চিরঞ্জীত সাহা

চিরঞ্জীত সাহা

প্রিয় বাবা,
 
               বেঁচে থাকতে ফাদার্স ডেতে তোমাকে উইশ করা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। সাহেবসুলভ উদযাপনের আতিশয্যে তোমার ভীষণ অ্যালার্জি দেখে এসেছি ছোট থেকেই …তোমার জন্মদিনটা ঠিক কবে, বলতে পারেনি কেউ। জানলেও যে কেক কিনে এনে সেলিব্রেশনের আয়োজন করতাম — তেমনটা একদমই নয়। কারখানা থেকে ফেরার পর গামছা দিয়ে ভেজা শরীরটা মুছিয়ে দিতে পারলেও ওসব বিলিতি আতিশয্যের সাহস জড়ো করে উঠতে পারিনি কিছুতেই। সিলভার স্ক্রিনের সিলসিলায় মোড়া সংসার আমাদের ছিল না কোনোদিনই। আলিশান প্রাসাদের বিলাসী ঝাড়বাতির মত চকচকে দেখাত না সম্পর্কের বন্ধনগুলো। ফাদার্স ডে কিংবা মাদার্স ডে — কোনোটাই আসত না ঠিকঠাক ক্যালেন্ডার মেনে। তবে বিজয়া দশমীর নিষ্ঠাপূর্ণ একটা প্রণাম ছিল আমাদের।দোলযাত্রার সকালে তোমার পায়ে আবির ছোঁয়ানোর আবেগাপ্লুত আশীর্বাদে ছিল হাজার চুমুর আনন্দ। পার্থিব প্রাচুর্যের স্বল্পতা সত্ত্বেও তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতে একটা নাম না জানা রং খুঁজে পেতাম রোজ। সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার পর পুব আকাশে ভোরের সূর্য ফোটার সাথে সাথে পাখির মনের ক্যানভাস রেঙে ওঠে নিশ্চয়তার যে আলোতে, সেই রং আমি আবিষ্কার করতাম তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তে। বৃষ্টি ভেজা পাখির যেমন স্পর্ধা হয় না প্রভাত সূর্যকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করার , পরিবর্তে প্রণত চিত্তে কৃতজ্ঞতা জানায় দূর থেকে ; তেমনি আমারও সিনেমার পর্দার মতো করে কোনোদিন তোমার গলা জড়িয়ে হামি দিয়ে বলে ওঠা হয়নি — ” আই লাভ ইউ বাবা !” কুণ্ঠা আর সমীহের আগলে ইচ্ছের বুদবুদেরা বাধা পড়েছে বারংবার।
  বাবা তোমার মনে আছে, আমার স্কুলের প্রথমদিনটার কথা! রডের ওপরের সিটে বসে শক্ত করে ধরেছিলাম সাইকেলের হাতলটা। একা একা স্কুলে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলাম ভীষণ। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে তুমি পার করিয়ে দিলে স্কুলের গেট। আমার ছোট্ট হাত দিয়ে তোমার তর্জনীটা আঁকড়ে ধরেছিলাম প্রাণপণ। মৃদু হেসে আলতো চুমু দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলে আস্তে আস্তে। আমি ভীষণ কাঁদলেও আর ফিরে তাকাওনি পিছনদিকে। জানি না, তোমার চোখের জলও সেদিন নিঃশব্দে ঝরেছিল কিনা! ছেলেকে নিজের পায়ে হাঁটতে শেখাতে ব্যক্তিগত আবেগটাকে হয়তো লুকিয়ে ফেলেছিলে অনায়াসে। বাবা তুমি তো এমনই…. তাই তো ঘুম ভেঙে ছোটবেলায় মাথার কাছে প্রায়ই আবিষ্কার করতাম রঙ বেরঙের প্যাকেটে মোড়া লজেন্সের ঠোঙা। কলেজের সেকেন্ডে ইয়ারে প্যান্ট কাচতে গিয়ে পকেটে বিড়ির গুঁড়ো পেয়ে মা বকেছিল খুব, তুমিও কথা বলোনি তিনটে দিন। কিন্তু তারপর থেকে প্রতিমাসে কোনো এক অজানা সান্তাক্লজ সিগারেটের প্যাকেট রেখে যেত আমার বইয়ের ভাঁজে; না বলতেই পকেটমানির বরাদ্দ বেড়ে যেত প্রতি বছর।
  ক্লাস ওয়ানে প্রথমবার তোমার হাত ধরে মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার কথা তোমার মনে পড়ে, বাবা? আমাকে বড়ো দাদারা সেদিন আউট করে দিয়েছিল এক বলেই আর ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলাম আমি। তারপর বাড়ির ছাদে শুরু হল তোমার-আমার ক্রিকেট। তোমার বলে আমি আউট-ই হতাম না কোনোদিন, উইকেটে লাগত না একটা বলও। এভাবে খেলতে খেলতেই আজ আমি অফিস টিমের ক্যাপ্টেন। প্রতিটা জয়ের পর নিঃশব্দে তোমাকে খুঁজে চলি আজও। খুঁজে চলি আমার প্রথম রুফ ক্রিকেটের সেই বিশ্বস্ততম অপোনেন্টকে — আন্ডার নাইন্টিন ডিস্ট্রিক্ট খেলে আসার পরও আমাকে খুশি করতে হারার অভিনয় যে করে চলত প্রতিদিন।
 রাত বারোটায় জন্মদিনের উইশ না পেলেও মাঝরাতে পড়ার টেবিলে তোমার হাতে বানানো কড়া কফি পেয়েছি বহুবার। ‘ হ্যাপি বার্থ ডে ‘ লিখে ‘ সেলিব্রেটিং’ স্ট্যাটাসও তুমি দাওনি কোনোদিন ফেসবুকে কিন্তু জন্মদিনের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে খাবার প্লেটে আবিষ্কার করেছি শহরের সেরা রেস্তোরাঁর বিরিয়ানি, চকচকে প্যাকেটে মোড়ানো ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট। ও! খাবারের কথা বলতেই মনে পড়ল! বছরে এক-আধদিন বাজার থেকে খাসির মাংস নিয়ে ফিরলে রাতটা না খেয়েই কাটিয়ে দিতে অম্বলের অজুহাতে। সেসব রাতে তোমার নিখুঁত অভিনয় খাবার টেবিলে ঢাকা পড়ে যেত রাশভারী মুখোশের আড়ালে। দুপুরে পরম তৃপ্তি ভরে আমাকে খেতে দেখার পর রাতে নিজের ভাগটাও আমার থালায় তুলে দেওয়ার জন্য অস্কারকে হার মানানো তোমার অনবদ্য অভিনয়শৈলী — বুঝে উঠতে পারিনি সেই দিনগুলোতে।
  পুজোর আগে শপিং মলে ঢুকেই সেরা পোশাকটা বরাবর তুলে দিয়েছো আমার হাতে আর নিজের বেলায় চুপিসারে প্রাইস ট্যাগ মিলিয়ে সস্তারটা, যেন ওটাই তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। মাঝেমাঝে এখন মনে হয়, তুমি শ্রমিক না হয়ে থিয়েটারকর্মী হলেও খুব বেশি ব্যর্থ হতে না জীবনে। গম্ভীর মুখে, কাঠিন্যের আবরণে দায়িত্বশীল,অকৃত্রিম অপত্য স্নেহকে আজীবন যেভাবে আড়াল করে গেলে; তার জন্য যে কোনো পুরস্কারই অনেক ছোট হয়ে যায় যে…
  কলেজ কেটে ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্রথমবার খেলা দেখতে গিয়ে হঠাৎ দেখা তোমার সাথে। ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আঁকড়ে ধরেছিলে হাতটা, পাশে বসিয়ে বলেছিলে — ” ব্যাটন তাহলে ঠিক হাতেই যাচ্ছে, নাকি!” তারপর কত ইউরো কাপ, ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের রাতে একসাথে বিশ্লেষণের কাঁচি চালিয়েছি দুজনে! পেশাদারি জীবনে কাগজে ম্যাচ পরবর্তী রিপোর্ট লিখতে বসে আজও মনে পড়ে হাতে ধরে তোমার ফুটবল পজিশন শেখানোর দিনগুলোর কথা কিংবা থার্ড স্লিপ আর গালির দূরত্বকে কম্পাসে মেপে বোঝানো — অর্থের মোহে ছুটে চলা এই গতিময় সভ্যতায় খেলা দেখার নেশা ধরিয়ে বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকার অক্সিজেনটুকুও তোমারই জোগাড় করে দিয়ে যাওয়া যে….সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে যখন হ্যান্ডেলটা হেলে পড়ত বামদিকে, ছুটে এসে ধরে ফেলতে তুমি। আজও জীবনের চাকাটা টাল খায় বারবার, কিন্তু তোমার মত করে ছুটে এসে হাতটা আর আঁকড়ে ধরে না কেউ। একা একা রক্তে ভেজে মন খাতার পৃষ্ঠাগুলো।
  মায়ের মুখে শুনেছি, আমি ক্লাস ওয়ানে উঠতেই জলাঞ্জলি দিয়েছিলে কিশোরবেলা থেকে সযত্নে লালিত দীর্ঘ কুড়ি বছরের পুরনো অভ্যেস। দেশ, নবকল্লোলের পরিবর্তে বাড়িতে আসতে শুরু করেছিল শুকতারা আর আনন্দমেলা। চারটে পত্রিকা কেনার মতো সামর্থ্য তখন তোমার ছিল না ; পাড়ায় ভালো লাইব্রেরিও গড়ে ওঠেনি সেসময়। নিজে পড়ে পড়ে আমাকে চিনিয়েছিলে নন্টে-ফন্টে , হাঁদা-ভোঁদা, বাটুল দি গ্রেট কিংবা ফেলুদাকে। আজ যখন দেশ, নবকল্লোল,কিশোর ভারতীতে আমার লেখা গল্প বেরোয়, তুমি পড়ে দেখো, বাবা? রূপাদির লোকেরা নবকল্লোল পাঠায় তোমার কাছে? হেডমাস্টার, হারুণ জেঠু, ব্রজেশকাকাদের পড়ে শোনাও আমার গল্পগুলো? আমার লেখা ছড়া পড়ে হো হো করে হেসে ওঠো ছোটবেলার মতো?
  পাড়ার রাজনৈতিক মঞ্চে আজকাল প্রায়ই বক্তৃতা দিতে হয় শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার কিংবা বেকারের চাকরির দাবিতে; ওই ওরা অনুরোধ করে আর কি…. নগেন দাদু মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে পুরোটা। বলে নাকি, আমার কথাগুলো পুরোপুরি তোমার মতো শোনায়! তুমি যে মঞ্চে উঠে বক্তৃতাও দিতে পার , জানা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। মায়ের মুখে শুনেছি ,সেসবই নাকি বিয়ের আগে কংগ্রেসি আমলের রক্তাক্ত সময়ে। আমার জন্মের পর রাজনীতির আঙিনা থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছিলে নিজেকে। রাজনীতি আর রক্ত তখন সমার্থক ছিল যে….
  ছোটবেলায় পাঞ্জাবি পরতে আমার বিরক্ত লাগত খুব, বোতাম লাগাতে পারতাম না ঠিক করে। পাজামার দড়ি বেঁধে দেওয়ার দায়িত্বটা পাকাপাকিভাবে ছিল তোমার কাঁধে। ঢিলে হয়ে যেত প্রায়ই আর একহাতে দড়ি ধরে খুঁজে চলতাম তোমাকে। বিরক্ত হওনি কোনোদিন। এখন আমি পাজামার দড়ি বাঁধতে পারি, বাবা। সভা সমিতিতে যাই আলমারি থেকে নামানো ইস্ত্রি করা তোমার পাঞ্জাবিটা পরে। নাকে এসে লাগে তোমার গায়ের গন্ধ, মঞ্চে যা এক অজানা সাহস জুগিয়ে যায় বারবার….
স্কুলের প্রথমদিনটায় তোমার হাত ছেড়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। মৃদু হেসেছিলে তুমি। চোখে ছিল আশ্বাসের প্রশ্রয়। সেই প্রশ্রয়কে সঙ্গী করেই গুটিগুটি পায়ে হাইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি,চাকরি — দৌড় থামেনি আজও। বছর পঁচিশ পরে আইসিইউতে ঢোকার মুখে অশীতিপর হাত দিয়ে আমার আঙুলটা আঁকড়ে তুমি কেঁদেছিলে একইভাবে — ঠিক যেন স্কুলের প্রথমদিনটা; শুধু জায়গাদুটো বদলে গেছিল তোমার আর আমার। সাহস দিয়েছিলাম আবারও একসাথে বসে খেলা দেখব লাল-হলুদ গ্যালারিতে। কথা রাখতে পারিনি আমি — ছেলেবেলায় হাত ছেড়ে আমাকে নিজের পায়ে হাঁটতে শিখিয়েছিলে জীবনযুদ্ধের ময়দানে আর আমি হাত ছাড়তেই আইসিইউতে থামল তোমার পথচলা। তারপর থেকে কাস্তে হাতে জীবনপথের বরফ কাটছি রোজ। হাঁটছি, পড়ছি , আবার উঠছি। বরফ কাটতে কাটতে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি শেষ স্টেশন পিস হাভেনের দিকে — যেখানে তোমার হাত ছুঁয়েছিলাম শেষবার। আবারও আমাদের দেখা হবে দুজনের। ব্ল্যাক কফি হাতে বসে দেখব — বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ঝড় কিংবা অ্যাশেজ সিরিজের ফাইনাল। তুফান তুলব জাত বনাম ভাতের রাজনৈতিক আলোচনায়। একসাথে আবারও —-
“সবাই ফিরে গেলে একদিন ঘর বাড়িও জ্যোৎস্না হয়ে যায়,
মৃত জোনাকির রং মেখে একা একা অস্ত যায় বাবা। “
 
                                                 ইতি
 
                                      তোমার ভালোবাসার
                                               টুবাই

This Post Has 2 Comments

  1. Manasi Mondal

    খুব সুন্দর

  2. Mausumi Chaudhuri

    খুব ভালোলাগল

Leave a Reply