মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট থেকে
বৈদূর্য্য সরকার
আমরা ছোটবেলায় শুনেছিলাম, পড়াশোনা এবং সততা বেশ দরকারি জিনিস। কৈশোরে জানলাম আদব কায়দা আর ইংরাজি বলাটাই আসল। উঠতি বয়সে শিখেছিলাম, সের’ম সুপারিশের জোর থাকলে সমাজে কলকে পাওয়া যায় সহজে। মধ্য তিরিশে এসে বুঝে গেছি, কোনও লজিক জীবনে শেষপর্যন্ত খাটে না। অদৃশ্য এক মন্ত্রবলে জীবনের মইতে কেউ চড়চড় করে উঠে যায়, আর কেউ পড়ে সাপের মুখে। অধিকাংশ লোককে কালসাপ গিলে খায়। সামান্য দু’চারজন ওঠে মগডালে। কিন্তু সে সম্বন্ধে লোকের আগেকার সব ধারণা বেমালুম ভুল। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ বা দারুণ মেরিট না থেকেও বহু লোক টাকার জোরে বিদেশ যায়। চরিত্র আচার ব্যবহার বলতে গোদা লোকেরা যা বোঝে, তার স্খলন ঘটেও জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে অসুবিধা হয় না। বাপের পয়সা থাকা ছেলে অধ্যাবসায়ের জোরে উন্নতি করলে লোকে তাকে ধন্যধন্য করে আর এমনিতেই কেউ প্রচুর রোজগার করে ফেললে সমীহ দেখায় সবাই। মোদ্দা কথাটা সবাই বুঝে গেছে, জীবনে কপাল নামক একটা মহা গোলমালের জিনিস আছে। তাকে যে মানে জীবনে শান্তি পায়, যে জোর করে অস্বীকার করে সেও। মাঝখানে থাকা লোকেদের হয় মহা সমস্যা। তবে শুনেছি, গল্পে সমস্যার বদলে সমাধান কিংবা বলা ভাল স্বপ্নের অবকাশ থাকাই প্রয়োজন। তাই লটারি গোছের একটা ব্যাপারকে কেউ অস্বীকার করে না সমাজে। ১. হ্যাপির গল্প হরি ঘোষ স্ট্রিটের ছেলে হ্যাপি । ছোট থেকে অনেক লোকজনের মধ্যে বড় হয়েছে। অনেক ভাড়াটের যৌথ বাড়িতে ঘর বাথরুম নিয়ে যেমন, সংসারে অন্যান্য জিনিস নিয়েও টানাটানি দেখে এসেছে। পড়তো হাঁটা-পথে এভি স্কুলে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত। অগামারা বাংলা মিডিয়াম স্কুল হলেও মোটামুটি মাথা ছিল পড়াশোনায়। কলেজে ভর্তি হয় ফিজিক্স নিয়ে। অনার্সের ক্লাসে ছেলেপুলে ভালই ছিল। তবে হ্যাপি ক্লাসে খুব যে থাকত, তা নয়। বরং এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো, বিড়ি গাঁজা খাওয়াতেই ওদের মন ছিল বেশি। হ্যাপির সাথে নিশ্চিত থাকত রেন। কখনও সঙ্গে আরও কেউ জুটে যেত। ঝাঁঝাঁ দুপুরে তপ্ত চরাচর ঘুরে বিকেলে ঘরে ফেরা। তবে পড়াশোনা কমপ্লিট করা ছাড়া সামনে অন্য উপায় ছিল না বলেই হয়তো দু’জনেই ভালভাবে উতরে গেছিল। তার আগে হ্যাপি অবশ্য লায়েক হয়ে যাবতীয় কাণ্ডকারখানা করে ফেলেছে। পাড়ার ছেলেপুলেদের সাথে মিশে নেশাভাঙ বা ভাসান ড্যান্স শুধু নয়, কিছুদূরের সুলভ নারীদের সাহচর্য হ্যাপি অল্পবয়সেই পেয়েছিল। তখনও ওদের পাড়ায় কিছু মাতব্বর গোছের ছিল, যারা খরচ করে অল্পবয়সীদের বখাতে নিয়ে যেত। ফলে হ্যাপি সমবয়স্ক অনেকের থেকে অল্পবয়সে সংস্কার কাটিয়ে ফেলেছিল। বন্ধুবান্ধবরা জানত হ্যাপির মেয়েদের ব্যাপারে ধারণা খুব পরিষ্কার। কিন্ডার গার্ডেনে পড়ার সময়ে মায়ের কোলে-চড়া হ্যাপি তার মতোই মায়ের কোলে-চড়া কোনও মেয়েকে দেখে বিয়ে করতে চেয়ে একেবারে কান্নাকাটি শুরু করেছিল, একথা পরেও ওর মা সবাইকে শোনাতো। রেন পরবর্তীতেও দেখেছে হ্যাপি কোনও মেয়ের সাথে আলাপের পর বন্ধুত্ব প্রেম এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে না, সে সরাসরি চলে যায়— যাকে বলে কাজের কথায়। হয় বিয়েথা নয়তো বাইরে বেড়াতে যাওয়া। তবে বেশিদূর বেড়াতে গিয়ে কোনও লাভ নেই । সেই ভেবে, অফারে সস্তা ওয়ে রুম ভাড়া করে এক-আধদিন কাটাতো হ্যাপি। সে কথা শুনলে অবশ্য লোকে ভাল বলে না। তাতে অবশ্য হ্যাপির কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। তার মনে বিশেষ কোনও ইনহিবিশান নেই এবং রেনের মতো তত্ত্বকথা আওড়ে জীবন চালায় না। অনেকে আশ্চর্য হয় হ্যাপির কাজকর্মের কথা শুনেও। হ্যাপি গ্রাজুয়েশানের পড়ে ঢুকে গেছিল একটা অ্যালমুনিয়াম প্ল্যান্টে। ওদের পাড়ার সূত্রে পরিচিত একজন ছিল ওখানকার হর্তাকর্তা গোছের। হ্যাপি দেখেছিল, সেই সুশীলদার একটা মহামূল্যবান ডায়েরি আছে। যাতে নানারকম রিঅ্যাকশান এবং প্রসেডিওর লেখা। সেটার ওপর ভর করেই এখানে কাজকর্ম চলে। হ্যাপি কিছুদিন কাজকর্ম করার পর ওই ধরনের আরেকটা ডায়েরি বানিয়ে ফেলল। সে ডায়েরির কীর্তিকলাপ ছড়িয়ে গেল অন্যদের মধ্যেও। বলা বাহুল্য, সুশীলদা ভালভাবে নেয়নি ব্যাপারটা। ওকে বলেছিল, আমার হাত ধরে ঢুকে আমার ঘাড়েই হাগছো! কথাটা খুব একটা ভুলও নয়। হ্যাপি এমপ্লয়িদের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। তারপর সব ছোট কারখানার মতো ওদের ফ্যাক্টরিতেও দুর্যোগ এল। বেশ কিছুদিন প্রোডাকশান বন্ধ, লসে চলা কোম্পানিতে মাইনে আটকে যাওয়া এবং অধিকাংশ সিনিয়র এমপ্লয়ির কাজ ছেড়ে দেওয়া । ঠিক এই জায়গা থেকেই হ্যাপি খেলাটা ধরল। মালিক তার ওপর ভরসা করল বেশ খানিকটা। হ্যাপি লক্ষ দেখেছে, এই লোকটাও অদ্ভুত…প্রচুর লসের পরেও বন্ধ করে চায় না ফ্যাক্টারি। ফ্যামিলি থেকে চাপ দিলেও এখানে পড়ে থাকে। বরং ফাইনান্সার জোগাড় করে ফেলে ঠিক। হ্যাপিও ওখানে থাকতে শুরু করল। সে এখন হয়ে উঠেছে প্রোডাকশানের মাথা। তার মনের জোরেই হয়তো, পাইলট প্রজেক্ট রান করে সাফল্যের মুখ দেখেছে কোম্পানি। হ্যাপিও তার কিছু অধঃস্তনকে নিয়ে জমিয়ে বসেছে। প্লান্টের কোয়ার্টারে সবাই মিলে থাকে। কাছাকাছি বয়সের একদল ছেলেছোকরা একসাথে নেশাভাঙ রান্নাবান্না করে। রেন গিয়ে রাতে থেকে দেখেছে, ব্যবস্থা বেশ ভালই। দারণ জমেছে নরক গুলজআর। হ্যাপিদের প্ল্যান্টে একমাত্র মহিলা এমপ্লয়ি ছিল মিস দত্ত। এইচ আর ডিপার্টমেন্ট। কারখানার একপাল ব্যাটাছেলের মধ্যে সেই একটি শিবরাত্রির সলতে। হ্যাপির নজর পড়ল স্বাভাবিকভাবেই। আর হ্যাপি এসব ব্যাপারে দেরি করে না, দ্রুত এমন কিছু ঘটিয়ে ফেলে— চোখ কপালে উঠে যায় সবার। নিরালা ছাদের কোনে ফোনে একসাথে ভিডিও দেখা এবং হাতের কাজ সেরে ফেলল ওরা। পরে ম্যাডাম দুর্বল হয়ে পড়লেন খানিক। হ্যাপি জানতে পারল, উনি সেপারেটেড। ততদিনে হ্যাপি ফোনে কথাবার্তা শুরু করেছে সুদেষ্ণার সাথে। ফেসবুক থেকে যোগাযোগ। তবে মুশকিল যেটা, সুদেষ্ণা শারীরিকভাবে ঠিক সুস্থ নয়। তবু হ্যাপির চোখে কীসের যেন এক ঘন মায়া দেখেছিল রেন। তার স্বাভাবিক বুদ্ধি বলেছিল, এসবে জড়িয়ে কোনও লাভ নেই। বাস্তবিক পরিণতি ছাড়াই হ্যাপি মোহে জড়ালো। শুনলে যে কারোর আশ্চর্য মনে হবে। হ্যাপি বলেছিল, ফোনে জল খেয়েছো বা খাবার খেয়েছো কিনা জিজ্ঞেস তো কেউ আগে করেনি তাকে। এই সামান্য কথাটুকুই যে কীভাবে মহান প্রেমের আপ্তবাক্য হয়ে উঠতে পারে, সবাই বোঝেনি অবশ্য। হ্যাপি তার জীবনের কৈফিয়েৎ অবশ্য কাউকে দিতে চায় না। সে রূঢ় বাস্তব বোঝে, যতক্ষণ পকেটে পয়সা থাকে ততদিন সবাই পাত্তা দেয় । কারখানাতেই সে ভাল থাকে, সপ্তাহে একদিন বাড়ি ফেরে । এখানে একটা ঘরে থাকতে যে বেশ অসুবিধে, ইদানীং যেন বেশি করে মনে হয়। রবিবার রেন আর বিহারিটার সঙ্গে দেখা করে খায়দায়, আবার সোমবার ভোরে ট্রেন ধরে কারখানা চলে যায়। পাড়ার ছেলেদের সাথে বিশেষ যোগাযোগ করে না। দু’চারদিন পরে তাদের দিক থেকেও আগ্রহ কমে যায়। হ্যাপি বুঝে গেছে, পাড়ার বয়ে যাওয়া ছেলেদের দলে অধিকাংশ ছিটকে গেছে জীবন থেক। গত বারো চোদ্দ বছরের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফল খানিকটা হলেও এখন ভুগতে হচ্ছে। কারোর অবস্থাই সুবিধের নয়। হ্যাপির মতো যারা খানিকটা হলেও স্বাভাবিক জীবন জীবিকার মধ্যে আছে, তাদের থেকে ধার চাওয়ার লোক ক্রমশ বাড়ছে। তবে রেন মাঝে মাঝে অবাক হতো হ্যাপির কথাবার্তার ধরনে। হঠাৎ যেমন সে বলে বসল, বিয়ে করবে। সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু ঘটনাটা একটু অন্যরকমত। হ্যাপি বিয়ে করতে চাইছে আগেই বিয়ে হওয়া পাড়ার এক বউদিকে। কেননা তার সঙ্গে সবদিক থেকে নিজেকে বেশ কমপ্যাটেবেল মনে হয়েছে তার। শুনে রেন খানিকক্ষণ খাবি খায়। এর আগে সেই অসুস্থ মেয়েটির সাথে ওর সম্পর্কের কথা শুনে হ্যাপির মা গলায় দড়ি দেবে বলেছিল। এবার পাড়ারই একটি বউকে ছেলে বিয়ে করতে চাইছে শুনলে উনি কী বলবেন, ধারণা নেই কারো। ২. বিহারির কিসসা শিবকুমারকে সব অর্থেই দুর্দান্ত বলা চলে। ছোট থেকেই স্কুলে হ্যাপি রেনদের সাথে পড়ত। থাকত একটা দুর্দান্ত জায়গায়। মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট। যার গায়ে লেগে আছে কুখ্যাত বেশ্যাপল্লি। তবে ওর বাবা ছিল ইমানদার লোক। নিজের শৈশবে ঝাড়খণ্ডের ভিটে ছেড়ে কাজের ধান্দায় পৌঁছেছিলেন এ শহরে। অনেক জায়গায় ঠেকে এখানে মোটর পার্টসের দোকান করে বসেছেন। রেন দেখেছে, চারপাশের নানারকম আদিরসাত্মক ইঙ্গিতের ভেতর শিবকুমারের বাবা মা বেশ শক্ত হাতে ছেলে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে যতটা বিগড়ে যাওয়ার কথা, ততোটা পারেনি শিবকুমার। বড় বয়স পর্যন্ত রাত করে বাড়ি ফিরে বাপের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছে সে, তারপর মায়ের হাতে ভাত। ফলে যথেষ্ট শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে তার শরীর। মনের ভেতরেও খুব বেশি টানাপোড়েন নেই। স্কুলে হ্যাপি বা রেনের থেকে খানিকটা কমা স্টুডেন্ট হলেও সবার দেখাদেখি সায়েন্স নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। অনার্স ইত্যাদি আর টানতে পারেনি। তবে টাকাপয়সা রোজগারের প্রয়োজনীয়তা সে ছোট থেকেই বুঝেছিল। তাই নানারকম কাজকর্ম করে রোজগার করত। রেন হ্যাপিরাও টিউশানি করত তখন। তবে সামান্য টাকা জমিয়ে রাখার মতো দৈন্য নিয়ে শিবকুমার জন্মায়নি । সে উড়িয়ে দিত বেশিরভাগ। তাদের পাড়ার আবহাওয়ায় সেটাই মানানসই বোধহয়। তবে স্কুল কলেজের সময় তার একটা পিছুটান ছিল অবশ্য। সকলকে অবাক করে শিবকুমারের জীবনে একটি মেমসাহেব ছিল। তার নাম ওই দিয়েছিল মেম। গৌরবর্ণের প্রতি উপমহাদেশের আগ্রহ কোনও ভেদাভেদ মানে না বোধহয়। সেই মেমটি আশপাশেই থাকত। মাঝেমধ্যে সামান্য দেখাসাক্ষাৎ… সে বয়সে দশটা ছেলের চক্ষুশূল হতে সেটুকুই যথেষ্ট। কলেজ জীবনটা বোধহয় অধিকাংশ ছেলের এভাবেই যায়। সামান্য কিছুর টানে ভেসে যায় জীবন। তবে সেভাবে বেশিদিন চলে না। বিশেষত অল্পবয়সের সুন্দরী মেয়ের জীবনে। যার বাপ জেল খাটছে এবং মাও নেই ঘরে। একটা বুড়ি ঠাকুমা শুধু। মেমের বাড়ির অবস্থা জানতো শিব। কিন্তু তার পক্ষে কতটাই বা করা সম্ভব! ফলে মেম নিজের পথ দেখল। তবে সেটা বেশ ভাল যোগাযোগ বলতে হবে। টিভি চ্যানেলের কোনও লোকের সাথে সম্পর্কের সূত্রে সিরিয়ালে চান্স লাগিয়ে ফেলল। শিবকুমারের আবহমান দেবদাসের মতো অবস্থা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বাপ জমিদার নয়, ফলে তাকেও নিজের পথ দেখতে হল। কোনওরকমে গ্রাজুয়েশান শেষ করে টুকটাক সেলসের কাজ শুরু করল শিবকুমার। রেন অবশ্য পোস্টগ্রাজুয়েশানে ভর্তি হয়েছে ততদিনে। তবু যোগাযোগ থেকে গেল মোটামুটি। মেমের অধ্যায় শেষ হওয়ার পরে পাড়াতুতো মেয়েদের সাথে ঘোরাফেরা শুরু করেছে শিবকুমার। লোকে জানে, ওদের পাড়ায় আজ এর সাথে তো ক’দিন পরে আরেকজনের সাথে চলে। পাড়ার নানারকম উৎসব অনুষ্ঠানে তার বেশ দরাজ ছাড়পত্র মেলে। কিছুদিন নানা ঘাটের জল মালে মিশিয়ে খেয়ে শিব সুযোগ পেল বিপিওতে। তখনও বিপিও নিয়ে লোকের মধ্যে একটা নাক সিটকানো ভাব ছিল। হয়ত তাদের জীবন স্বাভাবিক ঘড়ি মেপে চলে না বলেই। সারারাত কানে ফোন নিয়ে কাজ করে ভোরবেলা ঘরে-ফেরা ছেলে হয়ে উঠল শিব। তবে রাতে কাজে যাবে বলে সন্ধেগুলো নষ্ট করত না সে। যথারীতি আমোদ অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতো। তবে পার্থক্য এই, যখন অন্যরা বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়তো তখন শিব কাজ শুরু করত। শরীরের এনার্জি কিছুতেই যেন ফুরোয় না শিবের। দেখে সবাই আশ্চর্য হতো। ততদিনে রেনও চাকরিতে ঢুকেছে। হ্যাপি তো আগে থেকেই। তাই তিনজন মিলে আগের রাতে হঠাৎ প্ল্যান করে ভোরে দীঘা চলে যেতে কোনও আপত্তি নেই। রাতের আসরে শিব আকণ্ঠ খাওয়ার পরে একটা কথাই বলে, আমি বলেছিলাম মাল কম পড়ে যাবে! তবে শেষপর্যন্ত সে শুয়ে পড়ে, নয়তো হ্যাপি বা রেন ওকে ইচ্ছে করে ওকে শুকনো খাইয়ে দেয়। শিবের এই ব্যাপারে খুব দুর্বলতা। শুকনো নেশা দেখলেই ভড়কে যায়। যতক্ষণ জেগে থাকে, তার জীবনের উঁচু উঁচু স্বপ্নের গল্প বলে। শুনে, অঙ্ক পরীক্ষায় তার থেকে টুকে পাশ করার কথা বলতে হ্যাপি অবশ্য ছাড়ে না। সেসব গায়ে মাখে না শিব, এদের সে অন্য চোখে দেখে। স্কুলেও তার পেছনে লাগলে এদের কিছু বলতেনা শিবকুমার, অন্য ছেলেরা হাসলে মার খেতো শিবের হাতে। সেইসব ছেলেরা এখনও হ্যাপিদের সমঝে চলে। যদিও তারা শিবের নামে পেছনে চারটে কথা বলতে ছাড়ে না। তাতে শিবের ঘণ্টা। সে জানে, যেখানে যাবে ঠিক জমিয়ে নেবে। ওদের মতো হাঁদাক্যাবলা হয়ে পড়ে থাকার মাল নয় সে। পড়াশোনা সেভাবে না হলেও নানারকম কাজকর্ম জানা আছে তার। দু’চারটে পাশ দিয়ে ঘরে বসে বাপের অন্ন ধ্বংসের থেকে সেই ভাল। ওদের পাড়ায় একটা বিরাট ভাঙা বাড়ি ছিল। এখন বেওয়ারিশ বলা যায়। বারো জাতের লোক যে যেখানে পেরেছে দখল করে বসেছে। ছাদের ওপরের চিলছাদও বেশ প্রশস্ত। সেখানে মইয়ে করে উঠে পাড়ার ছেলেরা মালঝোল খায়। কে আবার একটা শিবলিঙ্গ বসিয়েছে, সেই উপলক্ষে বাবার প্রসাদ। সব মিলিয়ে হট্টগোল একেবারে। সেখানে হ্যাপি রেনকেও নিয়ে গেছে শিব। হাওয়া যেন একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে শিব ক্রমশ আলাদা হতে থাকল এসব থেকে। সে কর্পোরেটে ঢুকে পড়েছে। বিপিও হলেও চাকচিক্য যথেষ্ট। সেখানকার লোকেদের আর কিছু থাক বা না থাক, টাকা আছে। শিব বুঝে গেছে, সেটাই আসল কথা। শিবকুমারের একটা বড় গুণ ছিল, যে কোনও জায়গায় মিশে যেতে পারে। বস গোছের লোকেদের সাথে ওঠাবসা করে, সেই সূত্রে জুনিয়ার ছেলেমেয়েদের কাছে খাতির পায় বেশ। সেসব গল্প রেন বা হ্যাপি শুনে আমোদিত হয়। অফিসের পার্টিগুলো মুক্তাঞ্চল। শিব দু’চার পাত্র সিনিয়ারদের সাথে খেয়ে চলে আসতো জুনিয়ার ছেলেদের কাছে, সেই সূত্রে আলাপ হতো মেয়েদের সাথে। তাদের সাথে জমাতে বেশি সময় লাগতো না ওর। তাদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া-আসা কিংবা কারো সাথে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত করে নিয়েছিল শিব। ততদিনে পাড়ার একটা মেয়ের সাথেও খানিকটা সিরিয়াস সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয় অবশ্য। তবু সেই মেয়েটি স্বাভাবিক নারীসুলভ কায়দায় শিবের চালচলনে বাধ সাধছে। রেন জানতো, শিব মুখে হাজার বললেও একে কাটাতে পারবে না। বাড়িতেও জানাজানি হয়েছে সব কথা। দু’বাড়ি থেকেই বিয়ের জন্যে চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে। শিব অবশ্য চাকরিতেও খানিকটা উন্নতি করেছে। একবার যদি অনসাইট যেতে পারে, তাহলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়। ৩. রেনের কাহিনি ওর জীবনযাত্রা বেশ অদ্ভুত। পাড়ার অনেকে ঠাট্টা করে বলে, বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ ঘোড়সওয়ার। অসম মেঘালয়াতেও তাকে চরকি কেটে বেড়াতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রোডাকশান প্ল্যান্টে নানারকম ইন্সট্রুমেন্ট সার্ভিসিং এবং বিক্রি করতে যায় সে। তবে কর্পোরেট নয় বলে মাইনে বিরাট কিছু পায় না। চালিয়ে নেয়। তাছাড়া উপায় কী! পুরনো হলেও নিজেদের বাড়িতে থাকে রেন, সেই একটা বাঁচোয়া। তবে শরিকদের সঙ্গে টানাপোড়েন লেগে থাকে। বাইরে ফ্ল্যাট বা বাড়ি করে চলে গেলেও পৈতৃক সম্পত্তি বেচে ভাগের টাকা নেওয়ার ষোলোআনা ইচ্ছে তাদের। সেজন্যেই কি রেন কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না? সেটা একটা কারণ বটে আবার তার স্বভাবও কিছুটা দায়ী। সব মিলিয়ে সে নিজের মতো জীবনযাপন করে এবং বিশ্বাস করে তার ব্যাপারে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। অবশ্য সে লোকের নামে চারটে কথা বলতে ছাড়ে না। সাধারণ ছাপোষা বাঙালি জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা এপিক পর্যায়ে। সে বাবদে মধ্যবিত্ত লোকেদের সমস্ত কিছু তার চোখে বিষবৎ ঠেকে। উত্তর কলকাতার পুরনো পাড়ার যাবতীয় ভ্যাদভ্যাদে সেন্টিমেন্ট সে খারিজ করে দেয়। তার বদ্ধমূল ধারণা, সে অদ্ভুত সব জায়গায় ঘুরে ততোধিক অদ্ভুত লোকেজনের সাথে মেলামেশা করে জগৎ উদ্ধার করে দিচ্ছে। তার মতো আশ্চর্য সব পরিস্থিতিতে কেউ পড়েনি। সে কথা অবশ্য মিথ্যে নয়। কাজের সূত্রে সে এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে— সেখানকার সম্বন্ধে জানা তো দূরের কথা, নাম পর্যন্ত শোনেনি শহুরে মধ্যবিত্তেরা। সেসব এলাকায় দুষ্কৃতিদের ছোড়া বোমা ফেটেছে তার দশ ফুটের মধ্যে। আবার মেয়ে ছিনতাইবাজের হাতে সে টাকা খুইয়েছে। তারা আসে মোহিনী বেশে এবং তাতেই ছেলেছোকরারা ফাঁসে। মধ্যরাতে রেন ট্রেনে চাপে বিনা রিজারভেশানে। সেখানে টিটি বা আটেনডেন্টদের টাকা দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে। ট্রেন মিস হলে বাসের ছাদে অন্যান্য প্রান্তিক লোকজনের সঙ্গে চড়ার অভিজ্ঞতা ক’টা লোকেরই আছে! কোনও জায়গা থেকে ফিরে সকালে হাওড়া স্টেশনে বাথরুম সেরে আবার অন্য কোনও জায়গার ট্রেন ধরে ওকে বেরিয়ে পড়তেও হয় কখনও। অনেকে ঠাট্টা করে, ট্রাভেলিং সেলসম্যান প্রবলেম ওর মতো কাউকে দেখেই তৈরি হয়েছিল। সন্ধেগুলো নিয়ে যে কী করবে সেই নিয়ে রেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে সর্বদা। বিভিন্ন পানশালায় ঘোরাঘুরি করে এবং বিদেশি গল্পের মতো দৃশ্যপট কল্পনা করে থাকে। সেসময় সে কার্পণ্য করে না। চোখমুখে অদ্ভুত একটা কাঠিন্য এবং সবকিছু কিনে নেওয়ার স্পর্ধা ফুটে ওঠে তার মধ্যে। টাকাপয়সা ছড়ালে এসব জায়গায় খাতির পাওয়া যায় বেশ। অদ্ভুত এক ধরনের ক্ষোভ তার জগৎ সংসারের প্রতি। কিশোরবেলার মেয়েটিকে না পাওয়ার জন্যে? স্বীকার অবশ্য করতে চায় না রেন। তখন রেনের স্কুলের ওপরের দিক। বাংলা ইংরেজি পড়তে পাড়ার কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল। সেখানেই দেখাশোনা মৌয়ের সাথে। প্রচণ্ড ফরসা তুলতুলে একটি মেয়ে। চোখমুখে কেমন খরগোসের মতো বিহ্বল ভাব। তার মুখ চোখ ঠোঁট চিবুক সব জায়গাতেই আশ্চর্য একটা মায়া লেগে আছে বলে মনে হতো রেনের। অবশ্য ওই বয়সে যে কোনও ছেলের যে কোনও মেয়েকে ভাল লাগে। আবার সময়ের সাথে কেটেও যায়। তবে রেন ঠিক বুঝতে পারত না সবটা। সরস্বতীপুজোয় স্কুলের ছেলেরা দল বেঁধে মৌদের স্কুলে যাওয়া এবং সেখান থেকে একসাথে কিছু পথ হাঁটাহাঁটি। মৌকে রেন বলেছিল, ওদের পাড়ার ঠাকুরের থেকে ওর মুখটা ভাল। পুরনো অঞ্চলে থাকার এই একটা সুবিধে, চাইতে বা না চাইলেও পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে বাঁচতে হয়। আর পাড়ার ক্লাব সে তো ঘরের ভেতর। রেনেদের বাইরের ঘরে তার বাবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে ক্লাব চালায়। সে ঘটনা ছোট থেকেই দেখে আসছে রেন। সবকিছুতেই তার রাগ হতো খানিকটা। কিংবা বিরক্তি। ওদিকে বাবার ব্যবসার গণেশ উল্টেছে। তার ফলশ্রুতিতে তাকে ভর্তি হতে হয়েছে জেনারেল কলেজে। প্রাইভেটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার বিলাসিতা করার উপায় ছিল না। তখনও কষ্ট করে মানুষ হওয়ার একটা মনোহারী গপ্পো বাজারে চলতো বেশ। কলেজবেলায় মৌয়ের সাথে দেখাশোনা হলেও অনুভবে কেমন যেন একটা অচেতন ভাব ছিল। শুনেছিল, মৌয়ের একটা বাইকচড়া বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। তখনও সেটাকে খুব একটা ভাবনার কিছু মনে হয়নি রেনের। সময় বইতে লাগলে সে দুরূহ নানা ইক্যুয়েশানে এবং ইউনিভার্সিটির বাঁশ সিলেবাসে ঝুলে পড়ল । জীবন সাদা কালো হয়ে যায় সেসময়। পাস নয়তো ফেল। ইদানীংকালের মতো ঢেলে নম্বর দেওয়ার চল তখনও শুরু হয়নি। হাওয়ায় ভাসছে রাজনৈতিক পালাবদলের গল্প। বামপন্থী সরকারের দৌরাত্ম্য রেনের চোখে অসহ্য ঠেকে। বদল দরকার বললেই তো আর হয় না। তবে চেষ্টা থাকলে কী না হয়! যখন রেন পাস করে পোস্ট গ্রাজুয়েশানে ভর্তি হয়েছে, সরকারেও বদল এল। তার পরে পরেই সব জায়গায় উর্দিবদল শুরু হল। এতদিনের লাল দুর্গ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে শুরু হল ছাত্র রাজনীতির পালাবদল। রেন তাদের ক্লাসের রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচিত হল। তবে নির্বাচন তার এমনিতেই হয়ে ছিল, নানারকম কায়দায় কথাবার্তা বলার জোরে। এখানে অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা । গোটা রাজ্যের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এসে জড়ো হয় । প্রবাদপ্রতিম সব প্রফেসরদের লেকচার । তার সাথে ঐতিহাসিক সব বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে লেগে থাকা পুরনো দিনের জলছাপ । লাস্ট সেমিস্টারে উঠে আশ্চর্য কাণ্ডটা হল। মৌ ফিরে এল চোখের সামনে। বিনা কারণে নয় অবশ্য। সে কোন একটা অ্যাকাউন্স ফার্মে ঢুকেছে, সেখানকার কী একটা কাজে সায়েন্স কলেজে আসছে। পেটের ভেতর নাকি মাথার ওপর কে জানে, তবে প্রজাপতি উড়েছিল নিশ্চয়। কয়েকদিন দেখা, গলিপথে একসাথে হাঁটা, কফিশপ, আঙুল থেকে ঠোঁট এবং প্রায় সারারাত ফোনে কথাবার্তা… ভাসতে লাগল দু’জনে। তবে মুশকিল হচ্ছে, কয়েকমাসের মধ্যেই মৌয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে আছে। ততদিনে দু’জনেই জীবনের গতি হারিয়ে ফেলেছে। সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই, অসম্ভব জেনেও মানুষ মিলতে চায়। রদ্দি সিনেমায় সেসব হয়ে থাকে বটে এবং তা দেখে লোকে হাততালি দেয়। রেনের পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, পড়াশোনা কমপ্লিট করে চাকরি না পেয়ে মৌকে নিয়ে পালাতে হবে । মুখে যতই বৈপ্লবিক কথা বলুক রেন, বাস্তবে সে তো নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে । যাদের নুনের ব্যবস্থা করতে জীবন ফুরিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত যা হওয়ার ছিল তাই হল। পূর্ব নির্ধারিত দিনে মৌ সিংহাসনে বসে হাসিমুখে উপহার নিল। আর রেন গেল নতুন পাওয়া চাকরি নিয়ে নয়ডায়। এক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে দেখা হওয়ার থেকে সেটাই বোধহয় ভাল। তবে রেন তিনমাসের টেনিং মিটিয়ে ফিরলো শহরে। ততদিনে সে কাজকর্মে থিতু হয়েছে। নতুন জীবন বাধ্যত মানাতে হল তাকে। দৌড়দৌড়ি এবং ব্যস্ততার মাঝে নিঃঝুম রাতে মৌয়ের ফোন অবশ্য আসত মাঝে মাঝে। তবে সে নিয়ে বেশি ভাবার অবকাশ কই! রেন বরং ইচ্ছে করেই খারাপ ব্যবহার করত ওর সাথে। তবুও সে মাঝে মাঝে বিবেকের বাণী শোনাতে ফোন করে। রাতবিরেতে তা শুনে কখনও বিরক্ত হয় রেন আবার ভালও লাগে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন ঘোর লেগে থাকে। নেশা ঘুম এবং টিনএজ সুগন্ধ মিলেমিশে যায় । কী বলে, কেন বলে কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারে না। শুধু মনে হয়, আকাশ বাতাস জুড়ে বৃষ্টি এসে যায় আর দু’দিকের ছুটন্ত গাড়ির স্রোতের মধ্যে দু’জনে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল। এ যেন একটা সাইক্লিক প্রসেস। বিভিন্ন শহরে ঘোরাঘুরি করতে করতে রেন কোথাও মৌয়ের মতো কাউকে দেখতে পায়। পরের মুহূর্তে মনে হয়— চোখের ভুল। তার মনে ক্রমে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায়, সব জায়গাতেই মৌয়ের মতো মেয়ে আছে। রেনের মতো ছেলে, তার হ্যাপি বা শিবের মতো বন্ধুও থাকে নিশ্চিত। সবাই থাকছে নিজের মতো করে। তবু যেন জড়িয়ে একটা আশ্চর্যে বন্ধনে। ৪. বাকি কথা মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের বেওয়ারিশ চারতলা বাড়ির চিল ছাদের অনেক ওপরে দিয়ে উড়ে গেছে শিবকুমারের ঘুড়ি। গরীবের ছেলে আইআইটিতে পড়ে কোটি টাকার চাকরি পায়, সে খবর মিডিয়াতে আসে। কিন্তু পড়াশোনায় সাধারণ তার ওপর এলেবেলে বিপিওর কাজ করে বিদেশ যাওয়া সে বোধহয় শুধু শিবের কপালেই ছিল। ওদের দেখেছিলাম খানিক দূর থেকে। কখনও কাছ থেকে। একসঙ্গে সন্ধেবেলা নেশাভাঙ, দু’চারবার বেড়াতে যাওয়া। তাছাড়া যেমন হয় আড্ডা ঠাট্টা তুমুল যৌবন উৎসব। মূলত রেনের সূত্রেই আলাপ। তখন ও রাজাবাজারে পোস্টগ্রাজুয়েশান। সেই প্রাগৈতিহাসিক শিক্ষার জায়গায় তার কীর্তিকলাপ ছড়িয়েছিল কি? ঠিক জানতাম না। রাজাবাজার মোড়ের একটা দোকান থেকে দু’ক্যান বিয়ার এবং দু’টো মুরগির ঠ্যাং ভাজা কিনে ওলিগলি দিয়ে হেঁটে জমিয়ে নিতাম সন্ধের রঙ। রেন কিছু ক্ষেত্রে অকুতোভয়, আমিও দলে পড়ে নির্ভিক। তখনও সামাজিক কোনও কেলো করিনি। সেসব শুরু হল খানিক পরে। রেন তখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। শিবেদের কুখ্যাত পাড়া থেকে ঝাড়খণ্ডের অখ্যাত রেলস্টেশন কিংবা শিলং থেকে দিল্লি পর্যন্ত ছুটছে তার অবিশ্রান্ত রথ। কলকাতাতেও সে এক দণ্ড স্থির থাকতে পারে না। সবসময় ছটফট করে। তার কোনও এক জ্যাঠা সারাজীবন মদ খেয়ে মরে গেছে, তাকে বরং বেঁচে থাকা বাপ কাকাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যে রেন রান্নাবান্নায় বেশ উৎসাহী হয়েছে। পছন্দসই নানারকম পদ রাঁধে। এটা যে ইদানীংকার এলিট কর্পোরেট কায়দা তা মানে না অবশ্য। পাড়ার হরিণঘাটার দোকান থেকে পর্ক কিনে বাহারি রান্না করে আমাদের খাওয়ায়। মাছ নিয়েও নানা কারুকাজ করে। বলি, গৃহকর্মে নিপুণ হয়ে উঠেছিস যে একেবারে! তবে অন্য সবার মতো হতে আপত্তি বলেই সে ছাপোষা লোকেদের মতো নিয়ম মেনে সকালে বাজারে যায় না। বরং রাতে বেশি দাম দিয়ে হলেও জিনিস কিনে ফেরে। অনলাইনে মুদিখানার জিনিস অর্ডার দেয়। হ্যাপি কারখানা সম্বন্ধে তার যাবতীয় সেন্টিমেন্ট কাটিয়ে ফেলেছে ততদিনে। একবার বকেয়া মাইনে সংক্রান্ত কারণে লেবাররা বিক্ষোভ শুরু করে। মালিক অনুপস্থিত বলে ম্যানেজার হিসেবে হ্যাপিকে সামনে পেয়ে গালিগালাজ ও মারের হুমকি। সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার— এতদিন যারা তাকে মাথায় করে রেখেছিল, রান্না করে খাইয়েছে কিংবা তার পয়সায় মোচ্ছব করেছে… তারাই বাপমা তুলে খিস্তি করছে! তবে তার থেকে বড় কেলোটা নিজেই করে বসেছে হ্যাপি। অফিসের পিকনিকে কাউকে একটা খিস্তি করাতে তার সমর্থনে নতুন জয়েন করা দু’তিনটে ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়ায়। তাদেরও উল্টোসিধে বলে বসে হ্যাপি। সেটাকেই মলেস্টেশন বলে কমপ্লেন যায় এইচআরের কাছে। ফলত সবার সামনে ওকে ক্ষমা চাইতে হল ওই মেয়েদের কাছে। বলতে গেলে, ম্যানেজার পোস্টের কারো পক্ষে তা যথেষ্ট অপমানজনক। সেই থেকেই অফিসে বেশ চুপ করে গেছে হ্যাপি। বেশি থাকেও না ওখানে। রেন বলেছিল, কম দামের ফ্ল্যাট খুঁজছে হ্যাপি। শহর থেকে দূরে ছাড়া বাজেটে কুলোবে না। রেনের মনে হতো, ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখার সেই ‘আমাদের কি বাড়ি হবে না’ মতো অবস্থা হয়েছে হ্যাপির। বাস্তুহারা পূর্ববঙ্গের মানুষদের মধ্যে দু’চার প্রজন্ম পরেও সেই আকর্ষণটা থেকে গেছে। এখানকার লোকেরা সেসব বুঝবে না বোধহয়। সেই একই কারণে শিবেরাও শহরতলিতে পুরনো বাড়ি কিনেছিল। তবে এখন সে যে কাণ্ডটা করেছে, ক’বছর বাদে ফিরে শহরের মধ্যেই ফ্ল্যাট কিনতে পারবে। হ্যাপি বা রেনের কাজকর্মে উন্নতি পাটিগণিতের নিয়ম মেনে একটু-একটু করে হলে, শিবের টাকাপয়সার গ্রাফ এক্সপোনেনশিয়ালি বেড়েছে। শুনলে আশ্চর্য লাগে, সেই এক কামরায় বড় হওয়া শিব কর্পোরেটের দৌলতে গিয়ে পৌঁছেছে অক্সফোর্ডশায়ারে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শহরটা। উইকএন্ডে সেখানকার পাবে অক্সফোর্ডের স্টুডেন্টদের জন্যে বিশেষ ছাড় থাকে। বলতে গেলে, এঁদো পুকুরের সেই শিবঠাকুর এখন অক্সফোর্ডের ছেলেমেয়েদের সাথে ওঠাবসা করছে। এখানে অবশ্য তার নামকাওয়াস্তে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েটার হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে শিব। তার আগে অবশ্য ক’বার হনিমুন করে নিয়েছে সমুদ্র বা পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। তার জীবনের গতিপথ আগামি ক’বছরে কোনদিকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। হ্যাপি টু বেডরুমের ফ্ল্যাট কিনে সংসার পাতার কথা ভাবছে। সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল শিবের ব্যাপারে— এতদিন যে লেখাপড়া পরীক্ষা নিয়ে শিবের পেছনে লাগতাম… তাও করা যাবে না আর। আগামিতে শিব হয়ে উঠবে সবার রোলমডেল। আমরা ক’জন সংসারে প্রবেশ করে প্রবল নাটাঝামটা খাচ্ছি। রেন সে বাবদে নানারকম বিদ্রূপ করে। স্বাভাবিকভাবে ওদের সাথে পাল্লা দিতে পারি না। শুধু জীবনের নিষেধাজ্ঞায় নয়, খরচের বহরেও। তাই রেন তাদেরই পাত্তা দেয়, যাদের সামর্থ আছে। অন্তত একটা সন্ধে তার ঘাড় ভেঙে সময়টা কাটায়। অপেক্ষা করছি, রেনের মতো ছেলে কবে পড়বে ফাঁদে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে আর সংসারের ফাঁদ জীবনে। তাতে যতই ছটফট করো ছাড় মিলবে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই পুরস্কার জোটে সবার কপালে। তার মধ্যেই খুঁজে নিতে হয় দার্জিলিং টি’র সুবাস কিংবা রোববারে খাসির মাংসের সুখ। |