বিশিষ্ট কবি এবং সাহিত্যিক তৈমুর খান সোমা দত্তের লেখা ‘নীলাভ সবুজ শৈবাল’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে যা লিখেছেন, সেটি নিচে দেওয়া হল। কবি তৈমুর খানকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ।

আত্মনির্মাণের কবিতা
———————————————————
সোমা দত্তের লেখা ‘নীলাভ সবুজ শৈবাল’(বইমেলা ২০২৫) কাব্যখানি পড়তে পড়তে মনে হলো কবি আদি জীবন থেকে উঠে এসেছেন সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে। তাঁর উত্থান ও গমনের মধ্যেই সেই পরিচয় ফুটে উঠেছে। কাব্যের প্রথম কবিতাতেই লিখেছেন—
“শ্লীলতা সমুদ্রে ফেলে
মেয়েটি এগোয়—”
কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি?
কবি উত্তর দিয়েছেন—
“ডানা মেলে
আগুনের দিকে।”
আগুন আদি সভ্যতার প্রথম আবিষ্কার। সেই আগুনের মধ্যেই সভ্যতার যাবতীয় উল্লাস ও সামর্থ্য বিরাজ করছে। সেই আগুনকে নিয়েই তিনি এগিয়ে চললেন। তারপর সভ্যতার ধ্বংসকারী ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ এর সম্মুখীন হলেন। অ্যাপোক্যালিপ্স হলো একটি বিপর্যয়মূলক ঘটনা বা ঘটনার সিরিজ যা বিশ্বের শেষ নিয়ে আসে এমনটিই আমরা জানি। শব্দটি প্রায়ই ধর্মীয় বা পৌরাণিক বিশ্বাসের সাথে যুক্ত, তবে এটি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের এবং আরও ধর্মনিরপেক্ষ বা বৈজ্ঞানিক ধারণা বর্ণনা করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কবিতায় তিনি লিখলেন— “অতলখাদের ঘুম থেকে ডাক দিয়েছেন অধিশ্বর
শোনা যায় সম্মিলিত ‘জনগণমন’…
শোনা যায় ওদের ধ্বংস,
ব্যর্থকামান, জলদস্যুপ্রবণতা,
কালোজাহাজ…”
যুদ্ধবাজ সভ্যতার স্বরূপই উদঘাটিত হলো। সভ্যতার বিনোদন-সংস্কৃতিরও অবস্থান বোঝা গেল। রক্তাক্ত তরল মেরীমাতা, শালীন হিজাব, অথবা লাল বেনারসিও চক্রাকারে ঘুরতে লাগল মৌলবাদী নাশকতা সূর্যের চারিপাশে। কবিতা সেই প্রাজ্ঞ ভুবনের বোধ থেকেই যাপিত জীবনের সময়ের ঘর্ষণকেই তুলে আনতে চাইল। তাই কবি অকপটে লিখতে পারলেন—
“জানি পারি না কিছুই আমি,পারি না মুছে দিতে যন্ত্রণা—
পারি না লিখতে রূপকথা
অর্থহীন শব্দের পাশে মূক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখি,
নিরুত্তাপ তাকিয়ে আছ,আমার চেষ্টার দিকে—
তবু যদি যাও, বলে যেও না কিছুতেই—
আমি তো নির্ভয়ে, পরাজয় মেনে নিয়ে,
লিখি তোমাকেই,তোমাকেই লিখে লিখে
নির্মাণ হয় ভালোবাসা,
কাঠের নৌকা
ছই…”
নিজের কাছে নিজেকেই দাঁড় করিয়ে যা বলতে চাইলেন, যা লিখতে চাইলেন তা সেই যন্ত্রণা, তা সেই ধ্বংস, তা সেই আততি। বীভৎস এই মোক্ষমকে এড়িয়ে যেতে চাইলেন না। তাই আত্মনির্মাণের পরিধি বিস্তার করলেন। পরাজয় মেনে নিয়েও ভালোবাসার রসদ সংগ্রহ করলেন। আর তা নৌকা নির্মাণের রূপ পেল। নৌকার ছই সেই রূপক অর্থের নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে উঠল।
সোমা দত্তের কবিতা উচ্চকিত নয়, কবিতায় উদ্দামতাও নেই; শুধু নির্বিকল্প এক উপলব্ধির চলাচল। সংশয় ও জন্মান্তর পর্ব। নিজের সঙ্গে নিজেরই পরিচয়। কথা বলা আর কথার ভেতর দিয়ে পথ খোঁজার প্রয়াস। তবু তাঁর মননে এক তীব্র বিশ্বাস আছে। ধৈর্য ও অপেক্ষা আছে। নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসে গৌরবহীন যাত্রা আছে। অতিপ্রাকৃতির মধ্য দিয়ে তিনি সচকিত সম্মোহনে নিজেকে নির্মাণ করতে থাকেন। প্রেমের শক্তি ও সামর্থ্য থেকে বোধের দীপ্তি প্রজ্জ্বলিত করতে পারেন। কবিতায় সে কথা উঠেও আসে—
“যখন প্রথম প্রেমিক কাগজের এরোপ্লেন ছুড়ে মারে,
তখন শরীর থেকে সুগন্ধ বেরোয়,
ভিতরে জন্ম নেয় কুবোপাখি,
গলাটা জিরাফের মতো বেড়ে উঠে আকাশ ছুঁতে চায়—
আমি টিমটিম করে জ্বলি হ্যারিকেন-সলতের উপর,
গোল হয়ে ফুলে উঠি রুটির ভিতর,
দেওয়ালের ছায়ার মতো বেড়ে উঠি,
ফের ছোট হই,
কলমের প্যাঁচ থেকে চুইয়ে পড়ে নীলাভ সবুজ শৈবাল—”
জিরাফের মতো উঁচু গলায় আকাশছোঁয়ার প্রয়াস থেকে, হ্যারিকেনের সলতের উপর অগ্নিভ আলোয় প্রজ্ঞাপারমিতার প্রকাশ ঘটান, অথবা রুটির ভেতর গোল হয়ে ফুলে ওঠেন। দেওয়ালে নিজের ছায়ার পতিত হওয়াও অনায়াসেই ঘটে চলে। কলম থেকে নীলাভ সবুজ শৈবালের ঝরে পড়ার বিস্তারে উপলব্ধিরও রূপান্তর ঘটে। নিজের জীবনের ধারাপাত সেই ভাবেই মিশে যায়। কবি লিখেছেন— “এক স্বপ্ন থেকে অন্য স্বপ্নে লাফ দিতে গিয়ে দেখেছি আমার পা দুটো পিঁপড়ের মতো ছোট হয়ে পড়েছে আর স্বপ্নগুলো দৈত্য। তুমি কি এমনই চেয়েছিলে? হাত বাড়িয়ে ছুতে পারব না, এমন একটা গল্প?”
দীর্ঘ জীবনের প্রত্যয় জন্মানোর পরই এই অস্বাভাবিক ক্রিয়ায় কবিকে প্রতারিত হতে হয়। সংঘাত তখনই আত্মিক ও অপার্থিবতায় রূপ পায়। সত্তার দ্বৈত শিহরনে কার্যত এক টানাপোড়েন চলতে থাকে। মাকড়সা, পেঙ্গুইন থেকে প্রবোধ ও প্রবৃত্তির অবসাদগ্রস্ততা সংসারের পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত তার গতিবিধিতে সড়গড় হয়। অপত্য স্নেহের কারুণ্য থেকেও আততির অমোঘ সীমানা স্পর্শ করেন। তখন উপলব্ধি হয়— “প্রাগৈতিহাসিক বাম-হাতখানা ড্রাগনের ট্যাটু আর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসতে চাইছে।” সময়ের উচ্চারণকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। চেতনা সেখান থেকেই তার মুকুলিত পল্লবে দৃশ্য তৈরি করে।
তাই কবি সহজ ভঙ্গিতেই লিখতে পারেন—
“দৃষ্টিশূন্যতার সীমানায় ওই উড়ে যায়
আমাদের শখবাদ্যানতার ঘুড়ি,অসম সংযোগ—
এরপর অতর্কিতে ঘটে প্যাক আপ
বহুমূল্য সময় শেষ। প্রতিবাদ, নারী স্বাধীনতা,
চলৎশক্তিহীন কবিতা….”
কবিতাগুলি এভাবেই সময় ও ঘটনার সরঞ্জামে চৈতন্যকে স্পর্শ করেছে। আত্মরসায়নের ভাবলোকে নিজস্ব বৃত্তের মধ্যেই কবি নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম দশকের কবি হিসেবে কবিতার ভাষা, চিত্রলিপি, ব্যক্তিচেতনা এবং আত্মদর্শনের নির্মাণে গভীর প্রভাব পড়েছে। নিজের স্বরকে আলাদাভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পেরেছেন।
তৈমুর খান