পাঞ্চালী ঘোষ
অধ্যাপক শুভব্রত মিত্র অর্থনীতি বিভাগ লন্ডন মেট ইউনিভার্সিটি হলোওয়ে রোড লন্ডন, এন ৭৮ ডিবি চৈত্র পূর্ণিমা চিরসখা শুভ, অনেক দিন পরে হঠাৎ একটা একান্ত সময় পেয়ে গেলাম । গতকাল বোলপুরে এসেছি….আরো নির্দিষ্ট করে বললে শান্তিনিকেতনে এসেছি। শান্তিনিকেতন… “আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন শান্তিনিকেতন” নিজের ওপর ভরসা রেখে সাহস করে এখানে একাই এসেছি। অবশ্য সমস্ত ব্যবস্থাপনা আমার ছেলে ব্রতীই করে দিয়েছে। আমাকে এ নিয়ে ভাবতে হয় নি। আসলে নস্টালজিয়া আমাকে আজকাল পেয়ে বসেছে।মধ্য ষাটে পৌঁছে এই পেয়ে বসাটা প্রায় বাড়াবাড়িতে পৌঁছেছে। শরীরের আর মনের বয়স বোধকরি হাত ধরাধরি করে চলে না। শরীর শিথিল হয়ে পরনির্ভর হয়ে পড়লেও মনের বিচলন এখনো স্বাধীন। আমাদের যে সখ্যতা অর্ধ শতাব্দীরও আগে শুরু হয়েছিল বুঝি তাতে পরতে পরতে পলি জমে গেছে! হয়তো সেই দিনগুলোর কথা আজ আর সেভাবে তোমার মনে আসে না..তবুও নতুন করে মিতালি পাতাতে আমি আজ চিঠি লিখছি। কেমন আছো তুমি? “পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে তোমার পরশ আসে কখন কে জানে” আচ্ছা শুভ, এক ক্লাসে পড়তাম, দেখা তো আমাদের হতো! কিন্তু প্রথম কখন তুমি আমার মন ছুঁয়ে নিলে মনে আছে তোমার? ক্লাসে… ডাইনিং হলে…লাইব্রেরীতে? না কি শালবীথির আড্ডায়? উঁহু, এর একটাতেও নয়। হাসপাতালে! শিক্ষাভবনের কয়েকজন ছাত্রী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলো। হাসপাতালে দিতে হয়েছিল তাদের। আমাদের পালা করে ওদের সেবা করতে হাসপাতালে যেতে হতো। কে যাবে, কখন যাবে এটার পরিকল্পনার দায়িত্ব তুমি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলে। সেবায় নিয়োজিত সকলের প্রতি তোমার সজাগ দৃষ্টি ছিল। তারা সময়মতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা অথবা তাদের কোথাও কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা! সবকিছুতে তোমার নজর ছিল প্রশংসা করার মতো । একদিন তোমার সাথেই আমার সেবার পালা পরেছিল। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার সঙ্গে তোমার মমতা মাখা মনেরও পরিচয় সেদিনই পেয়েছিলাম! তোমাকে ভালো লেগেছিল আগেই এবারে ভীষণ ভালো লেগে গেল। বন্ধুদের মাঝে ‘তুই’ হলেও আড়ালে তোমাকে আমার অনুরাগের ‘তুমি’ করে নিলাম। বন্ধুদের কাছে অবশ্য এই লুকোচুরি ধরা পড়ে গিয়েছিল। আমি তখন ওদের বলে দিয়েছিলাম…”হ্যাঁ, আমি শুভ অনুরাগিনী”। তুমি হেসেছিলে আর কাব্য করে বাকি বন্ধুদের বলেছিলে …”তোমরা এতো নিষ্ঠুর হয়ো না..ঐ ডাক’টি (গাছটি পাল্টে) থাক্ আমার একটি মাত্র গোপন কথার মতো”। তোমার ঠাট্টায় ওরা হো হো করে হেসেছিল। আর আমার তখন তোমার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। কি মজার সব দিন ছিল! এখন ভাবলে আপনিই ঠোঁটে হাসি ফোটে। তার সাথে এখন গর্ব হয়, আমার সেই প্রিয় শুভ, সবার কাছে অধ্যাপক শুভব্রত মিত্র আজ একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। অর্থনীতি নিয়ে তার কাজ দেশ বিদেশে সমাদৃত । গত প্রায় দুই বছর আমার নানা কারনে মন ভালো নেই (কেন? সেটা না হয় তোলা থাক!)। বলতে পার মন ভালো করতেই ফিরে এসেছি এই আনন্দ নিকেতনে। তোমাকে লিখতে লিখতে মন খারাপ লাগাটা কিভাবে যেন কেটে যাচ্ছে। হতে পারে এটা সাময়িক তবুও তো কাটছে। ওপর থেকে দেখলে এ শান্তিনিকেতনের সাথে আমাদের যৌবনের মনের আনন্দের শান্তিনিকেতনের তেমন কোনো মিল নেই, না চেহারায় না চরিত্রে! কিন্তু আমি যে ওপর থেকে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! যা দেখছি সবই মনের ভেতর থেকে আর আমি ভাসছি স্মৃতিবিলাসের মায়াবী ঘোরে। সেই ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে এদিনের প্রবীণা আমি মুহূর্তে ফিরে গেছি সেদিনের যুবতী আমিতে…. যাক! এবার আমার ওই নস্টালজিয়া বা স্মৃতি বিলাসের কথায় আসা যাক… স্মৃতি সততই সুখের আর তাকে তাজা করতেই কাগজ কলম নিয়ে বসে গেছি তোমাকে চিঠি লিখতে। খামে ভরে চিঠি পাঠাবো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঝপঝপ করে ওই ই-মেইল লেখা আমার আসে না। আর ইংরেজি শব্দ দিয়ে বাংলা লেখা…নৈবচ! রবিঠাকুরের অঙ্গনে অত গুলো দিন কাটিয়ে বাংলাকেই আমার যাপনের ভাষা করে নিয়েছিলাম, সেটার বিচ্যুতি ঘটার কোনো কারন আমার আজও ঘটে নি। তোমাকে লিখবো বলেই আমার এতো আয়োজন। চিঠি লিখে খামে ভরে আঠা দিয়ে খামের মুখ বন্ধ করবো। তারপর খামের ওপরে তোমার ঠিকানা লিখে নিজে যাব ডাকঘরে, চিঠি কাল সকালের ডাকে দিতে। জানো, পিয়ারসন হাসপাতালের সামনের সেই ডাকঘর এখনো আছে, কেবল সেই দাড়িওয়ালা পোস্ট মাস্টার বদলে গিয়ে, হয়েছেন এক টাকমাথা মোটাসোটা ভদ্রলোক । চিঠি পাঠাতে ঠিকানা চাই! তোমার বাড়ির ঠিকানা জানা নেই। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটির ঠিকানাটা জোগাড় করেছি ওয়েবসাইট থেকে। অনুমান করছি সেখানে চিঠি একবার পৌঁছে গেলে তোমার হাতেও পৌঁছে যাবে। এমনিতে বড় ভুলো মন এখন আমার। কিন্তু এখন যখন তোমাকে লিখছি অতগুলো যুগ পেরিয়ে এসেও, স্মৃতির দ্বারে টোকা মেরে দেখছি সব মনে পড়ে যাচ্ছে … মনে ফুটছে আমাদের ইকনোমিক্স ক্লাসের ছবি। আশ্রমের আনাচে কানাচে আমাদের আড্ডা গান ভালোবাসা! বন্ধুগনের সিগারেটে টান মেরে বান্ধবীদিগের লুকিয়ে সাহসী হওয়া । রিনরিন করে বাজছে ক্লাস নোটের খাতার মধ্যে পাঠানো আমাদের হাতে লেখা সেই চিরকুটগুলোর কথা… হলুদ বসন্তবৌরীর ডাকে উদাস তুমি, একদিন লিখেছিলি “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান” বাইরে সেদিন বর্ষা মেঘের আনাগোনা, আর শ্রী সদনে সেদিন আমাদের চর্চায় কেবল তুমি। সেদিন খুব হেসেছিলাম আমরা…..মানে আমি, বিথি, শ্রাবণী, সুজাতা। …আর আমি খুঁজে বার করতে মরিয়া হয়েছিলাম, কার উদ্দেশ্যে তোমার মনে শ্রাবণের গান। আজ তোমাকে জানাতে আর কোন দ্বিধা নেই , সেদিন আমার মনে গুনগুন করে বেজেছিল একটাই গান… “পূব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি। হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী” তোমার মনে আছে? সেই ঘটনাটা! ঘটনাই ছিল সেটা সেদিন আমার কাছে ….অফিস ঘরের পাশে লাইব্রেরীতে ছিলাম। আমি পরেছিলাম একটা সাদা খোলের হলদে নীল ডুরে শাড়ি। মাথার বেনীতে গুঁজেছিলাম রক্তকরবী। তখন থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথে ডুবতে থাকার শুরু, যা আজও আবহমান। বইয়ের তাকে খুঁজছিলাম প্রমথনাথ বিশীর লেখা “রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন” বইটি। হঠাৎ পিছন থেকে এসে তুমি আস্তে করে আমায় ডাকলে। আমি ফিরে তাকাতেই আমার হাতে দিলে একটা বই। পাতা ওল্টাতেই টুপ করে একটা চিরকুট নীচে পড়লো। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তোমার হাতের লেখায় রক্তকরবীর দুটো লাইন… “মালতী ছিল, মল্লিকা ছিল, ছিল চামেলি, সব বাদ দিয়ে এ ফুল কেন বেছে নিলে। জান, মানুষ না জেনে অমনি করে নিজের ভাগ্য বেছে নেয়?” আমি চিরকুটটা পড়ে চোখ তুলে চারিদিকে তাকিয়ে তোমাকে খুঁজলাম। তুমি নেই! ছুট্টে লাইব্রেরীর বাইরে এলাম। নাহ! কোথাও সেদিন তোমাকে পাইনি। সেদিন রক্তকরবীর নন্দিনী হতে চেয়ে যা তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, আজ বলছি…. ”জানি নে, আমার কেমন মনে হয়, আমার রঞ্জনের ভালোবাসার রঙ রাঙা, সেই রঙ গলায় পরেছি বুকে পরেছি হাতে পরেছি” তারপর কি যে হলো! ক’দিন ধরে তুৃমি বে-পাত্তা। শিক্ষা ভবনে নেই বিদ্যা ভবনে নেই হস্টেলে নেই খোয়াইয়ের ধারে নেই গৌড় প্রাঙ্গণে নেই। নেই নেই কোথাও নেই। আমার মন খারাপ। অবশেষে মন খারাপটা উধাও হলো! হঠাৎ করে ধুমকেতুর মত তুমি আবার উদয় হ’লে …. আর আমার মন গাইল, “তুমি হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন– তাই হঠাৎ-পাওয়ায় চমকে ওঠে মন ॥ গোপন পথে আপন-মনে বাহির হও যে কোন্ লগনে, হঠাৎ-গন্ধে মাতাও সমীরণ” চীনা ভবনের কাছে দেখতে পেলাম, ওদিকের বেণুকুঞ্জ পেরিয়ে আসছ তুমি। উসকোখুসকো চুল খোঁচাখোঁচা গালে দাড়ি কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ঝোলা মুখে শিশুর সারল্য মাখা হাসি। আমি মনে একরাশ অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি তোমাকে। উদ্দেশ্য, এড়িয়ে যাওয়া। কাছে এসে আমাকে ডাকলে, “হোম”! ব্যাস! আমার সব সংযম ভেঙে চুরমার হলো আমি উদভ্রান্তের মত তোমার হাত দুটো ধরে বললাম, “কোথায় চলে গিয়েছিলে আমাকে না বলে”? তুমি উদাত্ত স্বরে আমাকে শোনালে, “জানি তোমার অজানা নাহি গো কী আছে আমার মনে। আমি গোপন করিতে চাহি গো, ধরা পড়ে দু নয়নে” হৈমন্তীকে ‘হোম’ তুমি’ই করেছিলে। বন্ধুরা সবাই পরে সে নামেই ডাকত আমায়। আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, “হৈম না হয়ে হোম কেন”? তুমি বলেছিল, “নরম শিশির মাখা হেমন্ত নয়, হোমাগ্নির আগুন হতে হবে তোকে”! সেদিন আমার গায়ে জেগেছিল পদ্মকাঁটার শিহরণ, চোখে জল এসেছিল। নাহ! আগুন হওয়া হয়নি আমার। একদিন মনে আগুন লাগিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি, সে আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে জ্বলতে একদিন নিভে গেল। এখন দেখি, কেবলমাত্র সেই আগুনের পোড়া ছাই টুকুই অবশিষ্ট পড়ে আছে। তবুও রবিঠাকুরের কথাই বলতে ইচ্ছে করছে… “প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্প ক্ষণ। প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন” আমি তখন প্রেমের জোয়ারে ভেসেছিলাম। জানতে চাই নি সে জোয়ারের ঢেউ তোমার মনকে কতটা উথাল পাথাল করেছিল ! একালের ছেলেমেয়েদের মত, মনের কথা বলতে চেয়ে, আমি সেদিন বাঁধনহার হতে পারিনি। হয়তো অলক্ষ্যে আমার মন, সংযমের একটা গণ্ডী কেটে রেখেছিল। আবার এটাও হতে পারে একসাথে পড়া একসাথে গান একসাথে খেলতে খেলতে বন্ধুত্বের মধ্যেই আমি আনন্দ খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম তাই নারী পুরুষের সম্পর্কের সেই চিরন্তন রহস্য ঘুচিয়ে দিয়েছিলাম!…. আনন্দে মাতোয়ারা আমরা তখন সবাই! বুঝতে পারি নি, কখন দুঃসময় ঘনিয়ে এলো। নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলা ঘিরে। গুরুদেবের শান্তিনিকেতনের চারিদিকে বিপ্লবীরা ঘাঁটি গেড়েছে। সেই উৎপাতের মধ্যেই খবর পেলাম সমাজ বদলের রোমান্টিসিজমে উদ্বুদ্ধ নব্যবিপ্লবীদের দলে তুমিও নাম লিখিয়েছ। আমি পাগলের মতো ছুটে গেলাম তোমাকে বাঁধা দিতে কিন্তু তুমি তখন বিপ্লবের নেশায় বুঁদ। এরমধ্যে ক্যাম্পাসের মধ্যে এক কর্মীকে খুন করার চেষ্টা হলো। আশ্রম বন্ধ করে দেওয়া হলো। সবাই ফিরে গেলাম যে যার ঘরে… তুমি গেলে কলকাতা আমি কীর্ণাহার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, ফিরে এলাম আবার আশ্রমিক জীবনে, এবারের লক্ষ্য স্নাতকোত্তর ….বন্ধুদের অনেকেই ফিরল, তুমি ফিরলে না। জানিয়েছিলে, তুমি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যাচ্ছ। শুনে, কিছুই বলতে পারিনি কেবল মনখারাপ ঘিরে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। আজ জানতে ইচ্ছে করে সেই মধ্যবিত্ত বিপ্লবীয়ানায় এখনো কি তুমি বিশ্বাস কর? জানো, সে বার তোমাকে ছাড়া পৌষ উৎসব আমার ভীষণ ফাঁকা লেগেছিল। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও বুকের মধ্যে সেই ফাঁকা অনুভূতিটা অবিকল টের পাচ্ছি। সেকথা আজ তোমাকে জানাতে আর কোনো কুন্ঠা নেই, জড়তা নেই! এক নির্মোহ অবস্থান থেকেই বর্ণনা করছি সেদিনের কথা… ছাতিমতলায় উপাসনায় আমরা জড়ো হয়েছি প্রার্থনাসঙ্গীত গাইছে সবাই! আমার কানে ভাসছে তোমার গান। সঙ্গীতের মূর্ছনা আমায় আকুল করছে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি গৌর অশোক বরেনের পাশে তোমাকেও। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বলো না! এখনও কি খোলা গলায় গান গাও আবৃত্তি করো? রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে ডুবে থাকো তুমি? আজ সারাদিন আমি ঘুরে বেরিয়েছি আশ্রমের আনাচেকানাচে, ছুঁতে চেয়েছি আমার দু…উরে চলে যাওয়া মেয়েবেলাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেছে তৈরী হয়েছে একের পর এক দৃশ্যকল্প, যা মননে আজও টাটকা …পাঠভবনের হলুদ ফুলের মতো ছেলেমেয়েরা সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে। ভূবনডাঙ্গার ওদিক থেকে ছুটে আসছে বন্ধুদের কেউ হাতে বকুল ফুল নিয়ে প্রিয় বান্ধবীর খোঁপায় পরাতে। মহুয়া গাছের তলায় বসে পড়ুয়ারা পড়ছে, বেদীর ওপরে বসে ক্লাস নিচ্ছেন মাষ্টারমশাই। সঙ্গীত ভবন থেকে ভেসে আসছে সমবেত কন্ঠের গান…”আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে”। কলাভবনে শিক্ষক ছাত্রদের রামকিঙ্করের তৈরি মূর্তি ‘সাঁওতাল মেয়ে’র শৈল্পিক দিকগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অশোক পলাশ শিমূল অমলতাস বসন্তের আকাশে বাতাসে রঙ ছড়াচ্ছে। সেই পাঠভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যাভবন, চীনা ভবন, কলা ভবন, সংগীত ভবন, গ্রন্থাগার সব আছে আমাদের সময় যেমন ছিল। হয়তো থেকে যাবে আরো বহু বছর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কিন্তু বিশ্বভারতীর শরীরে এখন নানা রোগের সংক্রমণ; নগর উন্নয়নের উগ্র ছাপ। জটিল সংকীর্ণতার ছোঁয়া লেগেছে আশ্রমের গায়ে। উন্মুক্ত বিশ্বভারতীর সীমা বেঁধে দিতে পাঁচিল উঠেছে, আমার কেমন অচেনা ঠেকছে । “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ” পাল্টে পাকা রাস্তা হয়েছে। অটো টোটোর দাপটে রাস্তায় চলা দায়। বড় বড় ঝাঁ চকচকে বাড়ি উঠেছে চারিদিকে। বাস্তবটা মেলাতে পারছি না আমার সেই প্রাণের আরামটুকুর সঙ্গে। মন কেমন করছে। কি ভাবছ? হঠাৎ করে ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসেছে? আসলে মনের গভীরে সব মানুষেরই হয়তো ছেলেমানুষটা থেকে যায়, একেবারে মুছে যায় না। কেউ মনের জানালা বন্ধ করে রাখে কেউ জানলা খুলে দেয়। আমি খুলে দিলাম। গুরুদেবের লেখার উদ্ধৃতি দিয়েই বলি… “আমার ভিতর মহলের ব্যথা আজ গেরুয়াবসন পরেছে। পথে বাহির হতে চায়, সকল কাজের বাহিরের পথে,—যে-পথ একটিমাত্র সরল তারের একতারার মত, কোন মনের মানুষের চলায় চলায় বাজছে” শুভব্রত, আমি তোমার কাছ থেকে আজ আর কিছুই চাইনা….উহু, একেবারেই কিছু চাই না বললে অসত্য হবে। আমাদের সম্পর্ক যেন সেদিনের সেই চিরকুটের লেখাগুলোর মতোই প্রীতির রসে সম্পৃক্ত থাকে, আজ এটুকুই আমার চাওয়া। ভালো থেকো। ইতি, – তোমার হোম রতন পল্লী, শান্তিনিকেতন বীরভূম ফিরে – আমার কলকাতার বাসস্থানের ঠিকানাটা লিখে দিলাম। আশা করবো, এতটা ভুলোমন হয়ে যাওনি যে নিরুত্তর থাকবে। শ্রীমতী হৈমন্তী রায় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সরণি, রানীকুঠি কলকাতা ৭০০০৪০ |