জয়িতা ঘোষ হালদার
সহজিয়াপুর জেলা – বর্ধমান ১৩/৮/২০২২. মিস্টার সুখময় সেন , হ্যাঁ, তোমার নাম কোনোদিনই এভাবে মুখে উচ্চারণ করি নি। কিন্তু,আজ লিখলাম।তুমি হয়তো খুব আশ্চর্য হয়ে যাবে, জানি। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে যেতে পারো নি — এ বিশ্বাস আমার আছে। হঠাৎ,প্রায় পনেরো বছর পর তোমাকে কেন চিঠি লিখছি তাই নিয়ে তো তুমি বেশ ধাঁধায় পড়ে গেছো এতক্ষণে! যাক্,ভণিতা ছেড়ে এবার আমার এই পত্রের অবতারণার কারণটা লিখেই ফেলি।তোমার সঙ্গে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে কোনদিনও তোমার সঙ্গ পাই নি মানসিকভাবে।অযথা , মানসিক চাপ ও বিভিন্নভাবে শারীরিক অত্যাচার আমাকে ক্লান্ত -বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। তুমি দেখেও দেখো নি। তোমার ও তোমার পরিবারের অভিযোগ ছিল আমি কেন নিঃসন্তান! তুমি সত্যিকথাটা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমার সমস্ত ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট লুকিয়ে রেখে আমাকেই অপরাধী করে রেখেছিলে সকলের কাছে।প্রতি পদে পদে আমাকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হতো। তুমি কখনো এতটুকু আমার স্বপক্ষে কোন কথা কাউকে বলতে না।উল্টে গরীবের ঘরের মেয়ে না হওয়া স্বত্ত্বেও মিথ্যে অপবাদ দিতে। এতকিছু করতে পারার একটাই কারণ ছিল —- আমি তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমার বাবা তাঁর অফিসের উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে বিয়ের ঠিক করেছিলেন। কিন্তু, আমার ভালবাসাকে মূল্য দিয়ে তিনি নিজে তোমার হাতে আমাকে তুলে দিয়েছিলেন। তুমি অত্যন্ত সুপুরুষ।তাই আমার বাড়িতে শেষ পর্যন্ত কেউই আপত্তি করে নি। তাছাড়া তোমার ব্যবসাও ছিল আন্তর্জাতিক স্তরে।তাই আমার শ্বশুরবাড়ি প্রসঙ্গে কোনো কথা কাউকে বলি নি আমি কখনো —- এই সুযোগে তুমি চিরদিন যথেচ্ছাচার করে গেছো আমার সঙ্গে। খুব অবাক লাগে –আমি তোমাকে এতটুকু চিনতে পারি নি বিয়ের আগে।ফুলশয্যার রাত হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে এক বিভীষিকাময় অনুভূতি। তোমার আচরণে তোমাকে প্রেমিক নয় পশু বলেই মনে হয়েছিল সেদিন। তবুও,অন্ধ ভালবাসা আমাকে তোমার কাছ থেকে ফিরে যেতে দেয় নি। ধীরে ধীরে পাঁচ -পাঁচটি বছর প্রেমের অভিনয়ে আমি নিজেই নিজেকে সামলে রেখেছিলাম।নিজে বিয়ে করে আবার ফিরে যাবো বাপের বাড়িতে!সে তো হতেই পারে না। তা—- এই দুর্বলতা তুমি জানতে খুব ভালো মতো।তাই যথেচ্ছ বিকৃত যৌনাচারের প্রতিফলন তোমার শরীরে তোমার প্রতিটি চালচলনে আমার চোখে পড়তো। তুমি এসব কথাই জানো— তবুও আজ প্রাণখুলে শেষবারের মতো তোমাকে সবকিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। যা জানা ছিল না তোমার—- সেটা বলি এবার। তোমাদের সকলের অলক্ষ্যে আমি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করি। সেখানে মহিলাদের জন্য নিরাপত্তা ও কাজের সন্ধান করতাম।কারণ, আমার পক্ষে তোমাদের বাড়ির ও তোমার এত নেগেটিভ প্রভাব আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। অধিকাংশ সময় একা ঘরে, আমার আরাধ্য দেবতার ছবি সামনে রেখে ধ্যান করতাম।প্রতিক্ষণে প্রার্থনা করতাম,বিশ্বের অসহায় মানুষের পাশে যেন দাঁড়াতে পারি। তোমাদের বাড়ির পরিবেশ আমার জন্য নয়—- তা বেশ বুঝেছি ততদিনে। কিন্তু, বিভিন্নভাবে ব্যর্থ হতে হতে শেষ পর্যন্ত আমি একটা ছোট্ট মিশনে কাজ পেয়ে গেলাম। ওখানে মাতাজী আমাকে দেখা করতে বললেন। মনে আছে তোমার? একদিন অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখতে না পেয়ে তুমি একের পর এক ফোন করেছিলে। আমার ফোনটা সায়লেন্ট করা ছিল।কারণ, আমি তখন মিশনে প্রার্থনায় বসেছিলাম সকলের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে তোমার প্রচন্ড রোষের শিকার হয়ে বেশ মার খেয়েছিলাম। তোমার মা সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন — আমি দেহ-ব্যবসায় নেমে গেছি। এতটা অপমানেও আমি মুখ বুজে ছিলাম। আমার থাকার জায়গা যেখানে ঠিক হচ্ছিল, সেখানে ষড়রিপুকে সংযত করতে না পারলে আমার যে ঠাঁই হবে না……… ধীরে ধীরে ঐ প্রচন্ড বিরুদ্ধ পরিবেশেও আমি নিজেকে তৈরী করে—-একদিন অবশেষে সকলের অজান্তেই বাড়ি ছাড়লাম।তোমরা বোধহয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলে। সেইসাথে আমিও। স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যখন এক কাপড়ে আমার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে মিশনের মাতাজীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী একটি গ্ৰামে গিয়ে উপস্থিত হলাম — মনে কোনো সংশয় ছিল না।কারণ, তোমাদের সঙ্গে থেকে যে তীব্র অশ্লীলতা আমি দেখেছি তার থেকে এই জীবন অনেক ভালো হবে এই বিশ্বাস আমার ছিল। অনুন্নত গ্ৰাম , এখানকার সহজ-সরল মানুষ, অশিক্ষিত স্নেহময়ী মায়েরা আমকে মেয়ের মতো ঘরে তুললো। জানো, আমি আজ প্রায় তিরিশজন সন্তানের মা। তোমার সঙ্গে থাকার সময় বেশ কয়েকবার আমার মনে হয়েছিল আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু,আজ আমি বুঝতে পারছি কেন আমার প্রাণ এত মূল্যবান করে ঈশ্বর আমাকে এই পথে নিয়ে এলেন। আমি উচ্চশিক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের কাছে ছিলাম চরম অশিক্ষিত।আর আজ আমি এতগুলি সন্তানের শিক্ষিকা এবং মাতৃসমা।এমন কি গ্ৰামের সবাই আমার কাছে এসে খুব আনন্দ পায় , শান্তি পায়।সহজ- সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো আমাকে খুব বিশ্বাস করে,ভালবাসে। ওদের আমি কি শেখাই জানো —-মানুষ হতে শেখাই।পরস্পরকে ভালবেসে সাহায্য করতে শেখাই। পড়াশোনা শিখে পন্ডিত হওয়া যায় কিন্তু মানুষ হওয়া যায় না। আমি চাই ওরা শিক্ষিত মানবিক মন নিয়ে বড় হয়ে উঠুক। এরপর যখন ওরা সাবলম্বী হয়ে দেশের সেবায় কাজ করবে তখন আমাদের দেশের প্রকৃত উন্নতি হবে।সেই স্বপ্নের দেশে নারী-পুরুষ সমানাধিকার,মর্যাদা পাবে প্রতিটি সংসারে। সংবিধানে লিখিত আইনে কখনো সংসার সুন্দর হয় না।যদি ছোটবেলায় উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হয় তবে ,কোনো আইন লাগে না —- সঠিকভাবে জীবন সাজাতে। যাক্,এ সবই তোমার অপছন্দের কথা — আমি জানি। কিন্তু,এটুকু বলি আমি গর্বিত আমি তোমার সন্তানের মা নই—- আমি আমার গরীব দেশের অসংখ্য সন্তানের মা। আমি খুব আনন্দে আছি।এ এক পরমানন্দ। এখানে মানুষের টাকা-পয়সা,গয়নাগাঁটি,জামা-কাপড় কোনো কিছুর বাহুল্য নেই।তাই ওদের সঙ্গে ওদের ঘরের মেয়ে হয়ে আমি খুব সুখী। অনেক অনেক অভাব স্বত্ত্বেও — আমি শান্তিতে আছি। এসব কথা তোমার না জানলেও কিছু আসে যায় না আমি জানি। তবুও জানালাম —- আমি মরে যাই নি। আমি বিপথে যাই নি। আমার এতগুলো অনাথ সন্তানের মা ডাক আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। তুমি কি বাবা ডাক শুনতে পেয়েছো? জানি না —- ডাক্তারি পরীক্ষায় তুমি জেনেছিলে তুমি বাবা হওয়ার যোগ্য নও।তাই বৃথা পুরুষত্বের আস্ফালন দেখিয়ে আমাকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু আমি শেষ হই নি। বরং, আমি সমাজের প্রতি আমার কর্তব্য পালন করে ধন্য হয়েছি। তুমি ও তোমরা সমাজের কলঙ্ক । তোমাদের মতো একজনও কখনো ভাবে না আমাদের গরীব দেশে নিজে আত্মমগ্ন হয়ে বেঁচে থাকাটা বেঁচে থাকা নয় — শুধুমাত্র আর পাঁচটা প্রাণীর মতো জীবনধারণ করা। মানুষ হওয়ার কোনো যথার্থতা তোমাদের কাজে প্রকাশ পায় না। যাক্, এবার তোমার কাছে আমার শেষ বিদায়ের পালা।দিনের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। চারিদিকে পাখিরা ঘরে ফিরছে—– নিজের বাসায় , নিজের শান্তির নীড়ে,নিজের শিশুদের মাঝে।আমিও বিরাট এক পরিবারে সকলের কাছে ফিরে এসেছি যা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আমার সম্পর্কে অনেক ভুল, অনেক মিথ্যে সাজিয়ে তোমরা তোমাদের আর নীচে নামিও না। আমার অবশ্য এতে কোনো ক্ষতি নেই। তবুও মনে হলো এটাও বোধহয় আমার দায়িত্ব —– পাপের পথ সুস্থ মানুষের জন্য নয়।তোমরা আমার সঙ্গে চরম শত্রুতা,প্রতারণা করেছো। আমার জীবনের পথে তাই মানবিকতার শিক্ষাই আমার শ্রেয়—— সকলে ভালো থাকুক।সুচিন্তায় নিজেকে সমর্পণ করুক। এজন্যই আজ বিবেকের তাড়নায় এই চিঠি লিখতে বাধ্য হলাম —- ভালো থেকো তোমরা সবাই। ইতি —– তোমাদের পরিবারের অতীতের এক অবাঞ্ছিত সদস্যা—– মাতা গৌরী। ঠিকানা: শ্রী সুখময় সেন ৩৭ নং রাজবাড়ি লেন কলকাতা ——৭০০০৫৬. পশ্চিমবঙ্গ |