চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে, সমাজে স্ত্রী
বর্ণালী কোলে
“স্ত্রী” শব্দটি ভাবলেই একটি আয়না ভেসে ওঠে। আয়নার মধ্যে পথ। সেই পথের মধ্যে কত যুগ, কত কাল।কত ইতিহাস। আর কত গাথা। হেঁটে চলেছেন কত নারী। কত তার আঙ্গিক। পথের মধ্যে আকাশ। নক্ষত্রমণ্ডলী। সপ্তর্ষিমণ্ডল । বশিষ্ঠের পাশে উজ্জ্বল অরুন্ধতী। জ্যোতি দিচ্ছেন । ডাকছেন।সৃষ্টি হচ্ছে সেতু আকাশ-পৃথিবীর। তারই আলো লাগছে চোখে? সেই আলোয় নারী হয়ে উঠছেন স্ত্রী? বধূ? “যতবার তুমি জননী হয়েছে, ততবার আমি পিতা।” রচিত হচ্ছে সংগীত। ভেসে যাচ্ছে ভেলা। ইন্দ্রের সভায় শোনা যাচ্ছে ঘুঙুরের ধ্বনি। ধ্বনিত হচ্ছে বাংলার “নদ নদী ভাঁটফুল”। বেঁচে উঠছেন লক্ষীন্দর । আরও কত কাহিনি। সত্যবানের দেহ আগলে সাবিত্রী। দময়ন্তী চিনে নিচ্ছেন নলকে। স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করছেন পার্বতী। লক্ষ্মীর পাশে বসে নারায়ন। শ্রীরামকৃষ্ণের পাশে সারদাদেবী। সেই আদিকাল থেকে আজকের সময়। স্ত্রীদের কত রূপ। জেগে নক্সী কাঁথার মাঠ। রূপাই-সাজু। জসীমউদ্দিন থেকে জয় গোস্বামী। কবি লিখছেন, “পাগলী,তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।” সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় স্ত্রীর নানা মুখ দেখা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত “অপুর সংসারের” শর্মিলা ঠাকুরের সেই মুখ, সদ্য বিবাহিতা, দারিদ্রের মধ্যেও সে সুখে, খুশিতে, আনন্দে ভরপুর। তার নতুন সংসার। ফুলদানিতে নতুন ফুল। সেই নারীর লালিত্যের থেকে দূরে “পথের পাঁচালীর” সর্বজয়ার মুখ। তার মধ্যে দৃশ্যমান বাংলার চিরন্তন সংগ্রমী নারী যাঁদের আজীবন সংগ্রাম, সংসার প্রতিপালনের জন্য এবং সন্তান প্রতিপালনের জন্য। সর্বজয়ার কপালের টিপ আর ঘোমটা, অন্তরালে লুকিয়ে কত কাহিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ও গল্পের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি ছবির কথায় আসা যাক। “ঘরে বাইরে” চলচ্চিত্রে বিমলার মাধ্যমে এক আধুনিকা নারী এলেন। যিনি একবাড়ি লোকের সামনে দিয়ে বৈঠকখানায় অন্য পুরুষের সঙ্গে নিসংকোচে কথা বলেন এবং ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন। যদিও বাইরের মোহ তাঁর অচিরেই বিনষ্ট হয় এবং নিখিলেশের বিশাল হৃদয়ের সত্য তিনি অনুভব করেন একজন সত্য মানবীর মতো। এখানে স্ত্রী কেবল স্ত্রীই নন, একজন নারী মননে, মেধায় তথাকথিত নারীকে ছাপিয়ে যান। “চারুলতা”র নারী, তাঁর অত গুণী মেধাবী স্বামী থাকা সত্ত্বেও তাঁর দেবরের প্রেমে পড়েন, তাহলেই বিবাহিত স্বামীই সব নয়? মন বলে কিছু আছে? হৃদয়? “ন্যায়-অন্যায়ের” বাইরে যিনি তাঁর মনের কাছে নত হন এবং সেই ইচ্ছের অনলে নিজে পোড়েন এবং কিছুটা পোড়ে পরিবার। “মণিহারা” ছবিতে স্ত্রীর সেই রূপ, সোনার গহনায় যাঁর কাছে সব। সেই গহনার প্রতি মোহে তাঁর সত্যদৃষ্টি নষ্ট হয় এবং তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। “সমাপ্তি” চলচ্চিত্রে একজন সদ্য বিবাহিত কিশোরীর মনে ধীরেধীরে প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং অচিরেই হয়ে ওঠে সে অন্য এক নারী।স্ত্রী। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প “অবতরণিকা” অবলম্বনে নির্মিত “মহানগর” চলচ্চিত্রে আসেন আর এক স্ত্রী, যাঁকে জীবনের প্রয়োজনে সংসারে বাইরে চাকরির অনুসন্ধান করতে হয়। চাকরি করে তিনি আত্মনির্ভরশীল হন এবং পরিবারকেও কিছুটা আত্মনির্ভরশীল করেন। তাঁর এই আধুনিক চলাফেরাকে সহজভাবে নেয় না সমাজ। তাঁর স্বামীও কেমন বদলে যান। স্ত্রীর যে চিরায়ত রূপ (স্ত্রী নরম স্বভাবের হবেন,তিনি কখনই একজন হতে পারেন না, যাঁর মুখ মিশে যাবে অজস্র নারীর আঙ্গিকে, যাঁকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যাবে না, তিনি একটা বৃহত্তর স্রোতেরই অংশ, স্বামী উপার্জন করবেন এবং স্ত্রী সংসার সামলাবেন), সেই রূপের বিপরীতে মহানগরের মাধবী চরিত্রের স্ত্রী রূপের নির্মাণ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “স্ত্রীর পত্র” গল্পের উল্লেখ করতেই হয়। সেখানে মৃণালের চরিত্রের মাধ্যমে এই ছবিই স্পষ্ট হয় আপাত সংসারে অভ্যস্ত নারীরাও অন্য নারীর (বিন্দু) প্রতি অবেহেলা অনুভব করে সমাজে তাঁদের স্থান অনুভব করেন ও বিদ্রোহী হওয়ার ক্ষমতা রাখেন ও সংসার ত্যাগ করেন। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের “মালঞ্চ” উপন্যাস। সেখানে দেখা যায় রোগশয্যায় শায়িত এক স্ত্রীর মনস্তত্ত্ব, তাঁর স্বামীর অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়া ও মালঞ্চের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া। অপর্ণা সেন “পরমা” চলচ্চিত্রে স্ত্রীর রূপ ভেঙে দিলেন ও নারীর আধুনিকীকরণ করলেন। একজন মধ্যবয়স্কা নারী, স্বামী আছে, গৃহ আছে, স্বাচ্ছন্দ্য ও সন্তান, তাঁর থেকে বহু ছোট এক যুবকের প্রেমে পড়ছেন, মুক্ত করছেন নিজেকে, চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছেন, পৌঁছে যাচ্ছেন এক সত্তা থেকে অন্য সত্তায়। এছাড়া অপর্ণা সেনের “পারমিতার একদিন” ছবিতেও নারীর আধুনিক এক রূপ দেখা যায়। যিনি তাঁর শাশুড়ির প্রতি সব কতর্ব্য করছেন, আবার জীবন থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনে জড়াচ্ছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাহিনির ওপর নির্মিত “দহন” সিনেমায়, স্ত্রীর আর এক রূপ। সেখানে সুখ একটি আপাত প্রহসন। যেখানে স্ত্রী যৌন হয়রানির শিকার হলে সম্পর্ক কেমন মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায়। সমাজের তথাকথিত মুখচোখ স্পষ্ট হয়। আগুন পেরোনো মেয়েটি নিজেকে চিনে নেয়, চিনে নেয় এই সমাজকে “রক্তের অক্ষরে অক্ষরে।” এছাড়া অজয় করের পরিচালিত “হারানো সুরের” সেই স্ত্রী আর তাঁর অনবদ্য প্রেম। অজয় কর পরিচালিত, সৌমিত্র–সুচিত্রা অভিনীত “সাত পাকে বাঁধা” চলচ্চিত্রের সেই প্রণয় আর প্রতীক্ষা। আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত সৌমিত্র-তনুজা অভিনীত “তিন ভুবনের পারে” সিনেমার সেই স্ত্রী, মননে, মেধায়,প্রেমে যিনি পারেন একজন পুরুষকে অনেক আকাশ দিতে। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত “কোমল গান্ধার” ছবির শেষ দৃশ্য, ভৃগুর হাত মিলে যাচ্ছে অনুসূয়ার হাতে। সেও এক প্রতিশ্রুতি। সে তো স্ত্রী ই। নির্মল দের পরিচালনায় ও বিজন ভট্টাচার্যের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত “সাড়ে চুয়াত্তর” ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করা মলিনা দেবীকে কী ভোলা যায়!কী অনবদ্য ও অতুলনীয় সেই প্রেম! তরুণ মজুমদার পরিচালিত “দাদার কীর্তি” ছবিতে সন্ধ্যা রায়ের মাধ্যমে যে স্ত্রীর রূপ দেখা যায়, তাকে হয়তো সব বাঙালিই আপন করে নেন। (২) দৈনন্দিন জীবনে অনেক স্ত্রী এখনও “বিরাজ বৌ”। স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কালো মেয়েরা এখনও ব্রাত্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “মেজাজ” কবিতায় সেই সমাজ ও একজন কালো রঙের বধূর নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার আলো ধরা আছে। আত্মশক্তিতে ভরপুর মা হতে চলা বধূ তাঁর আসন্ন সন্তান সম্পর্কে বলছেন, “কী নাম দেব,জান? / আফ্রিকা।/ কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে।।” আবার কোথাও স্বামী মদ্যপ, নারীরা ঘর সামলাচ্ছেন, মার খাচ্ছেন, গৃহ পরিচারিকার কাজ করছেন। গৃহ বলে কিছু নেই। সম্পর্ক ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সন্তানের মুখ চেয়ে সহাবস্থান। বিবাহের পর পরস্পর অনুভব করছেন এক সঙ্গে থাকা দুঃসাধ্য, পারস্পরিক অভিযোগে দীর্ণ, প্রেমে আসছে তাদের জীবনে আবার। এটা জানার পরও একে অপরের সঙ্গীকে স্পেস দিয়ে একজন অপরজনের সঙ্গে থাকছেন। আবার কোনও স্বামী সারাজীবন অসংযমী, বহু নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তা জেনেও সেই স্বামীর সঙ্গে ঘর করছেন অনেক স্ত্রী, কারণ তাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই। আবার ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে মাথা উঁচু করে বাঁচছেন অনেকেই। অনেকে আবার সবর্দা সুখী দাম্পত্যের ছবি দিচ্ছেন, অন্যদিকে অন্য প্রেমে ছিন্নভিন্ন । অনেক স্ত্রীই রাত দুটোর সময় উঠে রান্না করে বেরিয়ে পড়েছেন ভোরের ট্রেনে, কেউ বা সব্জির ঝাঁকা নিয়ে, কেউ অন্যের জমিতে চাষের কাজে। কেউ বা ঘর সামলে টোটো চালানোকে পেশা করেছেন, কেউ বা ট্রেনে হকারি করছেন। আবার এখনও কেউ পণপ্রথার শিকার। সন্তান না হলে নির্যাতনের শিকার। আরও কত গাহর্স্থ্য হিংসা ও যৌন হেনস্থার শিকার। সম্প্রতি দেখা গেল, সন্দেশখালিতে স্ত্রীদের অন্য রূপ। দিনের পর দিন তাঁদের স্বামীর, সন্তানের ক্ষতির হুমকির ভয়ে কী অসহ্য নিপীড়ন ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। এবং তাঁরাই এখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আবার স্ত্রী কবে নার্সিংহোম থেকে ফিরবেন, তার জন্য রোজ ক্যালণ্ডারের দিকে তাকাচ্ছেনও অনেক স্বামী। (৩) বিষ্ণুপ্রিয়া। শ্রী চৈতন্যদেবের স্ত্রী। কেমন ছিলেন তিনি? কেমন ভাবে কেটেছিল তাঁর জীবন? তাঁর মন? কেমন ছিলেন দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী হয়ে? যখন নিপীড়িত হচ্ছিলেন কৌরবদের কর্তৃক, নত যুধিষ্ঠির? কেমন লেগেছিল সীতার বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে? যশোধরা। গৌতম বুদ্ধের স্ত্রী? কেমন কেটেছিল তাঁর জীবন? কেমন ছিলেন সেইসব স্ত্রীরা যাঁরা বাল্যবিধবা ছিলেন? আর সেই সব স্ত্রীরা যাঁরা তাঁদের স্বামীর বহু বিবাহের একজন? কেমন ছিল তাঁদের সেই সময়কার মন,যাঁদেরকে তুলে দেওয়া হচ্ছিল স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায়? “কোনও এক মানুষীর মনে! /কোনও এক মানুষের তরে/ যে– জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!-/ নক্ষত্রের চেয়ে আরও নিঃশব্দ আসনে/ কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!” (নির্জন স্বাক্ষর,জীবনানন্দ দাশ)। আবারও নক্ষত্র! তার চেয়েও নিঃশব্দ আসন!.যদি সত্যিই জন্মায় এই প্রেম, সেই প্রেম যদি সমাজসিদ্ধ না হয়, সে ও কী স্ত্রী-ই নয়! |
সুন্দর স্বচ্ছ অনুভূতির লেখা!