পিয়াংকী
প্রিয়, ঘুলঘুলি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছ, ওজনও তো দেখছি বেড়েছে বেশ। তোমার একান্ত নির্বাক ভরণপোষণ নিয়ে দীর্ঘ হয়েছি দুই বিনুনির সেই আমিও। মিহি যাতায়াত আর মিইয়ে যাওয়া প্রাচীন শব্দের ভেতর আজও অসংখ্য ফাঁকফোকর। সেখানে লুকিয়ে আছে বিগত জন্ম আর যাবতীয় ঋণমুকুব দস্তাবেজ। রাজত্ব ফেলে রেখে রাজা এসেছে, সাথে তার পোষা পাখি, খড়কুটো জমিয়ে রেখে তারা চলে গেছে নির্দিষ্ট সময় অন্তর। তুমি বাড়োনি কমোওনি। মনে পড়ে? কত কথা,বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম রজঃস্রাব আর ঋতুস্রাবের পার্থক্য। মনে পড়ে একঘর একদুয়ারের যাপন আমাদের। টালির চালের ঘরে চৌকিতে একচোখ অন্ধ ঠাকুমা আর খোদলা ওঠা ঘ্যাসের গাঁথনির মেঝেতে পাছা ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে ছোট ভাইয়ের প্যানপ্যানে কান্নাকাটি। মায়ের সেলাই মেশিনের একটানা ঘড়ঘড় শব্দে বিরক্ত হতে হতে মুখবিকৃতি দেখে মায়ের জলদাগ জীবন। সেবার দুর্গাপুজোর আগেই মা’র ছয় ডজন ব্লাউজের মজুরি নিয়ে এসে মা রাজমিস্ত্রী ডেকে ঘরের পেছন দিকটায় একটা ছোট মতো চালা বাড়ালো রান্নার জায়গা করবে বলে। শীতের সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে আমড়ার পাতলা ডাল আর রেশনের মোটা চালের ভাতদুটো গিলে যেই ধরেছি ছাই সাবান, ওমনি আলো আঁধারিতে ছেঁকে ধরেছে হাজারো মশা আর ঠিক সেই সময়ই পিছন বারান্দার উনুনের ওপর তোমার পুরুষালি ছায়া। আহা,শিউরে উঠেছি তোমার সেই গিঁট গিঁট নকশাকাটা রূপে। ভাতের হাড়ির পোড়া কালি আর অ্যলুমিনিয়ামের থালায় তখন আঁকিবুঁকি অট্টালিকা আর ভেজা পায়ে মশার কামড়ে মুখের অশ্লীল গালাগালি। আমার সেইসব যাবতীয় সংরক্ষণের সাক্ষী তো শুধু তুমি। নিরাপত্তাহীন ওসব দিনে রূপকথার গল্পের নায়ক আমার ঘুলঘুলি, তুমি কী বোকা ! ভেবেছিলে তোমায় ভালোবেসেছি, ভেবেছিলে এত ছায়া এত আশ্রয় এত উচ্চতার প্রেমে বশ হয়ে গেছি। জানতেও পারোনি শব্দ সাজিয়ে ঘরবাড়ি বানানো উঠতি বয়সের কিশোরী তোমায় রূপক ধরে, একটানা তোমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থেকে ধ্বক্ এনেছে দুই স্তনের মাঝের গুমোট অন্ধকারে। টালির ছাউনি,নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের ছিটকিনি আর ওই এক সাধের ঘুলঘুলি, তুমি আমার, একার সম্পত্তি। চুরাশি লক্ষ জন্মের পর এইটুকুই আমার সঞ্চয়ের খতিয়ান। যখন সবে দাঁড়াতে শিখছি, তোমাকে দেখিয়ে ঠাকুমা বলতেন,”আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা,চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা”। বড় হলাম সামান্য, ওই একই ঘুলঘুলি দেখিয়ে, একটুও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বৃদ্ধি পাওনি তখনও, ঠাকুমা আবার ভয় দেখাতে শুরু করলেন,বললেন, “ওই ছেমড়ি, মা উনানডা নিভায়া আইসার আগে তাড়াতাড়ি খায়া ল, ঘুলঘুলিডার ভিত্যর দিয়া দৈত্য আইবো নে”। শৈশবের বেভুল কথোপকথনের একটা অধ্যায় শেষ হল।আবারও খানিক লম্বা হলাম, মহল্লায় মহল্লায় ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ালাম, ” আমার নিজস্ব একটা ঘুলঘুলি আছে, তামাটে রঙের শরীর হলুদ হলুদ চোখ”। কিশোরী শ্যামলা মেয়ে তখন জানে ঘুলঘুলি মানে ফেলে আসা জীবনের দু’চারটে বোবা ছিদ্র বৈ কিচ্ছু নয়। বকুলফুল খোঁপায় গুঁজে ভরসন্ধ্যায় ধূপধূনো দিতে দিতে মা বলল,” তোমার বয়স হচ্ছে, দেখছো না ঘুলঘুলিটা কেমন পুরুষ হয়ে উঠছে রোজ”। আমি সেদিন থেকে বনলতা অথবা অহল্যা। একথালা ভাতের মতো পুষ্টিকর নারী। রোজ দুপুর নিভলেই তাকিয়ে থাকি জানালা দিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে,চৌকাঠ থেকে অনেক দূরে। ভাগ্যিস তোমার দুটো চোখ নেই, তুমি আমায় দেখো না। পুরুষ হয়ে ওঠার আড়ালে তোমার গায়ে থরে থরে জমছে সূর্য পোড়া অবসন্ন বিকেল। ছিদ্রগুলোর ওপর সমুদ্রস্নান ছিটিয়ে দিয়ে সরে যায় যারা তাদের বিচ্ছিন্নতাকামী বলার সাহসটুকু অর্জন করতে গিয়েই আরও একফুট উচ্চতা বেড়েছে আমার , এক গোছা খোলা চুলের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি সাজিয়ে বসেছে পসরা। হাটে-বাজারে নক্ষত্র কিনতে আসছে লোকজন। ঘুলঘুলিতে পাখি ডাকছে চিঁচিঁ। ঘেঁটুফুল শিকড় বিছিয়ে রেখে নেমে আসছে আমার সাদা বিছানায়। ভেন্টিলেটর বলে হাঁকডাক করে আধভাঙ্গা খিড়কি দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছি, “আপনিই কি এত এত রাত জেগে থেকেছেন আমার শামুকভাঙা বিছানায়? হে প্রেমিক, আপনাকে কি আর একটি বার ঘুলঘুলি বলে ডাকতে পারি?” শীত অকালে চলে গেছে, আমার রাজ্যে বর্ষা হয়নি কতকাল। তবু এই এতদিনের নির্বাসনের পর আজ এই মুহূর্তে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি ঘুলঘুলি, ” মাত্র এক রাতের জন্য আমার সঙ্গমপুরুষ সাজতে পারো তুমি?” ইতি তোমার শ্রাবণজাতিকা |