ডাঃ প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল

 ডাঃ প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল

প্রিয়  তথাগত,
                 
                 তোমার জন্য আজ আঁকছি সবুজপাতার মতো মনের সব জমানো কথাদের।অক্ষরে অক্ষরে গানে গানে আর রং তুলিতে যে ছবি আমরা আঁকার স্বপ্ন দেখতাম সেই সব কথাদের ব্যালকনির তাকে বেডরুমের নকশা করা বাক্সে খুব যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছি,নিয়ম করে ধূলো ঝেড়ে ভালোবাসার স্নেহের পরশ দিয়ে হাত বুলিয়ে রাখি।সকাল ছটায় নতুনগ্রামের শিল্পীদের কাছ থেকে তুমি যে বারোটা প্যাঁচালাগানো সৌখিন ঘড়িটা এনে দিয়েছিলে সেই ঘড়ির ডাকে ঘুম ভাঙে ,তারপর বাথরুমে যাই দেওয়ালের ইটালিয়ান টাইলস্ দেখি আর মনে হয় এই তো সেদিন কতো শখ করে মেহনত করে বাথরুমটা বানিয়েছিলে যাতে আমার এটকুও অসুবিধা না হয়,আর বাথরুমের জানালায় যেসব ক্যকটাস গুলো ও সুন্দর সুন্দর বোতলের মতো দেখতে টবে লাগিয়েছিলে সময়মতো জল দেই আর রোদ লাগছে কিনা খেয়াল রাখি । তখন নিজের মনে নিজেই হেসে উঠি আর ভাবি তুমি বলতে এই গাছেরাই অক্সিজেন দেয় তাই এসি লাগানোই যায় কিন্তু প্রকৃতির পরম বন্ধু গাছই লাগালাম তোমার জন্য।বছর পাঁচেক আগে আমরা একসঙ্গে দীঘা বেড়াতে গিয়ে যে ঝিনুকের ময়ূর নকশা করা আয়না টা কিনেছিলাম সেটাও তুমি বাথরুমে লাগিয়েছিলে বলেছিলে এই আয়নাটার মধ্যে শিল্পীদের ছোঁয়া আছে তাই এর মূল্য টাকার বিচারে হবেনা,আমার ও খুব পছন্দ হয়েছিল তোমার এই কথাটা। স্নান সেরে যখন পূজোর ঘরে যাই সেখানেও শুধু তুমি আছো লক্ষ্মী,গনেশ শিব এসব মূর্তি গুলো শুশুনিয়া পাহাড়ের পাথর দিয়ে বিভিন্নরকম জিনিস বানায় এরকম শিল্পীদের কাছ থেকে কিনে এনেছিলে আর ঠাকুরের বাসন গুলো এনেছিলে বেলপাহাড়ি গ্রামের একটা অনামী শিল্পীর থেকে ,মনে আছে তুমি ঔ বাসনগুলোর যা দাম হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে বেশ কিছুটা বেশিই দিয়েছিলে ,গরীব শিল্পী খুব খুশিও হয়েছিল তোমার মুখে ওনার কাজের প্রশংসা শুনে ,আমি এইসব বাসন গুলো রোজ খুব যত্নে পরিস্কার করি। বিভিন্ন রকমের ধূপদানি আর প্রদীপ দানি সংগ্রহ করা তোমার শখ ছিল তাই বাড়িতে একডজনের ও বেশি বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন শিল্পের ধূপদানি আছে তবে পূজোর কাজে মুর্শিদাবাদের খাগরাঘাটের পিতলের ধূপদানি আর প্রদীপদানি ব্যবহার করি ,আর কোন পূজোর অনুষ্ঠান হলে পাথরের রূপোর প্রদীপদানিও ব্যবহার করি। আর আমাদের পূজোর শাঁখটা ছিল বাকুঁড়ার শিল্পীদের থেকে কেনা। পূজো শেষ করে চিনিছাড়া এক কাপ গ্রীন টি খাওয়ার অভ্যেস আমার এতোদিন সেটা তুমিই বানাতে কিন্তু এখন আমাকে নিজের ব্যবস্হা নিজেকেই করতে হয়।তোমার আমার ছবিকোলাজ করা কাপে প্রতিদিন সকালের গ্রীন টি আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি ,কোন কোনদিন জানো গ্রীন টি শেষ করতে বেলা এগারোটা বেজে যায় । তারপর নিজের মতো কিছু দু এক পদ রান্না করে নিই ,দুপুরের খাবার টেবিলটা ভীষণ নিরিবিলি কোনো কথা হয়না কথা বলতে হাতা খুন্তির সাথেই যা হয় আর কি! অবশ্য সেটা আমার অভ্যেসই ছিল তুমি তো দুপুরে অফিসেই থাকতে বেশিরভাগ দিন। খাওয়া শেষ করে বেডরুমে আসি ,দেওয়াল জুড়ে আমাদের ছবির কোলাজ।হানিমুন থেকে শুরু করে যত ছোট্ট ছোট্ট জায়গায় ঘুরতে গেছি ছবছরে সব ছবি তুমি কোলাজ করে দেওয়ালে টানিয়েছিলে নকশা করা ফ্রেমে,পুরো ঘর জুড়ে শুধু তুমি আর আমি আর আমাদের সুখমুহুর্ত।তুমি খুব চালাক জানো তো আমাদের ঝগড়া মন কষাকষির কোন স্মৃতি তুমি রাখোনি ,চারিদিকে শুধুই সুখস্মৃতি আর কত কত রঙিন পাহাড় পর্বত জঙ্গল নদী এসবের ছবি। বিভিন্নরকম বিছানার চাদর কেনার ও শখ ছিল তোমার তাই বাটিকের জয়পুরি কটনের কাঁথা স্টিচের আরো কতসব চাদর আছে এখনো দু একটা একেবারে নতুন আছে,হয়তো কোন না কোনদিন সেগুলো ব্যবহার করবো । এই দুপুর গুলো ভীষণ মায়াবী ,বিশেষ করে রবিবারের দুপুরগুলো। অনেক অনেক দুপুরের খুনসুটির কথা আজও মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে । তখন আমি লজ্জা পাই আর তখনই সারা দেওয়াল জুড়ে তোমার ছবিরা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে আর দেওয়াল ঘড়িতে বিকেল চারটে বেজে যায়।আমি বিছানা ছেড়ে বাগানের দিকে যাই ,পুরানো ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে তোমার বানানো ফুলগাছের টবগুলোকে দেখি আর বিস্মিত হই মনে মনে বলি সত্যি কি ট্যালেন্ট।গাছ গুলোতে জল দেই ।আমাদের বাগানে যতো রকমের ফুল আছে তার সব কটার নাম গোত্র সব জানতে তুমি কখন কোন গাছটার কি ওষুধ কি সার লাগবে সব ,আমি তখন তো এসব খেয়াল রাখিনি ভীষণ আফশোষ হয় সেইজন্য,দুএকটা ক্যাকটাস গাছ কে বাঁচাতে পারিনি আমি ,তারাও তোমার মতো ছেড়ে চলে গেল আমাকে … এসব ভাবতে ভাবতে পাশের বাড়ির শঙ্খধ্বনি চারদিকটায় ছড়িয়ে পড়ে,খেয়াল হয়,সন্ধ্যে প্রদীপ দিতে হবে। সন্ধ্যেপ্রদীপ দিতে দিতে প্রায় সাতটা বেজে যায়।সাড়ে সাতটার মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা চলে আসে ,তোমার কথামতোই আজও আমি টিউশন পড়াই।তোমার ইচ্ছা ছিল আমি একেবারে গৃহবধূ না হয়ে কিছু না কিছু করি,নিজের একটা জগৎ তৈরি করি।কিছু মানুষের উপকারে লাগি।তাই টিউশন পড়ানো কখনো ছাড়বো না আমি,গরীব মেধাবীদের তোমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে কম পয়সায় কাউকে কাউকে পয়সা না নিয়ে ও পড়াই আমি।বেশিরভাগ বাঙালী ছেলেমেয়েরা ইংরাজীতে কাঁচা হয় তবে সেটা তাদের দোষ নয়,উপযুক্ত গাইড পায়না এইসব মফস্বলের ছাত্রছাত্রীরা তাই আমি চেষ্টা করি ওদেরকে গাইড করতে,নিজের যেটুকু যা বিদ্যা আছে তা দিয়ে।সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নটা বা দশটা অব্দি পড়াই আমি ওদের,সপ্তাহের ছয়দিন ,রবিবার ছুটি ।তবে প্রতিটা ক্লাসের জন্য দুদিন করে ,আপাতত অষ্টম নবম দশম শ্রেনীর ছাত্রছাত্রীদের পড়াই।তুমি চলে যাওয়ার পর একটু বেশি কাজের মধ্যে থাকতে চেয়েছি তাই সবদিন পড়াই,আর রবিবার টা নিজের জন্য তোমার জন্য ।
ছাত্রছাত্রীরা চলে গেলে একটু ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে নেই ।রুটি তরকারি খাই বেশিরভাগ দিন ,ওবে গরম কালে ভাত সব্জি ও খাই। দুএকটা দিন রাতে অবশ্য তেমন কিছু খাইনা ইচ্ছা হয়না ,জানি তুমি শুনলে ভীষণ রাগারাগি করবে!  
তারপর কোন কোনদিন গল্প কবিতার বই পড়ি,আবার কোন কোন দিন গান শুনি,টিভি দেখি। ঘুম না আসার রোগে পেয়েছে,ডাক্তার বলেছে ইনসোমনিয়া।এই রোগের নাকি তেমন কোন চিকিৎসা নেই,আর ঘুমের ওষুধ রোজ খাওয়া তো একেবারে ঠিক না,তবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার দেখিয়েছিলাম,তোমার ছাত্রী সঙ্গীতা কে ,কদিন খুব ভালো ছিলাম জানো,আবার কি যে হলো ! আজকাল একাকীত্বর সাথে ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে । আমার আর একা থাকতে ভয় করেনা ,তুমি জেনে খুশি হবে সোলো ট্রাভেলিং করেছি গতমাসে ,পাহাড়ে গেছিলাম।খুব এনজয় করেছি,তোমাকে সারাক্ষণ ভেবে ভেবে। আরো কত কি সব কি একটা চিঠিতে লেখা যায় নাকি !
আমার ভালোবাসা নিও…অপেক্ষায় আছি একদিন তুমিও চিঠি পাঠাবে তোমার কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য,সেদিন হয়তো আর খুব বেশি দূরে নয়,আমি তোমারই জন্য শুধু তোমারই জন্য একলক্ষ কোটি বছর অপেক্ষা করবো…


যেখানেই আছো,ভালো থেকো।

                               ইতি 
                           তোমার ভালোবাসার টিয়া পাখি

Leave a Reply