একটা দশ টাকার নোট এবং…
পার্থ রায়
এই গল্পের প্রধান চরিত্র দেবেশ। দেবেশ সরকার। কোন ভিআইপি, সেলিব্রিটি, হাই প্রোফাইলের কেউ নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহী মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত গণিত শিক্ষক। এলাকায় সুপরিচিত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয়। এবার দেবেশবাবুর অন্যদিক নিয়ে আলোকপাত করা যাক। তাহলেই তো আমার গল্প এগোবে। মানুষের নানা রকম নেশা থাকে। মদ্যপান, ধূমপান, বাগান করা, টিভি দেখা, বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, গান শোনা, ছবি তোলা ইত্যাদি। এগুলো সাবেকি হলেও আভিজাত্য হারায়নি। সেলফি তোলা, চুকলি কাটা, কাঠি দেওয়া, ঢপের চপ বিলি করা মানে বানিয়ে বানিয়ে গপ্পো করা, ফেসবুকের দেয়ালে টিকটিকির মতো ঘুরে বেড়ানো, সান্ত্রী মন্ত্রী নেতাদের সান্নিধ্যে থাকা; এসবও কিন্তু বেশ বড়সড় নেশা। আধুনিক এবং উপযোগীও বটে। নো বস! দেবেশের সেরকম কোন নেশা নেই। যে কটা নেশার কথা বললাম তার কোনটাই নেই। ওঁর নেশা বাজার করা আর গল্প, কবিতা লেখা। পরেরটা শখের। পেশা নয়। আগেই বলেছি অংকের শিক্ষক ছিলেন। বছর দুয়েক হল অবসর নিয়েছেন। ফেসবুকের দেয়ালে ঘুরে আসেন দিনে এক আধবার, বই খবরের কাগজ পড়েন, গান শোনেন, খেতে বসে একটু টিভিও দেখেন। সবই একটু একটু। পরিমাপ বজায় রেখে। বুফে সিস্টেমে প্লেটে খাবার তোলার মতো। ধূমপান করেন। সেটাও মেপেজুকে। সারা দিনে চারটে। কখনও এক আধটা বেশি। মদ্যপান করেন না। আর বাকি বিশেষ ক্যাটাগরির যেগুলো বললাম তার ধারে কাছে উনি নেই। নিখাদ মধ্যবিত্ত, নিরীহ জীবনে এই দুটোই শুধু নেশা। লেখালিখির নেশাটা জমাট বেঁধেছে বছর কয়েক আগে। ফেসবুকে যোগ দেবার পরে। দুই একটা নামী বাণিজ্যিক দৈনিকের রবিবাসরীয় এবং পত্রিকাতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। অবিশ্যি নিয়মিত নয়। তবে লিটিল ম্যাগাজিনের জগতে আর ফেসবুকের ওয়ালে দেবেশ সরকার এখন এক সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় নাম। এ তো গেল দেবেশের এক নেশার কথা। অদ্ভুত শোনালেও বেশ গুছিয়ে, দাম দস্তুর করে বাজার করা দেবেশের আর একটা নেশা। বাজার করাটা ওঁর কাছে রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। দরদাম করে সরেস টাটকা সবজি, খলবলে মাছ, খাসির গর্দান থেকে মাংস কিনতে পারলে ওঁর অন্তরে যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি। চিকেনটা রবির দোকান থেকেই কেনেন। কারণ রবির একটা সততা আছে। ছোট মুরগি না থাকলে ও সেটা সোজা সাপটা জানিয়ে দেয়। যেটা অন্যরা করে না। থিকথিকে চর্বি লাগানো গোদা পায়ের চিকেন? নৈব নৈব চ। চিকেন উইদ স্লিম ফিগার! ট্রু লাভের মতো ট্রু টেস্ট! যে জন্যে উনি কখনও কাটা মাংস আনেন না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মুরগিটাকে কাটিয়ে, সুন্দর করে ড্রেসিং করিয়ে তবে ঝোলায় পোরেন। রবি তাই সোজা ব্যাটে খেলে। জানে ভুল খেললে এই নিয়মিত খদ্দেরটি ফুড়ুৎ! অন্য ডালে গিয়ে বসবেন। যাক গে, ছাড়ুন এসব কথা। এই চিকেনের দোকান থেকেই আমার গল্পের সূত্রপাত। দেবেশের এই দুই নেশাকে ঘিরেই আমার গল্প দানা বেঁধেছে। একে একে অন্য চরিত্রগুলো এসেছে। *** এক রবিবার রবির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দেবেশ। দশ টাকা ফেরত পাবেন। দশ টাকার নোটগুলোর বেশির ভাগই তো এখন বিপিএল তালিকাভুক্ত। বড্ড দৈন্য দশা। ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ অ্যাকসেপ্ট করার মতো। যাচাই করে তবে নোটগুলোটকে “অ্যাকসেপ্ট” করতে হয়। আগেই বলেছি রবির ওপর দেবেশের আস্থা একটু বেশি। শুধু চিকেনের কোয়ালিটিই নয় অন্য ব্যাপারেও। রবি যখন ব্যালান্স ফেরত দিয়েছে, অতো দেখার কী আছে? দশ টাকার নোটটা ভাল করে না দেখেই পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন। কী যে খেয়াল হল! হয়তো অভ্যাসবশত। ৱ্যাপিড ফায়ার করার মতো চোখ বোলালেন। আরে এসব আবার কী? নোটটার ওপর ইংরেজিতে কিছু লেখা। নোটের সাদা অংশে যেখানে গাঁধিজীর মুখ আবছা আড়ালে থাকে, ঠিক সেইখানে। Shrija, I really miss you. Plz back in my life, Hasan Rubel। পিলে চমকে যায় দেবেশের। পেয়ার মোহব্বত মানে প্রেম ভালবাসার জন্য সাধারণ মানব থেকে অতিমানব কী না করেছে। কেউ তাজমহল বানিয়েছে। কেউ বাছুর সমেত রাজমিস্তিরির সাথে ভোঁ ভা হয়েছে। কেউ আবার এই সাবজেক্টে ফেল মার্কস পেয়ে থার্ড লাইনে ঝাঁপ দিয়েছে। দেবেশের কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথে পড়ার সময়। ক্লাসরুমের দেয়ালে, ক্যান্টিনে হেথাহোথা এমনকি হিসু করার জায়গায় পর্যন্ত লাভ লেটার থুরি লাভ মেসেজ লেখা থাকত। দেবেশদের সময় মর্নিং কলেজ মেয়েদের আর ডে কলেজ ছেলেদের ছিল। তখনা মুঠোফোন ছিল না। ডে কলেজের কোন প্রেমিকপ্রবর ফিজিক্স ল্যাবের দেয়ালে লিখেছে “প্রিয়তমা, তোমা বিনা জগৎ আমার শুনাশুনা”। পরের দিন মেয়েলি ছাঁদে রীতিমতো ছন্দ মিলিয়ে লেখা “ঘাটের মরা, কচু গাছে গলা দে না”। তারপর কোন একটা গল্পে পড়েছিলেন। গল্পের নামটা দেবেশের মনে আসছে না। জাহাজ ডুবি কেস। গল্পের নায়ক ভাসতে ভাসতে এক নির্জন দ্বীপে গিয়ে পৌঁছেছে। তার বোতলবন্দি বার্তা হেলে দুলে চলেছে সমুদ্রের বুকে। যদি অন্য কোন জাহাজ দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। সে যুগ তো আর নেই। হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রামের যুগে এমন ওল্ড মেথড? আহা যে লিখেছে কী কষ্টটাই না পাচ্ছে! অভিভূত দেবেশের মন আলোড়িত হয়। নোটটাকে যত্ন করে মানিব্যাগে রাখেন। এ তো এখন আর নিছক বিপিএল তালিকাভুক্ত একটা দশ টাকার নোট নয়। বিবর্ণ, করুণ কাগজের গায়ে লেখাগুলো যেন গ্লোসাইন বোর্ডের মতো জ্বলজ্বল করছে। বাড়ি ফিরে গিন্নি সুজাতার শ্যেন দৃষ্টির সামনে সাফ সুতরো হতে হয়। অতিমারিজনিত সাবধানতা! ব্রেকফাস্ট সেরে সুজাতার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে সেই দশ টাকার নোটটা বের করে বলল, “এই লেখাটা দ্যাখো দিকিনি। এই না হলে ভালবাসা, প্যায়ার মুহব্বত!”। “উফ! তোমাকে নিয়ে আর পারি না। চোদ্দ হাত ঘোরা নোটটা এখন না ধরলে হচ্ছিল না?” “ধুর বাবা! স্যানিটাইজ করে নেব খন। পড়েই দ্যাখো না” “ওরে বাবা! এ তো ইন্টার কাস্ট নয়, রীতিমত ইন্টার রিলিজিয়ন ব্যাপার!” দেবেশ চমকে ওঠেন। সত্যিই তো! এটা তো মাথায় আসেনি। এই না হলে মেয়েদের চোখ! শ্রীজা হিন্দু, হাসান রুবেল মুসলিম। ইন্টারেস্টিং! দেবেশের কেন জানি আচমকা আমজাদ শুভলক্ষ্মী, শাহরুখ গৌরির কথা মনে হল। সুজাতাকে সে কথা বলেও ফেললেন। “চাঁদে আর কিসে! ওঁরা সমাজের কোন স্তরের মানুষ? আর এই শ্রীজা, রুবেল হয়তো সাধারণ ঘরের। দুই পরিবার ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মেরে পাট পাট করে দেবে। দ্যাখো গিয়ে মেয়েটাকে ঘর বন্দি করে ফেলেছে।” সুজাতার কথা ফেলে দেবার মতো নয়। বিচলিত হন দেবেশ। “দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একে অন্যকে ভালোবেসে ঘর বাঁধতে পারবে না? শুধু মাত্র দুজনের ধর্ম ভিন্ন বলে?” “কী করে বুঝলে যে ওরা প্রাপ্তবয়স্ক? ব্রেকআপটা ধর্মের কারণে না হয়ে অন্য কোন কারণেও হতে পারে।” অকাট্য যুক্তি। সুজাতার একটা যুক্তিও অস্বীকার করা যায় না। অঙ্কের শিক্ষক দেবেশ অঙ্ক না পারা ছাত্রর মতো চুপসে যান। *** “হ্যাঁ গো তোমার কি কোন আক্কেল নেই? তুমি ওই টাকাটার ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়েছ? সব কিছু ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে?” পিয়ানোতে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে সবে খবরের কাগজটা খুলেছিলেন। যেন হারমোনিয়ামের রিড ভেঙে গিয়ে সুর বেসুরো! সাত সকালে গিন্নির বেজার মুড দেখে দেবেশ একটু ঘাবড়ে গেলেন। কী হল আবার কে জানে? “কেন কী হল? লেখাটা পড়েছ?” “মেয়ে ফোন করেছিল। রেগে আছে। একটা ঝামেলা না বাঁধালে তোমার চলছে না বুঝি?। ও পোস্টটা ডিলিট অথবা হাইড করে দিতে বলেছে।” দেবেশ ফুঁসে ওঠেন। “তোমাদের মা মেয়ের সবটাতে বাড়াবাড়ি। লেখাটা কি ও পড়েছে? কেউ তো খারাপ কিছু বলেনি। বরং সবাই খুব অ্যাপ্রেসিয়েট করেছে।” “ভাল করে দ্যাখো। অ্যাপ্রেসিয়েট করেছে না তোমার মুণ্ডুপাত করেছে। নিনি সেসব দেখেই তো ফোনটা করেছে। ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে আজকাল কতো বিতর্ক! পুলিশি ঝামেলা! তুমি কি কোন খবর রাখো না?”। সুজাতার গলায় বিরক্তি আর উৎকণ্ঠা। দেবেশ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই সুজাতার মোক্ষম জবাব, “প্রতীপকেও জানিয়েছে নিনি। এবার তুমি যা ভাল বুঝবে করবে।” “প্রতীপ কী বলল?” “ওরও খুব একটা সায় নেই।” এবার দেবেশ থমকে যান। প্রতীপ ওঁদের একমাত্র মেয়ে নিনির বর। ওর ওপর দেবেশের খুব আস্থা। প্রতীপ কিছু বললে দেবেশের কাছে তার আলাদা গুরুত্ব। কারণ ও খুব ঠান্ডা মাথার বুদ্ধিমান ছেলে। আর যাই হোক মা মেয়ের মতো একপেশে নয়। মেয়েরা নাকি বাপের ন্যাওটা হয়। নিনিকে দেখে দেবেশের সেটা মনে হয় না। সব সময় মায়ের দিকে ঝুঁকে রয়েছে । পোস্টটা গতকাল সকালে করেছিলেন। দুপুরের পরে আর ফেসবুকে যাওয়া হয়নি। পোস্ট করা মাত্রই গাছ-ঝারা শিউলি ফুলের মতো বেশ কিছু দারুণ, দারুণ লাইক কমেন্ট পড়েছে। তৃপ্ত দেবেশ প্রাত্যাহিক অন্য কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আসলে সেদিন নোটটার ওপর রুবেল নামে ছেলেটার আকুল আবেদন দেখে দেবেশ খুব অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। পোস্টটা যদি শ্রীজার নজরে পড়ে! যদি ওর কোনো বন্ধু বান্ধবের নজরে পড়ে! যদি শ্রীজার মন আর্দ্র হয়! এমন অনেক যদির সম্ভাবনায় পোস্টটাকে সচেতন ভাবে শুধু ফ্রেন্ডসদের জন্য আবদ্ধ না করে পাবলিক পোস্ট করেছিলেন। আবেগপ্রবণ দেবেশের কিছুটা অবাস্তব এবং ছেলেমানুষি ভাবনা! উত্তম সুচিত্রা এফেক্ট! সিনেমাতে যা হয় বাস্তবে সেটা হয়? এছাড়া আর একটা ব্যক্তিগত কারণও ছিল বৈকি। বাহবা পাওয়ার লোভ। একদিকে সরেস আবার অন্য দিকে সেন্টিমেন্টাল একটা ইস্যু। পাবলিক গপাগপ খাবে আর সাধু সাধু করবে। আকাশ ফেটে পুষ্পবৃষ্টির মতো লাইক কমেন্টের অকাল বরিষণে ভেসে যাবে দেবেশের পোস্ট। তেমনই তো দেখেছিলেন। “আহা! শ্রীজা রুবেলের কাছে ফিরে আসুক এই শুভ কামনা জানাই”, “দাদা, অসামান্য লিখেছেন!”, “আপনার লেখাটা পড়ে এক দুজে কে লিয়ে সিনেমাটার কথা মনে পড়ে গেল”, “সামান্য একটা দশ টাকার নোট নিয়ে এমন লেখা, দাদা আপনিই পারেন”, “দেবেশদা হ্যাটস অফ! শ্রীজা রুবেলের মিলন হোক।” এমন আরও কতো। দেবেশের চিত্ত ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা।’ আইসক্রিমের মতো নরম তুলতুলে। দেবেশ জানেন ধর্মীয় মৌলবাদীরা ভীষণ সক্রিয় এখন। কবি শ্রীজাতর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। যে মৌলবাদি ভাবনা এবং হিংস্রতা আগে কিছু সংখ্যক মানুষ এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে ব্যাপ্তি লাভ করছে। দেবেশ তাই লেখার সময় খুব সতর্ক ছিলেন। চিরন্তন প্রেমের জয়গানকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জারক রসে চুবিয়ে লিখেছিলেন। বেশ জমিয়ে। লিখে তৃপ্তি পেয়েছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে ‘একদা পুলকিত’ দেবেশ এখন রীতিমতো শঙ্কিত। কী হল আবার? কে জানে! ফেসবুকে গিয়ে দেবেশের চক্ষু চরক গাছ। সত্যিই তো। একজন লিখেছে, “আপনাদের মতো কিছু পা-চাটা সেকু, মাকুর জন্য এই দেশটা একদিন পাকিস্তান হয়ে যাবে”। দুই একজন আবার সেটাকে সমর্থন করে চামড়া চিড়বিড় করা কমেন্ট করেছে। উল্টোটাও আছে। মানে অন্য ধর্মাবলম্বী। সেরকম একজনের কমেন্টে রীতিমতো হুমকি। একজন হিন্দু মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য রুবেলের কাকুতি মিনতিতে নাকি তাদের ধর্মের অবমাননা হয়েছে। সুতরাং রুবেল বিধর্মী। আর বিধর্মীর শাস্তি মৃত্যু। যারা এমন কমেন্ট করেছে তারা কেউ ওর ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। দেবেশের বুক ঢিপঢিপ করছে। হায় ঈশ্বর! কী ভেবেছিলেন আর কী হল! যাঁরা ওর পোস্টে নিয়মিত লাইক কমেন্ট করে তারা চোখে ঠুলি পরেছে। ভাব খানা এমন যেন কিছু দেখেনি। অবশ্য ব্যাতিক্রমও আছে। অনেকেই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল যারা প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের বেশিরভাগই ‘প্রতিবাদিনী’ অর্থাৎ মহিলা। দেবেশের ফিমেল ফ্রেন্ডরাই ওনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা অনেক বেশি সোচ্চার। কয়েকজন ইনবক্সে এসে এদের ব্লক করতে বলেছেন। সেই তুলনায় মেল ফ্রেন্ডরা অনেক বেশি ভীত। ফ্রেন্ড! হাহ! যত সব সুবিধাবাদীর দল! ইনবক্সে এসে ভয় ধরানো, হাড় জ্বালানো মেসেজ দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। “দেবেশ বাবু, পোস্টটা তুলে নিন”, “রাত বিরেতে পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারে”, “মৌলবাদীরা হামলা করতে পারে” ইত্যাদি, প্রভৃতি। আর ঠিক এখানেই দেবেশের অন্তরাত্মা সায় দিচ্ছে না। কেন তুলে নেবেন পোস্টটা? কোন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াননি! কোন ধর্মীয় ভাবাবেগ বা সম্প্রদায়কে সমালোচনা করেননি! আঘাত তো দূর অস্ত। শুধুমাত্র কিছু দুষ্টু লোক উল্টোপাল্টা কমেন্ট করেছে বলে একটা পোস্ট তুলে নিতে হবে? মহা সমস্যা তো! ইনবক্সের মেসেজগুলোকে নাহয় উপেক্ষা করলেন। বাড়ির চাপ কী করে ঠেকানো যায়? মেয়ের ফোন আসার পর সুজাতার ভ্রু সেই থেকে তৃতীয় পাণ্ডবের ধনুক হয়ে আছে। পোস্ট তুলে নেওয়া তো কয়েক সেকেন্ডের কাজ। সেটা করা মানে অন্যায়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করা। এই পরাজয় তো শুধু দেবেশের পরাজয় নয়। এই হার প্রেমের হার। ভালবাসার অপমৃত্যু। শ্রীজা রুবেলের ভালবাসাকে খুন! মন সায় দিচ্ছে না। আবার এদিকে ভয়ও যে করছে না, তা তো নয়। মনটা এখন টাগ অফ ওয়ারের দড়ি। একবার বিবেক টানছে। হেঁইয়ো! আর একবার ওদিক থেকে সমঝোতাকারী ভীরু মধ্যবিত্ত অস্তিত্ব। মার টান জোরসে! সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পোস্টটার গায়ে হিংস্র আঁচড় কামড়ের ক্ষত চিহ্ন বাড়ছে। পরস্পর বিরোধী আক্রমণাত্মক মন্তব্যের মাধ্যমে দুদল জুজুধান সাপদ যেন অবদমিত রিরংসা, ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। এমনটা তো দেবেশ চাননি। তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। এ কেমন ডিজিটাল ইন্ডিয়া? এটা কোন বাংলা? অন্তরে কলুষিত আঁধার, বহিরঙ্গে রূপের বাহার! মুখে এক, কাজে আর এক। *** পোস্টটার বয়েস আজ চার দিন পূর্ণ হয়ে পাঁচে পড়ল। পোস্টের গায়ের উত্তাপ কিছুটা হলেও কমছে। কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছেন না দেবেশ। পাবেন কী করে? এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে। এপার্টমেন্টের কেয়ার টেকার যুধিষ্ঠির সিং। তার কাছে তিন চারটে ছেলে নাকি দেবেশের ফ্ল্যাট কোনটা খোঁজ করে গেছে। যুধিষ্ঠির পোড় খাওয়া লোক। এক সময় কটন মিলে ইউনিয়নের পান্ডা ছিল। মাথাটা ঠান্ডা। ছেলেগুলোকে দেখে ছাত্র বলে মনে হয়নি ওর কাছে। তাই অম্লান বদনে বলে দিয়েছে, “ইস ফিলাট ম্যে ইসি নামকা কোই নেহি রহতা হে।” “বহুত আচ্ছা কিয়া।” কারা হতে পারে? প্রাক্তন ছাত্ররা? প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা আসে। খোঁজ খবর করে। বেশির ভাগই ফ্ল্যাট চেনে না। সেটা হলে ভাবনার কিছু ছিল না। কিন্তু যুধিষ্টিরের কথা অনুযায়ী ছেলেগুলো হিন্দীতে কথা বলছিল। দেবেশরা যেখানে থাকেন সেখানে উভয় সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। বিচ্ছিন্ন ছোট খাটো ঘটনা ছাড়া সেই অর্থে কোন অশান্তি, ঝামেলা নেই। ওর পোস্টটা নিয়ে যদি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তাক্ত বিরোধ শুরু হয়? শান্তি ব্যাহত হয়? মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন উভয় সম্প্রদায়ের লোক তাঁর মুণ্ডু চাইছে। ফ্ল্যাটে হামলা, ভাঙচুর। অ্যাপার্টমেন্টের অন্যরা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রক্তাক্ত ভূলুণ্ঠিত দেবেশ অসহায়ের মতো দেখছেন সুজাতাকে একদল উন্মাদ টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। নাহ! আর ভাবতে পারছেন না দেবেশ। প্রতীপের সাথে একটু একান্ত শলা পরামর্শ করা দরকার। বউ, মেয়েকে এড়িয়ে সেটা করতে হবে। আগে পোস্টটাকে ফ্রেন্ডস ওনলি করে দেওয়া যাক। এটা তাপসীর বুদ্ধি। তাপসী দেবেশের ফেসবুকতুতো বোন। বলেছিল, “দাদা, পোস্টটাকে ফ্রেন্ডস ওনলি করে দিন। তাতে বেনো জল ঢোকা কমবে।” ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। প্রতীপ হয়তো খুব বিজি। আইটি সেক্টরের কাজ সম্পর্কে দেবেশের তেমন একটা ধারণা নেই। এই সময় ওকে ফোন করাটা কি ঠিক হবে? আবার কনফিউশন। বেস্ট টাইম হল লাঞ্চ আওয়ার। ইয়েস! দেবেশ খুশি হলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে করা যাবে না। সুজাতা ঠিক পাশে এসে দাঁড়াবে। হয়তো ফোনটা কেড়ে নিয়ে জামাইকে বলবে, “তোমার আংকেলকে পোস্টটা তুলে নিতে বলো তো। এসব ঝামেলা ভাল লাগে না।” সময় বদলেছে। মনের সায় না থাকলেও শুধু রীতি নীতির দায়ে শ্বশুর শাশুরিকে বাবা মা বলার রেওয়াজ পাল্টে গেছে। নিনি একটু চেষ্টা করেছিল প্রতীপকে দিয়ে বাবা মা বলানোর। কপট রাগে বলেছিল, “তুই যদি আমার বাবা মাকে বাবা মা না বলিস, তাহলে আমিও…।” টেরছা চোখের ঝিলিক এনে বরের দিকে তাকিয়েছিল। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল প্রতীপ। “তোকে কি আমি জোর করেছি?” নিনি অবশ্য সুন্দর একটা মধ্যম পন্থা নিয়েছে। শ্বশুরকে নুতন বাবা আর শাশুরি মাকে নুতন মা বলে ডাকে। প্রতীপ আংকেল আনটি। যে যা ডেকে খুশি থাকে থাকুক। আপনজনের মতো তুমি বলে। দেবেশ সুজাতা দুজনকেই। এটাই বা কম কী? দেবেশ সিগারেট আনার অছিলায় অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে এসে ফোনটা করল। কথা বলতে বোঝা গেল নিনির কাছে সবটাই শুনেছে। তবে পোস্টটা পড়েনি। দেবেশ সংক্ষেপে লেখার সারমর্ম জানালো ফোনে। “বিবেক, যুক্তি আর সততার দিক বিবেচনা করলে পোস্টটাতে দোষের কিছু নেই। অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে তুলে নেওয়াই ভাল।” “তোমার কী অপিনিয়ন? তুমি কী সাজেস্ট করছ?” “তোমার টেনশনটা ফিল করতে পারছি। একটা টানাপোড়েন চলছে।” “একদম ঠিক, প্রতীপ।” কিছু সময়ের নীরবতা শেষে প্রতীপ বলল, “এটাও সত্যি অকারণ সমঝোতা করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে আমাদের। একটা কাজ করো। তোমাদের লোক্যাল কাউন্সিলরের সাথে পরিচয় আছে?” “হ্যাঁ, থাকবে না কেন? ও তো আমার প্রাক্তন ছাত্র।” “দ্যাটস ভেরি গুড!” বেশ আশ্বস্ত শোনালো প্রতীপকে। “তুমি ওনাকে একটা ইনটিমেশন দিয়ে রাখো। নিজে যাবে। দরকার হলে পোস্টটা পড়াবে। উনি যদি তুলে নিতে বলেন তাহলে তুলে নেওয়াই বেটার। আর ওনার যদি সমর্থন থাকে পুলিশি ঝামেলা হলে উনি ঠিক সামলে নেবেন। পুলিশ এখন নেতাদের কথা বেশি শোনে। তাছাড়া আমার এক ক্লাসমেটের বাবা ভবানী ভবনে পুলিশের উঁচু পদে আছেন। সেরকম হলে ওনার হেল্পও পাওয়া যাবে।” এই সাজেশনটা দেবেশের বেশ মনঃপুত হল। *** কাউন্সিলর তাপস সমাদ্দার খুব সক্রিয়, চটপটে, মার্জিত ছেলে। তাছাড়া পেটে বিদ্যে বুদ্ধি ভাল বলে ওর দলে এবং এলাকায় ওর গুরুত্ব আলাদা। ওর আমলে এলাকায় বেশ উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে। কাটমানি-টানি খাবার কোন অভিযোগ শোনা যায় না। বরং বাজারে যেটা খুব শোনা যাচ্ছে সামনের বিধানসভা নির্বাচনে ওর প্রার্থী হবার এভরি পসিবিলিটি। দেবেশ আগে থেকে ফোন করে ওর সময় মতো গিয়েছিলেন। খুব সম্মান করে ওঁকে বসিয়ে মন দিয়ে পোস্টটা, কমেন্ট, পাল্টা কমেন্ট সব পড়ছে তাপস। দেবেশের বুকের ভিতর সাঁওতাল পরগণার ড্রাম দ্রিমি, দ্রিমি, দ্রিমি! যেন খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের রায়ের অপেক্ষায়। দেবেশ চারপাশে তাকালেন। তাপসের অফিসে আরও অনেকে বসে আছে। ঘরটা ছিমছাম। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজি, নজরুলের ছবির পাশে মুখ্যমন্ত্রীর হাসি মুখের একাধিক ছবি। সবার সামনে ছাত্রের কাছে না তিরস্কৃত হতে হয়! ঘরের ভিতরের নীরবতা দেবেশের অস্বস্তি বাড়ায়। যতই প্রাক্তন ছাত্র হোক, যতই সম্মান করে বসাক আফটার অল রাজনীতির লোক। রিস্ক নেবে বলে মনে হয় না। পোস্টের জীবন মৃত্যু নিয়ে দেবেশ অবশ্য খুব একটা আশাবাদী নন। তাপসের কাছে তো এসেছেন নিরাপত্তা পেতে। “ওটা থাক না স্যার। কী অসুবিধা আছে?” ঠিক শুনছেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না। দেবেশ আরও নিশ্চিন্ত হতে চান। “পোস্টটা থাকবে বলছ? দেখছ তো কিছু লোক কেমন ধারা কমেন্ট করছে। তোমার মাসিমা তো ভয়ে অস্থির। আমিও যে ভয় পাচ্ছি না তা নয়। তাই তো তোমার কাছে আসা।” “হ্যাঁ, স্যার। থাকুক পোস্টটা। ফ্রেন্ডস ওনলি করে ঠিক কাজ করেছেন। আর একটা কথা। আপনি কোন রিঅ্যাকশন করবেন না। ভাল মন্দ কোন কমেন্টের উত্তর দেবেন না। পারলে অন্য কিছু পোস্ট করতে থাকুন।” “কী আর বলবো? গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো কিছু ছেলে এসে আমার ফ্ল্যাটের খোঁজ করে গেছে। হিন্দীতে কথা বলছিল।” তাপসের মুখে কাঠিন্য দেবেশের নজর এড়ায় না। “বিশ্ব, তোকে দায়িত্ব দিলাম। পাত্তা লাগা কারা এবং কেন স্যারের খোঁজ করতে এসেছিলো? এটা সিরিয়াসলি নিবি।” “স্যার, এতটুকু চাপ নেবেন না। কোন অসুবিধা হলে আপনার এই ছাত্র আছে তো।” কৃতজ্ঞতায় দেবেশের চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। কে বলেছে রাজনীতি করলে সুকোমল বৃত্তি নষ্ট হয়ে যায়? ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে যাবেন তাপস এগিয়ে এসে বলল, “একটু দাঁড়ান স্যার। কত দিন পরে দেখা! একটু প্রণাম করতে দিন।” “স্যার, আপনি আমাদের অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়াতেন। আপনি যে এত সুন্দর লেখেন আজ জানলাম।” “আমার দুটো গল্প আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে বেরিয়েছিল। যতদিন চাকুরিতে ছিলাম সময় পেতাম না। তখন অবশ্য ফেসবুক ছিল কিনা জানি না।” “নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। সামান্যতম অসুবিধা হলে শুধু একটা ফোন করবেন। আপনার নাম্বার সেভ করে রেখেছি। বিশ্বর নাম্বারটাও সেভ করে নিন। আমি কোন কারণে রেসপন্স করতে দেরি করলে বিশ্বকে করবেন।” গত দুদিন ধরে একঘেয়ে মেঘলা আকাশ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির পরে একফালি রোদ উঁকি মেরেছে। শিশুর ফোকলা, সলাজ হাসির মতো। সুন্দর একটা বিকেল। দেবেশের মনের অবস্থা এখন ঠিক বিকেলটার মতন। ঝরঝরে, হালকা। আসলে প্রতিটি মনের ঘরে একটা বাগান থাকে। যে বাগানে ঋতুদের অবাধ আনাগোনা। তবে ছন্দোবদ্ধ শিফটিং ডিউটির কর্মীদের মতো ধরাবাঁধা রুটিন মেনে নয়। সে বাগানে কোন ঋতু কখন আসবে তার কোনো পূর্বাভাস থাকে না। যখন যেমন মনের স্টেটাস, তখন তেমন ম্যাচিং ঋতু ডানা মেলে উড়ে এসে বসে। মনের বাগানে। কদিন ধরে যে ভার বয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেটা এক ফুৎকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আরও বেশি ভাল লাগছে যে তাপস পুরো ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছে। উপরন্তু পোস্টটাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়নি। রাত্রে দেবেশ নিনি, প্রতীপকে সব বললেন। সুজাতা পাশে বসে। এই সময়টা হয় নিনি নাহলে সুজাতা ভিডিও কল করে। রোজকার ব্যাপার। শুধু ওই ছেলেগুলোর কথা বাদ দিলেন। সুজাতার টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। ভাগ্যিস যুধিষ্ঠির ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে বলে যায়নি। নিনি, প্রতীপকে আশ্বস্ত দেখালেও পাশের জনের হাবভাবে রকমফের কিছু চোখে পড়ল না। “নুতন কিছু পোস্ট করার অ্যাডভাইসটা খুব ভালো। বাবাই, তুমি পরপর কয়েকটা পোস্ট করে দাও। তাহলে নুতন পোস্টের নোটিফিকেশনে পুরোনো পোস্টটা চাপা পড়ে যাবে” *বেশ কয়েক মাস পরে* সুজাতার সান্ধ্যকালীন ঠাকুর দেওয়া শেষের দিকে। এখন শঙ্খ ফুঁ চলছে। সব ঘড়ির কাঁটা অনুসারে সেট করা। এর পরে চা মুড়ির পর্ব। ব্যাস! টিভিতে ইভিনিং শো শুরু। টানা দু-ঘণ্টা ভদ্রমহিলা অন্য এক জগতে বিরাজ করেন। বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝে ওয়াশ রুম, টুকরো কথা, একটু জোয়ান মুখে দেওয়া। দেবেশ চায়ের জল বসিয়ে গিন্নিকে ইমপ্রেস করবেন ভাবছিলেন। কলিং বেলের আওয়াজ। দুজন অল্প বয়েসি ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে। ছেলেটি ছিপছিপে লম্বা। দুগালে দুব্বো ঘাসের মতো কচি দাড়ি। চোখ দুটো মায়ালু। অনেকটা কবি, আর্টিস্টদের মতো লুক। দেবেশ দৃষ্টি ঘোরালেন। কেন জানি অসময়ে চলে যাওয়া অভিনেত্রী মহুয়া রায় চৌধুরীর মুখ মনে পড়ল। বোধ হয় খুব বেশি ফর্সা হলে মুখের মিষ্টত্বে ঘাটতি হতো। পরনে নীল বর্ডার দেওয়া রক্ত লাল কামিজ, ম্যাচিং নীল সালোয়ার। মেয়েটির মুখটা চেনা লাগছে। দেবেশ কি আগে দেখেছেন? মনে পড়ছে না। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে ভাবার সময় সুযোগ এই মুহূর্তে নেই। “স্যার, আপনার সাথে একটু কথা ছিল।” “কী কথা? আমি কিন্তু টিউশন করি না। ইন ফ্যাক্ট কোনোদিন করিনি।” “আঙ্কেল, অন্য বিষয়ে কথা বলতাম।” এবার মেয়েটি অস্ফুটে বলল। হরিণী চোখে। “ভিতরে এসো।” *** কিছু আগে আজান শেষ হয়েছে। কাছেই কালী মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সাথে ঢাকের অনবদ্য সঙ্গত। বিভাস সত্যিই দারুণ বাজায়। দেবেশ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দিনের তৃতীয় সিগারেট ধরালেন। দেখতে পাচ্ছেন ওরা দুজন তড়িৎ গতিতে হাতের ইশারায় বিদায় জানালো। তারপর দুজন দুদিকে হাঁটতে থাকে। কোন একদিন স্থায়ী ভাবে মিলিত হবার আকুল আশায়। ওরা হাসান রুবেল আর শ্রীজা ঘোষ। সময় ঢেউয়ের মতো। যা কিছু সামনে পায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে সব ঢেউ বানভাসি নয়। কিছু ঢেউ সাগরের ঢেউয়ের মতো। আবার ফেরত দিয়ে যায়। দেবেশ ভুলে গিয়েছিলেন সেই দশ টাকার নোট ঘিরে ওঁর ফেসবুক পোস্টের কথা এবং তৎপরবর্তী উদ্বেগ, টানাপোড়েন। কী অদ্ভুত! যে তাৎক্ষণিক আবেগ ও সুপ্ত ইচ্ছে থেকে এই পোস্ট করেছিলেন, তা যে এমন সত্যিকারের অবয়বে হাজির হবে কল্পনা করেননি। দুজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তরুণ তরুণীর পাগলপারা ভালোবাসার শরীর থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অথচ দুজনেই ভালো শিক্ষিত পরিবারের। দুজনেই কলেজ জীবনের শেষ প্রান্তে। শ্রীজা দেবেশের পাশের পাড়ার মেয়ে। ওর দাদা দেবেশের প্রাক্তন ছাত্র। তাই বোধ হয় শ্রীজার মুখ চেনা চেনা লাগছিল। কোন ভাবে ওই পোস্ট দেখে ওরা জানতে পেরেছে কেউ একজন অন্তত এই পৃথিবীতে আছেন যিনি ওদের সম্পর্ককে সমর্থন করেন। খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো তাই দেবেশের খোঁজ করে আকুল প্রার্থনা নিয়ে ছুটে এসেছে ওরা। অংকের শিক্ষককে এক কঠিনতম হোমটাস্ক দিয়ে গেছে। দুই পরিবারকে রাজি করিয়ে সমাজের দৃষ্টি প্রসারিত করা। শিক্ষকতার জীবনে গণিতের অনেক জটিল অংকের হেলায় সমাধান করেছেন। কিন্তু এই সিঁড়ি ভাঙা অংকের সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ভাঙা কাচের টুকরো ছড়ানো। সব বাধা সুনিপুণ ভাবে সরাতে হবে। তা নাহলে পরাজিতের মতো নতজানু হতে হবে নিজের বিবেকের কাছে। আশাতীত ভাবে তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গী এই ইস্যুতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। সুজাতার দেওয়া শর্ত মেনে নিয়েছে দুজনেই। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আগে পড়াশুনা শেষ করবে। সাবলম্বী হবে। দেবেশ জানে ওরা ফিরে আসবে চিরন্তন ভালোবাসার দাবি নিয়ে। ততদিনে সব হোমটাস্ক নির্ভুল ভাবে সেরে রাখতে হবে দেবেশকে। চকিতে আবার একবার মস্তিষ্কের আয়নায় তাপসের মুখ ভেসে ওঠে। ওকে সাথে নিয়ে এগুলে কাজটা সহজ হয়। এবারেও কি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে? এবার যদি সাড়া না দেয়? তবে… রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়ে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে দেবেশের। |