দেখতাম। তুইও খুঁজতিস। বাড়ির এদিক ওদিকে তাকাতিস। আমি বুঝতে পারতাম। সে যে কী আনন্দ! সারাদিনে একবার বড় জোর দুবার। ব্যস ওটুকুই। মনে হতো আজ দিনটা সার্থক হল। কোনো কোনো দিন স্কুল যাওয়ার পথে কিম্বা ফেরার পথে ক্যানেলের জোড়া বাঁধের রাস্তায় সাইকেলে তুই আমার পাশ দিয়ে আমাকে পেরিয়ে চলে যেতিস। ওইটুকু সান্নিধ্যে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম। আমার সহপাঠীরা হালকা ঠাট্টা ছুঁড়ে দিত আমার দিকে। ওরা আমাকে বাঁধের উপরে ইউক্যালিপ্টাস গাছের গায়ে লেখা ইংরেজিতে এম আর এস এর যোগ দেখাত। আমি মনে মনে দুষ্টু লেখক ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিতাম। দুর্নামের মধুর সৌরভ আমাকে ঘিরে থাকত।
কত কথা বলতে চাইতাম, কত কী বলার ছিল। বইয়ের পাতায় ছবি ভাসত। তুই আর আমি হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছি ক্যানেলের বাঁধের রাস্তা দিয়ে।ভিডিওর সিনেমায়  তখন বনে বনে গান গেয়ে বেড়াত প্রসেনজিৎ আর দেবশ্রী.. উড়ু উড়ু মন আর এই দুরু দুরু বুক, লজ্জায় হল গাল লাল টুকটুক। 
দুদিকের গাছেরা পাতা দিয়ে আড়াল করে রেখেছে আমাদের। বইয়ের পাতা খোলাই পড়ে থাকত। আমি ভাবতেই থাকতাম। কোনদিন এসে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে বলবি তুই, , এই শোন, তোর সঙ্গে কথা আছে আমার। কত অপেক্ষা, কত কত অপেক্ষা ছিল আমার।
 
তোর বয়েজ স্কুল আমার গার্লস। তখন তুই ক্লাস এইট আর আমার সেভেন। তোর পুরনো ক্লাসের সব বই  তোদের পাশের বাড়ির বুড়িকে দিতিস। এক ছুটির দুপুরে তোর জন্য খুব মনখারাপ করছে। তোকে একটিবার দেখতে ইচ্ছে করছে। অথচ তোর বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই আমার। কেন যাব, কোন বাহানায়? আমি বুড়িদের বাড়ি গেলাম। যদি একঝলক দেখা পাই তোর। বুড়িকে লুকিয়ে অনেক বার তাকালাম তোর বাড়ির দিকে, দেখতেই পেলাম না। কিছু একটা মিথ্যে বাহানায় বুড়ির বই দেখতে চাইলাম।তোর হাতের লেখা চেনা ছিল না আমার। দেখিনি কখনো। তোর বইয়ের পাতায় তোর হাতের লেখা খুঁজছি। ইংরেজি বইয়ে বৃক্ষরোপণ নিয়ে একটা প্যারাগ্রাফ ছিল। তার নীচে একটা ছবি। দুটো ছেলে একটা গাছের চারা নিয়ে মাটিতে বসাচ্ছে। ছেলে দুটোর শরীর থেকে কালি পেনে আঁকা জীবনবিজ্ঞানের লেভেলিং এর মত দুটো তীর বেরিয়ে গেছে। একটায় নাম লেখা তোর আর একটায় তোর প্রিয় বন্ধুর। সেই প্রথম আমি তোর হাতে লেখা তোর নাম দেখছি, স্পর্শ করছি শব্দটাকে। মনে মনে কল্পনায় চলে গেছি তোর ক্লাস রুমে। স্যার ইংরেজি পড়াচ্ছেন। আর চিরকালের ফাঁকিবাজ তুই পড়া না শুনে বসে বসে ছবিতে লেভেলিং করছিস। তারপর থেকেই নানা অজুহাতে, মিথ্যা বাহানায় তোর ইংরেজি বইটা বুড়ির কাছে দেখতে চাইতাম। আঙুল ঘোরাফেরা করত তোর নামের উপর।
সেবছর আমি বোধহয় ক্লাস এইট, তুই নাইন ।দোলের দিন দুপুরে স্নান সেরে খোলা চুলে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। খিড়কি আর সদর দরজা দুটোই বন্ধ করে রেখেছি পাছে কেউ এসে রঙ মাখায়। হৈ হৈ শুনে পাঁচিলের ওধারে রাস্তায় কী হচ্ছে আন্দাজ করার চেষ্টা করছি এমন সময়ে হঠাৎ আমার ফ্রকে রঙের ছিটে। আমার নীলচে ফ্রক এক নিমেষে বেগুনি। আমাদের বাড়ির একতলার ছাদে দাঁড়িয়ে পিচকিরি হাতে হা হা করে হাসছিস তুই। আমি হতভম্ব।লজ্জায় গাল আবীর। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। রাস্তা থেকে দেওয়াল বেয়ে একতলার ছাদে উঠেছিস তুই! তোর এত সাহস। তোকে তখন আমার অরণ্যদেব মনে হচ্ছিল। আর একদিন তোর গুলতি দিয়ে অনেক উঁচু খড়ের চালের মাথায় বসে থাকা গিরগিটি কে একবার টিপেই মেরে ফেললি। কী সাংঘাতিক টিপ তোর হাতে। বেচারা গিরগিটিটার জন্য দুঃখ হলেও তোর জন্য গর্ব হচ্ছিল খুব। তুই হিরো। আমার কি? কখনো বললি না তো কিছু। মাধ্যমিকের পর গ্রাম ছেড়ে এলাম পড়াশোনার জন্য। জানতাম ফেরা হবে না আর। একবার যদি বলতিস, যাচ্ছিস যা, আমাকে কিন্তু ফেলে যাচ্ছিস। বললি না। একবারও না। তোকে রেখে শহরে এলাম। আমার মনে হল কখনো চাসনি তুই আমাকে। চাইলে এভাবে চলে আসতে দিতিস না।তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাই নি আমি। সময় কোথায় তাকাবার? আমার তখন অনেক অনেক পড়া। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। পল্লীবধূ হওয়া আমার ভবিতব্য নয়।
 
তারপর নদীর জলের মত গড়িয়ে গেল কত বছর। আমার পড়া শেষ হল। প্রত্যাশামতো চাকরি  ।তারপর শেষ পর্যন্ত সেই মানুষটা এলো। আমি তাকে কতটা চাই তার তোয়াক্কাই করল না। তুমুল ভালবেসে আমাকে বিয়ে করল। তারপর  আমার ছেলে, সংসার । আমি ঘোর সংসারী। তোকে ভুলতেই বসেছিলাম। তুই তখন স্মৃতি। কখনো সখনো এক আধবার তোর কথা মনে পড়ে। সেই লোকটা  দশবছর আমাকে আর ছেলেকে জাপটে ধরে সংসার করল। তারপর হঠাৎ এক গভীর রাতে আমাদের ছেড়ে চলেও গেল।আবার আমি একা ।একা হওয়াটাই বোধহয় নিয়তি ছিল। চোখের জল আর বিরহের কত রূপ হয়। তখন তোর জন্য এখন এর জন্য। জীবন কী আশ্চর্য। হাত ধরে কত কত বাঁকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রতি বাঁকে নতুন কিছু। পুরনো যা কিছু সব পরতে পরতে সাজিয়ে রাখে কোন অতলে কে জানে। একের পর এক পরত জমতেই থাকে। কোনো এক ভূমিকম্পে সব ওলট পালট হলে সে পরতের ঢাকনা খুলে অতীতেরা দেখা দেয় আবার মিলিয়েও যায়। এখন আমার এই একা জীবনে অনেক অবসর। ছেলে বড় হচ্ছে। ওর নিজের জগৎ। মায়ের প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে আসছে ওর। 
আজকাল সকালবেলা বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বয়েজ স্কুলের খেলার মাঠে হাঁটতে যাই। স্কুলটা ভারি সুন্দর ।মাঠের চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা। তোদের বয়েজ স্কুলটাও ভারি সুন্দর ছিল। স্কুল আসা যাওয়ার পথে দূর থেকে চোখে পড়ত। কোনো একবছর রেজাল্ট বেরোনোর দিন ওই মাঠে বড় আমগাছের নীচে  তুই আর নুপূর বসেছিলি। তুই নাকি তখন তোর বন্ধু নুপূরকে বলেছিলি, আমি পাশ করব কিনা ভাবছি আর ও ভাবছে ফার্স্ট হবে না সেকেন্ড হবে। সেকথা নুপূর বলেছিল আমাকে তুই তো কোনদিন কিছু বললিই না। আমি যে মাঠে সকালে হাঁটি ওখানে অনেক ছেলেরা ব্যাট বল নিয়ে খেলে।বছর তিন আগের কথা। একদিন আমি হাঁটছি নিজের মনে আর মনে মনে কোনও একটা লেখা নিয়ে ভাবছি হঠাৎ দেখলাম তোকে। তুই মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছিস।  সেই সাদা প্যান্ট, মেটে মেটে রঙের টিশার্ট, ঠোঁটের উপরে হালকা গোঁফের রেখা।আমি দূর থেকে দেখছি। ওটা তুইই। তুইইতো ।আমি দেখছি, দেখতেই থাকছি। আমার হাঁটার পা থেমে গেছে। সবাই হেঁটে আমার পাশ দিয়ে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। তখন আর আমার চোখের সামনে কোনও স্কুলের মাঠ নয়।তখন সকাল নয়। তখন বিকেল। আর এক শ্রাবণ বিকেল। আমি স্কুল থেকে ফিরছি। ফেরার পথে স্নানের পুকুরের ঘাটে নেমে পায়ের মেঠো কাদা ধুয়ে নিচ্ছি। সবুজ পাড় সাদা শাড়ি একটু উঁচু করে ধরে তুলে আছি।হঠাৎ কানে বাঁশির আওয়াজ। পুকুরের ওপাশে আর এক পুকুর। তার পাড়ে দাঁড়িয়ে তুই আর তোর ফুটবল খেলার সঙ্গীরা। তোর হাতে ফুটবল। তোর বন্ধুরা কিছু একটা বলে মজা করছে তোর সঙ্গে। তুই হাসছিস ।আমি মাথা নীচু করে চোখের পাতা তুলে দেখছি। এক পায়ে করে অন্য পায়ের পাতা ঘষতে ঘষতে আমি জল হয়ে গলে জলে মিশে যাচ্ছি।  তোকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। একটা  চল্লিশ বছরের মহিলা একটা পনেরো ষোলো বছরের ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরাতে পারছি না। মনে হচ্ছে দেখতেই থাকি। বাড়ি ভুলেছি, স্কুল ভুলেছি ।একসময় মনে হল কী হচ্ছে আমার? এ কী করছি আমি? বাড়িতে তো আমার একটা ছেলে আছে ঠিক এরই বয়সী। আর আমি? এই আমি কি মা নই? আমি অনন্ত প্রেমিকা। কত যুগ যুগ ধরে কোন অতলে চোর কুঠুরিতে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি তোকে। সে আমির বয়স এগারো বারো কখনো পনেরো। তারপর আর বয়স বাড়ে নি তার। তোকে এভাবে চেয়েছি আমি? তাহলে যে আমি আমার সংসারের মানুষটার কথা ভেবে চোখের জল ফেলে, সে কে? ওই যে বললাম না বুকের পরত। পরতে পরতে নতুন আমিরা লুকিয়ে থাকে খুব গোপনে তার খবর আমরা নিজেও জানি না।
 
কত বছর পর তোকে দেখলাম আবার। খুব ইচ্ছে করে গ্রামে যাই। সেই ইচ্ছেটাই এবার এত তীব্র হল হরিনাম সংকীর্তনে না  গিয়ে পারলাম না। সেই হরিনাম সংকীর্তন ।মনে আছে তোর সেদিনটা? স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেছে। নতুন ক্লাস। আমার সিক্স আর তোর সেভেন।অষ্টপ্রহর শুরুর সকালে পড়া সেরে এসে দুর্গামন্দিরে তুই আর আমি বসে ঘটিং খেলছি। সুর করে ছড়া বলছি, ঘটিং ছুঁড়ছি, লুফছি আবার ছড়াচ্ছি। তুই অপেক্ষা করছিস কখন আমার হাত থেকে দান পড়ে যায়। ঘুঁটি পড়লেই তোর দান। হঠাৎ কোথা থেকে মিঠুর দাদা এসে আমাদের পাশে বসল। তোর কাছে বলতে লাগল উল্টো পাল্টা আমাকে তোর সঙ্গে জড়িয়ে। নাম বলেনি আমার তবু বুঝতে পারছিলাম সব আমাকে উদ্দেশ্য করেই। কী রে খুব খেলছিস ।খ্যাল খ্যাল ।বিয়ে করবি ।তোর বড়লোক শ্বশুর হবে। কিন্তু বিশ্বাস কর তার আগে তোর জন্য অন্যরকম কিচ্ছু অনুভূতি ছিল না। পাড়ার আর সব ছেলেপুলেও যা তুইও তাই। মিঠুর দাদার ওসব কথা শুনে বরং রাগই হচ্ছিল। তারপর দুপুরবেলা আবার একপ্রস্থ খেলা। এবার ছোঁয়াছুঁয়ি। আমি স্নান সেরে একটা নতুন ফ্রক জামা আর তুই ধবধবে সাদা পাৎলুন আর একটা টিশার্ট। তুই ছুটে আসছিস আমাকে ছুঁয়ে দিবি বলে। আমি ছুটছি। হঠাৎ কী ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকিয়েছি। তোর চোখে চোখ পড়ে গেছে আমার, একেবারে সোজাসুজি।  সকালের মিঠুর দাদার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেছে আমার। আমি খিলখিল করে হেসে ফেলেছি। আমার হাসি দেখে তুইও হাসছিস। খেলা ভুলে তাকিয়ে আছিস আমার দিকে। ঠিক তক্ষুণি আমি বুঝতে পারলাম আমার হাত থেকে দান পড়ে গেল। তারপর শুধুই তোর দান আর আমার হাপিত্যেশ অপেক্ষা।
 
প্রতি বছর অষ্টপ্রহরের সময় এলে আমি শুধু সেই দিনটা রোমন্থন করেছি আবার ভুলে গেছি। জানি না কীসের টান আমাকে টেনে নিয়ে গেল আবার গ্রামে। এবার গ্রামে গিয়ে দেখি সব বদলে গেছে।আমাদের সে মাটির দোতলা বাড়ি, দক্ষিণের বারান্দা ভাঙা হয়ে গেছে কবেই। সদর দরজার পাশে মাধবীলতার ঝাড়টাও নেই। বদলে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাস্তাঘাট, অষ্টপ্রহর মণ্ডপ সব। আমি চলে আসার পর যাদের জন্ম তারা সব যুবক, যুবতী। তারা কেউ দ্যাখেই নি আমাকে। গল্প শুনেছে।
যেমন তোর মেয়ে। স্কুলের দু এক জন দিদিমণিদের মুখে মুখে আমার নাম শুনেছে। আমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ওর। । তোর মেয়ে এখন ঠিক তত বড় যে বয়সে গ্রাম ছেড়ে এসেছি। তোর বৌয়ের সঙ্গে আলাপ হল। সঙ্গে করে ধরে নিয়ে গেল তোর বাড়িতে। আমিও তোর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় তোকে দেখতেই গেলাম। কত সহজে তোর বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোলাম। আজ আর ভয়ের কিছু নেই পাওয়ারও। মিথ্যে বলব না আমার নীল শাড়ি আর মুক্তোর মালার আসল উদ্দেশ্য ছিল তোর চোখ। তুই শুধু দেখবি দূর থেকে। এটাই আমার প্রতিশোধ। কেন কোনদিন সামনে এসে দাঁড়ালি না, কেন একবার বললি না তোকে খুব ভালবাসি। আমি তোর মুগ্ধ চোখ দেখছিলাম। আমার আনন্দ হচ্ছিল, যণ্ত্রণা হচ্ছিল।
 
ওখান থেকে ফিরে আসার পর তুই আমাকে এক রবিবারের সকালে ফোন করলি। এই প্রথমবার তোর আমার কানে কানে কথা। তুই বলিস, আমি বলি। তোর মেয়ের কথা, আমার ছেলের কথা, আমাদের নিজের নিজের সংসারের কথা। আজকাল প্রায় প্রতি রবিবারেই সকালে ফোন আসে তোর। ছুটির দিন। তখন কত কাজ থাকে আমার সংসারের। ফোন কানে ধরে কাজ করি আর কথা বলি। এত বছর পর জানালি তুই কত ভালবাসতিস আমাকে।আমার জ্বর শুনে রোজ খোঁজ নিচ্ছিলি । এখন তো আবার আমার রূপেরও প্রশংসা করিস ।আমার হোয়াটস ডিপিতে আমার ছবির খুঁটিনাটিও তোর চোখ এড়ায় না। আমি নাকি ঠিক আগের মতই আছি। আগের মতোই তো। সিঁদুর পরা আমিকে তো দেখলিই না কোনদিন। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি আর আগের আমি নেই। আমিও ভাবতাম আমি বোধহয় আগের আমিই আছি। তোকে খুব করে চাই হয়তো এখনও ।তা না হলে গ্রামে গেলাম কেন তোকে দেখতে। কিন্তু সেদিন যখন তোর দাম্পত্যের গোপন কথা গল্প করে বলছিলি, তুই জানাচ্ছিলি এখন এই মধ্য চল্লিশেও তোর পৌরুষের গৌরবের কথা, গরম হয়ে উঠছিল আমার কান। আমি শুনতে চাইছিলাম না। কাজের বাহানায় ফোন কেটে দিয়েছিলাম। আমি কি এখন তোর কাছেও একটা শরীর? আমার যৌবনে বৈধব্যে কত কত পুরুষের চোখে শুধু লালসাই দেখেছি, এখনো দেখছি, তুইও কি তাদের দলে?যে তোকে আমি ভালবাসি সেখানে কোথাও শরীর ছিল না। যেটুকু ছুঁয়েছি খেলার ছলে। কিন্তু তার জন্য আমার ভালবাসায় ঘাটতি পড়েনি কোথাও। তাহলে আজকেই বা শরীর কেন? ভাবছি আর কথা বলব না তোর সঙ্গে। দেখা করব না তোর সঙ্গে। আমি চাই না আমার ভুল ভাঙুক।  তুইও আর পাঁচটা পুরুষের মত খুব সাধারণ হয়ে যা। তুই আমার হিরো। তুই আমার হাত ধরে ক্যানেলের বাঁধের গাছের ছায়ায় গান করবি। বিকেলে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে খুব জোরে ফুটবলের বাঁশি বাজাবি। আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ঠাকুমার ভেজা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে তোকে খুঁজব। আমার নাকে ঠাকুমার কাপড় থেকে সাহেববন পুকুরের জলের গন্ধ এসে লাগবে। প্রতিবার দোলে আমার ফ্রক জামা বেগুনি হবে। বাদল দিনে আমি দক্ষিণের বারান্দায় বসে পুতুল খেলব। তুই আমার গ্রাম, তুই আমার কৈশোর,তুই আমার ঠাকুমার মুখে চিবিয়ে দেওয়া পানের স্বাদ। এসবের অনুষঙ্গে তুই আসিস তোর অনুষঙ্গে এরা আসে।শুধু তোর জন্যই আমি এখনও সেই পনেরোর কিশোরী। কিছুতেই হারাব না তোকে, তোকে যে খুব ভালবাসি, আর সেই কিশোরী মেয়েটাকেও। আর বোধহয় আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো। আমাদের কারো হাতে আর দান নেই রে, সময় দুজনের হাত থেকেই ঘুঁটি ফেলে দিয়েছে। 
 
ইতি 
সেই মেয়েটা
 

Leave a Reply