পিয়ালী বসু

উচ্চারিত জীবনের প্রতি

পিয়ালী বসু

আলো আসে, আলো যায়
এক একটি অন্ধকার শুধু থেকে যায়
হৃদয়ে প্রেমের বালাপোষ জড়িয়ে।
২৩টা বছর! ভাবলে আজও অবাক লাগে! সত্যিই তেইশটা বছর কাটিয়ে ফেললাম সিঙ্গল মাদার’ হিসেবে।
একক মা’ কিন্তু কেন এই একক যাত্রা? আসুন, একটু ফিরে যাওয়া যাক ফ্ল্যাশব্যাকে|
আসলে ছোটবেলা থেকেই আমি খুব স্বাবলম্বী| মা চাকরি করতেন, ফলত ছ বছরের ছোট ভাই কে মানুষ করা থেকে শুরু করে বাবার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে আমাদের প্রকাশনার প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজ হাতে করে শেখা, কলেজে পড়াকালীন বিশ্বস্ত স্টাফ মেম্বার কে নিয়ে একা একা জেলা বইমেলা করা… আমি এমনটাই চিরকাল|
পড়াশোনা করেছি কোএড স্কুল পাঠ ভবনে| ছেলেদের নিয়ে তাই কোনোদিনই বাড়তি আকর্ষণ ছিলো না…
যাদবপুরে পড়াকালীন সময় অবশ্য প্রচুর খুচরো প্রেম এসেছিল জীবনে, যেমন সবারই ঘটে থাকে। তার মধ্যে তিনটি সম্পর্ক বেশ ঘনায়ীত হয়েছিল, প্রমিত মজুমদার ছিল বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক সুবিমল মজুমদারের ছেলে— প্রমিত ছিল ইকোনমিক্স এর, আমাদের চেয়ে এক বছরের সিনিয়ার, প্রথম বছরের সংস্কৃতিতেই দুজনের ফর্মাল পরিচয়, যেটা মাত্র এক মাসে ইনফরমাল হয়ে চূড়ান্ত ঘনত্বে পৌঁছেছিলো।
এসি ক্যান্টিনে ক্লাস কেটে আড্ডা, যাদবপুর কফি হাউসে কলেজ শেষে একান্ত আলাপচারিতা, এবং গান্ধিভবনের পিছনে সেই সন্ধেটা— প্রমিতের ঠোঁট যেদিন আমার ভেসলিন মাখা ঠোঁট ছুঁয়েছিলো, সেদিনই— ভালোবাসার চাদর বুকচাপা দিয়েছিল সম্ভবত আমার মনে।
ধাক্কাটা এসেছিলো সেদিন যেদিন প্রিয় বান্ধবী হিমেলার কাছ থেকে প্রমিতের অ্যাকসিডেন্টের খবরটা পেয়েছিলাম, সাহস সঞ্চয় করে গিয়েও ছিলাম বেলভিউ নার্সিং হোমে— নীল চাদরে ঢেকে প্রমিত কে শুইয়ে রাখা হয়েছে, ঘর ভর্তি লোক!! ডাক্তার এসে অতর্কিত দুঃসংবাদ টা দিলেন। সেদিন সত্যিই পায়ের নীচে মাটি সরে গিয়েছিল আমার— চোখে তখন অন্ধকার, হিমেলা ধরে এনে রিসেপশনের সোফায় বসিয়েছিল। কি ভাবে যে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম!! আজও জানি না।
পরের ঘন প্রেম মাস্টার্সের সময়।
শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন বন্ধু— তখন ডিসেম্বর। লাল মাটিতে তখন পৌষমেলার রেশ— কালুদার চায়ের দোকানে এক সন্ধেয় দেখা প্রদীপ্ত র সঙ্গে— প্রদীপ্ত সান্যাল। কলকাতা আর আরও প্রিসাইজলি বলতে গেলে জেভিয়ারস এর ছেলে । আমাদের ভাষায় ‘তৈরি ছেলে’।
শান্তিকেতনে খোয়াইয়ের ধারে বেশ কয়েকটা সন্ধে কাটিয়েছিলাম প্রদীপ্তর সঙ্গে– অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে, চেহারায় যৌবনের রবী বাবু— এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল যেন আগামী কে বহন করছে শিরস্ত্রাণে— চোখ মুখে গ্রীক ভাস্কর্য। স্পেলবাউনড না হয়ে উপায় ছিল কি?!
যাদবপুরের লবি তে তখন সপ্তাহে দু দিন বাঁধা ছিল প্রদীপ্তর— যদিও আমার কাছে সে তখন ‘পুপুল’।
তৃতীয় সম্পর্কটা হয় অতর্কিতেই| পাঠ ভবনে আমাদের ক্লাসমেট আনন্দর বন্ধু নীলাঞ্জন হঠাৎই ঢুকে পড়ে আমার জীবনে… আমি তখন মাস্টার্স করছি, বেশ স্বাবলম্বীও… নিজের কলেজের মাইনে নিজেই দিচ্ছি টিউশনির টাকায়| কলেজে বেশ পপুলারও| ড্রামা ক্লাবের হয়ে ‘রক্তকরবী’ নাটক করার সূত্রে সকলেই আমায় নন্দিনী’ নামে চেনে| প্রসঙ্গত জানাই, সে নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমাদেরই প্রফেসর, নাট্যকার অভিনেতা সৌমিত্র বসু|
…বাবা সে সময়ে এক্টিভলী রাজনীতি করছেন, জ্যোতি বসুর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক| এইরকম পরিবেশে বড়ো হওয়া আমার| কোনোদিনই আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে করে সংসার করতে চাই নি আমি, চেয়েছিলাম বাবার মতো হতে, ঠাকুমার মতো হতে| বঞ্চিত মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে, তাদের স্বর হয়ে উঠতে|
এই যে একা একা হাঁটা
এই যে খরস্রোতার ঝিরি ঝিরি আশ্বাস
এসব আসলে স্পর্ধিত আবেগে
নিজেকেই খুঁজে ফেরার অছিলা|
সংশয় আর নেশার অভিমুখে অবিরত হেঁটে যাওয়া, আসলে আমার জীবনে চিরকালই wrong রুটের হাতছানি।
I shall become only dependent on one.
That one will be me.
I will rise with my petals high.
মনে মনে এতদিন এটাই ভেবে এসেছি, বিশ্বাসও করেছি।
Alone isn’t lonely, rather being alone means you are strong enough to walk of your own— এটাই আমার জীবন মন্ত্র
এম এ শেষ করার পর বাবার ইচ্ছেতেই পাড়ি দেওয়া আয়ারল্যান্ডে… বাবার বন্ধু Irene Casey সে সময় ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর| তাঁর আন্ডারেই নাম রেজিস্ট্রেশন করালাম |
মাস শেষে বছর ঘুরলো, শুরু হলো বিদেশে থিসিস রেডি করার সাথে সাথে মা হিসেবে সদ্যজাত সন্তানকেও দেখার দায়িত্ব পালন, হ্যাঁ সে সময় আমার পুত্রের বয়স মাস দুয়েক |
Everything I do
I do it for you”
সৌম্যর খুব প্রিয় ছিল এ গান। আমি অবশ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত, অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতায় মগ্ন তখন, ইংরেজি গান সে ভাবে শোনা হতো না। সৌম্যর দৌলতেই ক্যানাডিয়ান সঙ্গীত শিল্পী Bryan Adams কে চেনা আমার।
“কথা কও, কথা কও।
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে
কেন বসে চেয়ে রও?”
রবীন্দ্রনাথের মতোই সৌম্যও বসে গিয়েছিল আমার গভীর মননে, চেতনায়, চিন্তনে।
নাঃ! ঘর বাঁধিনি আমি, কারণ সমঝোতার জীবনে বিশ্বাসী নই আমি, ছিলাম না কোনোদিনও, তাই কম্প্রোমাইজ করি নি | সৌম্য আজও আমার ভালো বন্ধু, যেমন সেদিনও ছিলো ডাবলিন ইউনিভার্সিটিতে।
বাবা, মায়ের পূর্ণ সমর্থন ছিলো আমার এ সিদ্ধান্তে, হয়তো তাঁদের এই ব্যাকআপটা ছিলো বলেই এতগুলি দশক কাটিয়ে ফেললাম… সন্তান কে একা হাতে বড়ো করে বিদেশের মাটিতে লড়াই করে নিজের জায়গা টিকিয়ে রাখা, বেশ কঠিন কাজ… কিন্তু আমি পেরেছি।
আজ যখন পিছন ফিরে দেখতে বসি, মনে হয় অতীত ও বর্তমান’কে সময়ের নিরিখে বিচার করলে, শুধুমাত্র একটি শব্দই স্পষ্টতর হয়… ‘দূরতা’। অতীতচারিতার অর্থই হল, গলার নীচে দুমড়ে মুচড়ে শুয়ে থাকা চেনা অথচ অচেনা সেই কষ্টটির মোহে পড়ে যাওয়া।
একক মা’ ক্লিশে, ভীরু সংবিধানের চোখে হয়তো বা এই আমার একমাত্র পরিচয়, কিন্তু আমি জানি, আমার জীবন আসলে লড়াইয়ের প্রতিটি ওম ঝরে যাওয়া স্তবকে বিরাজিত… যারা যাপন করেনি এ জীবন, তাঁদের পক্ষে আমার ‘র জেহাদ অনুভব করা অসম্ভব।
২৩ বছরের পুত্রের চোখে আমি ‘পৃথিবীর সেরা মা’, আর এই পরিচয় আমি জীবন দিয়ে পালন করে এসেছছি। জীবনের একমাত্র প্রায়োরিটি হিসেবে প্রথম দিন থেকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি সন্তানকে, আর আজও সেই প্রায়োরিটির বদল হয়নি।
আমি চলছি… স্মৃতির মানচিত্র থেকে তুলে আনা ছবি মিলিয়ে, সঞ্চয় ভাঙিয়ে… চলছিই। বাবা’র মুখ স্পষ্টতর হচ্ছে আমা’র আত্ম-পটে… মা, ভাই… একমাত্র সন্তান ফিরে আসছে বারম্বার জীবন সফরে, …তবুও আমি চলছি… নেপথ্য জুড়ে তখন…
“The dream is over
What can I say?
The dream is over
Yesterday
I was the dream weaver”
বুকভর্তি পাড়ভাঙ্গা সমুদ্র নিয়ে আমি হাঁটছি … সুদূরপ্রসারী নির্মোহ ছায়াঘেরা জীবন ছুঁয়ে… এবার অনুভব একই জন্মের অন্যতর অধ্যায়ের।

Leave a Reply