ঋতুকাল
পিনাকী চক্রবর্তী
১ আরেকবার মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠল। হাতের শিরাগুলো এমন ভাবে উপড়েছে— যেনও মাটি থেকে নির্দ্বিধায় দূর্বা ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ! এই মৃত্যু ভয়ানক বেদনাদায়ক। কাঁধটা একদিকে হেলিয়ে, নিথর দেহটা কলেজের ছাদেই পড়েছিল। মেয়েটির সম্বল বলতে বিধবা মা। বয়স ষাট।দিনের আলোয়, শ্রীরামপুরের একটি নার্সিং কলেজ চত্বরে সোমবারের সকালটা মৃত্যুময় হয়ে উঠল! একজন অফিসার আর তিনজন কনস্টেবল লাশটিকে ঘিরে আছে। চারপাশের বাসিন্দারা উদ্বেগ নিয়ে দেখতে এসেছে। ছাত্রীদের মুখে ভয়ের ছবি, অজানা আতঙ্ক; মুহূর্তে কলেজটা যেনও এক প্রেতপুরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! চারতলা নার্সিং কলেজের পিছনে হুগলি নদী থেকে হাওয়া আসছে, মৃতদেহের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে, শুয়ে থাকা দেহটা যদি বেঁচে উঠে সত্যি ঘটনাটা বলে দিতে পারত বেশ হতো। ঘড়িতে বেলা আটটা। কলেজের মালি এই ঘটনাটা প্রথম দেখেন। মেয়েটির নাম সুকন্যা দাস। ফর্সা, হাল্কা চেহারার, বয়স একুশ বছর। সম্পূর্ণ ঘটনা ঝরঝর ভাবে বলে গেল চয়নিকা। ডাক্তারের সামনে যদি রুগি সিনেমার মতন নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে, অনেক রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা খুব দ্রুতই শুরু হতে পারে। চয়নিকা একেকটি দৃশ্যের বর্ণনা করে গেল। কালীঘাটের অশ্বিনী দত্ত রোডের অফিসে, ওরা তিনজন বসে আছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাট। সোফার উপর বসে, তিনজনেই কাচের টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা ছবিগুলো দেখছিল; মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত ছবি। চয়নিকা বলল— এই মৃত্যু ভাবা যায় না! বয়স সাতাশের একটি মেয়ে বসে গভীর ভাবে ভাবছিল। তাঁর দিকে তাকিয়ে চয়নিকা বলল— মেঘবালিকা ভাবছো? —ভাবনা আছে বলেই তো মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে। মেয়েদের প্রতি সমাজের রাগটাই ফুটে উঠছে! সেই রাগ আদিম প্রবৃত্তির। চয়নিকা ও মেঘবালিকার তুলনায় বয়সে ছোট আরেকটি ফর্সা, পাতলা চেহারার মেয়ে ঘরে বসে আছে। তিতলি। মেয়েটি বলল —এই কেস আমরা সলভ্ করতে পারবো? —মানে? মেঘবালিকার কণ্ঠে বিরক্তি। বলল —এই অবস্থায় এতটা নেগেটিভ ভাবছিস! —মেঘদি , এমন ভাবনার পিছনে যুক্তি আছে। শ্রীরামপুর শান্ত জায়গা। প্রায় তিনদিন হয়ে গেল, এখনো তদন্ত এগোয়নি। একটা মেয়ের উপর এই রকম বর্বরতা প্রমাণ করছে খুনি ভয়ানক। —তো? —খুনি কোন ক্লু রাখেনি। —কেমন ভাবে বুঝলি? আমাদের অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি। এইভাবে তুই আমাদের সাথে কাজ করতে পারবি না। মনে রাখবি প্রাইভেট সংস্থা, কাজে সফল হলেই টিকে থাকতে পারবে। তিতলি, আমরা যদি কেস সলভ করতে না পারি, পাড়ার মুখে চাউমিনের দোকান দিতে হবে। নতুন মক্কেল আসবে না। মেঘের কথাগুলো শুনে তিতলি বলল —সরি দিদি। চয়নিকা বলল— বডি ছাদে পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ বলছে খুনটা অন্য জায়গায় করা হয়েছিল। তারপর ছাদে লাশ রেখে আসা হয়। মেঘ বলল— তদন্তের জন্য যাদের সাথে দেখা করেছ, রিপোর্টটা আমাকে বলো। চয়নিকা বলতে শুরু করল। —কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে পরের দিনই দেখা করি। উনি দুপুরবেলা নিজের অফিস রুমেই ছিলেন। চয়নিকা বর্ণনা দিতে শুরু করল। ঘরের বাইরে চয়নিকা দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি নিয়ে ঢুকল। চয়নিকা বলল— নমস্কার স্যার। উল্টোদিকে বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক বসে আছেন। চয়নিকাকে দেখে বললেন —বসুন। —স্যার মেঘবালিকা বসু আমাকে পাঠিয়েছে। —জানি। আমরা কলেজের গভর্নিং বডি ঠিক করেছি কেসটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি দিয়ে তদন্ত করা হবে। তাই খুনের সাথে সাথেই সময় নষ্ট না করে ফোন করি, যাতে তথ্য সংগ্রহে অসুবিধা না হয়। —আপনাদের কোন নিরাপত্তারক্ষী নেই? —আছে, তবে বডি যেখানে পাওয়া গিয়েছে, সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। আমরা সেই জায়গাগুলোতে সিসিটিভি লাগাইনি। পরে লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। এখনো কলেজটি সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়নি। তো বুঝতেই পাচ্ছেন। —বডি প্রথম কে দেখে? —গুড্ডু। কলেজের মালি। —ঠিকাছে স্যার এখন উঠছি। আবার আপনাকে ডিস্টার্ব করতে হতে পারে। —না না। এমন ভাবে বলছেন কেন? কলেজের রেপুটেশন—এর বিনিময়ে যতদূর যেতে হয় যাবো। যেমন ভাবেই হোক অপরাধীদের খুঁজে বের করুন। না হলে বুঝতেই পাচ্ছেন, কলেজটা ডুবে যাবে। চয়নিকা পুরো ঘটনাটা ঝরঝর করে দৃশ্যের পর দৃশ্য বর্ণনা করে, থামল। তিতলি বলল —দিদি জল খাও। মেঘ, তিতলির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, আবার চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বলল— খুনি কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকে বা কলেজ ক্যাম্পাসের সাথে পরিচিত। কথাটা শুনেই চয়নিকা ও তিতলির শরীরে শিহরণ খেলে গেল! —মানে দি! তিতলির কণ্ঠে উষ্মা! মেঘ বলল— এরপর? চয়নিকা আবার বলতে শুরু করল —মায়া ম্যাডামের কাছে গেলাম। উনি কলেজে গাইনো বিভাগটা দেখেন। ঘড়িতে তখন বেলা দেড়টা। ক্লাস ছিল না। ওনার কথা মতন ল্যাবে গিয়ে দেখা করি। চয়নিকা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বছর পঁয়ত্রিশের একজন মহিলা খাতা দেখছিল। চয়নিকাকে দেখে বলল —দাঁড়িয়ে কেন ? —বসছি ম্যাম। চয়নিকা সামনের টুলে বসল। —ম্যাডাম, যে মেয়েটি খুন হয়েছে, আপনি তাকে কোন দিন পার্সোনালি চিনতেন? —না। আসলে তেমন ভাবে পরিচয় জিজ্ঞেস করিনি। কোথায় থাকে বলতে পারবো না। বাকি মেয়েদের মতনই ছিল। তবে একজন মহিলা হিসেবে বলতে পারি, খুনি শুধু নিষ্ঠুর নয়, সে বিকৃত স্বভাবের। মেয়েটির মাসিকে ভেজা প্যাড খুলে নিয়েছে! ছিঃ । কথাগুলো বলেই মায়া ম্যাডাম কাঁদতে শুরু করলেন। চয়নিকা হাত বুলিয়ে দিলো। চয়নিকা মেয়েটির বাড়ির লোকের সাথেই আলাদা ভাবে কথা বলেছিল। ঘরের মেয়ে নার্সিং শিখে রোজগার করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে; বাড়ির বৃদ্ধ বাবা মায়ের চোখে সেই আনন্দই ফুটে উঠত। আচমকাই গরীব পরিবারে যেনও শোকের ছায়া নেমেছে। ২ চয়নিকা কলেজ ক্যাম্পাসে আজ কিছুটা বেলার দিকেই এসেছে। সামনেই বিল্লু যাদবের আবাসন।চয়নিকা দেখল এই দুপুরে সিমেন্টের বেদির উপর বসে বছর পঞ্চান্নোর বিল্লু ঝিমুচ্ছে; নির্ঘাত নেশা করেছে। কিছুটা সামনে যেতেই, বিল্লু চোখ খুলে বন্ধ করল। আবার চোখ খুলল। বলল— আপ ম্যাডাম জি? হামি কুছ ভি নেহি কিয়া, ছোড় দিজিয়ে। —আপ মুঝে বোলিয়ে, লাশ তো পেহেলে আপনেহি দেখে না? —বিটিয়াকা লাশ ম্যাঁয় নেহি দেখা পেহেলে। মালি দেখে। ও হামকো লে আয়া। ফির ম্যায়নে সবকো বাতায়া। —আগের দিন মেয়েটির মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছিলেন? —না। ক্যাম্পাসে ইতনা লড়কি। ক্যায়সে কিসি এক কো দেখে হাম! ভোঁর সাড়ে চার বাজে মালি পেহেলে দেখে, উঙ্কে বাদ হাম দেখে। ব্যাস অউর কুছ নেহি জানে হাম। চয়নিকা ঘড়িতে দেখল, তিনটে বাজল। লেডিস হোস্টেলের সুপারিটেনডেন্ট এখনো তাঁর সাথে দেখা করবার ফুরসৎ পাননি। তিনটে কুড়িতে উনি অফিসে এলেন। চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বললেন —বলুন। —আপনার হোস্টেলের ছাত্রীটির মৃত্যু নিয়ে আমাদের তদন্ত চলছে। সেই ব্যাপারে এসেছি। —দেখুন, মেয়েটির দোষ ছিল। —কেন বলছেন? —না, দোষ থাকা মানেই যে তার খুনির প্রতি আমার সহানুভূতি আছে তেমন নয়। তবে আমি ওকে রাতে তাড়াতাড়ি হোস্টেলে ফিরতে বলতাম। প্রায়ই বাইরে লুকিয়ে ঘুরতে যেতো। সিনেমা দেখত। এটা ঠিক? —আর কিছু? —আমি দেখিনি। কিন্তু কথা না শোনা খুব খারাপ অভ্যাস। মেয়েরা ইদানীং দেখছি বড্ড বেয়াদপ হয়ে উঠছে। এরজন্যই এদের বেশিদূর পড়াতে নেই। কিছুদূর পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। ঠেলুক স্বামীর ঘর। টের পাবে। চয়নিকা কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। —আপনার নামটা যেনও কী? — দ্বিজ মাধব গাইন। —বয়স? —৫৬ —এই বয়স অবধি শুধুই ছেলেদের বাঁদরামি দেখে এসেছেন না? এইবার মেয়েদেরটা দেখা অভ্যাস করুন। এরপর দুই দিকেরটা মিলিয়ে দেখবেন, বেয়াদপিতে মেয়েরা এখনো ছেলেদের তুলনায় অনেক কম। কলেজ থেকে বেরিয়ে, চয়নিকা আড় ভাঙল। মনে মনে বলল আজ মাথাটা ভীষণ ধরেছে। পকেট থেকে ফোন নিয়ে ফোন কাউকে ফোন করল। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে বিছনার উপর দুটো নারী-পুরুষের নগ্ন দেহ পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে মেয়েটির মুখে শীৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘন ঘন শব্দ আবেগ ঘন পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে ছেলেটি চিৎ হয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে। ছেলেটি বলল —উফ! কতদিন পর তোমাকে পেলাম!! —মাথাটা হ্যাং করেছিল। ভাবলাম তোমাকে ফোন করে নিই। —হায় এইরকম ফোন মাঝে মাঝে আসে না কেন? —অসভ্য। ওঠো। —আরেকটু প্লিজ। —কেসটা খুব ভাবাচ্ছে। এইবার তো গোটাতে হবে। —চয়নিকা, তোমার মেয়ে কেমন আছে ? — আছে। তবে বাড়ি গেলে সেই বায়না, ছুটিতে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। —এটাই স্বাভাবিক, মায়ের উপর একটা দাবি আছে। এমন সময় চয়নিকার মোবাইল স্কিনে মেঘবালিকার নম্বর ভেসে উঠল। চয়নিকার দেহে কোন পোশাক নেই। সোফায় পড়ে থাকা ব্রা, প্যানটি, টিশার্ট, জিন্স তাড়াতাড়ি পরে নিলো। বিছানায় শুয়ে থাকা বছর চল্লিশের ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, —সাহিল তুমি শুয়ে থাকতে পারো। আমি চললাম। পেমেন্ট করা আছে। চেকাআউটের টাইম বেলা বারোটা । মেঘের ফোন। ফোনটা ধরেই ওপার থেকে মেঘের গলা ভেসে আসছে। —কেসটা কতদূর এগিয়েছে? অফিসে একবার আসতে পারবে? —আসছি। চয়নিকা বলল— আমি প্রথম যখন ওনার সাথে কথা বলে ছিলাম বদরাগি বলে মনে হয়নি। দ্বিজমাধবের সাথে দেখা করে, শান্তুনু সেনের কাছে যাই। উনি কেন জানি না শুরু থেকেই এই তদন্তকে সমর্থন করেননি। মেঘ শুনছিল। টেবিলের দুই দিকে তিনজন বসে আছে। চয়নিকা, তিতলি আর উল্টো দিকে মেঘবালিকা। চয়নিকা যখন বর্ণনা করে মনে হয় চোখের সামনে দৃশ্য ভাসছে! চয়নিকা বলল— আমি ওনার অফিসেই দেখা করেছিলাম । ঘরটা ছোট হলেও পরিপাটি করে সাজানো ছিল। আলমারি-ভরা বই, ফাইল আর স্টুডেন্টদের খাতা সাজানো রয়েছে। লোকটির বামদিকের কাচের জানলার উপর দিনের আলো ঢুকছে, এই আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ওখানে আলাদা ভাবে বাল্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই দিকে তাকিয়েই চয়নিকা বলল— খাতাগুলো এখনো জমা দেননি! — হ্যাঁ, এইসব কাণ্ডের জন্য সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। —আপনার ক্লাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছে না? —আপনি এই ব্যাপার নিয়ে এত ভাববেন না। কেন এসেছেন বলুন? —না খাতার ব্যাপারে নয়। আমি খুনের ব্যাপারে তদন্তের জন্য এসেছি। মেয়েটির সম্বন্ধে জানতে চাইছি। —দেখুন মেয়েটি নিজেদের মতনই থাকতো। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না। —খুব ভালো করে ভেবে বলুন, তাঁর মধ্যে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখে ছিলেন? —আমি অধ্যাপক, তাদের বন্ধু নই। চোখে চোখ রেখে পড়াই না। তবে এটা বলবো মেয়েটি পড়াশুনোই খুব আগ্রহী ছিল। —খুনের দিন আপনি কোথায় ছিলেন? —খুন কখন হয়েছিলো? —আনুমানিক রাত আড়াইটা। —গভীর ঘুমে ছিলাম। নিজের রুমেই। চয়নিকা বুঝতে পাচ্ছে, শান্তুনু সেন এড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘকে কথা গুলো বলবার পর চয়নিকা বলল— ম্যাডাম মায়ার সাথে, শান্তনু সেনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমি নিজে এই ব্যাপারটা প্রথম সুকন্যার মায়ের কাছে শুনেছিলাম। সুকন্যা একবার ছুটির পর ফাঁকা টিচার্স রুমে ঢুকে পড়ে, দুজনকেই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল। এরপর থেকে তাঁর মনে একটা ভয় কাজ করত। মেঘ বলল – তারমানে, হতেই পারে এই ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল বলে , ওরা দুজনেই প্ল্যান করে খুন করে। তিতলি বলল— তিন কাপ কফি আনছি, বেশ জমছে ব্যাপারটা। ছিল খুন হয়ে গেলো বাংলা সিরিয়ালের প্লট! এক্সট্রা ম্যারিয়াল এ্যফেয়ার! মেঘ বলল— কে কার সাথে থাকবে বা থাকবে না , সেটা আমাদের তদন্তের বিষয় নয় তিতলি। মেয়েটির খুন যে বা যারা করেছে, তাঁদের বের করতে হবে। চয়নিকা বলল— মায়ার স্বামী হচ্ছেন অবিনাশ মণ্ডল। এই ব্যাপারে মানে নিজের বউয়ের ব্যাপারে জানলেও মেনে নিয়েছেন। ওনার সাথে অবশ্য কলেজের বাইরে দেখা করি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমরা দুইজন পাশাপাশি বসে ছিলাম । গঙ্গার পাড়েই বসেছিলাম। অবিনাশ নিজেই এখানে দেখা করতে চাইলেন। তিতলি বলল— পুরো ব্যাপারটাই রোমান্টিক ,উফ! অন্যের বরের পাশে তদন্তকারী কলকাতাবাসী সুন্দরী ম্যাডাম বসে আছেন! কথাটা শুনে চয়নিকা মুচকি হাসল। মেঘ বলল— তিতলি বি সিরিয়াস, কফিটা নিয়ে আয়। কিছুক্ষণ বাদে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিয়ে চয়নিকা বলল —অবিনাশ বাবুর সাথে মায়ার প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো। —ভগবান প্রেম করে বিয়ে করেও আলাদা! তিতলির কথা শুনে, মেঘ বলল —প্রেমের সাথে প্রেম ভাঙবার সম্পর্ক নেই তিতলি। চয়নিকা বলতে শুরু করল— —তিনবছর তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই। দুজনে এক ঘরে থাকেও না। অবিনাশ নির্বিকার কণ্ঠে বলল— শান্তনুর প্রতি রাগ নেই। মায়া মনে করে যখন আমাদের ভালোবাসার ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যায়, তাকে আগে চার্জ করতে হয়। সব সম্পর্কই অবশ্যই রিচার্জেবল, কিন্তু তাঁর ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। মায়ার মনে হয়েছে, অবিনাশের ভালোবাসার বিনাশ ঘটেছে। চয়নিকা কিছুক্ষণ থেমে বলল, —অবিনাশ ক্যাম্পাসের স্টাফ আবাসনে থাকে না। কলেজ থেকে একঘণ্টা বাইক চালিয়ে নিজের ভাড়া বাড়িতে প্রতিদিন চলে যায়। তাই সন্ধ্যা বেলা থেকেই সে ছিল না। চয়নিকা বলল— মালি ও বাকিদের প্রায় সকলেরই স্টেটমেন্ট নিয়ে বিচার করে এদের উপর সন্দেহ হয়েছিল। মেঘ বলল, —সন্দেহ সবার আগে মায়া আর শান্তনুর উপর হচ্ছে। এই খুনের পিছনে ওদের হাত থাকাটাই স্বাভাবিক। দ্বিজমাধব সেই রাতে ঘরেই ছিলেন, অন্তত ঘরের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ তাই বলছে। বিল্লু বাইরে বেরিয়েছিল গাঁজা টানতে, সন্দেহ সেইদিকেও আছে। অবিনাশ কলেজেই থাকে না, তাই ওকে সন্দেহ করা যায় না। তাহলে এদের মধ্যে খুনি কে? মেঘ কথাগুলি বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। চয়নিকা বলল— প্রিন্সিপালের ছেলে অয়ন সামন্ত। তাকে এই তদন্তের সন্দেহজনক ব্যক্তির তালিকায় রাখাই যায়। —কেন? —ছেলেটি ভারসাম্যহীন। বয়স বাইশ। তবে ওর মহিলাদের প্রতি এক অদ্ভুত হিংসা রয়েছে। লুকানো নিষ্ঠুর প্রতিশোধ স্পৃহা। —কেন? —ছেলেটি আমাকে চিৎকার করতে করতে বলল,পৃথিবীতে নারী সম্প্রদায়তো ক্যান্সার। এরাই জীবন শেষ করেছে, তাই যখন কোন নারী মারা যায় তার খুব ভালো লাগে। আমাকে দেখে হিংস্র হয়ে গিয়েছিল। আমি দুইদিন আগে প্রিন্সিপালের ক্যাম্পাস লাগোয়া ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানাতে। ৩ তিতলি দাঁড়িয়ে ছিল। মেঘবালিকা আর চয়নিকা বসেছিল । তদন্তের আজ অন্তিম পর্ব। আগের দিন রাতে একটি বড় কাজ হয়েছে, পুলিশের সাথে কথা বলে সন্দেহভাজন লোকেদের পরের দিন অবশ্যই কলেজে থাকতে বাধ্যতামুলক বলা হয়েছিল। হলঘরের মধ্যে অবিনাশ, বিল্লু, শান্তনু, মায়া এবং প্রিন্সিপাল অভ্রজিত বসু বসে রয়েছে, সকলেই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। লোকাল পুলিশ অফিসার তিলক সামন্ত দুজন কনস্টেবল নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ঘড়িতে সময় সকাল নটা । মেঘবালিকা দাঁড়িয়ে গেল। বলল— মায়া ম্যাডাম, আমরা অনেক সময় মহিলারাই মহিলাদের শত্রু হয়ে উঠি। অল্প বয়সি মেয়েকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে, অথচ আপনার কণ্ঠ একদমই উদ্বেগহীন ছিল। এটা আপনার প্রতি সন্দেহকে আরও দৃঢ় করেছে। মায়া বলল— মানে? —অভ্রজিত বাবুর সাথে ছাদে আপনার দেখা হয়েছিল, সেটা বিল্লু স্বীকার করে দিয়েছে। সবাই ঘরের মধ্যে চমকে গেল! —মায়া আর শান্তনু যখন তখন কলেজ ক্যাম্পাসের পিছনে অন্ধকার জায়গায় নিজেদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে যেত। সেইদিনও গিয়েছিলেন। আর তাঁরা যখন পিছন দিক থেকে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠছে বিল্লু আর অভ্রজিত বাবু। মায়া, আপনি আর শান্তনুবাবু এই সত্যিটা চেপে গেলেন! মায়া মাথা নিচু করে রেখেছে। —অভ্রজিত বাবু, আপনি আর বিল্লু দুজনেই নেশাখোর। বিল্লু গাঁজা টানবার নেশা করে। আপনার নেশা তাঁর থেকেও ভয়ঙ্কর, আর এর জন্যই নিষ্পাপ মেয়েটির প্রাণ অকালেই ঝরে গেল! —মানে? —অভ্রজিতবাবু আপনি যেই সেন্টের বোতলটা ছাদে ফেলে এসেছিলেন। যেটা বিল্লু তুলে নেয়। আপনার ঘরে প্রথম যেই দিন সেন্টের গন্ধটা পেয়েছিলাম , বিল্লুর গায়ে একই রকম গন্ধ পাই। সন্দেহ হয়। পুলিশ অফিসার বললেন, মানে? তিতলি বলল— পুরো ব্যাপারটা বলো দিদি? মেঘ— অল্প বয়সি মেয়েদের মাসিক মাখা প্যাড-এর গন্ধ নেওয়া একটা বিকৃত নেশা। অভ্রজিত এই নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে এই নেশা করতেন। রাতে মেয়েদের হোস্টেলে ফেলা প্যাডগুলি বিল্লু লুকিয়ে নিয়ে এসে অভ্রজিতকে দিত । একদিন রাতে বিল্লুর এই কাণ্ড দেখে ফেলে সুকন্যা। বিল্লুর সাথে এই ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়। সুকন্যা ঠিক করে অভ্রজিতকে বলবে। বিল্লু নেশার ঘোর সামলাতে না পেরে, জোরেই ধাক্কা মারে, সুকন্যা সামনে থাকা পাথরের টিলার উপর উল্টে পড়ে, মারা যায়। লাশ অভ্রজিতের কথা অনুসারে বিল্লু ছাদে রেখে আসে। —বিল্লু সবটাই পুলিশের কাছে স্বীকার করে ফেলেছে। তবে আমার কাছে একটাই প্রশ্ন, এই মেয়েটির খুনের জন্য সবচেয়ে বেশি শাস্তিযোগ্য অপরাধী কে? তিতলি দেখছিল বারান্দায় দুটি শালিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। হলঘরের দরজার বাইরে রবিবারের সকালবেলার রোদ। হলঘরের ভিতরের মলিনতা তাকে আর স্পর্শ করছে না। |
ভালো লাগল পিনাকী