জয়িতা   সেনগুপ্ত

 জয়িতা   সেনগুপ্ত

সত্যবতীকে খোলা চিঠি…

কল্যাণীয়াসু রাগের ঠাকুর,
                নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ, সম্পূর্ণ অজানা একজন মানুষের লেখা প্রথম চিঠিতে নিজের প্রতি উক্ত সম্বোধনটি দেখে? তোমার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমি তোমার অচেনা হলেও,  তুমি আর জগৎ-সংসারের অপরিচিতা নও। বর্তমান সমাজ বা বলা ভাল, সমাজের একটা বড় অংশের পাঠককুল তোমায় এখন মর্মে মর্মে চেনে!
 পাঠককুল-
 শব্দটা মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করছে, তাই না, সত্য-?
 হ্যাঁ-
 তুমি তো শ্রীমতি সত্যবতী দেবী?
 না, শ্রীমতি সত্যবতী বন্দ্যোপাধ্যায়?
 কোন নামে তুমি বেশী স্বচ্ছন্দ, সত্য?
 আমার ধারণা, দুটোর কোনওটাতেই নয়। পাঠক হিসাবে তোমায় যতটুকু জানার সুযোগ পেয়েছি, তাতে নিজের উপর ‘দেবী’ত্ব আরোপ করার পক্ষপাতী তুমি কস্মিনকালেও নও। আর ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’র উপর থেকে নিজের যাবতীয় অধিকার তো নিজেই ছেড়েছিলে! এমতাবস্থায়, স্রেফ ‘সত্য’ই বোধহয় তোমার প্রতি চলনসই। তাছাড়া, সেই বাল্যকাল থেকে যে মানুষটা মিথ্যের সঙ্গে একবিন্দুও আপোস করেনি, ‘সত্য’ বৈ অন্য কোনও মুকুট কি তাকে মানায়!
 কিন্তু সত্যিই কি মানায় না?
 তবে তোমায় ‘রাগের ঠাকুর’ বলে ডাকার সময়, সর্বাঙ্গে অমন কাঁটা দিয়ে উঠল কেন?
 সে, বোধ করি, ওই কচি মুখখানা মনে করে!
 ওই কাচের পুতুলের মত সোনার বরণ ছোট্ট মেয়েটা, আদর করে যার নাম রেখেছিলে তুমি, ‘সুবর্ণলতা’-
 তোমার সুবর্ণকে কি তোমার এখনও মনে পড়ে, সত্য?
 সেই সুবর্ণ, রান্নাঘরের দোরের সামনে বসে যে বাবার সঙ্গে খেলত খেলনাবাটি! ভেতর থেকে হাতের কাজ সারতে সারতে তুমি শুনতে পেতে বাবা-মেয়ের টুকরো টুকরো খুনসুটির শব্দ!
 সেই সুবর্ণ, ‘মা’ মানেই লেখাপড়া, এই প্রাথমিক ধারণায়, নিতান্ত শৈশবে তোমার সঙ্গে মোটেই না বনলেও, ক্রমে বাল্যে পদার্পণ করার পর, তুমিই হয়ে উঠেছিলে যার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!
 সেই সুবর্ণ, ঘরের কাজ শেখাতে শেখাতে যাকে পদ্য আর নামতা মুখস্থ করাতে, শাক বাছতে বাছতে মুখে মুখে শেখাতে বাংলা, ইংরেজী বানান?
 সেই সুবর্ণ, বয়সছাড়া ভঙ্গীমায় পাকা কথা বলার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া তোমার ভ্রুকুটিকে যে কখনও ভয় পেত, আবার কখনও অকুতোভয়ে বলে উঠত,“রাতদিন রাগের ঠাকুর হয়েই তো আছ!”
 নিজের মায়ের এহেন অভিনব নামকরণ করা, তোমার সেই ন’বছরের আত্মজার মুখখানা কি তোমার স্মৃতির পটে আজও ভাস্বর, সত্য?
 নিশ্চয়ই তাই।
 নচেৎ নিজের মৃত্যুর আগে, ছোট ছেলে সরলের হাত দিয়ে সুবর্ণকে পাঠানো প্রথম তথা শেষ চিঠিটায় তুমি কেন লিখেছিলে, তার বেণীবাঁধা স্কুলপথযাত্রীণি বালিকারূপটি ছাড়া অন্য কোনও রূপ দেখার বাসনা তোমার নেই?
 হয়ত সত্যিই ছিল না।
 কিম্বা, পাছে সেই বাসনা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের অন্তরের দৈন্যও প্রকাশ হয়ে পড়ে সুবর্ণরই সংসারজীবনে ঘূর্ণিঝড় তোলে, তাই নিস্পৃহতার জোরে সেই ইচ্ছেকে নিজের বুকের খাঁচাবন্দী করে রেখেছিলে তুমি!
 নাকি, তোমার নিস্পৃহতার জাতক অদম্য এক অভিমান? অবচেতন মনে, তুমি প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষা করেছ, তোমার সুবর্ণর স্বতঃস্ফূর্ত পদধ্বনী শুনতে পাওয়ার জন্য? পাওনি! তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছ নির্লিপ্তির এক কঠিন খোলসের মধ্যে আর ভেবেছ, ‘তবে থাক!’-
 ভাবতেই পার।
 অভিমানকে নিজের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা তো তোমার আবাল্যের অভ্যাস!
 নিত্যানন্দপুর মাতিয়ে রাখা রামকালী কোবরেজের ছোট্ট মেয়েটা যে ঘরবসতে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার কয়েকমাসের মাথায়ই বাপেরবাড়ী থাকতে পারার তীব্র আকর্ষণকে হেলায় জয় করতে পেরেছিল বাবার প্রতি প্রচ্ছন্ন অভিমানে, তা কি সংবেদনশীল মনের বুঝতে বাকি আছে?
 এমনকি, মৃত্যুশয্যায় শায়িত স্বামীর জন্য তোমার বড়দার হাত দিয়ে তোমার ধন্বন্তরী কবিরাজ বাবার পাঠানো ওষুধ যে তুমি ফেরৎ পাঠিয়েছিলে, সেও তো ওই অভিমানের কারণেই, তাই না? বুঝেছিলে, বাবার মনে আঘাত দিচ্ছ! তবু তাঁর সশরীরে উপস্থিত হতে না পারাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারনি! তাই যে ওষুধের অপমানে একদিন তুমি জ্বলে উঠতে, সেই ওষুধকেই সেদিন প্রকারান্তরে অসম্মান করেছিলেন নিজে! কলকাতা থেকে আনিয়েছিলে, সাহেব ডাক্তার। সুস্থ হয়ে উঠেছিল, তোমার স্বামী নবকুমার।
 হ্যাঁ, তোমার জোরেই।
 কিম্বা, তোমার জেদের জোরে।
 নিজের অভিমানকে জেদের আকার দেওয়ার অসম্ভব শক্তিটা যে তোমার বরাবরই ছিল, সত্য! তাই অভিমানের সামনে কখনও বশ্যতা স্বীকার করনি! সে তোমায় পেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্বেও, শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে তোমারই চালিকাশক্তি!
 তবে তোমার মেয়েটার প্রকৃতির কিয়দংশ এমন উল্টো ছাঁচে ঢালাই করা হল কেন?
 তার জীবনটা,আচমকা কুমোরের একটা উল্টোপাল্টা চাকে পড়ে গেল বলেই কি?
 শ্রীমতি আশাপূর্ণা দেবীর তো তেমনটাই মত।
 আশাপূর্ণা দেবীকে হয়ত তুমি চিনবে না। আবার চিনতেও পার। তোমার ছোট নাতনী বকুলের বান্ধবী তিনি। ভাল কথা, বকুল মানে তোমার সুবর্ণর ছোট মেয়ে এখন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, এ কথা তুমি জানো না বোধহয়? ‘অনামিকা দেবী’ ছদ্মনামে এখন তার দেশজোড়া খ্যাতি! তা বলে, মা-দিদিমার কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধ করার গুরুদায়িত্বটাও সে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। সেটা সে তুলে দিয়েছে, নিজের প্রিয় বান্ধবীর হাতে। হয়ত, নিরপেক্ষতা রক্ষার্থেই। আশাপূর্ণা দেবীর রচিত ‘সত্যবতী ট্রিলজী’ আজ পাঠকমহলে বিপুল সমাদৃত! এই ট্রিলজীর প্রথম দুটি খন্ড ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ এবং ‘সুবর্ণলতা’, যথাক্রমে তোমার এবং তোমার মেয়ের জীবনকাহিনী। আর শেষ খন্ড ‘বকুল কথা’, তাঁর নিজের বান্ধবীর।
 আচ্ছা সত্য, তুমি কি এই ট্রিলজী পড়েছ?
 সম্ভবত, নয়।
 পড়লে, তোমার সুবর্ণকে লেখা চিঠিতে কখনও লিখতে পারতে না,‘আজ তুমিও আমার অপরিচিত। আমিও তোমার অপরিচিত।”-
  পরের লাইনেই অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিলে, ‘কিন্তু সত্যই কি তাই?– তবু সমস্ত চিঠিটা পড়তে পড়তে মনে হয়, তাকে সবটুকু চিনে, বোধহয় তুমি উঠতে পারনি। না পারাটাই স্বাভাবিক। তুমি চেয়েছিলে, তোমার সুবর্ণকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে। পরিবর্তে, ন’বছরের শিশুটাকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হলেন, তার মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ বাবা! তাও তোমার অজ্ঞাতসারে! তুমি সইতে পারলে না এতবড় প্রতারণা! যখন বুঝলে, এই পুতুলখেলার বিয়েটা ভেঙে নিজের মেয়েকে বের করে আনা কার্যত অসম্ভব, তখন তোমার বৈপ্লবিক মাতৃত্ব তোমায় বাধ্য করল, তিল তিল করে নিজের হাতে সাজানো সংসার ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে! তুমি অনুভব করলে, তার অসারত্ব! তাই নিজের সারবস্তু আত্মবিশ্বাসটুকু নিয়ে পথে নামলে, আরও সহস্র সার্থক ‘সুবর্ণলতা’ তৈরীর স্বপ্ন চোখে এঁকে!
 কিন্তু তোমার সুবর্ণ?
 তার জীবনের প্রবাহ এমন ছন্দছাড়া হওয়ার দায় কার?
 আংশিক তোমারও নয় কি?
 একটা সময় পর্যন্ত তেমনটাই ভাবতাম। ক্রমে সেই ভুল ভাঙল। বুঝলাম, তোমার অনুপস্থিতি সুবর্ণর জন্য আশীর্বাদ না হলেও, অভিশাপ নয়। মনে আছে সত্য, সংসার ত্যাগ করার সময় ননদ সৌদামিনীকে বলে গিয়েছিলে,“সুবর্ণ যদি মানুষ হওয়ার মালমশলা নিয়ে জন্মে থাকে ঠাকুরঝি, তবে হবে মানুষ, নিজের জোরেই হবে…”? এর চেয়ে বড় সত্যি বোধহয় আর হয় না! সহজাতভাবেই, তোমার সুবর্ণর মধ্যে ছিল মানুষ হওয়ার মালমশলা। তোমার অনুপস্থিতি, তাদের সক্রিয় করে তোলার সহায়ক হয়েছিল। উপস্থিতি, হয়ত এতটা কার্যকারীতা সরবরাহ করতে পারত না। পরিবর্তে, তোমার সঙ্গে সৃষ্টি হত, হয়ত নিত্য নতুন সংঘাত! কে বলতে পারে, প্রতিনিয়ত তোমার আর সংসারের মধ্যবর্তিনীর ভূমিকায় যুঝতে যুঝতে সুবর্ণই একদিন তোমার চোখের সামনে অচেনা হয়ে যেত না?
 তার চেয়ে, এই ভাল।
 তোমার সুবর্ণর সান্ত্বনা, ‘যে বস্তু ছিল না, তার আবার হারানো কী?’–
 কিন্তু যাবতীয় লোকসানের ভাগীদার কি একা সে?
 তুমি নও?
 চিঠিতে যে সংশয় প্রকাশ করে গেলে, সুবর্ণ তোমার ‘কথা’ বুঝতে পারছে কিনা, এর চেয়ে বড় ঠকে যাওয়া হয়?
 তুমি তো জানতেই পারলে না, তোমার ‘কথা’, তোমার সুবর্ণর ‘বর্ণপরিচয়’!
 হ্যাঁ, সত্য-
 সাদা চোখে, ছোট্ট মেয়েটার ওই ন’বছর বয়সের পর থেকে, আর মা ‘ছিল না’!
 কিন্তু অনুভবে-চেতনায়-ব্যাকুলতায় যে, সেই মুহূর্ত থেকে তোমার সুবর্ণর তুমি ছাড়া আর কেউ ‘ছিল না!’
 শুনে অবাক লাগছে?
 অল্পবিস্তর শিহরণও জাগছে কি?
 লাগা অস্বাভাবিক নয়।
 জাগাও প্রত্যাশিত।
 কিন্তু এটাই সত্যি। যে মুখ তার কার্যত ভুলে যাওয়ার কথা, সেই মুখই তার মনের আকাশে আমৃত্যু জ্বলজ্বল করেছে ধ্রুবতারার মত! তাকে পথ দেখিয়েছে! তার দ্বন্দ্বমোচন করেছে নিরন্তর! হয়ে উঠেছে, তার মনস্ত্বাত্বিক জগতের একমাত্র অবলম্বন!
 তা বলে, এমনটা ভাবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই, তোমার প্রতি সুবর্ণর ছিটেফোঁটাও অভিমান ছিল না! অন্তত ন’বছরের ছোট্ট অবুঝ শিশুটা যখন অবিরত  তার মাতৃনিন্দায় শ্বশুরবাড়ী মুখর হয়ে উঠতে দেখত, তখন মায়ের প্রতি মূঢ় অভিমানেই পাথর হয়ে যেত সে! অনুষঙ্গ ছিল, মাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা!
  কিন্তু যত বয়স বাড়ল, তত যেন তোমার সার্থক আত্মজা হয়ে উঠতে আরম্ভ করল তোমার সুবর্ণ! ওই দর্জিপাড়ার চাটুজ্যেবাড়ীর মানুষগুলো তো কম চেষ্টা করেনি, তাদের মেজোবৌয়ের চৈতন্যকে তোমার প্রভাবমুক্ত করতে! শেষপর্যন্ত সফল হতে পেরেছে কই? বরং তাদের প্রতিটি ব্যর্থ চেষ্টাই, সুবর্ণর চৈতন্যে তোমাকে করে তুলেছে মূর্ত থেকে মূর্ততর !
  সত্য, তুমি কি জানো, যে শিশুটা সেই নবছর বয়সের পর নিজের মায়ের মুখদর্শনটুকু পর্যন্ত করার অবকাশ পায়নি, সেই শিশুটার হৃদয়সিন্দুকে তাঁর মা আজীবন বন্দী ছিল, তার একমাত্র রাজৈশ্বর্য হয়ে? তোমার কি বিন্দুমাত্র
ধারণা আছে, সুবর্ণর জীবনে নিজের অবস্থান সম্বন্ধে? নেই। থাকবার কথাও নয়। তবে আজ জেনে নাও। তুমি ছিলে তার ঈশ্বর!
  হ্যাঁ–
  ন’বছরের সুবর্ণলতা নিজের মাকে হারিয়েছিল!  
  বদলে যাকে পেয়েছিল, সে তার ধর্মদাত্রী!
  তুমি হয়ত বলবে, সে তো সবার ক্ষেত্রেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মা মাত্রই কি ঈশ্বর? পেরেছিলেন তোমার শাশুড়ীমা, তোমার স্বামীর ঈশ্বর হয়ে উঠতে? কিম্বা তোমার বেয়ান, তোমার জামাইয়ের জীবনে ? তুমিই কি পেরেছিলে, তোমার বড় ছেলে সাধনের মননে সেই প্রভাব বিস্তার করতে?
  পারনি।
  পারা যায় না।
  নিষ্ঠুর শোনালেও,’কুপুত্র যদ্যাপি হয়, কুমাতা কখনও নয়’– আদপে একটি একপাক্ষিক পক্ষপাতদুষ্টতার নিদর্শনমাত্র।
  এমনকী, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’কেও সর্বজনীন ক্ষেত্রে সার্থক প্রবাদ বলা চলে না।
  তাই, ‘জননী’ থাকা সত্ত্বেও,সন্তান প্রয়োজনীয়তা বোধ করে উপদেষ্টার। বিপদে – আপদে স্মরণ নেয় ঈশ্বরের। সেই উপদেষ্টার নাম, গুরু। সেই ঈশ্বর, কয়েকটা মাটির পুতুল। অবিরত তাদের নিয়ে খেলা করতে করতেই মানুষ ভাবে, বুঝি কেটে ফেলছে স্বর্গে পৌঁছনোর পথ! প্রকৃত স্বর্গসুখের নাগাল আর পায় কজন ?
   তোমার সুবর্ণও পায়নি ।
   কিন্তু চেয়েছে আমৃত্যু ।
   তার সেই স্বর্গধাম, কৈলাশ বা বৈকুণ্ঠ নয়।
   তোমার বাসস্থান, কাশী!
   তার আরাধ্যা, তার মা, সত্যবতী !
   হ্যাঁ, সত্য–
   তোমার মুখোমুখী, অন্তত একটি বারের জন্য দাঁড়াতে পারাই ছিল, তোমার আত্মজার আমরণের সাধনা! তার প্রতিটি শ্বাস – প্রশ্বাস, তোমার কাছে পৌঁছানোর অপেক্ষামাত্র! ইচ্ছেয় – অনিচ্ছেয় যতগুলি সন্তানকে সে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে, তাদের মানুষের মত মানুষ করে তোলার চেষ্টাতেও সর্বস্ব পণ করেছে, ওই একটিমাত্র লক্ষ্য সামনে রেখে! তার স্বপ্ন ছিল, এরা এমন মানুষ হবে, যেমনটা হলে,  মানুষ সংজ্ঞার মান রেখে, যাবতীয় সামাজিক – সাংসারিক ঠুনকো বাধা অতিক্রম করে মাকে পৌঁছে দেওয়া যায় তাঁর দীর্ঘঅদেখা মায়ের কাছে! আর তারপর…
  তারপর যে কি, তা সম্ভবত সুবর্ণর নিজেরও জানা ছিল না। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও কারণ, সন্তানদের ‘মানুষ’ করে তোলার আশা, তার পূরণ হয়নি। কিম্বা আংশিক হলেও, সেই পূর্ণতা সে দেখে যেতে পারেনি। আর তাই বোধহয় বারংবার বশ্যতা স্বীকার করেছে অভিমানের সামনে ।
   হ্যাঁ–
  এই উল্টো ছাঁচের কথাই পূর্বে উল্লেখ করেছি।
   সত্য, তোমার মেয়ে প্রকৃতিটি পেয়েছিল তোমারই। তোমার আদর্শেই উদ্ধুদ্ধ ছিল তার জীবন। মননে বুনে দেওয়া তোমার স্বদেশচেতনাই তাকে স্পর্ধা যুগিয়েছে, অচলায়নের বুকে বস্ত্রযজ্ঞের ধ্বজা ওড়াতে! তোমার ‘বিদ্যেই আসল’ মন্ত্র জপতে জপতে পেরিয়ে গেছে তার সারাটা জীবন। সেই দীপ্তি, সেই ঔজ্জ্বল্য যা একদিন তোমার ব্যক্তিত্ব থেকে ঠিকরে বেরোত, তা সমৃদ্ধ করেছে সহস্র মাইল দূরে থাকা তোমার মেয়েকেও! ঠিক তোমারই মত চিরকাল শিক্ষার – সাম্যের – রুচির – উদারতার – মুক্তচিন্তার পূজারী তোমার মেয়েও অন্যায়ের কাছে হার মানেনি! মেনেছে, কেবল আত্মাভিমানের কাছে!
  হ্যাঁ–
  শত পরাজয়েও মেরুদন্ড টানটান রেখে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মানুষটা, একমাত্র অভিমানের আঘাতেই কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়েছে মৃত্যুর সামনে! মৃত্যু যদিও তার বিশ্বস্ততার মান রাখেনি! ফিরিয়ে দিয়েছে জীবনের কোলে! তবু, সে বারংবার আত্মসমর্পন করতে চেয়েছে মৃত্যুর হাতেই!
   আচ্ছা সত্য, তোমার আত্মজাকে কি এই আত্মহত্যার চিন্তা শোভা পায়?
   তুমি থাকলে কি এই চেষ্টাদের ভর্ৎসনা করতে?
   না, তোমার উপস্থিতিতে আত্মহননের চিন্তা বা চেষ্টারা মাথা তুলে দাঁড়াবারই ফুরসৎ পেত না সুবর্ণর ভাবনার জগতে?
  বোধহয়, তৃতীয়টাই ।
  তাই একসময় প্রায়শই মনে হত, যদি একবার তোমার সুবর্ণকে তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম, মেয়েটা মরার আগেই অমন ভাবে মরে যেত না! হয়ত, তোমার সান্নিধ্যই হয়ে উঠত তার বেঁচে থাকার প্রেরণা! হয়ত অজস্র স্বপ্ন দিয়ে তোমার নিজের হাতে গড়ে তোলা কাশীর ইস্কুলটার দায়িত্ব, তোমার অবর্তমানে, বর্তাতো তোমার মেয়ের কাঁধে! হয়ত কাশীর বুকেই গড়ে উঠত আর একখানা ‘মেজগিন্নীর পাঠশালা’! হয়ত…
  এমন অজস্র ‘হয়ত’র ফুলেই, একসময় গাঁথার চেষ্টা করেছি, এক অনন্ত স্বপ্নিল সম্ভাবনার মালা! পরে বুঝেছি, যা হয়, মঙ্গলের জন্যই। তোমার সঙ্গে সুবর্ণর চিরঅসাক্ষাৎও সেই মাঙ্গলিকেরই নিদর্শন। নচেৎ কে বলতে পারে, তোমার কাছে গিয়ে পড়লে, তুমিও চেনা ছকের সাবধানবাণীতে তার তৃষিত হৃদয়কে জর্জরিত করে তুলতে না? কে বলতে পারে, তাঁর পিছুটানদের কথা স্মরণ করিয়ে তুমিও তাকে ফিরে যেতে বাধ্য করতে না দর্জিপাড়ার ওই অচলায়তনে? সে যে আরও ভয়াবহ হত ! নিজের ‘কূল ভেঙে অকূলে ভাসা’ মায়ের সঙ্গে ভাসতে এসে, নিজেই অকূলপাথারে তলিয়ে যেত মেয়েটা! সে মরণ বুঝি, আত্মহত্যা নয়, হত্যার সমান!
   তাঁর চেয়ে, এই ভাল।
   সুবর্ণ চিরকাল জেনেছে, তার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে আর কেউ গর্জে না উঠুক, তার মা উঠেছিল! অতএব, যদি কোনওভাবে কোনওদিন সে তোমার কাছে পৌঁছতে পারত, তুমি তাকে নিশ্চয়ই ফেরাতে না! ঠেলে দিতে না, তার অপদার্থ বাবার মত ফের অপমানের নরককুণ্ডে! বরং হয়ে উঠতে তার ঢাল! খুঁজে দিতে, তাকে বেঁচে থাকার কারণ! ঠিক তার কল্পনার মত !
   সত্য, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, এতকাল বাদে আজ হঠাৎ এই দীর্ঘ চিঠিতে, তোমায় এত কথা লেখার কারণ কী? কারণ, স্রেফ তোমার সংশয়মোচন। সুবর্ণকে লেখা তোমার চিঠিটায়, তুমি বেশ কয়েকটি ‘হয়ত’ ব্যবহার করেছ। সেগুলি থেকে সহজেই বোঝা যায়, সুবর্ণর ভেতরে মানুষ হয়ে ওঠার মালমশলার উপস্থিতি নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকলেও, সেগুলি পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে কতটা ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সে বিষয়ে তুমি যথেষ্ট সন্ধিহান। এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য, সেই দ্বন্দগুলি থেকে তোমায় মুক্তি প্রদান। তোমার গর্ভের ছাঁচটি যে পরিপূর্ণরূপে তোমার মনের ছাঁচের নাগাল পেয়েছে, এই তথ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়ার পর, আশা রাখি, তোমার মনেও কোনও গ্লানি থাকবে না।
   আর বেশী কী লিখব? এমনিতেই, পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলেছি। জানি না, পড়তে পড়তে তোমার ধের্যচ্যুতি ঘটবে কিনা। তুমি এখন পরলোকের বাসিন্দা। নিশ্চয়ই সেখানেও একটা মেয়েদের ইস্কুল খুলে, মজে গেছ শিক্ষার বিস্তারের কাজে! তবু আকাশের ঠিকানায় এই চিঠিটা পাঠালাম তোমার নামে। সময় করে পড়ে দেখ, কেমন?
  ভাল থেক, ভাল রেখ। দ্বিতীয়টিতে তুমি অভ্যস্থ। এবার, প্রথমটির প্রতি যত্নবতী হয়ো! সত্য চিরনবীন, চির সুকুমার। তাই সে বয়োঃজেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, তার কল্যাণকামনায় ‘কল্যানীয়াসু’ লেখার অধিকার আমার আছে বলেই মনে করি। আর দোহাই, এ চিঠির উত্তর দিও না! কিছু অপেক্ষার অবসান , না হওয়াই বাঞ্ছনীয়!
ইতি,
তোমার নিত্য পূজারিণী।
____________________________
সত্যবতী – প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসের নায়িকা
নবকুমার – সত্যবতীর স্বামী
সুবর্ণলতা – সত্যবতীর মেয়ে
রামকালী – সত্যবতীর বাবা
বকুল – সুবর্ণলতার ছোট মেয়ে
চাটুজ্যেবাড়ি – সুবর্ণর শ্বশুরবাড়ী
কাশী – গৃহত্যাগের পর সত্যবতীর ঠিকানা।
 

Leave a Reply