পর্ণা চক্রবর্তী

পর্ণা চক্রবর্তী

কবি, 
ভেবেছিলাম কথাগুলো তোমাকে সামনেই বলবো কিন্তু সুযোগ  মেলার আগেই, হঠাৎ করে কোন সাত সমুদ্দুর তেরো নদীপার পার,সুদূর দেশ থেকে  ডাক এলো তোমার যাওয়ার। 
তুমি চলে গেলে। বলে গেলে ফিরে এসে শুনবে। তোমার কাজের তাড়া ছিল।  তুমি কত ব্যস্ত, কত কাজ তোমার ,আমার কথা  শোনার  তোমার সময় কই। আমারও কাজ আছে তবে  সেসব বড়োই আটপৌরে।  তোমার কাজের তাড়া,আর আমার এখন যাওয়ার তাড়া।
এবারে চলে যেতে হবে,  বেশী সময় নেই আর। তাই আমার সব প্রাণের কথা ,  লিখে রেখে  গেলাম তোমার জন্য।
জানো কবি খুব ইচ্ছে ছিল মুখোমুখি দুজনে বসে গল্প করি।হয়তো কোন
বৃষ্টি মুখর শ্রাবণ সন্ধ্যায়, চারপাশ যখন  কামিনী , হাস্নুহানাদের গন্ধে  মেতে  থাকবে ,বনজ সুবাসে  ভরে থাকবে  ভিজে বাতাস , সে সময় পশ্চিমের বারান্দায়  বসে থাকব তুমি আর আমি।  ঝরোখা গুলো ফেলা থাকবে।  তুমি বরং তোমার  আরাম কেদারায় বসো আর আমি তোমার পায়ের কাছটিতে।  সব কাজ  হয়ে থাকবে সারা । তোমার  ঐ বাঁধানো খাতাটা  সেদিন কিন্তু তোমার কোলে থাকবে না। তার বদলে থাকবে আমার হাত দুটো তোমার হাতের মধ্যে বন্দী হয়ে। ঝরোখার  ফাঁক দিয়ে  আসা দামাল সোঁদা বাতাস  আমার আঁচল ছুঁয়ে তোমার  চুল এলোমেলো করে দেবে । সেই মুহূর্তে  আকাশ  চিরে বিদ্যুৎ রেখায় ,বজ্র নিনাদে  যখন শিহরিত হবো , তুমি  জড়িয়ে  ধরে বলবে,” ছুটি এই তো আছি।” বাইরে তখন অঝোর ধারাপাত,  বারান্দার আলো আঁধারীতে  বসে শোনাবে আমাকে বিদ্যাপতির পদাবলী। 
 আমি পুলকিত হৃদয়ে শুনব,
“প্রথম বয়স হম ,কি কহব সজনি
পহু তজি গেলাহ বিদেস
কত হম ধৈরজ বাঁধব সজনি,
তহি বিনু সহব কলেস।”
কিংবা ভরা জোৎস্নায় নদীঘাটে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মাঝে  বসে তুমি গান গাইবে আর গুনগুন করে আমার    গান তোমার কন্ঠস্বর ছোঁবে।  এক  অপূর্ব সুর স্রোতে ভেসে যাব  আমরা দুজনে।  


কল্পনাই সার। কিছুই হলো না কোনদিন।  সারাদিন শুধু দূর থেকে তোমাকে দেখতাম। রাত আঁধারে বিরাট পালঙ্কের এক কোণে জেগে শুয়ে থাকতাম , কখন তুমি এসে আমাকে গ্রহণ করবে বলে। যেদিন তেমন হতো সেদিন  আমি  বর্ষার নদীর মতো কানায় কানায় ভরে থাকতাম। তুমি আমাতে অবগাহন করতে । আমি তৃপ্ত হতাম,পূর্ণ হতাম। বাকি দিন তোমার অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম জানি না। তোমার লেখার কাজ শেষ করে ফিরতে তোমার রাত হতো, কখনো ফিরতে না, পড়ার ঘরেই রাতটুকু কাটিয়ে দিতে।
আচ্ছা তোমার কি কখনো মনে হতো না একজন তোমার জন্য তৃষিত হৃদয়ে বসে আছে শুধু তোমাকে একটু ছোঁবে, আলো আঁধারে আবছায়া তোমাকে দেখবে বলে ?  তুমি আমাতে রমণ করেছ , কোনোদিন কোনো স্মৃতি মনন করেছ কি ? শুধুই তীব্র আশ্লেষ ?   পাশাপাশি শুয়ে গদগদ ভাসে বিনিদ্র রজনী কেটেছে একবারও? অকারণ হাসিতে কখনো ঝংকৃত হয়েছে আমাদের শয়ন কক্ষ?  পনেরোটি বিবাহিত বছরে পাঁচটি সন্তানের  মা হয়েছি,কিন্তু  তোমার যথার্থ  সহধর্মিণীর স্থান কি আমাকে দিতে পেরেছো? সারাদিন সংসারের কাজ সামলেছি, যত্ন করে তোমার জন্য নানাবিধ পদ রান্না করেছি,কিন্তু তোমার খাওয়ার সময় কখনো সামনে থাকতে পারিনি। তেমন নিয়ম ছিল না। তাই দূর থেকে দেখেছি।
তুমি কি পারতে না কবি এই বিশ্রী নিয়মটা পাল্টাতে?  তোমার দাদারা তো পেরেছিল।
আসলে  প্রয়োজন বোধ করোনি  হয়তো। আমি  তোমার শুধু অভ্যাস ছিলাম  আর তুমি আমার  শ্বাস প্রশ্বাস।  অভ্যাস বদলে যেতে পারে কিন্তু শ্বাস ছাড়া মানুষ যে বাঁচে না। 


মনে আছে তখন তুমি এতো বিখ্যাত হও নি।  গুণমুগ্ধের  সংখ্যাও ছিল নিতান্ত কম। সেই সময় তোমার যা কিছু নতুন সৃষ্টি , তার প্রথম স্বাদ নেওয়ার অধিকার ছিল শুধু আমার। এখন সে সব দেখি কাগজে, পত্রিকায় ছাপার পর।  আমাকে বলতে তোমার খেয়াল  থাকে না। কেন কবি? ,  কেন সব এমন ভাবে বদলে গেল ? আমি কি তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি? আমিও যে লিখতে পারি ,
ছবি আঁকি  আমারও গলায় যে সুর আছে, সব  কেমন ভুলে গেলাম।   শুধু এইটুকু জানলাম আমি ভালো রাঁধতে পারি , সংসারে  উদয় অস্ত  পরিশ্রম করতে পারি আর  উর্বরা জমির মতো আমার গর্ভ। আমার মতো শ্যামলা ,সাধারণ দর্শন এক মেয়ে এই  সুবিখ্যাত পরিবারের  রাঙা দাদার রাঙা বৌ হয়ে রইলাম। 
“রাঙা বউ…. “, যতবার শুনি, ততবার   নিজেকে আয়নায়  দেখতে ,দেখতে মনে হয়  তোমার বেলজিয়াম কাঁচের দেওয়াল জোড়া  সৌখিন আয়নাটা যেন আমাকে উপহাস করছে। মাঝখান থেকে বাবা মার  দেওয়া  আদরের কমল নামটা কোথায় হারিয়ে গেল।  এ বাড়ির বৌদের মনে হয় নিজের বলতে  কিচ্ছু থাকেনা , এমন কি নিজের নামটাও না। 


   তোমার  কি মনে পড়ে  বিয়ের পর কত রাত অবসরে, তোমার  কাছে লেখার মকশো  করেছি ,  তোমাকে আমার   কবিতা  কখনো বা গল্প পড়ে শুনিয়েছি। আমি তোমার লেখার 
যতটা কঠোর সমালোচক ছিলাম তুমি তেমন ছিলেনা। যাতে আরো ভালো লিখতে পারি তারজন্য আমাকে কত উৎসাহ দিতে। হঠাৎ সব কেন এমন  পাল্টে গেল বলতো? 
আচ্ছা কবি তুমি কি আমাকে কখনো  একটুও ভালো বেসেছিলে ?   সত্যি করে বলো।
ওই “ছুটি”  ডাকটা,   আমাকে এত উৎসাহ দেওয়া,  নিদ্রাহীন একান্ত  রাতগুলো , আমার  কাছে পরম সম্পদ  ছিল।  কখনো  হয়তো বা কিছু পড়তে পড়তে  আনমনে চোখ তুলে ,স্মিত হাসিতে আমার  দিকে একটু চেয়েছো,   আমি ভালবাসায় ভেসে  গেছি। 
কোনোদিন যে একবারের জন্য বললে না , আমাকে ভালোবাসো কিনা  ,তাই নিয়ে মন খারাপটাকে,  না পাওয়ার সব আঘাতগুলোকে তোমাকে আরো অনেক  ভালোবেসে  সারিয়ে তুলেছিলাম।  শরীর খারাপে ডাক্তার ছিল , ছিল  বিনোদদাসী ,  ছোট ঠাকুরঝি ।  তুমি  ব্যস্ত ছিলে । রোগক্লান্ত  চোখদুটো তোমাকে কত  খুঁজেছে। তারপর  নিঃশব্দে মেনে নিয়েছে।  
আমার মনে পড়ে না কোনো দিন মুগ্ধ চোখে   চেয়ে দেখেছ কিনা  আমায় । কিন্তু জানো  এমন ইচ্ছে খুব  হতো। 
যখন  কোনো উৎসবে নতুন শাড়ি, নতুন অলঙ্কারে সাজতে হতো, সীমন্তে  গাঢ় সিঁদুরের রেখা আঁকা হতো , বিনোদ,  শ্যামা  এমনকি কখনো  তোমার  মাও বলেছেন  “রাঙা বৌয়ের আজ রূপ খুলেছে বেশ।” তুমি বলো নি তো? ঘুরেও দেখনি।  ওরা কি মিথ্যে বলেছিল তবে? 


তখন  অবিশ্যি  তোমার  সময় 
কোথায় ! শহরের বড় বড় সভা ঘরে  তোমার বক্তৃতা   থাকছে,   কোন জমিদারের বাড়িতে  বিদ্বজনের  সভায় চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ থাকছে  কখনো বা গুণীজনের সমাবেশে তোমার কবিতা,  গল্প পাঠ শুনতে ভীড় করছে পুরো শহর আর তার সাথে থাকছে সুবেশা  গুণবতী  অপূর্বাদের মধুর সঙ্গ লাভ।
তাই আমার জন্য আলাদা করে কোনো সময় তোমার ছিল না। নিভৃত   মুহূর্ত যাপনের কোনো ইচ্ছে ও ছিল না।আমি কিন্তু আকুল হয়ে  তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতাম, কবে তুমি আমার সাথে তোমার সব সুখ দুঃখ, ব্যর্থতা, অপমান  ভাগ করে নেবে।   সংসারের কেজো ,অকেজো কথা ছেড়ে একটু হৃদয়ের কথা বলবে। আমি বসে রইলাম, কিন্তু তুমি এলে না।   আমার ঘরের সামনে  দিয়ে তোমার পদধ্বনি  ধীরে ধীরে  থামত গিয়ে  তোমার পড়ার  ঘরের কাছে ,তারপর সব স্তব্ধ ।আমার  বুকের ভেতর জমে থাকা কান্না শব্দ হয়ে বাজত শুধু।   
তোমার  রাঙাবউ হয়ে সব অবহেলা এতদিন সহ্য করেছি। পড়াশোনার নামে  ছেলেমেয়েদের দূরে করে দিলে। একাকীত্বের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছি  তবু বলিনি  কিছু।  
কিন্তু এই অবজ্ঞা , প্রেমহীন এই জীবন আর মেনে নিতে পারছিলাম না।  তাই হয়ত বিধাতা করুণা করলেন। মন ক্ষইতে ক্ষইতে শরীরে ক্ষয়  ধরলো। 


 একটা  অনুরোধ কবি, ভূমি আর বন্যাকে মেয়ে বলে অবহেলা করো না। লেখাপড়া শেষ হলে পর তবে ভালো বরে  ঘরে বিয়ে দিও।  ওরা  ওদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে শিখুক।   ছেলেরা  যেন মানুষ  হয়। ওরা যেন ওদের বউদের  যথার্থ সহধর্মিণীর মর্যাদা দিতে পারে।  শুধু আত্মতৃপ্তির  জন্য অরণী  প্লাবন আর শাওনকে বাইরের কোনো উৎসর সন্ধান যেন না করতে হয়, এমন ইচ্ছা রইল।  
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা  আমার সন্তানেরা কেউ যেন ওপরের মর্মান্তিক কষ্টের কারণ না হয়। 
তুমি ভালো থাকবে আমি জানি আলাদা করে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।ভালো থাকতে পারার তোমার ক্ষমতা অসাধারণ।  আমার যা কিছু ছিল , লেখার খাতা, অসমাপ্ত ছবি ,  সব  নষ্ট করে দিয়ে  গেলাম। আর তোমার  দেরাজে  তোমাকে লেখা আমার চিঠিগুলোর  সাথে  সুগন্ধী রঙিন কাগজের আরো বহু এমন চিঠি  ,বড় যত্নে  রাখা ছিল দেখলাম। ক্ষমা করো অনুমতি ছাড়া তোমার দেরাজ খোলার জন্য।  আমারগুলো শুধু পুড়িয়ে ফেলেছি। দোহাই কবি আমার কোনো স্মৃতি রেখোনা। কিছু তো চাইনি তোমার কাছে কখনো, এইটুকু সম্মান খালি দিও।  তুমি যবে ফিরবে তখন আমি মিশে থাকব বায়ুতে , জলে, মাটিতে  হাওয়ায়। 
 “এতদিনে প্রথম যেন বাজে
বিয়ের বাঁশি বিশ্ব আকাশ মাঝে।
দ্বারে আমার প্রার্থী সে যে,নয় সে কেবল প্রভু,
হেলা আমায় করবে না সে কভু।
মধুর ভুবন মধুর আমি  নারী
মধুর মরন ওগো আমার অনন্ত ভিখারী….”
এই বেশ  হবে।
ছুটির ছুটি এতদিনে মিলবে তবে।
  ইতি,
  আমি 

Leave a Reply