পলাশ দাস
ওঁ প্রিয় সমুদ্র, কীভাবে যে আরও একটা জন্মদিন তোর পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। এখন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি। যত বয়স বাড়ছে ততই একটা চ্যাঁটচ্যেঁটে পর্দায় আটকে যাচ্ছে সব। কীভাবে যে ভুলে যাই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো, কেন যে মনে রাখতে পারি না ভাবতে বসলেই কষ্ট হয়। গলার কাছে আটকে ধরে কত জনমের পুরোনো দাহ। প্রত্যেক দিনের টানাপোড়েন উত্তেজনা আর খবরের হেডলাইনের মতো জীবনের হেডলাইন হিসাবে যেগুলো এসে দাঁড়ায় রোজকার জীবনে সেগুলোই যেন এক এবং একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। বাকি সব অপ্রাসঙ্গিক অচেতনের মতো কোন এক ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে পড়ে। এই চিঠির লেখার কোনো অবকাশ ছিল না, যদি কালকে তোর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনের কথা ভুলে না যেতাম। তবে এখানে একটা মনের কথা বলি, হয়তো কথাটা প্রবোধের মতো শোনাবে তবুও বলি, আজকাল কেমন যেন জন্মদিনটা মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। বারবারই মনে হয় ওই যেই দিন দরজায় দাঁড়িয়ে বলে যায়, দ্যাখো আরও বুড়োর দিকে, ভ্রষ্ট স্মৃতির দিকে, এগিয়ে চললে। মানে শেষের দিকে। তবুও দরজার ভিতরের মুখ গুলোর কথা মনে পড়লে আবার সেই উদ্দামতায় মেতে উঠতে চাই। আসলে আমরা একটা সময় ফেলে এসেছি যখন এত সব চিন্তা করিনি শুধু একটা উৎযাপনের দিন ধরে আমরা এগিয়ে গেছি। সেখানে প্রতিদিনই উৎযাপনের দিন। কত হাসি দিয়ে তাদের সাজানো হয়েছিল। এখন দূর থেকে দেখলে মনে হয় শুধুই সাজানো হয়েছিল, এখন আর কিছু নেই। ভাঙা ঝুলনের মতো। মনে আছে বারান্দার কোণে যেখানে আমরা ঝুলনের দিন পাহাড় করতাম, শেষবার ঝরনা আর পাশে খেত করেছিলাম। বেশ ভালো হয়েছে বলেছিল সবাই। খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু যেদিন ভাঙতে বসলাম আর ভালো লাগছিল না। তারপর সেই ঝরনা খুলে নিলাম। খেত সরিয়ে নেওয়ার পর কেমন একটা অবসন্নতা ঘিরে ধরেছিল সমগ্র বারান্দায়। সেইরকমই অবসন্নতা যেন জড়িয়ে ধরে আমাদের উৎযাপনের দিনগুলোকে। খুব ইচ্ছা হয় ফিরে যাই, আর পা বাড়ালেই দেখি পায়ে বেড়ি পরানো রয়েছে। সত্যি যদি একটা টাইম মেশিনে চেপে ফিরে যাওয়া যেত সেই দিন গুলোয় বেশ মজা হতো! আমাদের এই অনিয়মিত চিঠি চালাচালিতে কয়েকমাস আগের চিঠিতে তুই লিখেছিলিস নানা কথা। সেইসব ফেলে আসা দিনের কথা। আমি সেই চিঠির কোনো উত্তর দিতে পারিনি। বলতে পারিস ইচ্ছা করেই দিইনি। খুব ভারাক্রান্ত লাগছিল পড়তে পড়তে আর ছবির মতো ভেসে উঠছিল। আজকে সেই অবসর পেয়ে গেলাম অজান্তেই। তাই আজকেই সেই উত্তরগুলো দিয়ে দিই। আমরা খুব ছোট বেলার বন্ধু হতে পারিনি। বড়ো বেলার বন্ধু। লোকে বলে বড়ো বেলার বন্ধুদের মধ্যে নাকি বেশিদিন বন্ধুত্ব বজায় থাকে। জানিনা আমরা কতদিন এই বন্ধুত্বের বন্ধন বজায় রাখতে পারব। তবুও চেষ্টা একটা থাকবে। অনেকেই বলেছিল কলেজ শেষ বন্ধুত্ব শেষ। সে কথা আমরা ভুল প্রমাণিত করেছি। কলেজের দিন সেই কবেই শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও আমাদের বন্ধুত্ব বজায় আছে। আমদের সেই প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে? একটা উচ্ছলতা নিয়ে কলেজে প্রবেশ করেছিলাম। বেশ অন্যরকম একটা পরিবেশ। স্কুল থেকে একেবারে আলাদা। একরাশ খোলামেলা পরিবেশ, রঙিন ড্রেসের মতো তারা সবসময় যেন আহ্বান করে যায়। বন্ধু বান্ধবদের মন খোলা মেলামেশা, স্যার ম্যাডামদের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা। আমরা তো তার আগের বারোটা বছর একটা সম্ভ্রম দেখানোর পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছিলাম। শাসন আর শৃঙ্খলার মেলবন্ধনে থেকে হঠাৎ মুক্তি তাই বেশ আরামদায়ক হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। চুটিয়ে ক্লাস, অফ প্রিয়ড গুলোয় কলেজের ফাঁকা পড়ে থাকা ঘর গুলোয় দেদার আড্ডা, মাঝেমাঝে কলেজের পিছনের মাঠ পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা, বিশাল মাঠের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারতাম না। কাঁচা রাস্তার পাশ দিয়ে তখন জল নিকাশি কংক্রিকেটের বড়ো বড়ো ড্রেন তৈরি হচ্ছিল, সেই নালার উপর দিয়ে আমরা কত দূর দূর চলে গেছি মনে পড়েই না। আজও কেমন একটা ধাঁধাঁ লাগে, চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছা করে সত্যিই গেছিলাম তো! বিস্ময় জাগে। অবশ্য বিস্ময় জাগা কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা নয়। যেভাবে আমরা প্রত্যেকেই আজ বিভক্ত, প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনের ভিতরে আমরা যেভাবে বদ্ধ হয়ে পড়েছি, তাতে খোলা মেলা পরিবেশটাই হারিয়ে যাচ্ছে। সবসময় চারপাশ ঘিরে রয়েছে কিছু চিন্তা যার মধ্যে সবথেকে বেশি উপার্জনের চিন্তাই ঘিরে রেখেছে। আর আমরা ছুটছি ছুটছি। আর এর মাঝে পড়ে আমাদের স্বতন্ত্রতা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে তার খোঁজই রাখা যাচ্ছে না, হয়তো যেদিন আমরা নড়ে বসব সেদিন আর তার নামগন্ধ থাকবে না! আমাদের সেই কলেজের গ্রুপের বিশেষ কারও সাথেই আর যোগাযোগ হয় না। কোথায় তারা যেন সবাই হারিয়ে গেল, এক লহমায় কোথায় যেন গুম করে দিল সময়। সন্ধ্যার পর টুনটুনি পাখিটা দেখি বাসায় ঢোকার পর আর মুখ বার করে না, ব্যাপারটা যেন ঠিক সেরকম হয়ে দাঁড়ালো। সেই হৈ হৈ থেকে আজ আমরা শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছি। বেছে নিয়েছি একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। সত্যি বলতে সেদিনের সেই দু মানুষ সমান ড্রেনের উপর দিয়ে আজকে হেঁটে যেতে বললে আমরা সবাই হয়তো ভাবতাম। হয়তো পিছিয়েই আসতাম। যেভাবে প্রত্যেক দিন নিজের নিজের নিরাপত্তার খোঁজে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্মৃতির পরিচিত এক একটা মুহূর্ত। আমরা কখনই আর সেই পথে হেঁটে যেতে চাইছি না। সময় কত বদলে দিয়েছে আমাদের। সেই গ্রুপের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা আজ বদ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন, যেখানে শুধুই আমাদের মুখ, চারিদিকে আয়না লাগানো রয়েছে আমরা ছুটছি আর ছুটছি আর তার একটা ভিডিও দেখা যাচ্ছে আমরা সেই ঘর্মাক্ত আমিকে দেখে ততটাই উৎফুল্ল হয়ে উঠছি, মেতে উঠছি, আরও আরও জোরে ছোটার জন্য… ভুলে যাওয়া একটা রোগ মনে করে ক্ষমা করিস। কোন আশ্বাস দেবো না, যদি আবার ভুলে যেতে হয়! তার থেকে এই ভালো, যখন মনে পড়বে তখন মনে করব। এই ছোটার মধ্যে থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে চেষ্টা করব সেই দিনগুলোর গা থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে রাখতে। ভালো থাকিস। আনন্দে থাকিস। আমাদের ছোটা অক্ষয় হোক! ইতি – তোর বন্ধু পলাশ। |