বাপ্পা প্রামানিক
প্রাণের ছেলে মেয়েরা, নিস্তব্ধ বট বৃক্ষের কাছে আজ আমি ভগ্ন প্রায় একাকী নিঃসঙ্গ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। সশব্দে গড়ে ওঠা দালান বাড়িগুলো আজ আমায় উপেক্ষার ছলে চেয়ে। পর্যটকের দল আমার নিঃশেষিত যৌবনের বার্ধক্য দশাকে সহাস্যে ক্যামেরার সম্মুখে বন্দী করে। উপহাস্য করে অনাবাসী। সমস্ত আবাসির হৃদয়ে আমার প্রতি সহৃদয়তা ছাড়া আর কিছুই নেই। বন্য শেয়ালেরা রোজ রাতে আমার শরীরে দুর্গন্ধ মাখিয়ে এক বন্য উল্লাসে মেতে ওঠে। মানুষের মতো দেখতে জীবন্ত পিচাসরা আসোর বসিয়ে রাত্রের অন্ধকারের অট্টহাসিতে আমার সমস্ত শরীরকে উপহাস্য করে। বর্ষার অবিরাম জলরাশিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে আমার সারা শরীর নোনা জলে ভরে ওঠে। তবুও আমি একাকী দাঁড়িয়ে থাকি, প্রতীক্ষায় থাকি, ঘুরে দাঁড়াবার অপেক্ষায় ফিরে তাকাই আমার প্রিয় ছেলেমেয়েদের প্রতীক্ষায়। এই যে আমার প্রাণের ছেলে মেয়েরা কতদিন তোমাদের হন্নে হয়ে খুঁজছি। বিশ্বাস করো একটি রাতও আমার চোখে ঘুম নেই, একটি রাতও আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারছি না। তোমাদের কি দুদণ্ড সময় নেই আমার দিকে ফিরে দেখার? আজ প্রায় সত্তর বছর দাঁড়িয়ে রয়েছি এই বিশাল গ্রামের একমাত্র উঁচু স্কুলবাড়ি হয়ে। সারাদিন আমার বুকে তোমাদের চিৎকার, চেঁচামেচি, উল্লাস আমাকে আনন্দে ভরিয়ে রাখত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে যখন একে একে সবাই ফিরে যেতে, একাকী আমি প্রহর গুনতাম তোমাদের অপেক্ষায়। ওই তো সেদিন এই বট বৃক্ষের তলায় হাটবারে সমস্ত গ্রামের মানুষরা যখন একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল এই গ্রামে একটি স্কুল তৈরি হবে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করবে, বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করবে, সেদিন সারা গ্রামে উৎসবের হাট বসেছিল। যেদিন ভীদ গড়া শুরু হল সবার চোখে মুখে সে কি আনন্দ, উল্লাস। সবার চোখে মুখে তখন নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন, একটা সচ্ছন্দ জীবনের স্বপ্ন। ইংরেজদের অত্যাচারে নিপীড়িত নিঃসৃত অসহায় অর্থনগ্ন ক্ষুদার্থ মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল বিপ্লবী জননী মাতঙ্গিনীর গ্রামে, মাতঙ্গিনীর দেশে। সেই গোপাল বাউরী জমি দিতেই রফিক চাচা এক থলে জমানো দশ পয়সা, কুড়ি পয়সার কয়েন এনে দিল। সোনালি মুরমু তার সাধের কাঁসার কলসিটা বিক্রি করে কুড়ি টাকা দিল। সুরেন মাঝি তার পুকুরের মাছ বিক্রি করে সমস্ত মজুরের খাবারের আয়োজনের যোগান দিল। সতীশ, দিবাকর, ভোলা সবাই মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল তুলে এনে খাবারের বন্দোবস্ত করল। আরো আরো কত ভাবে গ্রামের মানুষ উৎসবের সমারোহে স্কুল তৈরিতে নিজের সাধ্যমত দিয়ে এগিয়ে এলো। ধীরে ধীরে একটু একটু করে অসহায়, দরিদ্র মানুষের ঘামের গন্ধে, ক্ষুধার্ত মানুষের নিঃস্বার্থ সেবায়, সমস্ত গ্রামের মানুষের ভালবাসায় ও প্রচেষ্টায় তৈরি হল আমার শরীর স্বপ্নের স্কুল বাড়ি। নামকরণ হলো গ্রামের নামেই। ঢোল, বাদ্য কাসর বাজিয়ে পুজো দিয়ে উদ্বোধন হলো, সংগীত হলো, উল্লাস হল, ক্লাস শুরু হল। একে একে শিক্ষক মশাইরা আসতে শুরু করল। আর তারপর আমার প্রাণের ছেলেমেয়েরা আমার বুকে এসে উল্লাসে উন্মাদনায় ঝাপিয়ে পড়লো। প্রত্যেকদিন ছোট ছোট ক্ষুদ্র হাসি মুখগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলো। এক একটা ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়ে যখন এক একটা ছেলে-মেয়েরা বড় হতে লাগলো তখন আমি দুচোখ ভোরে তোমাদের দেখেছি। কখনো আনন্দে হেসেছি আবার কখনোবা কেঁদেছি। যেদিন ইতিহাসের খাতায় দুলাল বড় বড় করে লিখেছিল পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা এবং লর্ড ক্লাইভের মধ্যে তুমুল যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার অস্ত্র ভেঙে যাওয়ায় সিরাজউদ্দৌলা ফেভিকুইক দিয়ে অস্ত্র জুড়ে তুমুল যুদ্ধ করেছিল। ইতিহাসের শিক্ষক হয়তো ফেবিকুইক আবিষ্কারের ইতিহাস ভুলে গেছিল। যে কাহিনি সারা ক্লাসের সবাইকে হাসির উন্মাদনায় বিভোর করেছিল। যখন অরুণ, মোবারক, সুমন, অপর্ণা সবাই মিলে নিজেদের টিফিনের খাবার টিফিন না আনা ক্ষুদার্থ রহিমকে তোমাদের ভাগ দিয়েছো, তখন আমার দুচোখ জুড়িয়ে গেছে। আবার সৌমেন স্কুলের শিক্ষকদের প্রণাম করে দেশ রক্ষায় নিজেকে আত্ম বলিদান দিয়ে নিথর দেহে যখন গ্রামে ফিরে এসেছে, তখন একাকী চোখের জলে সারা অঙ্গ ভিজিয়েছি। কত না স্বপ্ন দেখে এক এক করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কেউ গ্রামের মেঠো পথে বাড়ির দায়িত্ব সামলেছ, কেউ ভালো মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ওই ক্ষুদ্র আঙিনায় নিজের মেধাবীত্বকে নষ্ট করেছ। আবার কেউ কেউ শহরে পাড়ি দিয়েছো সুশিক্ষিত হতে। কত বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করেছ, মানুষের মত মানুষ হয়েছো। আবার কেউ মানুষের মত দেখতে হোলেও অমানুষও হয়েছো। ওই তো সৌরভ বলেই আমার প্রিয় ছেলেটি কলকাতায় পড়াশোনা করে কলেজে চাকরি পেয়ে ফিরে এসে আমার অঙ্গের একটি অংশ ভাঙাচোরা ঘর সে পুরোপুরি মেরামতের দায়িত্ব নিল। সেখানে নতুন করে দোতালা ঘর তৈরি করে সে তার প্রিয় ভাই বোনেদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিল। ওই যে লোকনাথ আমার প্রাণের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উৎসাহের জন্য প্রতি ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ছেলেমেয়েদের ১২০০, ১০০০, ৫০০ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিল। সবাইকে মানুষের মত মানুষ হতে পথ দেখালো। আর এক গুনি মেয়ে সুমিত্রা ব্যাংকে চাকরি পেয়ে তার ছোট ছোট ভাইবোনেরা তৃষ্ণার্ত হয়ে ওই রাস্তার কলে যাতে লাইন দিতে না যায়, তার জন্য নলকূপের ব্যবস্থা করে দিলো। এভাবেই ধীরে ধীরে গ্রাম পাল্টাতে লাগলো। ক্ষুদার্থ মানুষের অন্ন -বস্ত্রের সংস্থান হলো। শুরু হলো রাজনৈতিক কর্মীদের আনাগোনা। শুরু হলো ক্ষমতা দখলের লড়াই, শুরু হলো সেবার থেকে নিজের পকেট গোছানোর লড়াই। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য সরকারের দেওয়া খাবারের অর্থেও ভাগের পসরা বসলো। হঠাৎ করে আগাছার মতো গড়ে উঠলো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এক এক করে আমার বুক, আমার আঙ্গিনা ফাঁকা হতে শুরু করলো। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গ্রাম্য বাঙালি স্কুল আজ ধুলো মলিন হতে শুরু করল। শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী ছেলে মেয়েরা একে একে কমতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে এক একটা কক্ষে চেয়ার টেবিল ভগ্নস্তুপে পরিণত হতে লাগলো। যে শিক্ষা গুরুজন পিতা-মাতাকে সম্মানের জন্য গড়ে উঠেছিল তা সহজেই পণ্য শিক্ষায় পরিণত হলো। শহর থেকে গ্রাম আমার মত সমস্ত শিক্ষাঙ্গন গুলি আরো ভঙ্গুর হতে শুরু করলো। চারিদিকের শিক্ষাঙ্গনে আজ রাজনৈতিক রং শিক্ষকের গলা টিপে ধরল। শুরু হলো শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের নিয়ে মূলত শিক্ষাকে নিয়ে বৃহত্তর রাষ্ট্রনৈতিক ষড়যন্ত্র। এ হলো চাওয়া-পাওয়ার মাধ্যমে মানুষকে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র। সরকারের ষড়যন্ত্রে আজ শুরু হচ্ছে পিপি মডেলের স্কুল শিক্ষা। যেখানে অর্থ যার শিক্ষা তার, অর্থ যার চাকরি তার, অর্থ যার চিকিৎসা তার, অর্থ যার সম্মান তার, অর্থ যার ভালোবাসা তার। এই অর্থ আর পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে শিক্ষা আর শিক্ষাঙ্গন। ভগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মত কত শিক্ষাঙ্গন। তবুও অপেক্ষায় আমাদের ছেলেমেয়েদের অপেক্ষায় যেন স্বপ্ন দেখে যারা জেগে ওঠে যারা বিপ্লব আনে তারা ভাঙতে জানে যারা আবার গড়তে পারে। হ্যাঁ আমি আপনাকেই বলছি, হ্যাঁ আমি আপনাকেই বলছি, হ্যাঁ আমি আপনাদেরকেই বলছি এবার হয়তো ভাববার সময়, প্রতিবাদ করবার সময়। এখনই সময় রাষ্ট্রনৈতিক ষড়যন্ত্রের কান্ডারীকে সিংহাসন থেকে টেনে নামিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিক্ষা তথা শিক্ষাঙ্গনের ভগ্ন দশা দেখিয়ে দেওয়া দরকার। দেখিয়ে দেওয়া দরকার একটা সমাজের অবক্ষয়িত চিত্রপট। দেখিয়ে দেওয়া দরকার একটা জাতি তথা একটা ধর্ম তথা একটা ভাষার অবলুপ্তির প্রাথমিক প্রেক্ষাপট। ইতি ভগ্নপ্রায় কোন এক স্কুল (বাপ্পা প্রামানিক) |