নন্দিতা আচার্য
ডিয়ার গনেশ ঠাকুর অনেক দিন বাদে তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। আসলে আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে আছে। এখন তো বৃষ্টির সময়; বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু। বারান্দায় বসে আমি একমনে বৃষ্টি পড়া দেখি। খুব ইচ্ছে হয় বাড়ির সামনে বেশ জল জমবে, তাতে আমি নৌকো ভাসাবো। আর আজ সেই ভাবনাটার জন্যই দুঃখ হচ্ছে। নদীর ধারে জেলেপাড়ায় জল জমে গেছে গো! পৃথিবীতে এখন রাত্রিবেলা। একটু পরেই আমি, বাবা আর মা ডাইনিং টেবিলে খেতে বসব। কিন্তু ভোলা, পুঁটিরা কী খাবে, কোথায় শোবে… কিছুই জানিনা। ওদের ঘরে জল ঢুকে গেছে। আমাদের বাড়ির সিঁড়ির ঘরে জেলেবস্তির চারজন এসে উঠেছে। মা আর বাবা মিলে ওদের জন্য খাবার বানাচ্ছে, ডিম আলু দিয়ে তরকারি; শুধু ওই চারজনই নয়, অনেকের জন্য। তাই আমি যখন বলতে গেলাম, ভোলা, শিবু, পুঁটিরা আমাদের বাড়িই আসুক না… তখন হালকা বকা খেলাম। বাবা বলল, এখন বিরক্ত কর না, দেখছ না কত মানুষ বিপদে আছে, ওদের জন্য মা আর আমি মিলে রান্না করছি? স্বর্গে এখন সময় ক’টা গো গনেশদাদা? ছোট কাকু আমেরিকায় থাকে, সেখানে নাকি এখন ভোরবেলা। এ বাবা, তোমাকে দাদা বললাম! ঠাকুরকে কি দাদা বলা যায়… তাদের তো সবাই মা, বাবা এসব বলে ডাকে। সরি চেয়ে নেব? আসলে তোমাকে ঠিক দাদাও নয়, বন্ধু মনে হয়। তুমি আমাকে বন্ধু করেছ তো? স্বপ্নে জানিয়ে দিয়েছ কিন্তু। অনেক দিন তোমাকে স্বপ্নে পাইনা, আমি তাই এট্টুখানি রাগও করেছি তোমার ওপর। তাড়াতাড়ি এসো একবার। জানো, যখন পুজোর পর দিদুনকে বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখি, তখন শ্রীচরণেষু লিখি। মা বলেছে, বড়দের এমনই লিখতে হয়। কিন্তু আমার বন্ধু রিঙ্কির সঙ্গে যখন আড়ি হয় আমার, তখন চিঠি লিখতে গিয়ে ডিয়ার লিখি। স্কুলেও এমন শিখিয়েছে। তোমাকে ডিয়ার লিখে কোন দোষ করিনি তো? আমার মাসিমনির বাড়ি হৃদয়পুরে, বৃষ্টিতে ওখানে খুব জল হয়। দিদিরা গল্প করে, খাট উঁচু করে বসতে হয় তখন। খাটের তলা দিয়ে ঝিলমিলে জল; বড় বড় কাগজ দিয়ে ওই খাটে বসেই ওরা নৌকো ভাসায়। তারপর আরও আছে, বৃষ্টির জল পেয়ে ওদের বাগানের মধ্যের পুকুরটা থেকে সব মাছ, কাঁকড়া দল বেঁধে উপছে পড়ে উঠোনের মধ্যে ঘুরে বেরায়। দিদিরা গামছা পেতে ধরে সে সব। কী মজা না, বল? আমারও এমন শখ হয়, বাড়ির সামনেটায় নৌকো ভাসানোর মত জল হোক; খবরের কাগজ দিয়ে নৌকো বানানো আমি শিখে গেছি। ওই জলেই সেই নৌকো ভাসাবো, আর বাড়ির পাশে গঙ্গা থেকে মাছগুলো যদি রাস্তার জলে উঠে আসে, তবে তো আনন্দের শেষ নেই। বাবি যতই বলুক জল ঘাঁটলে আমার সর্দিকাশি হবে, আমি কিছু শুনবই না; ঠিক লুকিয়ে গামছা নিয়ে চলে যাব। তা বলে ভেবনা যেন আমি মাছ খেতে ভালবাসি। রোজ মায়ের সঙ্গে ঝামেলা মাছ খাওয়া নিয়ে। মাংসও খাইনা আমি। পাঁঠাবলি দেখে ফেলেছিলাম একবার, কী কান্না আমার; সেই থেকে কিছুতেই কেউ আর আমাকে মাংস খাওয়াতে পারেনি। আচ্ছা গনেশ দাদা, ঠাকুর তো সবার ঠাকুর, একটা পিঁপড়েরও; এ কথা দাদুভাই আমাকে বলেছে। তবে কেন তাঁরা জীবজন্তুদের এমন কষ্ট দেয়? ভগবানদের আমি মোটে বুঝতে পারিনা। ওই যে কৃষ্ণ ভগবান, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় বস্ত্র দিয়ে যাচ্ছিল, অথচ দুর্যোধনকে একটুও শাসন করল না! তাকে তো দুটো থাপ্পড়ও মারতে পারত, ভগবান বলে কথা, কিন্তু কিছুই করল না। দাদুভাই বলে, যুধিষ্ঠিরেরও দোষ ছিল। পাশা খেলার দানে সে দ্রৌপদীকে রাখবে কেন? কিছু দিয়ে খেলা তো জুয়ার মত, সেটা নাকি ভয়ঙ্কর খারাপ! কে জানে, বুঝতে পারিনা এত; কিন্তু মেলায় গিয়ে বায়না করে আমিও পয়সা দিয়ে চাকা ঘুরিয়ে খেলি। পুঁতির মালা, পেন্সিল বক্স, চিরুনি… কত কি পেয়েছি। একবার তো একটা লজেন্সের বাক্স পেয়েছিলাম। মা ওটা খেতে দেয়নি, বলল বাজে। আর বাবি রাগী চোখ করে বলল, এসব খেলাবে না মেয়েকে, খারাপ জিনিস, জুয়ার মত! আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করি, কেন খারাপ বাবি? সে তখন বলে, পরিশ্রম না করে যা কিছু পাওয়া হয়, সেগুলো ফাটকা, খুব খারাপ! আমায় একটুও পছন্দ হয়নি এ উত্তর। মেলায় গিয়ে আমি কী পরিশ্রম করব; চাকা ঘুরিয়ে আমার ভাগ্যে যদি ফুলের ছবি দেওয়া টিফিন বক্স ওঠে, তাতে দোষের কি! ‘ভাগ্য’ কথাটা মাসিমনির বাড়ি গিয়ে দিদিদের থেকে শিখেছি। জাতকের বই থেকেও জেনেছি; যারা ভাল কাজ করে তাদের ভাল ভাগ্য হয়। বুদ্ধদেব তো কত জন্ম পার করে বুদ্ধ হয়েছে; সরি, হয়েছেন। খারাপ কাজের খুব ভয় আমার গনেশ ঠাকুর! যদি আমাকে আরশোলা হয়ে জন্মাতে হয়? কী বিচ্ছিরি লাগে ওদের! তবে পাখি হতে খুব ইচ্ছে করে; লাল-নীল-হলুদ-সবুজ… রঙচঙে পাখি। আমি না সব অ্যানিম্যালদের ভালবাসি, এমনকি পিঁপড়েদেরও; ওই আরশোলা ছাড়া। তবে তাদের কেউ মারলে আমার দুঃখ হয়; ওরাও তো জন্মেছে, বল? ভাগ্য খারাপ বলে কষ্ট পাচ্ছে তারা। আচ্ছা ওই যে দ্রৌপদী, তারও কি ভাগ্যটা খারাপ ছিল? রাজার মেয়ে হয়েও রাজসভায় সকলের সামনে বস্ত্রহরণ! দ্রৌপদীকে আমার বেজায় ভাললাগে। তবে তার বরেদের আমার একেবারে পছন্দ নয়। কেমন যেন ওনারা; শুধু ভীমকে ভালবাসি আমি। আর অর্জুনকে পছন্দ করি, তবে ওকে ভালবাসি না; খালি গাদা গাদা বিয়ে করে! আচ্ছা ওনারা তো সবাই আনন্দ করেই এত এত বিয়ে করে; ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, দুর্যোধন, এমন কি কৃষ্ণও; তাহলে শুধু দ্রৌপদীকেই দুঃখী বানানো কেন পাঁচটা বিয়ের জন্য? এসব কথা বললেই সবাই হাসবে আর আমাকে পাকাবুড়ি বলবে। তা কি মিথ্যা বলব নাকি; সেটা তো পাপ, পরের জন্মে যদি আমার আরশোলা বা কেন্নো জন্ম হয়? তোমাকে চুপি চুপি বলি, ভীম আর অর্জুনের মত পাঁচটা বর থাকলে আমি খুশিই হব। ওই দেখ, মা ডাকছে আমায়; একটু একা একা বসে চিঠিও লিখতে দেবে না। আসছি এক্ষুনি, তুমি আবার আমার মন থেকে চলে যেওনা যেন। ওগো এসে পড়েছি গনেশ ঠাকুর; কী কান্ড, মা আর বাবা আমাকে খুব বড় সারপ্রাইজ দিল! ভোলা, শিবু, পুঁটি… ওরা তিনজনেই আমাদের বাড়ি এসেছে! রাতে খাবে এখানে, শোবে এখানে; কী আনন্দ! মা পারমিশন দিয়েছে সবাইকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার; ওরা আমার বন্ধু। ওদের যে আমি গরীব বলে তিতুন আর রিঙ্কিদের মত বন্ধুদের চেয়েও বেশি ভালবাসি, মা তা বোঝে। পুরো ভিজে একশা হয়ে এসেছে ওরা, মা এখন ওদের চেঞ্জ করে শুকনো জামা পরাচ্ছে। আমি দৌড়ে এলাম চিঠিটা শেষ করতে। এরই মধ্যে পঞ্চু কাকু একগাদা চিংড়ি দিয়ে গেছে, সবাই মিলে খাবার জন্য। বাবি জোর করে পয়সা দিয়েছে, আর মা বকেছে পঞ্চুকাকাকে; এমন করে সব দিয়ে দিতে হয়? কত কষ্ট করে মাছ ধর, তা বিলিয়ে দিচ্ছ। বউ আছে, ছেলেরা আছে তোমার! পঞ্চু কাকুও নৌকা নিয়ে সামনের গঙ্গায় মাছ ধরে, ভোলা শিবু পুঁটিদের বাবারাও তাই করে; কিন্তু আশ্চর্য, পঞ্চুকাকাকে কোনদিনও আমার গরীব মনে হয়না। বিকেল বেলা পঞ্চুকাকা হরিদাসীকে (পঞ্চুকাকার আদরের কুকুর, আমারও খুব আদরের) কোলে করে নদীর থেকে বাড়ি ফেরে। পেছনে তার পোষা হাঁসেরা প্যাঁক প্যাঁক করে ঘরের দিকে হাঁটে। তার ভাইদের আর ছেলেদের মাথায় থাকে মাছের হাঁড়ি। সে সময় আমি দোতলার ব্যালকনি থেকে রোজই জিজ্ঞেস করি, আমার জন্য সে নীল রঙের নৌকো দেখেছে কিনা। মনে মনে আমার একটা নৌকো কেনার খুব শখ। পঞ্চুকাকা এত্তো বড় ঘাড় নেড়ে বলে, হ্যাঁ মাঈ, দেখে রেখেছি। আমি বলি, ভাঁড়ে পয়সা ভরে গেছে; পঞ্চুকাকা হাসে আর বলে, মাঈ, ওইতেই লীল লউকা আনি দেব। তারপর আমার চোখের সামনে দিয়ে যত রাজ্যের কুকুর বেড়াল গরু ছাগল… সাবাইকে আদর করতে করতে সে রাজার মত ঘরে ফেরে! এই রে, আবার মা ডাকছে, এবার রেগে রেগে! তাহলে আজ এখানেই চিঠি শেষ করি গনেশ ঠাকুর? তুমি আমার ভালবাসা আর হাম্পি নিও। ইতি তোমার বন্ধু দিয়া। |