দীপ শেখর চক্রবর্তী
প্রিয় দীপ শেখর একুশ দিন আগে কলোনির মোড়ে দেখলাম তোমাকে। ডাকিনি। একুশ দিন আগে মানে তেইশে জুলাই। সেদিন আমার বয়স ছিল একত্রিশ বছর তিন মাস আট দিন। এখন তিন মাস ঊনত্রিশ দিন। মনে পড়ে, সতেরো বছর বয়সে তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। ভালোবাসতে বাসতে আরও তিনটি বছর। এক আশ্চর্য বালক ছিলে বটে। মনে পড়ে, টিউশন ব্যাচে পরীক্ষার মাঝপথে তোমার এবং বন্ধুদের পালানো। একদিন শুনলাম, বাড়িতে কিছু না জানিয়ে সমুদ্রে চলে গেছ। তারপর হঠাৎ উল্কার মতো আবির্ভাব ঘটল তোমার। সেকি চেহারা করেছিলে। মনে হল বহুদিন নিজের শরীরকে অত্যাচার করেছ খুব। শিক্ষক- শিক্ষিরা তোমার এই পাগলামিকে ভয় পেত। তুমিও কি পাওনি? একদিন ক্লাসের মাঝে তুমি যখন স্পষ্ট করে বললে, শাসককে ঘৃণা করো তুমি- সেদিন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। জানাতে পারিনি। ছিলাম, সাধারণের থেকেও সাধারণ। তোমার আলোতে নিজেকে স্পষ্ট মনে হত। ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষক যখন এডগার এলান পোর নিন্দে করছিল, তুমি বললে- পো তোমার প্রিয় কবি। আমি জানি, একথা সত্যি নয়। তোমার ভালো লাগত, এমন বলতে। বোদ্যলেয়ারের দুর্বোধ্য সব লেখা তুমি সে বয়সে করিডর দিয়ে চিৎকার করে করে পড়তে, যখন আমরা মুগ্ধ হয়েছি, রবীন্দ্রনাথে। দীপ, একুশ দিন আগে তোমাকে কলোনির মোড়ে দেখলাম। ডাকতে পারিনি। তোমার তেমনই উজ্জ্বল চোখ, চশমার কাঁচের ভেতর, কী যেন খুঁজে চলেছে। পরনে তেমনই অবহেলার পোশাক। কাউকেই তুমি লক্ষ করো না পথেঘাটে। এসব, এত বছরেও বদলায়নি। দেখলাম, তোমার সেই মাথাভরা চুলের ভেতর সামান্য মরুভূমি। রোগা হয়ে গেছ আগের থেকেও। শরীরটাকে যেন বয়ে নিয়ে চলে গেলে। ডাকা হল না। দীপ, তোমার মনে পড়ে, একদিন তুমি দোতলার ছাদে বসে আমাকে পড়িয়েছিলে- বিষ্ণু দে –এর শ্রেষ্ঠ কবিতা? তোমার তখন বিষ্ণু দে প্রিয় ছিল। আমার ছিল, দেবারতি মিত্র। তারপর তুমি আর আমি একইদিকে ঝুঁকে গেলাম। ভাস্করের অসীম এক বিপন্নতায় ডুবে গেলাম যেদিন দুজনে, বুঝলাম ভালোবেসেছি। তুমি শখ করলে এসরাজ বাজাবে। আমাকে একা ফেলে চলে গেলে সঙ্গীতভবন। আমি সেই মধ্যবিত্ত বাড়ির দোতলায় হারমোনিয়ামেই আটকে রইলাম। বললে, ওখানে নাকি একজন তোমাকে মুগ্ধ করেছে। ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে কতরাত ছাদে একা বসে থেকেছি, তুমি জানো না। আমার বাবা সিপিএম করত বলে তুমি তাকে অনেক খারাপ কথা বলেছ সেই বয়সে। তুমি বিশ্বাস করতে উগ্র বামপন্থাই এ দেশকে বাঁচাতে পারে। হাতে অস্ত্র তুলে না নিলে সমস্তটাই আদতে গদি দখলের লড়াই- এই তোমার বিশ্বাস ছিল। কোনও উগ্রতায় আমার বিশ্বাস ছিল না। আমি সামান্য হতে চেয়েছিলাম। মধ্যবিত্ত পরিবারের ভার একমাত্র আমার ওপরে। তোমার কাছে সেসবের কোনও অর্থ না থাকলেও আমার কাছে ছিল দীপ। তাই আমি পারিনি, তোমার মতো বিপ্লবী হতে, আর্টিস্ট হতে। বাবার প্রতি খারাপ কথাগুলোও আমি মেনে নিতে পারিনি। আমি বুঝতাম, মানুষকে বাঁচতে হলে একটা দুটো বিশ্বাস আঁকড়ে থাকতে হয়। তা যত অন্ধই হোক না কেন। দীপ, মনে আছে? যেদিন প্রথম আমাকে ছুঁয়েছিলে? দোতলার ঘরে, দরজা বন্ধ করে, টেনে নিয়েছিলে কাছে? তখন আমার মরমর অবস্থা। কেউ যদি, এমন অপূর্ব মুহূর্তে আমাকে মরে যেতে বলত, দ্বিধা করতাম না। কিন্তু ঈশ্বরের এতটা কৃপা আমার ভাগ্যে নেই। সেদিন মরিনি, তবে ভালোবেসে মরেছি। তিলে তিলে। তুমি বোঝনি। বুঝতে চাওনি হয়ত। অথবা ততটা গুরুতর কিছু মনে হয়নি তোমার কাছে। এক উজ্জ্বল আলোকবিন্দুর দিকে দৌড়তে দৌড়তে তুমি অন্ধ হয়ে গেছিলে। আমি সেই অন্ধত্বকেও আশ্চর্য ভালোবেসে গেছি। দীপ, একুশ দিন আগে কলোনির মোড়ে তোমাকে দেখলাম। তেইশে জুলাই। বড় রোগা হয়ে গেছ। বিষণ্ণ ক্লান্ত লাগে তোমাকে। শরীরের সেই আলোটি নিভে গেছে। তবুও কেউ যদি এখনও তোমার চোখের দিকে তাকায় – বুঝবে। দীপ, এডগার এলান পো এখনও ভালো লাগে তোমার? ভালো লাগে বিষ্ণু দে? ভাস্করের কবিতাসমগ্রের দুখণ্ড মাথার ওপর রেখে ঘুমাও এখনও? দীপ বারগম্যান না তারকোভস্কি সমাধান করতে পারলে এখনও? সত্যজিৎ কে বুর্জোয়া লাগে? এখনও বিকেলবেলা বাড়ির কাছে দীঘিটির কাছে যাও? পা ডুবিয়ে বসো? দীপ, যেসকল মেয়ে ভালোবেসেছিল তোমাকে, এখনও ভালোবাসে? তাদের কেউ কথা রেখেছিল? তুমি কথা রেখেছিলে ? কাউকে ছুঁয়েছিলে আমার মতো করে? বড় জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে দীপ, তুমি কি এখনও অতটা স্পষ্ট? আগুনটা জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছ? গোটা পৃথিবী জুড়ে মানুষের এই চূড়ান্ত অসভ্যতা ক্লান্ত করে না তোমাকে? মনে হয় না, সব ছেড়ে কোনও দূরদেশে চলে যাই। যেখানে এত মানুষ নেই, এত স্বার্থ নেই, প্রত্যাশা নেই। দীপ তুমি এখনও ততটা সৎ? আমি পারিনি জানো। সততা আমাকে কিচ্ছু দেয়নি, শুধু নীচু হওয়া ছাড়া। ঠকিয়েছি, চূড়ান্ত ঠকিয়েছি। সামান্য পেতে, শেষ করে দিয়েছি নিজেকে। আজ সেই নিয়ে কোনও অনুতাপ করি না। দীপ, একুশদিন আগে তোমাকে কলোনির মোড়ে দেখলাম। তেইশে জুলাই। সেদিন আমার বয়স ছিল একত্রিশ বছর তিন মাস আট দিন। আজ, ঊনত্রিশ দিন। তোমাকে দেখলাম, ডাকতে পারলাম না। মনে হল ডেকে কী বলব। কী প্রশ্ন করব? তোমার সমস্তই তো আমার জানা। সমস্ত ক্ষয়, অপরাধ। চুপি চুপি যুদ্ধজয়। তোমার স্পর্শ, লোভ, বিনয়- সবই তো জেনেছি এতবছর। তবুও অচেনা মনে হয়। মনে হয়, এই তোমাকে চিনি না। মনে হয়, কোনও দূরদেশে যাওয়ার ঠিকানা বলে দিই তোমাকে। মনে হয় উদ্ধার করি। সে ক্ষমতা আর নেই আমার। সে সমুদ্র ছিল একদিন। এখন, একমুঠো জল হয়ে আছি। পাত্রের আকার অনুযায়ী বদলে যাই। মাঝে মাঝে সে জলে নিজেরই মুখ দেখি। শুধু দীপ, তোমাকে একদিন ডাকতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, এই কলোনির মোড়ের ওপর তোমাকে ডাকি। তুমি কি শুনতে পাবে দীপ? শুনবে? তুমি কি সাড়া দেবে? এখনও কি হঠাৎ বাড়িতে না জানিয়ে তুমি সমুদ্রে চলে যেতে পারো? জানিও দীপ। ঠিকানা, তোমার অজ্ঞাত নয়। ইতি তোমারই দীপ শেখর |