সুগন্ধা
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
অফিস থেকে ফেরার পথে আগের স্টপেজেই বাস থেকে নেমে পড়ে বৈশাখী। এখানে একটা হকার্স কর্ণারে মোটামুটি ভালো পছন্দসই জিনিসপত্র একটু সস্তায় পাওয়া যায়। সেখান থেকে টুকিটাকি দুএকটি জিনিস কিনে নেবে। সেইজন্য অফিসে বলে একটু আগে বেরিয়েছে সে। সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। ছেলে পাপানকে যে দেখাশোনা করে সাতটা পর্যন্ত তার ডিউটি। প্রায় পনেরো বছর পর দ্বিতীয়বার দীঘা যাবে বৈশাখী, আগামী রবিবার, তাই পাপানের আর নিজের জন্য সামান্য কিছু কেনাকাটা। অবাক হচ্ছেন তো? হবেন না। বিশেষ ভাবে শারীরিক সক্ষম শিশুর হাজার হাজার মা এটুকুও দেখেনি! এই একজায়গায় উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের কোনো ব্যবধান নেই। বাড়ির সকলের অবজ্ঞার দৃষ্টি আর আত্মীয় স্বজনদের লোকদেখানো সহানুভূতি অথচ বাচ্চাটির থেকে সচেতন ভাবে দূরত্ব বজায় রেখে চলা এ দুইই অসহনীয় তবুও বছরের পর বছর তাই সহ্য করে চলেছে এরা। এমন শিশুর জন্মের দায় শুধুমাত্র যেন মায়ের, কেউই তার জন্য কিছুই করবে না। দায় না থাক, দায়িত্ব তো মা অস্বীকার করতে পারে না, তাই যতদিন শরীরে শক্তি আছে বৈশাখী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে তার পাপানকে ভালো রাখার। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যাতে তার শরীর ঠিক থাকে, নাহলে তার পাপানকে দেখবে কে! পাপানের বয়স এখন ষোলো। আঠারো বছর আগে বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিল দীঘা। সুদীপের সামান্য চাকরিতে ওর চেয়ে বেশি তখন সম্ভব ছিল না। ভবিষ্যতে আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দুচোখ ভরে সেদিন সমুদ্র দেখেছিল, নোনাজলে খেলা করেছিল দুজনে। দুবছরের মাথায় পাপান এলো, সবকিছু ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকলো। সমুদ্রের নোনা জল হল তার নিত্য সঙ্গী। পাপানকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে বৈশাখী, সুদীপ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল, বাড়ির বাইরে তার বেশি সময় কাটতো। তার সামান্য আয়ে এই ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাতে না পারায় নিত্য অশান্তি লেগেই থাকত অথচ বৈশাখী অসহায়। পাপানকে রেখে কোনো চাকরি করে ছেলের খরচ চালানোর জন্য বাইরে অনেকটা সময় দিতে হবে, অতটা সময় এরকম বাচ্চার দায়িত্ব নিতে শাশুড়ি সম্মত নন। চিকিৎসা বা কোনোরকম থেরাপি ছাড়াই নিজের শিক্ষা আর ধৈর্য সম্বল করে পাপানকে নিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে গড়ে উঠল তার জগৎ। সেই দেওয়ালে টাঙানো ছবিতেই সমুদ্র সৈকতে হেঁটে বেড়ানো আর পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখা। একটা নিরপরাধ অবোধ শিশুর কারণে সংসারের তিনজন মানুষ তিনটে দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে মন ভালো থাকলে সুদীপ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে আদর করলে স্নেহের কাঙাল সেই অবুঝ মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, আড়ষ্ট উচ্চারণে কত কিছুই বলত। ঠাকুমার আদর কোনদিন পায়নি পাপান, তবু স্নানে যাওয়ার সময় পড়ে যাওয়ার ভয়ে শাশুড়িকে তার ঘরে একটু বসতেই হতো, তখনও পাপান আনন্দে খিলখিলিয়ে উঠত। অপরদিক থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় তার অপরিণত মনটাও কেমন বুঝতে পেরেছিল, উচ্ছাস ক্রমশ কমে এসেছিল। দুটো ক্ষেত্রেই বুকের সমুদ্রের ঢেউ চোখের কোণে আছড়ে পড়ত বৈশাখীর কিন্তু সে খবর রাখার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই মা ছেলের ছিল না। কোন অনুষ্ঠানেও আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হল, প্রথম প্রথম সুদীপ একা যেত পরের দিকে তাও বন্ধ হয়ে সম্পর্কের সুতো ছিন্ন হল, কেমন একটা সংকোচ ঘিরে ধরায় কোথাও যেতে ভালো লাগত না। শরীর ও মনে ক্ষয় নিয়ে এভাবেই চলছিল দিনগুলো। তারপর পাপানের ঠাকুমা মারা গেলেন বছর পাঁচেক আগে। তার তিন বছরের মাথায় হঠাৎই ভয়ঙ্কর মহামারী সুদীপকে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। যদিও প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করত সুদীপ তবুও মানবিকতাকে অস্বীকার করেননি তারা। ওই অফিসেই বৈশাখীর একটা চাকরি হলো। সমস্যা হলো পাপানকে একা রেখে বেরোনো অথচ সারাদিন দেখাশোনার জন্য লোক রাখলে তার মাইনে দিয়ে সংসার চালানোর মতো মাইনে পায় না বৈশাখী। কিন্তু ভাগ্য একটু হলেও সুপ্রসন্ন ছিল। হঠাৎই তাদের এলাকায় “আধফোটা মুকুলেরা” নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ শুরু করে এমন শিশুদের নিয়ে। খুব সামান্য টাকায় পাপানকে সেখানে ভর্তি করে, সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত সেখানেই নাচ, গান, পড়াশোনা, ছবি আঁকার মধ্যে থাকে পাপান। অসম্পূর্ণ শিশুগুলো নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তোলে নিজেদের। চারটের পরে কয়েক ঘণ্টা সময় পাপানকে রাখার জন্য খুব কষ্ট করেও একজনকে রাখতে হয়েছে আর তাই টেনেটুনে কোনরকমে সংসার চালাতে হয় তাকে। তবুও যখন দেখে এতবছর ঘরবন্দি ছেলেটা অনেকগুলো বন্ধু পেয়ে খুব খুশি আর সেই আনন্দ তার চোখে মুখে আলো জ্বেলে দিচ্ছে তখন শত কষ্টের মধ্যেও বুকটা ভরে যায় বৈশাখীর। এই সংস্থা থেকেই বাচ্চাসহ তাদের মায়েদের নামমাত্র খরচে বাসে দীঘা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। একটু কষ্ট করে হলেও টাকাটা খরচ করে পাপানকে নিয়ে যাবে বৈশাখী। একবার অন্তত সমুদ্র দেখুক ছেলেটা। সংসারের খরচ চালিয়ে ভালো জামাকাপড় বিশেষ কেনা হয় না তাদের। বেড়াতে যাওয়ার আগে একটু কেনাকাটা তাই করতেই হবে। দরদাম করে প্রয়োজনীয় জিনিস কয়েকটা কিনে হেঁটে ফেরার পথে নিজের জীবনের স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বৈশাখী। গলি থেকে বেরিয়ে আসা একটা রিক্সার সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় বৈশাখী। রিক্সাওয়ালা খেঁকিয়ে ওঠে, ” দেখে চলতে পারেন না? মরবেন নাকি?” সম্বিত ফেরে বৈশাখীর, তাড়াতাড়ি উঠে একটু অপ্রস্তুত হেসে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায়। হাঁটু আর কনুইয়ের কাছে জ্বালা করছে, বাড়ি ফিরে দেখবে। এখন কোনদিকে না তাকিয়ে হাঁটতে থাকে আর মনে মনে বলে, “মরলে তো আমার চলবে না, আমার পাপাইকে সমুদ্র দেখাতে হবে যে, তার হাত শক্ত করে ধরে অশক্ত পা দুটোকে সৈকতে হেঁটে চলার শক্তি দিতে হবে যে! তার আধফোটা মুকুলটিকে যতটা সম্ভব ফুটিয়ে তুলে সুগন্ধে ভরিয়ে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে তার অপূর্ণতাকে।” |