দীপা মিত্র

দীপা মিত্র

 প্রিয় অমি,
জানি না, আজ এতো বছর পর তোমাকে এভাবে সম্বোধন করার অধিকার আমার আছে কিনা! তবু একদিন তুমি আমার, আমি তোমার প্রিয়ই তো ছিলাম। আজ সম্পর্কের শেষ প্রহরে দাঁড়িয়ে কেউ তাই আর কারও অপ্রিয় নাই বা হলাম!  
প্রথম প্রথম তোমার ওপর খুব রাগ হতো, জানো! ভাবতাম যে মানুষটা একটা সময় আমায় নিয়ে এতটা মত্ত থাকতো, সে কিভাবে আমার দূরে আসাটা এমন নিঃশব্দে মেনে নিল? বা আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়- কিভাবে আমাকে নিজের থেকে এতোখানি দূরে সরিয়ে দিল?
তুমিই তো সেদিন আলাদা হওয়ার কথা উচ্চারণ করেছিলে, বলো! তাই আমিও চলে এলাম অভিমান করে।  
কেন সেদিন আমায় আটকালে না, অমি?   
তোমার আমার সন্তান এ পৃথিবীতে এলো শুধুমাত্র মায়ের পরিচয়ে। কিন্তু কেন বলতে পারো? জানি, তুমি বলবে- ‘তুমিই তো জানাওনি আমায় !’    
সত্যি, জানাইনি আমি। সেদিন আকাশপথে যেতে যেতে ওই যে বললাম, বড় অভিমান হয়েছিল। সারাজীবন বাবা মায়ের আদরে মানুষ হয়েছি, বিয়ের আগেও বিদেশে ছিলাম তোমার আদরে।
দেশে ফিরে এতো লোকজনের মাঝে আমার সেই তুমি যেন ধীরে ধীরে কোথায় হারিয়ে যেতে লাগলে। এতো নিয়ম কানুন, এতো বিধিনিষেধ, আর তারই মাঝে তোমায় সেই আগের মতো করে না পাওয়া। 
সব মিলিয়ে বড় হাঁফিয়ে উঠেছিলাম, অমি! তাই হয়তো বাইরের জগতে আরও বেশি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম। নিজেকে ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় বিক্রি করে ভাবতাম, এবার হয়তো তুমি আগের মতো করে আঁকড়ে ধরবে আমায়।
কিন্তু না, ভুল ভেবেছিলাম আমি। তুমি আরও অনেক, অনেক, অনেকখানি দূরে সরে গেলে আমার থেকে। কেন অমি? কেন আমায় শাসন করে কাছে টেনে নিলে না? কেন জোর করলে না? আমি যে বড্ড আশা করেছিলাম!
আর ঈশ্বরের কি পরিহাস দেখো, একটা ফুটফুটে মেয়ে হল, তাও ঠিক তোমার মত দেখতে! কি করে ভুলবো বল তোমায়? ওর চোখ, নাক, মুখ, হাসি, হাঁটা, চলা সবটাই যে তোমার মতো!
ও যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, মনে হতো তুমিই বুঝি তাকাচ্ছো আমার দিকে। রাগ করলে পিছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে আদর করা, সেও তো একেবারে তোমার মতো!  
কি করতাম বল আমি? ওকে কাছে রেখে কি করে ভুলতাম তোমায়? তাই তো নিজের বুকে পাথর রেখে ওকে হস্টেলে পাঠিয়ে দিলাম। ভাবলাম এবার অন্তত ভুলতে পারবো তোমায়। 
কেরিয়ারে মন দিলাম। একের পর এক কাজ আসতে লাগলো। আমার তো আর তখন কোনও ভয়, ভাবনা , লজ্জা, ঘেন্না, কিচ্ছু অবশিষ্ট ছিল না। শুধু ওপরে, অনেক ওপরে ওঠার আর তোমায় ভোলার নেশা আমায় পেয়ে বসেছিল। 
কত পুরুষ যে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আমার এই শরীরটার দিকে! যে শরীরটাকে খুব ভালবাসতে তুমি, তাকে নেশায় মাতাল হয়ে ছুঁড়ে ফেলতাম ওই হিংস্র পশুদের দিকে। রাতের পর রাত! 
অমি, ঘেন্না হচ্ছে খুব? ভাবছ কি নির্লজ্জ এই মেয়ে! হ্যাঁ, খারাপ, খুব খারাপ আমি । কিন্তু কে আমাকে এতটা খারাপ বানালো বলতে পারো?  তুমি আর তোমার উদাসীনতা।  
আজ সবার চোখে তুমি মহান, বিরহী প্রেমিক। কিন্তু সে বিরহ কি তোমার একার? আমার কি কোনও বেদনা ছিল না?
রাগ অভিমান করার অধিকার কি একা পুরুষের? আর সারাজীবন ধরে তার ভার বয়ে দোষের ভাগী হওয়ার দায় কি শুধুমাত্র নারীর?  
বল অমি, চুপ করে থেকো না! আজ যে মেয়েকে দেখে তোমার পিতৃহৃদয় উত্তাল হয়ে উঠছে, নটা মাস তোমার সেই অংশকে তোমার ভালবাসার উপহার ভেবে কিন্তু এই পাপশরীরেই তো বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি আমি, এক পাহাড়প্রমাণ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে জন্ম দিয়েছি ওর। নিজেকে জোর করে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে ওকে স্বাবলম্বী করে বড় করে তুলতে চেয়েছি।  
আমার সেই কৃত্তিকাকে, যার দুটো ছোট্ট হাতের ছোঁয়ায় একনিমেষে মুছে যায় আমার মনের সবটুকু গ্লানি, আমার সেই ছোট্ট কৃতিকে,  আজ আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। না, শুধু তোমার হাতে বললে হয়তো ভুল হবে- তোমার আর লাবণ্যর হাতে দিয়ে গেলাম। ওকে মনের মতো করে তোমরা বড় করে তুলো।    
লাবণ্যকে আমি যতটুকু দেখেছি এটুকু বুঝেছি বড় শান্ত মিষ্টি মেয়ে সে।  তোমাদের ভালোই মানাবে। কৃতিকে সে হয়তো আমার চেয়েও ভালো রাখবে। 
অবশ্য লাবণ্যর কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই। তার সব দায়ভার নিয়ে আমি তার কাছে আলাদা করে ক্ষমা চেয়ে নেবো। তবে এটুকু বলতে পারি, যা করেছি সবটাই তোমায় ভালবেসে, তোমায় পাওয়ার জন্য।
তবে আজ এই শেষ সময়ে এসে বুঝতে পেরেছি- ভালোবাসা কখনও জোর করে পাওয়া যায় না, আবার জোর করে ছিনিয়েও নেওয়া যায় না। ভালবাসা তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে এক মন থেকে আর এক মনে। 
যেদিন থেকে আমার জায়গায় তোমার মনে লাবণ্য ঠাঁই পেয়েছে, সেদিনই আমাদের সব সম্পর্ক এ জন্মের মতো শেষ হয়ে গেছে। 
ভালো থেকো তুমি তোমার লাবণ্যকে নিয়ে।
তবে আমিও আজ একা নই অমি, ঈশ্বর হয়তো কাউকেই নিরাশ করেন না। তাই শোভনের মতো একজন বন্ধুকে আমি আজ আমার পাশে পেয়েছি।
মানুষটা নিঃস্বার্থে শুধুমাত্র আমার মুখে এতটুকু হাসি দেখার জন্য প্রাণপাত করছে। এ জন্মে তো পাপের শেষ নেই আমার, এ নিশ্চয়ই আমার গতজন্মের পুণ্যফল।
আমার বাংলা তো তুমি জান, তাই লিখতে গিয়েও শোভনেরই সাহায্য নিতে হল।   
ওর কাছেই  প্রতিদিন তোমাদের বাংলা সাহিত্য, আর পুরাণের গল্প শুনতে শুনতে অনুভব করছি বাংলা ভাষাটা সত্যিই বড় মিষ্টি!
তবে তোমার রবিঠাকুরকে এ জন্মে আমার সেভাবে জানা হল না! 
আমার মনে তো তোমার মতো ছন্দ নেই অমি, তাই শেষের কথাগুলো ছন্দবদ্ধ করে শেষের কবিতা লিখে যেতে পারলাম না তোমার জন্য।   
হয়তো তোমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম।    
ভালো থেকো অমি!  বিদায়!  
 
–       কেতকী
 
-ইতি
দীপা মিত্র

Leave a Reply