নারী (প্রকৃতি ও পরিণতি)
পিয়ালী বসু ঘোষ
নারী শব্দটি নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে বসিনি কখনো। যেমন পুরুষ শব্দটিও ভাবায়নি বিশেষ। সব সময় মনে হয়েছে শব্দগুলো আইডেন্টিকাল। এই শব্দগুলোর বদলে অন্য অর্থপূর্ণ যে কোন শব্দই প্রযোজ্য হতে পারতো। যেমন second gender শব্দেও আপত্তি আছে আমার। Why second? why not first? যাক এসব তর্কের সীমানাহীন আলোচনাকে অতিক্রম করে নারী নামক মানবীর জীবনকে আমি প্রায় সম্পূর্ণই প্রকৃতি ও পরিণতির যৌথ ক্রিয়া মনে করি। জল, আলো, হাওয়ায় একটি বীজ যেমন আস্তে আস্তে পূর্ণতা পায়, হয়ে ওঠে বনস্পতি, ঠিক তেমনি একটি ভ্রূণ প্রতিদিন মাতৃজঠরে থেকে স্ফীত হতে হতে এক সময় পূর্ণাঙ্গ শিশু দেহ লাভ করে। প্রকৃতির মতোই সে প্রাণের ধারক বাহক ও প্রতিপালক। তাই নারীকে প্রকৃতি ভাবতে আমার কোথাও অসুবিধা হয় না বরং মনে করি এর সবটুকুই ইকোক্রিটিসিজম এর অঙ্গ। প্রকৃতিকে ভালো রাখলে যেমন পরিবেশ রক্ষা করা যায় তেমনি নারী কেও প্রকৃতি ভাবলে একই ফল পাওয়া যায়। বিপরীত ক্রিয়ার উল্লেখ আর এক্ষেত্রে নাই করলাম। সেই প্রকৃতির জীবনকে আমরা ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী যদি দেখতে যাই তো দেখব, একটি কন্যা সন্তান জন্মের পর তার পিতা মাতার স্নেহ ছায়ায় বড় হয়। নতুন কিশলয়ের মতো। কখনো বৃহৎ বনস্পতির ছায়ায়, কখনো বন্ধু গাছের সাহচর্যে। যদিও সেই কন্যার কিন্তু নিজস্ব ঘর হয় না। অন্যের ঘরে অধিষ্ঠানের জন্য ধীরে ধীরে তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। “নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী”-কথাটা ভার্জিনিয়া উলফের। যিনি নিজের জন্য একটি কক্ষ দাবি করেছিলেন, কিন্তু পাননি। সমাজতন্ত্র কন্যাটিকে দেখতে চায় সুকন্যা, সুমাতা, সুগৃহিনী রূপে, সেই মতো বড় হতে থাকে সে। বেশিরভাগ পরিবারই তাকে নাম দেয় শাশ্বতী, কল্যাণী, ইত্যাদি প্রভৃতি। কেউ কেউ যে ব্যতিক্রম নন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলতে পারি বলে মনে মনে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। তা সেই শিশু কন্যাটির হাতে পুতুল ধরিয়ে দেওয়ার দিনে পিতা মাতা ও পরিবার তাকে জ্ঞানে অজ্ঞানে কিংবা অতি নীরব সচেতনতার মধ্যে দিয়েই বুঝিয়ে দিতে চায় আগামীতে স্বামী, সন্তান, গৃহ এই তিনের জটিল অঙ্কের খেলায় হেরে ভুত হয়ে তুমি ঘুরে বেড়াবে এই ইহলোকে, তা তুমি এখনই বুঝে নাও। তবু কুমারী পূজার দেবী টিকে ধীরে ধীরে দাসী করে তোলার প্রক্রিয়াটি, এ দেশে বেশ নিপুণ এক শিল্পকলাও বটে। এভাবেই শিশুটি একদিন দেখতে পায় সাদা টেপ ফ্রকের কোচরে রক্তের দাগ। সে পরিণত হয় কিশোরী সত্ত্বায়। তারপর ধীরে ধীরে সে হয় তরুণী। নারী হয়ে ওঠার পূর্ব প্রক্রিয়া বিশেষ বলা যায় এই পর্যায়ে কে। এ প্রসঙ্গে সিমন দা বোভায়ার এর বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে, “নারী হয়ে কেউ জন্মায় না বরং নারী হয়ে ওঠে” এই পিউবার্টির সময়টা একজন মানবীর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এ সময় মন বদলাচ্ছে, সে বালিকা থেকে তরুণী হচ্ছে। তার মাংসল বক্ষদ্বয় কখনো তাকে বিব্রত করছে, কখনো দিচ্ছে সৌন্দর্য। এদিকে অন্দরমহলে কড়া আদেশ তার জন্য– ইচ্ছে করলেই সে পুরুষের মতো আঙিনার বাইরে যেতে পারবে না, গলা ছেড়ে জোর গলায় কথা বলতে পারবেনা, জেদি হতে পারবে না, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে তার পোশাক ভিন্ন, তার দেহ ভিন্ন। সে ভিন্ন তার প্রিয় পরিচিত বালক ভাইটির থেকে। সে যেন খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার লিঙ্গ (gender) ভূমিকার সাথে। এভাবেই বয়ঃসন্ধি আসে তার জীবনে। বোভায়ার বলেছিলেন, “বয়ঃসন্ধির সাথে ভবিষ্যৎ শুধু ঘনিয়ে আসে না, তার শরীরে বাসা বাঁধে, পরিগ্রহ করে চরম মূর্ত বাস্তব রূপ।” হুমায়ুন আজাদ বলছেন “কৈশোর হল বালিকার জন্য সেই ক্রান্তিকাল যখন সে জানেনা তার জীবনের বিপজ্জনক সুন্দর পরিবর্তনটি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।” বয়ঃসন্ধি বদলে দেয় তাকে এ সময়ে। ঋতুস্রাব তার কাছে আসে ঋতু বদলের বৃষ্টির মতই, ভালোলাগা না লাগার বিব্রত দোলাচলে। মাথাব্যাথা, ক্লান্তি, তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরে যখন সে চোখের নীচে কালি ফেলে তখন ধর্মে তাকে অশুচি বলা হচ্ছে। সে বিস্তর উদাহরণে এই লেখা আর বিস্তারিত করবোনা। পুরুষের কাছে এসময় সে অবশ্য উৎপাদনশীল ভূমি। তার নিজস্ব কোনো ভালোলাগা মন্দলাগা নেই। সে তখন প্রস্তুত হতে থাকে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের সামগ্রী হিসাবে।যদিও দিন বদলেছে, তবুও এই নিকট অতীতেও বিয়েকেই তো মনে করা হোতো নারীর শ্রেষ্ঠ শিরোপা। তবে একটি জিনিস না উল্লেখ করলেই নয়, ভারত বর্ষের কিছু কিছু সম্প্রদায় অবশ্য মেয়েদের বয়ঃসন্ধি এই সময়টা উৎসবের মতো উদযাপন করে। এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর শব্দবন্ধের কথা মনে পড়লো। ‘পুষ্পদেখা’– বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নারীদের ঋতুসূচনাকে বলা হতো পুষ্পদেখা। এ সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কাল। এইটিই স্ত্রী শরীরের পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ইস্ট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি পেলে ঋতু কাল সান্নিকটে চলে আসে। প্রথমে অনিয়মিত ও পরে নিয়মিত একটি প্রবাহর ধরণ স্থির হয়ে যায়। এই সময়ই জীবনের সুন্দর কলাকৌশল গুলো শিখে ফেলে সে। কেরিয়ার স্কিল তৈরী করার সময়ও এটিই। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক সম্পর্কগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরীর সময়। আত্মসম্মান বোধ এবং sexual encounter এর এইটিই আদর্শ সময়, বুঝতে শেখে সে। এরপর নারীকে আমরা পাই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ রূপে। তার মাতৃত্বতে। মাতৃত্বর মাধ্যমেই নারী ধারণ করে তার পরবর্তী প্রজন্মকে।নারী জীবনের এই সময়টি যেন প্রকৃতির পূর্ণ বিকাশকেই ফুটিয়ে তোলে। এইটাই তার full bloom season বলা হয়। এই পর্যায় নারীকে দায়িত্ব নিতে শেখায়। শরীরের মধ্যে হরমোনগুলোর বিরাট পরিবর্তন হতে থাকে। আধ্যাত্মিকভাবে মাদারহুড একটি নারীকে শেখায় জীবনের সমর্পণের মানে, সে বুঝতে পারে একটি অতিশক্তি তাকে চালিত করছে। Sexsual desire কমে আসছে তার বরং শিশুকে nurture করার দায়িত্ব বোধ জেগে উঠছে। অনেকেই বলবেন নারীকে দমিয়ে রাখার জন্যই তাকে সন্তান প্রতিপালনে ব্যস্ত করে দেওয়া হয়। সিমন ও বলেছিলেন, “নারীর মাতৃত্ব তার পেশা।” এ বিষয়ে একজন নারী হিসাবে পূর্ণ অসমর্থন আমার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জন্ম দেওয়া ও বাঁচিয়ে রাখার এই মহান কর্মযজ্ঞ প্রকৃতি যে শুধু নারীকেই দিয়েছে, ভরসা করেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে যাই কোথায়! ইকোফেমিনিস্টরা বলছেন, মানবিক সম্পর্কগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পর্কটির গভীরে পৌঁছে আমরা দেখি যে আগামী প্রজন্মকে জন্ম দেওয়া ও গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা শুধুমাত্র শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করা। তারপরেই প্রকৃতি দখল নেয় হবু সন্তান ও মায়ের শরীরের এই সৃষ্টিকে সুরক্ষিত রাখতে। মাতৃজঠর হয়ে ওঠে জটিল এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পবিত্র আধার। নারী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো তার মেনোপজাল সময়টি। এ সময়টিতে ধীরে ধীরে তার শারীরিক আরও পরিবর্তন আসে। আসে মনেও পরিবর্তন। এবং হয়তো নারী প্রকৃতি বলেই এতো জখম সহ্য করার ক্ষমতা আছে তার। এসময় রক্তস্রাব কমে আসে তার। কিন্তু যৌন চাহিদা কমে আসে তা কিন্তু নয়। বরং এ সময়টি যৌনতাকে উপভোগ করার জন্য বাঁধনছেড়া আনন্দের সময়। এ সময় প্রতিটি নারী হোক ডানা মেলা গাংচিল। সাইন্স বলছে এ সময়টি হলো time of wisedom এর। তুমি প্রকৃতি ও সমাজ থেকে যা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন ও সঞ্চয় করেছো তা তুমি ফেরৎ দাও। এ সময়টি আধ্যাত্মিকতাকে উপলব্ধি করার একটা শ্রেষ্ঠ সময়। এটি নারী জীবনের এমন একটা সময় যখন সে জীবনকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। এতদিনের চেনা জগতের ছক থেকে বেরিয়ে এ যেন উতল হাওয়ার দিন। মেডিক্যাল সাইন্স বলছে ৭০-৮০% মহিলারা মেনোপজ কে উপভোগ করে ভীষণভাবে। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল সমাজ মেনোপজ কে এজিং প্রসেস এর মধ্যে ফেলে নারীকে একঘরে করার ষড়যন্ত্র করে। আসলে নারী বলি আর প্রকৃতি সে যে সৃষ্টি ও ধ্বংস দুইটিরই কারণ তা তো আমরা দেখেইছি। প্রকৃতির ধৈর্য ও স্থিতির সাথে একমাত্র তুলনা চলে নারীরই। পুরুষ তাকে কখনো দেবী বলে পায়ে লুটিয়েছে, কখনো বেশ্যা বলে বাজারে টেনেছে, কখনো তার দানবী রূপে ভয় পেয়েছে। তাই তো তাকে হারাতে, অস্বীকার করতে, তার কাছে নতি স্বীকার না করতে বিশ্বজুড়ে এতো আয়োজন। ইকোফেমিনিস্টদের মতে এ প্রকৃতি রুষ্ঠ হলে মুক্তির একমাত্র পথ হল পরিবেশ নারীবাদ। নারীর মন মমতায় পরিপূর্ণ। আন্তরিক যত্ন ও তন্নিষ্ঠ লালনের কথা উঠলে পুরুষ নয়, নারীর কথাই আমাদের মনে আসে। নারীর এই গুণেই সমাজ সঠিক পথে পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি যত্নবান হবে। নারী যেমন নিজের সংসারকে স্নেহ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে আগলে রাখে, সেভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে। নারী জীবনের বিভিন্ন স্তর, আসলে একটা জীবনের মধ্যে সহস্র জীবনের গল্প বলে। |
একটা লেখা, তার ভিতর তথ্য এবং নিজস্ব মতামত — এই দুইয়ের ব্যালেন্স করা টাফ।কিন্তু লেখিকা অতি সন্তর্পণে এই কাজটা করেছেন। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী হিসেবে নারীকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
Opurbo. Asole ” nari” shobdo ta ekta feeling. Lekhika sotyi khub sundor bhabe byakha koreche.
Ar etao thik, after menopause, meyeder modhye ekta “payback” monobhab ase. Khub jothajoto byakha eta piyali… 👍🏻
সুন্দর ব্যাখ্যা ও অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন লেখিকা ।ভারী সুন্দর বিশ্লেষণ।
তথ্যের বিস্তৃতি আমাকে চমকিত করেছে। সেইসাথে তাত্ত্বিক প্রেক্ষণ সঙ্গত ভাবেই ধারে বেড়েছে। লিখিয়েকে অভিবাদন, লেখাটির জন্য।