পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী
প্রতি স্যার সুভাস চন্দ্র বসু, “বজ্রের মত যার কঠিন আহবান, তুমি সেই নির্ভয়ে নির্ভীক মহাপ্রাণ, শিখায়েছ মুক্তির মহামন্ত্র, জয় হিন্দ, জয় হিন্দ, জয় হিন্দেরই গান।“ জানেন স্যার, উপরের এই লাইন কটা, যতবার পড়ি, দেখি, গুনগুন করি, ততবার আমার চোখের সামনে আপনারই অবয়বটা ভেসে ওঠে। আজকের আমাদের এই ‘ভারতবর্ষ’ নামক নিজস্ব যে ভূ-খন্ডটায় আমরা বাস করি, বলাই বাহুল্য, তার সর্বকালের সেরা সাহসের প্রতীক হলেন আপনি, ‘নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু’ !! কিন্তু, আজ আমি আপনার কাছে কিছু দুঃখগাথা নিয়ে এই চিঠি লিখতে বসেছি। স্যার, আপনার জন্ম থেকে শুরু করে অমরত্বে উত্তীর্ণ হবার মধ্যের পুরো সময়কালটার যাবতীয় সব ঘটনাবলী যে শুধুই উত্তরণের সাক্ষী, সে তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। দুঃখ কোথায় জানেন? আজ আমরা সেসব শুধু বইতেই পড়ে, তারপর বই বন্ধ করে রেখে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছি। দেশে আজ ভীষণ সঙ্কট স্যার। ‘ভারত মা’ বলতে যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল রাষ্ট্রের স্বপ্ন আপনি দেখতেন, সেই রাষ্ট্রের আজ চারিদিকে কালো কালো দাগ! আর সেই দাগগুলো থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে হিংসা, লোভ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দলাদলি, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ ইত্যাদি সবকিছুর দুর্গন্ধময় নির্যাস। জানেন তো, আমরা এখনও চাইলেই পারি, আপনার জীবনের প্রতিটা সংগ্রাম, প্রতিটা ঘটনার, প্রতিটা পদক্ষেপের মধ্যে দ্রবীভূত থাকা ওই ইস্পাত-কঠিন আদর্শবলীর সমগ্র নির্যাসের অন্তত সিকিভাগের সিকিভাগও নিজের মধ্যে আত্মস্থকরণ করতে, কিন্তু আমরা তা করিনা। একদল মানুষ নিজেদের ‘নেতা’ বলে দাগিয়ে নিয়ে সিংহাসনে বসে হীরক রাজার রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন, আর আমরা সেইসব খবর সকালবেলা খবরের কাগজে, ফেসবুকের পাতায় আর পাড়ার চায়ের দোকানের তর্কতেই শুরু করে, শেষ করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি। আপনি নিজের রাষ্ট্রের পরিচয় পাবার জন্য অন্য রাষ্ট্রের সর্বশক্তির বিরূদ্ধে লড়েছিলেন, আর আমরা নিজের অধিকারের ভাত-কাপড়টুকুর জন্যও নিজেদেরই ঘরশত্রুর সাথেও লড়াই করার সাহস জোগার করে উঠতে পারছিনা! ধিক আমাদের! অন্তর্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি ভালোই করেছিলেন স্যার। আজ যদি আপনি আমাদের মাঝে জীবিত থাকতেনও, কিংবা, আপনার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আপনার কোনও মূর্তি আমাদের সামনে থাকতো, আমরা কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াতাম আপনার সামনে? এখনও দেখি আপনার অনেক মূর্তি। প্রতি ২৩শে জানুয়ারী, ১৫ই আগস্টে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মালা পরায় আপনার মূর্তির গলায়। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের এই পরবর্তী প্রজন্মকে সেইদিন বলে দিইনা, যে শুধু মালা পরালেই নেতাজীকে শ্রদ্ধা জানানো হয়না। নেতাজীকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে গেলে নেতাজীর আদর্শকে শিরা-ধমনিতে মিশিয়ে ফেলতে হবে আমাদের, ওদের, সব্বাইকে। তবেই গিয়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এতগুলো বছর পরেও, যে স্বাধীনতা আপনি আপনার অদম্য জেদ, সাহস আর অন্যায়ের সাথে আপোস না করার বজ্রগম্ভীর পণের বিনিময়ে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, এত আফসোস করতে হবেনা এই ভেবে ,যে আদতে আমরা স্বাধীনতার প্রলেপ ঢাকা একটি শিকল পরা বদ্ধ জীবনে বাস করছি। আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে নিজের মাটিকে অন্যের শৃঙ্খলামুক্ত করার জন্য নিজের রক্তে তেজের ফল্গুধারা বইয়ে দিতে হয়। আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে নিজের মুলুকের সম্মানরক্ষা করার জন্য একটি অত্যাড়ম্বরপূর্ণ জীবনকে তুড়ি মেরে উপেক্ষা করতে হয়। আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে নিজের থেকেও বহুল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখিও নির্ভয়ে দাঁড়াতে হয় শুধুমাত্র নিজের সততা, সুসাহস আর নিজের আদর্শের প্রতি নিজের সম্মানের উপর ভর করে। আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, যখন আমাদের ডাকে কেউ সাড়া দেয়না, তখন কীভাবে বারবার পিছন ফিরে তাকিয়ে নিজেকে দুর্বল আর শূন্য না মনে করে শুধু লক্ষে দৃষ্টি স্থির রেখে সঠিক পথে পা ফেলে ফেলে একাই এগিয়ে যেতে হয়। সর্বোপরি, আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে সকলকে একই আদর্শের তরঙ্গে প্রভাবিত করে প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউ তুলতে হয়! আজ আমরা কেউ আপনার মৃত্যুদিনটা জানিনা। এর কারণ হিসেবে আমি এতদিন কী ভাবতাম জানেন? বোকার মত ভাবতাম, যে এটা বুঝি একটা ইঙ্গিত, যে আপনি এখনও বেঁচে আছেন। রক্ত-মাংসের বেঁচে থাকা নয়, বেঁচে আছেন আমাদের সকলের শিরা-উপশিরার সেই সাহসী কনিকাগুলোর মধ্যে, যা সংখ্যায় খুব কম হওয়ায় আজ বড় কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ভাবতাম, যে আশে-পাশের সব দুষ্ট চোখরাঙ্গানিগুলোকে একটু সাহস করে যদি আমরা সবাই পালটা তর্জনী দেখাতে পারতাম, তাহলে আমাদের এই ভূমিটা হয়তো সত্যিই সেই স্বর্গভূমিতে পরিনত হতে পারতো, যে স্বর্গের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আপনি একদিন অন্তর্ধানে গিয়েছিলেন। ভাবতাম, হয়তো সত্যিই সেদিন আপনি আবার প্রকট হবেন, আর দু-হাত মেলে বলবেন- “তোমরা আমাকে যে রক্ত দিয়েছিলে, এই নাও, তার বিনিময়ে স্নেহ।“ কিন্তু না স্যার, আমার এই ভুল ভেঙে গেছে। আজ আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি আর একদম ফিরে আসবেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায়, এখানে-সেখানে মাঝে মাঝেই একটা লেখা চোখে পড়ে বটে – যে “আজ আমাদের মধ্যে আবার নেতাজীর ফিরে আসার দরকার।“ কিন্তু না, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, একদম আসার দরকার নেই আপনার। আপনাকে ‘নেতা’ হিসাবে পাবার যোগ্য নয় আমরা। আমরা লোভী, আরামপ্রিয়। শুধু নিজের, আর নিজের আপনজনদের আখেরটুকু গোছানো হয়ে গেলেই আমরা চোখ-কান বন্ধ করে ফেলি। আপনি ফিরে এলে কী মুখ দেখাবো আপনাকে আমরা? জানি, অন্তরাল থেকে আপনি আমাদের রোজ দেখেন। আর মনে মনে আফসোস করেন, যে এই ভারতবর্ষ দেখার জন্য একদিন মায়ের কোল ছেড়ে কাঁধে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন আপনি? ‘নেতা’ কথাটা আজ একটা ব্যাঙ্গের নাম, এই অরাজকতা দেখার জন্য ‘নেতাজী’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিলো আপনাকে? ভীষণ রাগ হয় স্যার আপনার, তাই না? আমি জানি, ভীষণ কষ্ট পান আপনি। শেষে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবো আপনাকে, পারলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন স্যার? ইতি, পিউ ভট্টাচার্য্য মুখার্জী (আপনার ভারত মায়ের এক ভীরু সন্তান) |