পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়
(একটি স্বতন্ত্র গদ্য)
“পাথরের ফুল”—ধ্রুপদি অথচ স্বতন্ত্র এক নির্মাণ একটা এলিজি বা শোক-গাথা বা শোক-কবিতা কেন লেখা হয়? অবদমিত শোকের ক্যাথারসিস? শিল্পশীলিত পথে অবরুদ্ধ বিষাদের শান্তায়ন? মৃত্যুর অনিবার্যতাকে মেনে নিয়ে এবং দুঃখবোধের সংপৃক্তিকে স্পর্শ করে অবশেষে প্রাণের উজ্জীবন? নাকি ব্যক্তিগত শোককে আশ্রয় করে বৃহত্তর এক সর্বজনীন দুঃখের আবহকে ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টা করা? হয়তো এককথায় উত্তর হওয়া উচিত এলিজির উদ্দিষ্ট একসাথে সবগুলোই। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আঙ্গিক? নাকি নির্যাস? প্রসঙ্গ? না কি আধার? উত্তরটা নিঃসন্দেহে হওয়া উচিত প্রসঙ্গ বা আধেয়। তাই এলিজির ক্ষেত্রে গ্রিক বা রোমান সাহিত্য হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে রূপবন্ধ আর আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা কম হয়নি! আঙ্গিকের বিবর্তন ছুঁয়েছে বাংলাভাষায় লেখা শোক-কবিতাকেও। কেমন হওয়া উচিত এ-কালের শোক-কবিতার আঙ্গিক? গ্রীক বা,রোমান সাহিত্যের অনুসরণে উদ্ভুত যে ধ্রপদি ঘরানার ইংরেজি এলিজি, নির্যাসে বা রূপবন্ধে, বাংলা সাহিত্যের শোকগাথায় তার অনুসৃতি কম নেই। বিচ্যুতিও আছে বই-কী! যেকোন শিল্পসৃষ্টিকেই দেশকাল ও শিল্পচর্চার অবকাঠামোর মধ্যে থেকে উঠে এসে প্রতিবেশের উপাদানকে সৃষ্টির মধ্যে সমন্বিত করতে হয়। অথচ পারিপার্শ্বের সত্য বহুমাত্রিক ও বহুকৌণিক হয়ে থাকে। এই মাত্রা ও কোণগুলো পরিবর্তনশীল রাশি। পারিপার্শ্ব এদের অপেক্ষক( function) । তাই কী নির্যাসে, কী আঙ্গিক নির্মাণে, কৌণিক বিন্যাসের পরিবর্তন হয়। পারিপার্শ্বের দ্বন্দ্ব এবং কবির পক্ষে বহুস্বরের সঙ্গতি সাধনের চেষ্টার মধ্যে সময়ের ছাপ এসে যায়। সেটা বাঞ্ছিতও! সেগুলো নৈর্ব্যক্তিক উপাদান! আবার কবির নিজস্ব নিবিষ্ট উচ্চারণের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক উপাদানগুলোর যে দ্বিবাচনিক সংলাপ, প্রকৃতিতে তা মন্ময়। আর বলাইবাহুল্য, এই দুইয়ের সমন্বয়ই নির্মাণ করে দেয় সৃষ্টির ভাষা ও বিষয়। তাই রূপবন্ধের সঙ্গে পাল্টে যায় সৃষ্টির নির্যাসও। এটা সব কবিতা সম্পর্কেই সত্য। বাংলা ভাষার এলিজিও এর ব্যতিক্রম নয়। ইংরেজি সাহিত্যে যাকে বলে “Critical Elegy” “পাথরের ফুল” কি তাই? কতটুকু লগ্ন থাকতে পেরেছে সে-নির্মিতির ব্যাকরণ? কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ” পাথরের ফুল”কে আপাতদৃষ্টিতে শোক-কবিতাই বলা যায়। কবিতাটা “যত দূরেই যাই” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। উপলক্ষ্য ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যু। চরম দারিদ্র্য, অসুস্থতা আর প্রকাশনা জগত ও সরকারের চরম উদাসীনতা এবং অবহেলা তাঁর মৃত্যুকে তরান্বিত করেছিল। আমাদের সংবেদনশীলতায় যে বিদ্ধতা আরও প্রকট ও যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে, তা হলো শবযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিক মহাজনদের লোকদেখানো ব্যস্ততা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে এক ধরনের আত্মপ্রচার! অন্তঃসারশূন্য ও প্রদর্শনকামী এই উদ্যোগ মরমি কবি সুভাষের মানবিকবোধকে পীড়িত, আক্রান্ত ও যন্ত্রণামুখর করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে তাঁর কলমে উঠে এসেছিল ” পাথরের ফুল”। কবিতাটা শুরু হচ্ছে একটা শবযাত্রাকে কেন্দ্র করে। যেমনটা হয় আর কী! রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা! অপেক্ষায় সব মালা আর পুষ্পস্তবক! বেঁচে থাকতে পেয়েছিলেন অবহেলা আর উদাসীনতা! আর এখন শব উপছে পড়ছে ফুল আর পুস্পস্তবকে! এই অবস্থায় নিগূঢ় এক অভিমান উঠে এল কবিতায়—- “ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে।’ কেননা মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর” অন্তঃস্পন্দে যেন শোক-কবিতার লিরিক্যাল বাধ্যতা ছুঁয়ে আঙ্গিকের অনিবার্যতা! অথচ তাকে অনায়াসে অতিক্রম করে আমাদের ভেতর-ঘরে যন্ত্রণাকে বাজিয়ে তোলে চিত্রকল্পের গূঢ় তাৎপর্য। কী অন্তর্গূঢ় রক্তক্ষয়ী এক শ্লেষ! কাব্যালঙ্কারে ‘ফুল’ যেন synecdoche! “পাথরটা সরিয়ে নাও, আমার লাগছে। এখন আর আমি সেই দশাসই জোয়ান নই। রোদ না,জল না, হাওয়া না— এ শরীরে আর কিছুই সয় না।” নির্মিতির কুশলতা আছে। শব্দ-সমবায়ের আবশ্যিক ঘোরও আছে! কিন্তু সেসবকে অতিক্রম করে যেন উঠে আসে অনুচ্চ অভিমানী কন্ঠের যন্ত্রণাক্লিষ্ট এক মানবিক অভিজ্ঞান! ‘রোদ-জল-হাওয়া’র প্রতিকূল লালনে গড়ে উঠেছিল ‘দশাসই জোয়ান’-এর যে প্রতিস্পর্ধা, তাতে যেন আজ ‘কিছুই সয় না’! অথচ না-সওয়া শরীরের এ-উচ্চারণও কি উদাসীনতা আর তাচ্ছিল্যের বিপ্রতীপে আর এক প্রতিস্পর্ধা নয়? নতুবা, কেন তবে অভিমান এমনভাবে গাঢ় হয়ে আসে? আবার, অভিজ্ঞতাকে যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞান করে তুলতে চেয়েছে যেন এক অসহায় শ্লেষ! ছেঁড়া জামা পরে, শুকনো চোখে পুঁটলি পাকিয়ে বসে থাকা পিতৃহারা ছেলের জন্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসহায় পিতৃহৃদয়ের উদ্বেগ আর উপদেশও কখন যেন গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে সমাজ-সত্যের নিষ্ঠুর এক চিহ্নায়ন! ব্যক্তি ও সমাজসত্তার সংঘর্ষ নয়, শোক-কবিতার বিস্তৃত পটভূমি এবং ব্যক্তি ও সমাজের দ্বিবাচনিকতার উন্মুক্ত পরিসরে ব্যক্তিগত শোকই কখন যেন বৃহত্তর এক আবেদনে সমাজ ও সময়ের অভিজ্ঞান হয়ে এক সর্বজনীন ও করুণ আর্তি তুলে আনে! “এক কোণে ছেঁড়া জামা পরে – – – – – – পুঁটলি পাকিয়ে ব’সে। বোকা ছেলে আমার, ছি ছি, এই তুই বীরপুরুষ? শীতের তো সবে শুরু— এখনই কি কাঁপলে আমাদের চলে?” আবার অন্য এক স্তবকে দেখি— “ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই ফুলের উপর কোনদিনই আমার টান নেই তার চেয়ে আমার পছন্দ আগুনের ফুলকি— যা দিয়ে কোনদিন কারও মুখোশ হয় না।” এই শোকগাথায় মেটাফোরের সৃজন এক অন্য মাত্রার দিকচিহ্ন! সমাজ-বাস্তবতার অন্ধকার আর মানবিক চেতনার সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলা হল! সময় সে-মিথস্ক্রিয়ার অণুঘটক! এক অনুশীলিত চেতনায় উত্তরণই এখানে উদ্দিষ্ট! তাই মেটাফোর নির্মাণের শৈল্পিক কুশলতা নিছকই গৌণ হয়ে যায়! “বড় বেশি মিথ্যে বলায়”— কী এক নির্মম কষাঘাত যেন আমাদের চেতনায়! সমাজ-চলনের মেকি অনুষঙ্গ হিসেবে ফুল- সংস্কৃতির মুখোশ ছিঁড়ে যায় মুহূর্তে! মুখোশের প্রকরণে ‘ফুল’-এর দাসত্বের বিপ্রতীপে সমস্ত অভিমানী তীব্রতা অভিঘাত তৈরির স্বপ্নপ্রয়াসে যেন সূচাগ্রসংহত হয়! জন্ম নেয় “আগুনের ফুলকি”! কবিতায় শব্দ নিরন্তর জায়মান! জড়ত্ব, বন্দীত্ব আর একমাত্রিকতাকে পরিত্যাগ করেই সে ধুকপুক স্পন্দনে নতুন করে বাঁচে। তাই কবিতা এগোলেই আমরা দেখি ‘ফুলকি’ অন্য ব্যঞ্জনা নিয়ে ফিরে আসে! “”—যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে যেখানে যায়— কথার সেই উৎসে, নামের সেই পরিণামে, জল-মাটি-হাওয়ায় আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই। কাঁধ বদল করো। এবার স্তূপাকার কাঠ আমাকে নিক। আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা ভুলিয়ে দিক।” জীবন দর্শনের ইতিবাচক ভঙ্গিতেই তীব্র অভিমান অন্য এক বোধ ও আলোকিত চেতনায় সংপৃক্ত হয়ে আসে ধীরে ধীরে। আবার সৃষ্টির নির্মাণ আর যাপন যেন আলাদা নয়! কোন অলৌকিক জগতকে বিশ্বাসের পৃথিবীর বাইরে রেখেই “জল- মাটি- হাওয়ার” পৃথিবীতে নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো মিশে যেতে চায়। সৃষ্টির দর্শন আর সমাজদর্শনের সমাপতন ঘটে। এই শোক-কবিতায় কথক কে? যাঁকে নিয়ে এই কবিতা, তিনিতো? কবি নিজেও কি নন? সমাজ-সংপৃক্তির কথা মাথায় রাখলে বলতে হয়, সমাজ-উদাসীনতার শিকার যে কোনও সংবেদনশীল স্রষ্টাই যেন এ-কবিতার মূল চরিত্র! এক অর্থে এই কবিতায় তাই Pastoral Elegy বা রাখালিয়া শোকগীতির সাদৃশ্যচিহ্ন রয়েছে৷ শোকের মতো সরল অথচ গভীর একটা আবেগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এ-শোককবিতার ভাষা নমনীয় ও মৃদু। নির্যাসের অভিযাত্রা শুরু কিছুটা আত্মগত, নিমগ্ন ও যন্ত্রণার অনুষঙ্গ থেকে। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাকভঙ্গিতে ধ্রুপদি ডিকশনের ভার বা আবেগবর্জিত বৌদ্ধিকতার জটিলবিন্যাস যেমন নেই, তেমনি চেষ্টিত ও আরোপিত নাটকীয়তায় ও অশোধিত শব্দের প্রয়োগে উচ্চগ্রামের রোষদীপ্ত আবেগ সৃষ্টির চেষ্টাও হয়নি! বরং আটপৌরে ও পরিশীলিত কথ্যভাষাতেই কাঙ্ক্ষিত সংবেদনা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। বাকভঙ্গিতে প্রতিমার অনর্থক জটিল বিন্যাস নেই! বরং অনায়াস ও স্বচ্ছ বিবৃতিতে সহজ আবেদনকে গাঢ় করে তোলা হয়েছে। ছন্দের শৃঙ্খলা যেটুকু আছে তাও কবির প্রায় স্বতঃস্ফূর্ত এক সিদ্ধি। “পাথরের ফুল” শোক-গাথার নির্যাসে একই সঙ্গে ধ্রুপদি আর্কিটাইপের অনুসরণ আছে। স্বাতন্ত্র্যের বিচ্যুতিও আছে। সমাজদর্শনে কবির যে বিশ্বাস, তাকে দূরে সরিয়ে রেখে নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলেও বলতে হয়, সামাজিক উপাদনগুলোর অনুষঙ্গে সময়ের চিহ্নায়নও আছে এ শোক-কবিতায়। সাহিত্যধর্মী শোকগাথার মতই ব্যক্তিশোকের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করে “পাথরের ফুল” নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠেছে সেসব ক্ষেত্রে! স্রষ্টাজীবনের প্রতি প্রতিবেশের অবিচার ও অবহেলা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তাতে সময়চিহ্নের একরৈখিকতা ভেঙে অন্য কালচিহ্নের জন্যও মুক্ত পরিসরের আমন্ত্রণ রয়ে গেছে। এখানেও ধ্রুপদি বিচারের মানদণ্ডে “পাথরের ফুল”- এর সার্থকতা। আবার মৃত-ব্যক্তি নিজেই এখানে কথক। তাঁর সত্তায় কবি ও কবির ব্যক্তিক আবেগ কোথায় কতখানি মিশে আছে, সে-অনুসন্ধান পরের কথা! যিনি চলে গেছেন, অন্তত শোক- কবিতাটির স্বাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্যের বিচারে, অন্য কেউ নয়, তিনি নিজেই তুলে এনেছেন তাঁর যন্ত্রণাময় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, তাঁর নিজের অভিমান, আক্ষেপ আর নিজের ঐহিক অবশেষের পরিণতি নিয়ে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা। শোকের বিলাপের শেষে মৃত্যুর অনিবার্যতা মেনেও জীবনের দিকে তুমুল পাশ ফিরে তাকানো বা জীবনের জয়গানের মধ্যে শোক-কবিতার সমাপ্তির যে চেনা প্যাটার্ন তা থেকেও “পাথরের ফুল” এখানে কিছুটা স্বতন্ত্র। বিলাপ নয়, এক অভিমানী ও নিরুচ্চার প্রতিস্পর্ধাই এ- শোক কবিতার মূল স্বর। |