জয়ন্ত শীল

জয়ন্ত শীল

মা,
ভালোবাসা,কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাস পূর্ণ হৃদয় আজ তোমাকে এই পত্রখানি লিখিতেছি। তোমার প্রতি পত্র লিখিব তাহাতে কোন স্বার্থ থাকা উচিত নয়, কারণে-অকারণে তোমাকে পত্র লেখাই যায়। ইতিপূর্বে কখনো তোমার প্রতি পত্র লিখি নাই বা লেখার সৌভাগ্য হইয়া ওঠে নাই।অদ্য হঠাৎ করিয়া তোমায় পত্র লিখিতে বসিয়াছি  তাহার একটি কারণ অবশ্যই আছে।যে কারণেই লিখিতে বসিনা কেন,সেই কারণ গৌণ! তোমায় পত্র লিখিতেছি, ইহাই আমাকে তৃপ্তি প্রদান করিবে। আমি এই পত্রের মাধ্যমে তোমার নিকট আমার মনের সম্পূর্ণ অবস্থা প্রকাশ করিবার প্রয়াস করিব, কিছু ভুল-ত্রুটি হইলে সেই ভুলকে পুত্রের ভুল ভাবিয়া তুমি ক্ষমা করিবেই করিবে ইহা আমি জোরপূর্বক আশা করিতে পারি।
যেই মুহুর্তে তোমায় পত্র লিখিব বলিয়া মনস্থির করিলাম, সেই মুহূর্তেই তোমার সম্বন্ধে আরও আরও বেশি জানিতে আগ্রহী হইলাম। তৎসত্ত্বেও,তোমার সম্বন্ধে খুবই স্বল্প জ্ঞান লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছি। তোমার সম্বন্ধে জানিয়া,  আমি হতবাক হইয়াছি। এই আমি কাহার সন্তান!  আমি এত,এত পবিত্র!  নিজেকে এত পবিত্র কেন বলিলাম! তুমি এই কথাটি শুনিয়া নিশ্চয়ই অবাক হইতেছ। না, অবাক হইবার কিছু নাই, পবিত্র না হইলে তোমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব হইতো না।তোমাকে দেশমাতা হিসাবে পাওয়ার সৌভাগ্য হইতো না। সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য এত দান, এত ত্যাগ তুমি ব্যতীত অন্য কেউ করিয়াছে বলিয়া সন্ধানে পাইলাম না।  ভবিষ্যতে কেহ করিবে না ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অন্য কোন ভূমি তোমার দানের বিন্দুমাত্র  করিলেও আমরা মানব জাতি তাহার কাছে চির-কৃতজ্ঞ থাকিতাম। আমি নিশ্চিত, যতদিন অতিবাহিত হইবে তোমার প্রভা আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হইবে। তোমার দীপ্তিতে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হইবে। অতীতে তুমি যেমন শিক্ষার আলো দেখাইয়াছ,  নানা ক্ষেত্রে আচল ভরা অকৃপণ দানে লিপ্ত রহিয়াছো, ভবিষ্যতেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিবে। ভবিষ্যৎকালেও তুমি একই চরিত্রের পরিচয় দিবে। শতশত বছর ধরিয়া বিদেশি জাতির ভয়ংকর অত্যাচার সহ্য করিয়াও তুমি তোমার অবস্থানে অনড়। বারংবার তোমার ভান্ডার লুণ্ঠন করা হইয়াছে। কখনও বর্গীরা, কখনো হুনরা, আবার কখনো ওই দুর্ধর্ষ ভয়ঙ্কর ইংরেজরা তোমাকে লুণ্ঠন করার চেষ্টা করিয়াছে। বারংবার তুমি তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়াছো। এত আক্রমণ এত শোষণের পরেও তোমার ভান্ডার শুন্য হয়নাই উপরন্তু উপচাইয়া পড়িয়াছে। তোমার ভান্ডার হইতে নানা সম্পদ চুরি করিয়া বিদেশীরা কুলীন হইয়াছে। তোমার সন্নিকটেই আসিয়াছে সেই তোমার পুণ্য স্পর্শে  ধন্য হইয়াছে।কখনো বিদেশীরা তোমার ঝুলি হইতে জ্ঞান সঞ্চয় করিয়া নিজেকে সমৃদ্ধ করিয়াছে, আবার কখনও কোন বিদেশী কোহিনুর চুরি করিয়া পলায়ন করিয়াছে। আবার কেহ কেহ তোমার কাছে আসিয়া তোমাতে বিলীন হইয়াছে।  নানা যন্ত্রণা নানা কষ্টের পরেও তুমি দিন প্রতিদিন রত্ন ধারণ করিয়াই চলিয়াছো।
বিশ্বের যত মানবমনের উন্নয়নকারী ভাব সমূহ বাহির হইয়াছে, আর যত বিদ্যা আছে অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে অধিকাংশ মূল সব তোমাতেই। আমি জানিয়া গর্বিত ও সমৃদ্ধ হইয়াছি, তথাকথিত শিক্ষিত জাতির যখন অস্তিত্বও ছিল না, ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষরা যখন গভীর অরণ্যে অসভ্য অবস্থায় নিজেদের রঞ্জিত করিত, তখন তুমি তোমার সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা লাভের ব্যাপারে সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছিলে। বর্বর পাশ্চাত্যের সাথে তোমার তুলনা চলে না, তোমার সাথে কারো তুলনা টানার অর্থ তোমাকে নিম্নগতি দেখানো। তোমার জয়গান,গুনগান করা এইটুকু পত্রের মধ্যে সম্ভব নয়  বা আমার কলেমের সেই সামর্থ্য নাই। তোমার জয়গান,গুনগান তোমার সুপুত্ররা অন্য নানা স্থানে করিয়াছে এবং তাহাতে তোমার মুখ উজ্জ্বল হইয়াছে। তোমার এত উজ্জ্বল ইতিহাস,উন্নত ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহ্যশালী সংস্কৃতি থাকা সত্বেও কিছু অবুজ সন্তানের কুসংস্কারের জন্য তোমার অগ্রগতি কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মা তুমি রত্নগর্ভা যখনই তুমি ক্ষণিকের জন্য থমকে দাড়িয়েছে, তখনই কোন না কোন রত্ন তোমার গর্ভে উপস্থিত হইয়াছে। তোমার সুপুত্ররা নানা সময় নানা পরিস্থিতিতে উপস্থিত হইয়া পরিস্থিতির সঠিক বিচার করিয়া তোমার অন্য সন্তান-সন্ততিদের বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছে। থাক আজ আর তাহাদের কথা নাই বা বলিলাম। তুমি তো সবই জানো, অহেতুক সেই প্রসঙ্গ টানিয়া পত্রকে দীর্ঘায়িত করিলাম না।
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি,  স্বাধীনতা লাভের পরেও তুমি নানান সমস্যায় জর্জরিত ছিলে। ১৯৪৭ এর পর বহিঃশত্রু চীন, আর তোমারি অঙ্গচ্ছেদ করিয়া উৎপন্ন করা ওই পশ্চিমী দেশ পাকিস্তান  বারংবার তোমাকে আক্রমণ করিয়াছে,  কিন্তু না তোমাকে পরাস্ত করিতে পারে নাই,তোমার বীর সন্তান-সন্ততিরা  নিজেদের প্রাণের মূল্যও তোমাকে রক্ষা করিয়া নিজদের কে যোগ্য প্রমাণ করিয়াছে। তাহাদের জন্য তোমার গর্বে মাথা উঁচু হয় ইহা আমরা আনুভব করিতে পারি। চীন, পাকিস্থান জেটকু ক্ষতি করিতে পারে নাই তা হইতে আভ্যন্তরীণ শত্রুরা তোমাকে বেশি লজ্জিত করিয়াছে। বিদেশী শক্তির কাছে তুমি সবসময় মাথা উঁচু করিয়া নিজ স্থানে অটল থেকেছ। মা, কিন্তু বলতে লজ্জা নাই তোমাকে মাথা নিচু করতে হয়েছে বা হচ্ছে তোমারি কিছু সন্তানের জন্য। তোমাকে মাথা নীচু করতে হয়েছে “শিশুশ্রম” নামক ব্যাধির কাছে, “কন্যাভ্রুণ”-হত্যা নামক পাপের কাছে , “বহুবিবাহ” নামক প্রথার কাছে, “দুর্নীতির” কাছে “লিঙ্গ বৈষম্যের” কাছে “পণপ্রথার” কাছে, “গনধর্ষণ”,  “বধু হত্যা” নামক জিনিস গুলির কাছে। তোমার অগ্রগতির সব থেকে বড় বাধার কথা তো বলাই হলনা- সাম্প্রদায়িকতা। কখনো বিদেশীদের অনুপ্রেরণাতে আবার কখনো বা আমাদের নিজ ভ্রমের কারনে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়েছে। এই কথাতে তোমার মন ভারাক্রান্ত হইবে ইহাই স্বাভাবিক, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস  এই সব কিছুকে আমারা অতি শীঘ্রই অতিক্রম করিব , ঠিক যেমন ভাবে আমরা “বাল্যবিবাহ”, “সতীদাহ” কে অতিক্রম করেছি। বারংবার তুমি আমার স্বপ্নে আস। আমি বাল-গনেশ, গোপাল, ইহাদের স্বপ্নে দেখিনা। আমি মন্দির, মসজিদ গীর্জার স্বপ্ন দখিনা। কালী, জীশু, মহম্মদ আমার স্বপ্নে আসেনা। তুমি তিরাঙ্গা হাতে আমার স্বপ্নে আসো। আমি শিশু-শ্রম মুক্ত ভারতবর্ষের,  দূষন-মুক্ত ভারতবর্ষের,  জঞ্জালহিন ভারতবর্ষের,  প্লাস্টিক বর্জিত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দখি। আমি দেখি লালকেল্লার তিরাঙ্গা, আমি দেখি অজন্তার গুহা, আমি দেখি তাজমহল,খাজুরাহোর ভাস্কর্য, সুন্দরবনের বাঘ, গিরের সিংহ,  টাইগার হিলের সূর্যোদয়, কোভালাম বিচের বালুকা, আমি দেখি আমার দেশের চাষিরা মাঠে আনন্দে চাষ করছে, আমি দেখি আমার দেশের শ্রমীকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পেয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে। আমার স্বপ্নে তুমি এসে একটি অভিধান দিয়ে যাও, অভিধানের প্রতি পাতাতে একটাই শব্দ -ভারতবর্ষ। ভাষা,পোশাক, খাদ্যের নানান বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের একসাথে বেঁধে রেখেছে তোমার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও জাতীয়তা বোধ।
পরিশেষে তোমার কাছে আশীর্বাদ চাই, মা আমাকে মনুষ্যত্ব দাও, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসো। পরজন্ম বলিয়া কিছু থাকিলে তোমার কোলেই আমাকে বার বার ঠাই দিও। তুমি খুব খুব ভালো থেকো। তোমার শ্রী চরণে আমার শতকোটি প্রণাম, আমার ভালোবাসা নিও।
 
তাংঃ০৭/০৮/২০২২                                                                                          ইতি তোমার    
  এক পুত্র

Leave a Reply